২৪ জুন ২০১৩

জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ক্রমবিকাশ ও তাৎপর্য

শ্রীল সনাতন গোস্বামী জগন্নাথদেবের এভাবে স্তুতি করেছেন-
শ্রীশ্রীজগন্নাথস্তব
শ্রীজগন্নাথ নীলাদ্রি-শিরঃ-মুকুট-রত্ন হে।
দারু-ব্রহ্মণ ঘনশ্যাম প্রসীদ পুরুষোত্তম ॥১
প্রফুল্ল পুণ্ডরীকাক্ষ লবণ-অব্ধি-তট-অমৃত।
গুটিক-উদর মাং পাহি নানাভোগ পুরন্দর ॥২
নিজ-অধর সুধাদায়িন-ইন্দ্রদ্যুম্ন-প্রসাদিত।
সুভদ্রা-লালন-ব্যগ্র রাম-অনুজ নমঃ-অস্তু-তে ॥৩


গুণ্ডিচা-রথযাত্রাদি-মহোৎসব-বিবর্ধন।
ভক্ত-বৎসল বন্দে ত্বাং গুণ্ডিচা-রথ-মণ্ডণ ॥৪
দীনহীন-মহানীচ-দয়ার্দ্রীকৃত মানস।
নিত্য-নূতন-মাহাত্ম্য-দর্শিন্‌ চৈতন্যবল্লভ নমঃ ॥৫
শ্রীমৎ-চৈতন্যদেব ত্বাং বন্দে গৌরাঙ্গ-সুন্দর।
শচীনন্দন মাং ত্রাহি মতিচূড়ামণে প্রভো ॥৬
আজানু-বাহোমেরাস্য নীলাচল-বিভূষণ।
জগৎ-প্রবর্ত্তিত স্বাদু-ভগবৎ-নামকীর্ত্তন ॥৭
অদ্বৈতাচার্য-সংশ্লাঘন্‌ সার্বভৌম-অবিনন্দক।
রামানন্দ কৃতপ্রীত সর্ব-বৈষ্ণব বান্ধব ॥৮
শ্রীকৃষ্ণ-চরণাম্ভোজ প্রেমামৃত মহামুধে।
নমস্তে দীনদীনং মাং কদাচিৎ কি স্মরিস্যসি নমঃ ॥৯
[হে শ্রীজগন্নাথদেব, তুমি নীল মহাসমুদ্রের শিরোদেশে স্থিত বিশাল মুকুটের মহারত্ন সদৃশ শ্রীদারুব্রহ্মরূপে প্রকটিত। হে ঘনশ্যাম পুরুষ প্রধান, আমাকে প্রসাদিত কর।১। হে লবণাক্ত সমুদ্রের উপকূলে বিরাজিত প্রফুল্লবদন-পদ্মপলাশলোচন প্রভো! আপনার শ্রীউদরদেশে অষ্টোত্তরশত শ্রীশালগ্রামগণের অবস্থিতি, বিবিধ ভোগবিলাসে আপনি দ্বিতীয় পুরন্দর; আমাকে বহির্মুখতা হইতে সদা রক্ষা করুন।২। যিনি নিজ শ্রীঅধরামৃতসুধা প্রসাদ দানে শ্রীভক্তরাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজকে ধন্যাতিধন্য করেছেন, হে বলরাম রামানুজ; কণিষ্ঠা শ্রীসুভদ্রার লালনে যিনি সদা ব্যগ্র, আপনাকে বারবার প্রণাম করি।৩। হে ভক্তবৎসল প্রভু, শ্রীগুণ্ডিচায় রথযাত্রাদিদ্বারা ভূতগণের মহামহোৎসব বিবর্ধনকারী এবং তথায় সপ্তদিনব্যাপী অবস্থান করে বহুবিধ লীলাবিলাসকারী, হে গুণ্ডিচাবিহারী মহাপ্রভো, আপনাকে বারবার বন্দনা করি।৪। দীনাতিদীন, মহানিচকুলসম্ভূত ব্যক্তিগণকেও আপনার অহৈতকী কৃপাকণা লাভ করবার মানসে নিত্য নব-নব লীলা-মহোৎসব-মাহাত্মাদির প্রদর্শন করে নিত্য বিরাজমান আছেন, শ্রীচৈতন্যের প্রাণবল্লভ আপনাতে সদা প্রণত হই।৫। শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর শ্রীচৈতন্যদেব আপনাকে বন্দনা করি। হে যতি-পুরুষ শ্রীশ্রীশচীনন্দন আমাকে উদ্ধার করুন।৬। আজানুলম্বিত বাহুধারী সদা স্মিতহাস্যময় শ্রীশ্রীনীলাচল-বিভূষণ, হে প্রভো, আপনি পরম উপাদেয় শ্রীশ্রীভগবন্নাম-সংকীর্ত্তন মাধ্যমে সমগ্র জগতে প্রবর্তিত করেছেন।৭। হে অদ্বৈতাচার্যের সদা প্রশংসাকারী, সার্বভৌমের অভিনন্দনকর্তা, রামানন্দরায়ের দ্বারা সদাপ্রীত, সর্ববৈষ্ণবকুলের পরম বান্ধব শ্রীমন্মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র, নিজেই নিজের পাদপদ্মের প্রেমামৃতে মহাসমুদ্রে এই দীন-অতিদীনহীনকে কি কখনও একবারও স্মরণ্‌ করবেন না? আমি আপনাকে বার বার প্রণাম করি।৮-৯।]
ভারতবর্ষে শ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব অতি সুপ্রাচীন। এই রথযাত্রা উৎসব আসলে কখন ও কবে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। ঐতিহাসিকরাও এব্যাপারে একমত নন। কোন এক সত্য যুগে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সাক্ষাৎ ভগবান্‌ নীলমাধবকে খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থমনোরথ হয়ে স্বরাজ্যে ফিরে এলেন। তখন রাজা নীলমাধবের অদর্শন বেদনায় কাতর হয়ে অনশনে জীবনাহুতি দিতে প্রস্তুত হলে নীলমাধব দৈববাণীতে জানালেন-“হে মহারাজ! তুমি আমার কথা শোন, তুমি নীলমাধব স্বরূপে আমার দর্শন কখনও পাবে না। নীলাচল পুরুষোত্তমক্ষেত্রে দারুব্রহ্মরূপে তুমি আমার দর্শন পাবে।”
পুরীর মন্দিরের বর্তমান স্থান রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কর্ত্তৃক নির্বাচিত হয়। ১১১৯ খ্রীষ্টাব্দে গঙ্গাবংশের রাজা ভীমদেব কর্তৃক জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মিত হয় এবং পুষ্যানক্ষত্রযুক্ত বৈশাখ মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে বৃহস্পতিবারে দেবতা প্রতিষ্ঠা করা হয়।
শ্রীধাম মায়াপুর কৃষ্ণনগর যাবার পথে শরডাঙ্গা নামক পবিত্র একটি স্থান। সেখানে বিশাল অতি প্রাচীন এক বটবৃক্ষতলে জরাজীর্ণ এক কুটীরে শ্রীজগন্নাথদেব জনৈক দরিদ্র ব্রাহ্মণ দ্বারা সেবিত ও অর্চিত হয়ে আসছিল। বর্তমানে ইস্ককন (আন্তর্জাতিক শ্রীকৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ)-এর তত্ত্বাবধানে ও পরিচালনায় ১৯৮৫ সালে এরই সন্নিকটে একটি সুরম্য মন্দির সহ নাটমন্দির নির্মিত হয়। ঐ বৎসরই শ্রীশ্রীগৌরসুন্দরের আবির্ভাব তিথিতে তথা দোল পূর্ণিমা মহোৎসব বাসরে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের নবনির্মিত মন্দিরের শুভ উদ্বোধন করা হয়। শ্রীমন্দির উদ্বোধনের সাথে সাথে ভগবান্‌ শ্রীজগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রাদেবীর শ্রীবিগ্রহ সাথে নিয়ে স্বকৃপায় প্রাচীন ক্ষুদ্র কুটিরখানি পরিত্যাগ করে নবনির্মিত মন্দিরের সুরম্য প্রকোষ্ঠে, দিব্য কারুকার্য সমন্বিত সুশোভিত শ্বেতপ্রস্তর সুমণ্ডিত রত্নবেদীর উপরে সামাসীন হয়ে নয়নানন্দরূপে কীর্তনোল্লাসের তালে তালে ভক্তগণের পরাতুষ্টির মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়ে জগৎ কল্যাণার্থে সাড়ম্বরে নিত্যসেবিত হয়ে আসছেন। শরডাঙ্গা-শ্রীশ্রীলীলাপুরুষোত্তম দারুব্রহ্ম জগন্নাথদেবের নিত্য বিহারস্থলী হওয়ায় ইহা অভিন্ন জগন্নাথপুরী ধাম নামে পরিচিত। তাই শ্রীনিত্যানন্দ মহাপ্রভু শ্রীজীব গোস্বামীকে নিয়ে নবদ্বীপ পরিক্রমণকালে তাঁকে শরডাঙ্গা দেখিয়ে বলেছিলেন-
শ্রীপুরুষোত্তম সম ঐ ধাম হয়।
নিত্য জগন্নাথ স্থিতি তথায় নিশ্চয় ॥
(শ্রীনবদ্বীপ ধাম মাহাত্ম্য, ৬ষ্ঠ অধ্যায়)
গৌরসুন্দর ও জগন্নাথদেব এক ও অভিন্নরূপ। শ্রীজগন্নাথদেব নিজধামসহ শরবডাঙ্গায় স্বেচ্ছাক্রমে আবির্ভূত হয়ে নিত্য বিহার করছেন। তাই একে অভিন্ন ‘জগন্নাথপুরীধাম’ বলে অভিহিত করা হয়।
ব্রজরাজ শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র তাঁর পরমভক্ত শিবকে তাঁর নিত্য গোপনীয় ধাম ‘শ্রীনীলাচলপুরীর’ রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে বলেছেন, “সমুদ্রতীরে বটবৃক্ষতলে আমার সেই ধামটি মহাপ্রলয়েও ধ্বংস হয় না, তথায় শ্রীজগন্নাথরূপে আমি নিত্য বসতি করি এবং ভক্তগণদ্বারা নিত্য পূজিত হই। তথাকার জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ ও পশুপক্ষীসহ সকল ভূতসমূহ চতুর্ভুজদেবরূপে পরিনিশ্চিত। সেখানে নিদ্রিত হলে সমাধি হয়, শয়নমাত্রেই দণ্ডবৎ প্রণাম করা হয় এবং ঐস্থান পরিভ্রমণে তীর্থ পরিক্রমার ফলপ্রাপ্তি ঘটে। সেখানে যমের শাসন ও যমদণ্ডেরও কোন বালাই নেই।” শ্রীচৈতন্যভাগবতে অন্তলীলায় (২অঃ/পৃঃ ৩৬৪) শ্রীভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ বলছেন-
“শুন শিব! তোমারে দিলাঙ দিব্যস্থান।
সর্বগোষ্ঠীসহ তথা করহ প্রয়াণ ॥
একাম্রকবন-নাম-স্থান মনোহর।
তথাই হইবা তুমি কোটিলিঙ্গেশ্বর ॥
সেহো বারাণসী-প্রায় সুরম্য নগরী।
সেইস্থানে আমার আছয়ে গোপ্যপুরী ॥
সেই স্থান শিব! আজি কহি তোমা স্থানে।
সেই পুরীর মর্ম মোর কেহ না জানে ॥
সিন্ধুতীরে বটমূলে নীলাচল-নাম।
ক্ষেত্র-শ্রীপুরুষোত্তম-অতি রম্য স্থান ॥
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড কালে যখন সংহারে।
তবু সেই স্থানের কিছু করিতে না পারে ॥
সর্বকাল সেইস্থানে আমার বসতি।
প্রতিদিন আমার ভোজন হয় তথি ॥
সেইস্থান-প্রভাবে যোজন দশভূমি।
তাহাতে বসয়ে যত জন্তু কীট কৃমি ॥
সভারে দেখয়ে চতুর্ভুজ দেবগণে।
‘ভুবনমঙ্গল’ করি কহিয়ে স্থানে ॥
নিদ্রাতেও সেস্থানে সমাধি ফল হয়।
শয়নে প্রণাম-ফল যথা বেদে কয় ॥
প্রদক্ষিণ-ফল পায় করিলে ভ্রমণ।
কথামাত্র যথা হয় আমার স্থান ॥
হেন যে ক্ষেত্রের অতি প্রভাব নির্মল।
মৎস্য খাইলেও পায় হবিষ্যের ফল ॥
নিজ-নামে স্থান মোর হেন প্রিয়তম।
তাহাতে যতেক বৈসে, সেই মোর সম ॥
সংগ্রহে : অমিত সরকার শুভ

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।