আমাদের সনাতন ধর্মে প্রতিমাপূজা আরাধনার
সূচনাপর্বের বিষয়। প্রথমেই বলে
রাখি; আমাদের পূজা “মূর্তি পূজা” নয়, বরং এর
উচ্চারণ হবে “প্রতিমাপূজা”। আমরা কখনোই
মূর্তিকে পূজা করি না; মূর্তির মধ্য প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাকে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা
করি। প্রতিমার মাধ্যমে ঈশ্বরের পূজা করার অর্থ হল ঈশ্বরের প্রতি নিজের বিশ্বাসকে
দৃঢ় করা।
বেদ যখন রচিত হয় তখন মানুষের মধ্য তেমন কোন কর্মচঞ্চলতা
ছিল না। যজ্ঞানুষ্ঠানই
ছিল ঋষিদের প্রধান কর্ম। যজ্ঞের মাধ্যমে হোমানল
জ্বালিয়ে তখন দেবতাদের আহ্বান করা হত, অগ্নির মাধ্যমেই দেবতাদের উদ্দেশ্য দেওয়া হতো পুষ্পাঞ্জলি । তাই, আমরা বেদে প্রতিমা পূজার উল্লেখ
দেখতে পাই না।
এই কলিযুগে সনাতন ধর্মের নিরাকার উচ্চ স্তরের উপাসনা প্রায় অসম্ভব। কারণ, কলি যুগে আমাদের মন এতই চঞ্চল
যে একে নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। মনকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি সহজ উপায় হচ্ছে,
চোখের মধ্য কোন বস্তুর ছবি ফেলা। পরবর্তীতে, ওই ছবিটি যদি নাও থাকে তবে চোখের
সামনে তার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠবে। তাই, সাধারন মনোনিবেশ
তথা চিত্তকে বিষয় বাসনা থেকে সরিয়ে একাগ্রচিত্তে ভগবানকে স্মরণ করার জন্য প্রতিমাপূজা একটি বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি
।
একটি শিশুকে প্রথম পাঠদানের সময় অনেক রঙিন ছবি সম্বলিত বই দেওয়া হয় যাতে ঐ বইটির প্রতি শিশুর আকর্ষণ বাড়ে। এখানে ছবি মুখ্য নয়,
মুখ্য হচ্ছে বর্ণমালা। ঠিক তেমনি আমাদের চঞ্চল মন প্রতিমার মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রতি
আকৃষ্ট হয়। এখানে, ঈশ্বরের করুণা লাভই হচ্ছে মুখ্য বিষয়।
অদ্বৈতবাদী (নিরাকার) হয়েও রামানুজ শঙ্কর
প্রতিমাপূজা করতেন। তাঁর শিষ্যগণ স্বভাবতই একটু দ্বিধান্বিত ছিলেন গুরু মহারাজ এর উপর। কারণ, রামানুজ সকলকে শিক্ষা দিচ্ছেন অদ্বৈতবাদ আর নিজে চর্চা করছেন
দ্বৈতবাদ। রামানুজ তার শিষ্যদের বলতেন, “দেখ, এই পৃথিবীর সর্বত্রই আগুন আছে। এই আগুনকে আমাদের কাজে লাগাতে হলে তাকে বসার
আসন দিতে হয়, যেমন- কাঠ। ঐ কাঠে বসেই সে আমাদের প্রয়োজনীয় কাজ করে
দেয়। সেরূপ ঈশ্বর সর্বত্রই
আছেন। তার কাছে আমাদের প্রার্থনা
জানাতে হলে তাকে বসবার আসন দিতে হবে। তার বসবার আসন হল এই প্রতিমা। এখানে বসেই তিনি আমার প্রার্থনা শুনে যা করার
তাই করবেন।””
পরিশেষে একটি কথাই বলতে চাই যে, আমাদের আদিধর্ম গ্রন্থ বেদে নিরাকার উপাসনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, কলিযুগের জীবের উদ্দেশ্য গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ে
স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন যে, অব্যক্ত উপাসনা দেহাভিমানী জীবের পক্ষে সম্ভবপর নয়। তাই, দেহাভিমানী
জীবের জন্য সগুণ সাকার উপাসনাই শ্রেষ্ঠ ও সহজতর। আর এই সকল কারনেই,
বর্তমান কলিযুগে আমরা হিন্দুরা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে প্রতিমা পূজার মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনা করে থাকি।
----------------------------------------
শ্রী জয় রায় (১৯/০৬/১৩)