০১ মে ২০২০

মুসলিম শাসকেরা কেন ভারতবর্ষকে একটি ইসলামী দেশে পরিবর্তিত করতে পারেনি ?

"প্রথমে আমাদের মাথা থেকে এই ধারণাটা দূর করতে হবে যে ভারত এক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে ইসলামী শাসনের অধীন ছিল। অধিকাংশ এলাকা ছিল না। ইসলামী শাসকেরা যে ধরণের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল, প্রচলিত ইতিহাসে তাকে শুধুমাত্র উপেক্ষা করা হয়।

নিচে দেওয়া হল উমাইয়াদ খলিফাতন্ত্রের চিত্র, যা একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তি ছিল এবং যা আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া এমনকী ইউরোপেও বিস্তৃতি লাভ করেছিল। লক্ষ্য করুন ডান দিকে তাদের মানচিত্র সিন্ধু নদের তীরে শেষ হচ্ছে। তার কারণ হচ্ছে, উমাইয়াদ খলিফা তন্ত্রের ভারত অভিযানগুলো ভারতীয় রাজাদের প্রচেষ্টায় এবং বীরত্বে চূড়ান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। একমাত্র যে স্থানে খলিফাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পেরেছিল, তা হল সিন্ধ। এই সিন্ধ এলাকা মুসলিম এলাকায় রুপান্তরিত হয় এবং ১৯৪৭ এর ভারতবিভাগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।


উমাইয়াদ খলিফাতন্ত্র

উমাইয়াদ খলিফাতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই ধরণের প্রতিরোধ না থাকলে ভারতের আরও বড় অংশের ইসলামীকরণ হত।

(সিন্ধ ছাড়া) প্রথম ধাপের ইসলামী আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারত জয়লাভ করে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে ভারতে ইসলামী আক্রমণ শুরু হয় ৩০০ বছর পরে গজনবী বংশের হাত ধরে। এরা সিন্ধু নদ অতিক্রম করতে সক্ষম হয় এবং পঞ্জাব এর একটা অংশ এবং কাশ্মীর দখল করে।

গজনবীর সাম্রাজ্য

যদিও এই সাম্রাজ্যের স্থায়ীত্বকাল বেশিদিন নয়। এবং কয়েকটা হিন্দু নগরের উপর আক্রমণ এবং লুটতরাজ ছাড়া ভারতের উপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ এদের ছিল না।

তৃতীয় পর্যায়ের আক্রমণ শুরু হয় দুই শতাব্দী পরে মোহম্মদ ঘোরী-র মাধ্যমে। এই আক্রমণের মাত্রা পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। উত্তর ভারতের একটা বড় অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর দিল্লীর সুলতানতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যা দক্ষিণ ভারতের মাদুরাই পর্যন্ত পৌঁছেছিল- মাদুরাই সুলতানতন্ত্র। যদিও দক্ষিণে ইসলামী শাসন খুবই ক্ষণস্থায়ী ছিল কারণ অত্যন্ত শক্তিশালী বিজয়নগর সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে এবং তারা শক্তিশালী ভাবে এর প্রতিরোধ করে।
দক্ষিণে শক্তিশালী বিজয়নগর সাম্রাজ্য

এই খানদের মধ্যে অনেকেই ধর্মবিস্তারে অনুৎসাহী ছিলেন। এমনকী তাদের মধ্যে কয়েকজন, যেমন- খুসরো খান হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হন ।

এই সময়কালে হত্যা এবং ধর্মান্তরিতকরণ হয়ে চলছিল। কিন্তু সুলতানশাহীগুলির নিজেদের মধ্যে সামরিক বিবাদের কারণে ধর্মান্তরিতকরণের কাজ খুব একটা সফল হয়নি।

চতুর্থ পর্যায়ের ইসলামী আক্রমণ আসে মুঘলদের মাধ্যমে। যখন এই ঘটনা ঘটে, তখন দিল্লীর সুলতানী মোটেও সারা ভারতে বিস্তৃত ছিল না, তা আজকের দিল্লী, হরিয়াণা, উত্তরপ্রদেশ এবং পঞ্জাবের ক্ষুদ্র এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

বাবর দুর্বল লোদী বংশকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং তাদের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হন, কিন্তু তিনি এই সাম্রাজ্যের তেমন বিস্তার ঘটাননি।


বাবর দিল্লী আক্রমণের সময় দিল্লী সুলতানাত (মুসলিম শাসক নিয়ন্ত্রিত এলাকা)

এই পর্যায়ে প্রতিরোধের আরেকটি ধাপ গড়ে ওঠে হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্যের হাত ধরে। তিনি অনেক এলাকা মুঘলদের হাত থেকে উদ্ধার করেন।

কিন্তু দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে একটি উড়ে আসা তীর তাঁর দিকে ধেয়ে আসে। এতে আকবর জয়যুক্ত হন। তাঁর পূর্বজদের পথে না চলে তিনি ধর্ম সম্পর্কে নমনীয় নীতি গ্রহণ করেন [এমনকী তিনি ইসলাম ছেড়ে বেড়িয়ে গিয়ে দীন-ই-ইলাহী প্রতিষ্ঠাও করেন]। ধর্ম সম্পর্কে নমনীয় নীতি নেওয়ার ফলে তিনি ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত তিনি পোক্ত করতে সমর্থ হন। এবং তাঁর বিরুদ্ধে তেমন প্রতিরোধ ও গড়ে ওঠেনি।

এই সু-অবস্থার অবসান ঘটান তাঁর প্রপৌত্র ঔরঙ্গজেব। এই সময় মারাঠা সাম্রাজ্য, শিবাজীর নেতৃত্বে প্রতিরোধের শিখরে উঠে আসে। এবং ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর কয়েক দশকের মধ্যে ভারতবর্ষের অধিকাংশ এলাকা তাঁদের করায়ত্ত হয়।
পারসিয়ান সাম্রাজ্য- সিন্ধু নদের তীরে সমাপ্ত
আলেক্সান্ডার এর সাম্রাজ্য

ত্রয়োদশ শতকে ঘোরীর প্রথম বিজয়ের পর থেকে সর্বভারতীয় বৃহত্তম শক্তি হিসেবে মারাঠাদের উত্থান মাত্র পাঁচশো বছরের ব্যবধান। অর্থাৎ ভারতের অধিকাংশ এলাকায় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল মাত্র ৫০০ বছর। এই পাঁচশো বছরের সময়কালেও ভারতবর্ষের একটা বড় এলাকা ইসলামী শাসনের বাইরেই ছিল। এবং সব সময়েই একের পর শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল যা ইসলামী শাসকদের ধর্ম সম্পর্কে নমনীয় পথ নিয়ে সমর্থন জোগাড় করতে বাধ্য করেছিল বা তাদের শাসনের উৎপাটন ঘটিয়েছিল।

সংক্ষেপে বললে- এরকম নয় যে ভারতীয়রা আত্মসমর্পণ করেছিল। সবসময়ই একটা শক্তিশালী প্রতিরোধের অস্তিত্ব ছিল এবং সেজন্যই ভারতের দশা পারস্য বা মিশরের মতো হয়নি।

ইসলামী আক্রমণের ফলে যে ধর্মগুলো সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিল সেগুলি হল শ্রমণিক ধর্মগুলি- বৌদ্ধ ধর্ম এবং জৈন ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্মের বিশেষ ভাবে একটা শক্তিশালী সংগঠনের প্রয়োজন ছিল এবং শাসকের সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। এই ধর্ম ছিল কেন্দ্রীভূত ধর্ম এবং এর ক্ষতিসাধন করা সহজ ছিল।

হিন্দুধর্ম প্রচন্ডভাবে বিকেন্দ্রীভূত ধর্ম। এবং বহিঃআক্রমণের সময়গুলিতে তা ভারতের গ্রামগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং সময়ের অপেক্ষা করছিল।

বিগত কয়েক শতকে হিন্দুধর্ম শুধুমাত্র বেঁচেই থাকেনি, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। এই ধর্ম মণিপুরের মতো উত্তর-পূর্ব ভারতীয় ভূ-খন্ডে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। গত কয়েক শতক ধরে হিন্দু ধর্ম স্থানীয় এবং গ্রাম্য লোকাচারকে নিজেতে আত্তীকৃত করেছে — যা বহুসংখ্যক মানুষের কাছে এই ধর্মকে পৌঁছে দিয়েছে এবং তাতে কালাজাদুর মতো কিছু বিষয়ও পিছনে পড়ে থাকেনি।

অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় ভারত যে আলাদা এবং তা অত্যন্ত সফল ভাবে ব্রোঞ্জ যুগে উদ্ভুত নিজের ধর্মীয় আচার আচরণগুলিকে পালন করে, তার সুস্পষ্ট কারণ আছে, এবং সমস্ত শক্তিশালী সাম্রাজ্যের সীমানা ভারতের সীমানাতেই শেষ হয়, তারও একটা সুস্পষ্ট কারণ আছে, সেটা হল - সিন্ধু নদের পূর্ব তীরে এক দুর্ধর্ষ জাতি বাস করে যারা সবসময় রুখে দাঁড়াবে এবং কখনো আত্মসমর্পণ করবে না।"



(অনুবাদ করেছেন- ঋতব্রত ঘোষ,
এই উত্তরটি প্রথমে ইংরেজিতে Quora-এ Balaji Viswanathan দিয়েছেন।)

Post Courtesy by: Subrata Saha
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।