০৫ জুন ২০১৩

"সনাতন ধর্মে বর্ণভেদ ও পদবী বৈষম্যর ইতিহাস"


             
           সনাতন ধর্ম অতি প্রাচীন বলেই বিভিন্ন সময় এর পথ পরিক্রমায় বিচিত্র পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যা বাস্তব ক্ষেত্রে ধর্মীয় নিয়ম নীতির সাথে কোন সামঞ্জস্যতা নেই


            বর্তমান হিন্দু সমাজ এখনো বর্ণভেদের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনিভারতে এক সময় বিভিন্ন শহর বন্দর ও গ্রামে তথাকথিত নিম্ন বর্ণের হরিজনকে রাস্তায় চলতে ঘণ্টা বাজাতে হতোযাতে করে কুলীন বর্ণ হিন্দুরা তাদের ছায়া মাড়াতে কিংবা স্পর্শতা থেকে নিরাপদ দূরে সরে যেতে পারেআজও সমাজের হিন্দু ব্রাহ্মণ ঘরের মেয়েকে কায়স্থ তথা বৈশ্য বা শূদ্র ঘরের ছেলে বিয়ে করতে পারতে না



            
       আমাদের হিন্দু সমাজে এই বর্ণভেদ প্রথা নিয়ে বিড়ম্বনা যেতে না যেতেই আবার শুরু হয়েছে পদবী নিয়ে বৈষম্যপরবর্তীতে এই পদবী প্রচলন হওয়ার পর থেকে বর্ণভেদের চেয়ে আরও অধিকতর ভেদাভেদ বিভিন্ন পদবীভেদের লোকেরাই সৃষ্টি করতে শুরু করেপ্রশ্ন আসতে পারে যে, “হিন্দু সমাজে কি সেই সত্যযুগ থেকে এ পদবী প্রচলন ছিল?” একটু লক্ষ্য করলেই আমরা স্পষ্ট দেখতে পাবো যে, “রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, বিশ্বামিত্র, দুর্যোধন, দশরথ, শঙ্করাচার্য, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ মহামানবের নামের পেছনে কোন পদবী বা টাইটেল ছিল না” ....অতএব, আমাদের হিন্দু সমাজে নামের পিছনে পদবীর ব্যবহার প্রচলন কিভাবে শুরু হলো তার সঠিক ইতিহাস আমাদের সকলের জেনে রাখা দরকার



              ১৫১০ সালে আনন্দ ভট্ট রচিত ও ১৯০৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত “বল্লাল চরিত” নামক বইয়ে হিন্দু সমাজে পদবী প্রচলন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে (তথ্যসূত্রঃ সমাজদর্পণ ১৫ বর্ষ, সংখ্যা ১২; জুন ১৯৯৯) উক্ত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, গৌড়ের বৈদ্য বংশীয় রাজা বল্লাল সেন(১১৫৮-১১৭৯ সাল) নিজ সহধর্মিণী থাকা অবস্থায় অধিক বয়সে পদ্মিনী নাম্নী এক সুন্দরী ডোম নর্তকীকে বিয়ে করেনএতে দেশজুড়ে রাজার সুনাম বিনষ্ট হয় এবং এ কুকীর্তি নিয়ে প্রজারা সমালোচনা শুরু করে দেনরাজা এই কলঙ্ক থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সকল সম্প্রদায়ের প্রজাদের এক সম্মিলিত ভোজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেনকিন্তু, সকল সম্প্রদায়ের লোকেরা উপস্থিত থাকলেও নমশূদ্র বিপ্রগণ এই ভোজ অনুষ্ঠানে যোগদানে বিরত থাকেন, অথাৎ রাজার এই কুকীর্তিকে সমর্থন করে তারা ভোজ সভায় অংশ নেয় নি। রাজা তাদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হন এবং নমশূদ্র লোকদের চাকরীচূত করেন। শুধু তাই নয়, রাজা তাদের চণ্ডাল বলে গালাগাল করে নগর বন্দর থেকে উৎখাত করে দেন। অন্যদিকে ভোজ সভায় অংশগ্রহণকারী সম্প্রদায়ভুক্তরা রাজার সকল কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে রাজার অনুগ্রহ লাভ করতে যত্নবান হন। রাজাও এসব সম্প্রদায়কে সাহায্য করেন এবং অনেক সম্প্রদায়কে কৌলীন্য বা টাইটেল দান করেন।


                                    
                 এভাবেই, বল্লালসেন পদবী বৈষম্য সৃষ্টি করে হিন্দু সমাজে বিষাক্তবীজ বপন করেছিলো যা বর্ণভেদকে আরও শক্তিশালী করে। বল্লালসেনের পরবর্তী বংশ ধর লক্ষনসেনের ভূমিকাও ছিল লজ্জাকর। এই বর্ণভেদ আজও আমাদেরকে দুর্বল করে রেখেছে। সেন রাজারা বাঙালি ছিল না। তবুও, পদবী বৈষম্য সৃষ্টি করে বাঙ্গালীদের শাসন করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।


                         পরবর্তীতে মানুষের সৃষ্ট এ জাত ও পদবী বৈষম্য একজন মানুষের সাথে অন্য মানুষের মধ্য দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। এতে হিন্দু সমাজের হয়েছে অপূরণীয় ক্ষতি। ধর্মান্তরিত হয়েছে অসংখ্য নিম্নশ্রেণী ও বর্ণের হিন্দুরা। অথচ, ভগবান শ্রী কৃষ্ণ গীতার ১৮ অধ্যায়ের ৪১ নং শ্লোকে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন যে, মানুষের স্বভাব জাত গুণ অনুসারে ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের কর্ম সমূহ বিভক্ত করা হয়েছে। অথ্যাৎ, স্বভাবজাত গুণ অনুসারে কর্ম সমূহ বিভক্ত করা হয়েছে, জন্ম অনুসারে মানুষকে বিভক্ত করা হয় নি। 


                    রাস্তায় যেমন সকল যানবাহন একই গতিতে চলতে পারে না, তেমনি সমাজের সকল মানুষও সম আর্থিক সচ্ছলতায় চলতে পারে না। তাই সমাজের কেউ ডাক্তার, কেউ প্রকৌশলী, কেউ শিক্ষক, কেউ দারোয়ান, কেউ বা সুইপার। নিজের যোগ্যতার উৎকর্ষ সাধন করতে পারলে একজন কর্মকর্তা যেমন পদন্নোতি পান, তেমনি আমরা নিজ নিজ বর্ণ পরিবর্তন না করেও স্ব স্ব বর্ণে দক্ষতা অর্জন করে উচ্চাসনে বসতে পারি। কোন বর্ণ উঁচু আর কোন বর্ণ নিচু ভগবান শ্রী কৃষ্ণ গীতায় তা কোথায় উল্লেখ করে নি। 

              
                 "সুতরাং, একজন মানুষ জন্মসূত্রে নয়; বরং, তার কর্মগুণে স্বীকৃতি লাভ করুক এটাই আজ সকলের প্রত্যাশা।
 -----------------------------
শ্রী জয় রায়

             
Share:

1 Comments:

AJOY বলেছেন...

পড়ে খুব কষ্ট পেলাম...তাদের ভুলের শাস্তি আমরা ভোগ করছি

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।