নীলাচলে লবণাক্ত সমুদ্র-উপকূলে শ্রীপুরুষোত্তম ভগবান্ জগন্নাথ দারুব্রহ্মরূপে নিত্যবিরাজমান আছেন। স্বয়ং শ্রীলক্ষ্মীদেবী তাঁর ভোগান্ন রন্ধন করেন এবং পরম দয়ালু প্রভু তা ভোজনান্তে তাঁর ভক্তগণকে অধরামৃত দানে ধন্য করে থাকেন। আর এতেই সেই ক্ষেত্রবাসী ভক্তগণ দেবদুর্লভ অন্ন লাভ করে ধন্যাতিধন্য হন। প্রভু জগন্নাথের সেই প্রসাদ-অন্নের নাম ‘মহাপ্রসাদ’। এই প্রসাদ যে কেহ যে কোন অবস্থায় স্পর্শ করলে বা যে কোন স্থানে নীত হলেও কোনরূপ বিচার না করে তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করা উচিৎ। অহো! শ্রীজগন্নাথদেব বা তাঁর অন্ন মহাপ্রসাদ মাহাত্ম্য দূরে থাকুক, সেই ক্ষেত্রের এমনই মাহাত্ম্য যে তথাকার গর্দভও চতুর্ভূজরূপে পরিদৃষ্ট হয়ে থাকেন। সেই পরম পবিত্র শ্রীজগন্নাথক্ষেত্রে প্রবেশ মাত্রই কোন জীবের আর পুনর্জন্ম লাভ করতে হয় না।
স্বয়ং শ্রীগৌরসুন্দরই নীলাচলের পুরীধামক্ষেত্রের অচলব্রহ্ম শ্রীজগন্নাথদেব রূপে প্রকটিত। আবার তিনিই সচলব্রহ্ম রূপে শ্রীশ্রীনীলাচল বিভূষণ গৌরহরি। শ্রীসনাতন গোস্বামীপাদ তাই বলেছেন-
শ্রীমৎ-চৈতন্যদেব ত্বাং বন্দে গৌরাঙ্গসুন্দর।
শচীনন্দন মাং ত্রাহি যতিচূড়ামণে প্রভো ॥
আজানুবাহঃ স্মেরাস্য ‘নীলাচলবিভূষণ’।
জগৎ-প্রবর্তিত-স্বাদু-ভগবৎ-নাম কীর্তন ॥
(শ্রীলীলাস্তব, সংখ্যা ১০৪)
শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথারোহণের পর থাকার মণ্ডপকে বলা হয় গুণ্ডিচা। উরিষ্যার স্থানীয় লোকজন গুণ্ডিচা যাত্রা বলেন। কাকতালীয় ভাবে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নীর নামও ছিল গুণ্ডিচা। জগন্নাথদেবের রথখানিকে গণ্ডিচা গমনের পর আবার অষ্টম দিবসে নিজ মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়। এক বলে উল্টো রথ যাত্রা।
ভারতবর্ষে রথযাত্রার উৎসব অতি প্রাচীন। পশ্চিম বাংলার হুগলী জেলাস্থ শ্রীরামপুর মাহেশে সবচেয়ে প্রাচীনতম, আকর্ষণীয় ও উল্লেখযোগ্য রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এটি ৬১২ বৎসরের পুরানো উৎসবানুষ্ঠান। গুপ্তিপাড়ায় ৪০২ বছরের প্রাচীন দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা। বারুইপুরের রায়চৌধুরী পরিবারের ৩০১ বৎসরের অধিক রথযাত্রার উৎসব উল্লেখযোগ্য। বিধাননগর কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রার অনুষ্ঠান হয়। বাগবাজারে বলরাম মন্দিরের রামকৃষ্ণ মঠে ১১২ বৎসরের অধিক ঐতিহাসিক রথযাত্রার উৎসব পালিত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেও রথযাত্রার উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে। রথযাত্রা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য মিলন মেলা। এই দিনে এখানে নানা ধর্ম-বর্ণের লোক জগন্নাথদেবের মূর্তি এক নজর দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে সমায়েত হয় রথ-চত্বরে। জগন্নাথদেবও তাঁর জগৎজনকল্যাণময় মূর্তি নিয়ে মন্দিরের পূজাবেদী হতে বেরিয়ে এসে রথারোহণে যাত্রা শুরু করে দেন। বৎসরে একবার দর্শন দিয়েও তিনি অসংখ্য ভক্তের চিত্তবিহারী হয়ে ভক্তহদয়ে অবস্থান করেন। রাজধানী ঢাকায় ৫০০ বৎসরের পুরানো সূত্রাপুরের রামসীতা মন্দির কমিটির আয়োজনে অনেকদিন যাবৎ রথযাত্রার অনুষ্ঠান চলে আসছে। এছাড়া পুরান ঢাকায় শ্রীশ্রীরাধামাধব জিও দেববিগ্রহ মন্দির, ঠাটারীবাজার শিবমন্দির ও রাধাগোবিন্দ জিও ঠাকুর মন্দিরেও রথযাত্রার অনুষ্ঠান চলে আসছে। ঢাকায় সবচেয়ে বড় রথযাত্রার উৎসব অনুষ্ঠিত হয় শ্যামবাজার ইসকন্ মন্দিরে। জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর তিনখানি সুসজ্জিত রথ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে ইসকন্ মন্দির হতে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় আবার অষ্টম দিবসে উল্টোরথ যাত্রা হিসেবে রথ তিনটিকে আবার স্বস্থানে ফিরিয়ে আনা হয়। ঢাকার উপকণ্ঠে ধামরাইয়ে অনুষ্ঠিত হয় দেশের সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রার উৎসব। কোন কোন সূত্র থেকে জানা যায় যে, প্রায় ৪০০ বৎসর ধরে চলে আসছে ধামরাইয়ের রথযাত্রার অনুষ্ঠান। ধামরাইয়ের যশোমাধব মন্দিরের পরিচালনাপর্ষদের বর্তমান সম্পাদক রাজীবপ্রসাদ সাহার মতে প্রায় ২০০ বছর আগে ধামরাইয়ের যশোমাধব রথযাত্রা উৎসবের সূচনা হয়। কিংবদন্তী আছে, পালবংশের শেষ রাজা যশোবন্ত পাল একদিন গজে আরোহণ করে ধামরাইয়ের শিমুলিয়ায় বেড়াতে আসেন। পথে শিমুলিয়ার উপকণ্ঠে একটি লাল মাটির ঢিবির কাছে এসে রাজার হাতি থেমে যায়। পরে রাজার আদেশে ঐ মাটির ঢিবি খনন করে একটি মন্দিরের সন্ধান মেলে। ঐ মন্দিরটিতে মাধব বিগ্রহসহ আরও কিছু বিগ্রহ পাওয়া যায়। রাজা যশোবন্ত পাল সকল বিগ্রহ সংগ্রহ করে শিমুলিয়ার বিভিন্ন স্থানে পূজার জন্য স্থাপন করেন। রাজা মূল বিগ্রহটিকে ধামরাইয়ে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একজন ব্রাহ্মণকে দায়িত্ব দেন। এরই ধারাবাহিকতায় রাজার নাম সংযুক্ত করে মন্দিরের নাম হয় যশোমাধব মন্দির। এখানেই মাধব বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় স্থানটির নাম হয়েছে মাধববাড়ি। প্রথমে একটি কুঁড়েঘরে মাধবের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল বলে জানা যায়; আর মাধবের রথখানিও ছিল তখন বংশদণ্ডনির্মিত। পরে কবে কোন সময় মাধরের কুঁড়ের ঘরের মন্দিরের স্থলে পাকা দালান ও বংশদণ্ড রথের বদলে কাঠের রথ তৈরী হয়েছিল তাঁর সঠিক তথ্য জানা যায় নি। জনশ্রুতি আছে যে, দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ২৫০ জন দক্ষ কাষ্ঠশিল্পীর অক্লান্ত পরিশ্রমে ধামরাইয়ের প্রথম কাঠের রথখানি তৈরী হয়েছিল। এই কাঠের রথে নানা কারুকার্যখচিত মহাভারতের কাহিনী ও কলিকালচিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। ৩২ চাকার উপর প্রতিষ্ঠিত রথখানির উচ্চতা ছিল ৮০ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে উহা ছিল যথাক্রমে ৪০ ফুট ও ৪৫ ফুট। তিনতলা বিশিষ্ট রথখানিতে সুদৃশ নয়টি কক্ষ থাকায় উহাকে নবরত্ন রথ বলা হত। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় হানাদার বাহিনীর দোসরদের কালছোবলে ঐতিহ্যবাহী ধামরাইয়ের রথখানি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর পর আগের রথের আদলে আর একটি রথ তৈরীর প্রয়াস থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নি নানা কারণে। পরে ৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট আর একটি রথ তৈরী হয় যা বর্তমানে ধামরাইয়ের রথ হিসেবে আজও বিদ্যমান। শ্রীশ্রীজগন্নাথ-দেবের জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছর আষাঢ় মাসে নানা উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে পালিত হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে জগন্নাথদেব হলেন পাপবিমোচনকারী সাক্ষাৎ বিষ্ণুর অবতার। জনশ্রুতি আছে যে ধামরাইয়ের এতিহ্যবাহী সুপ্রাচীন রথের মেলা শুরু হয়েছিল ১০৭৯ বাংলা সনে। প্রতি বছর আষাঢ় মাসে দশ দিনের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে আসে রথ যাত্রার মেলা। প্রতি বছর যশোমাধবের বিগ্রহ মাধবমন্দির থেকে রথে উঠিয়ে ধামরাই পৌর এলাকায় গোপনগরে নিয়ে যাওয়া হয়। রথের এ যাত্রাকে বাবার বাড়ী থেকে শ্বশুরবাড়ি যাত্রা বলে বিশ্বাস করা হয়। রথখোলায় গোপনগরে দশদিন অবস্থান করার পর দশম দিনে আবার উল্টোরথ যাত্রার মাধ্যমে যশোমাধবকে আবার মাধবমন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়। বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলায় রথযাত্রার উৎসব পালিত হয়। ফরিদপুরের শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন মহাউদ্ধারণ মঠের আয়োজনে প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের শ্রীমূর্তি রথে চড়িয়ে রথযাত্রা করা হয়। সিলেট, ঢাকা দক্ষিণে শ্রীগৌরসুন্দর ও শ্রীকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ একই রথে প্রতিস্থাপন করে সাড়ম্বরে রথযাত্রার উৎসব প্রতিপালন করা হয়। রথযাত্রা শেষে ঐ বিগ্রহদ্বয় আবার ঢাকাদক্ষিণ মহাপ্রভুর পিতৃনিবাস ঠাকুরবাড়ির শ্রীমন্দির বেদীতে ফিরিয়ে আনা হয়। আজকাল পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রেই সাড়ম্বরে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার অনুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর বড় বড় শহরের রাজপথে, যেমন নিউইয়র্ক, সান্ ফান্সিসকো, টোকিও, মস্কো আদি বড় বড় শহরের রাজপথে ইস্কনের পরিচালনায় রথযাত্রার উৎসব প্রতিপালিত হয়ে আসছে।
সংগ্রহে : অমিত সরকার শুভ