যারা বুদ্ধিমান তারা ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে জীবনযাপন করবে। আর যারা নির্বোধ তারা ইন্দ্রিয়ের দাস হয়ে জীবনযাপন করে। ইন্দ্রিয়ের দাস হয়ে জীবনযাপন করলে তার যতো কিছুই প্রাপ্তি হোক না কেন পরিণামে তার তৃপ্তি হয় না। আর অতৃপ্তি হচ্ছে দুঃখের কারণ। যদি কারও কাছে কিছু নাও থাকে কিন্তু অন্তরে তিনি যদি তৃপ্ত হন তাহলে তিনি সুখেই আছেন, আর যদি কারও কাছে সবকিছু থাকা সত্ত্বেও যদি তিনি অন্তরে অতৃপ্ত হন তাহলে তিনি দুঃখেই আছেন। তাহলে সুখ বা দুঃখের মূল কারণটি হচ্ছে তৃপ্তি এবং অতৃপ্তি, অন্তরে সন্তুষ্টি এবং অশান্তি। অন্তরে যিনি সন্তুষ্ট তার কাছে যদি কিছু নাও থাকে, তবুও তিনি সুখী। আর অন্তরে যিনি অতৃপ্ত, অন্তরে যিনি অসন্তুষ্ট, অন্তরে যিনি অশান্ত, তার কাছে সবকিছু থাকলেও তিনি অসুখী।
যারা ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করে, যারা গো-দাস তারা সর্ব অবস্থাতেই অতৃপ্ত থাকে, কেন না ইন্দ্রিয়ের অবস্থাটিই এই রকম। ইন্দ্রিয় সবসময়ই ভোগ চাইছে। সে সর্বদা বলে আমি এটা চাই, আমি ওটা চাই। কিন্তু সে যতই পায় কখনও কি সে তৃপ্ত হয়? এই সম্বন্ধে বলা হয়েছে - আগুনে যেমন ঘি ঢালার ফলে কখনও আগুন নেভানো যায় না, ঠিক তেমনি ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার মাধ্যমেও ইন্দ্রিয়গুলিকে তৃপ্ত করা যায় না।
না জাতো কামান্ উপভোগেন সংযতে। অর্থাৎ উপভোগের দ্বারা কখনই ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করা যায় না বা তৃপ্ত করা যায় না। অগ্নিতে ঘি ঢালার ফলে সে আগুনটি কখনই নেভানো যায় না। ঘি ঢেলে কি আগুন নেভানো যায়? পক্ষান্তরে কি হয়? যত ঘি ঢালবে ততই আগুন বাড়তে থাকবে। আগুন উদ্দীপ্ত হয়ে উঠবে। অর্থাৎ যারা ইন্দ্রিয় উপভোগের মাধ্যমে তৃপ্তি সাধন করতে চায় তারা কখনই তৃপ্ত হতে পারে না।
তাহলে আমরা যদি প্রকৃতপক্ষে সুখী হতে চাই তবে আমাদের কি করতে হবে? ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করার পরিবর্তে ইন্দ্রিয়কে সংযত করতে হবে। আমরা যদি ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করি, অর্থাৎ ইন্দ্রিয় যা চায় তা যোগান দেওয়ার জন্য যদি তৎপর হই, তাহলে আমরা কোন দিনই সুখ ভোগ করতে পারব না। জড় জাগতিক জীবন মানে হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করা। চোখ বলছে আমাকে এটা দাও, তখন সঙ্গে সঙ্গে সে সেটা পাওয়ার জন্য তৎপর হচ্ছে। তাহলে সে কার দাসত্ব করছে?
ইন্দ্রিয় বলছে আমাকে এটা দাও তখন সে সেটা পাওয়ার জন্য ছুটছে। তেমনি স্পর্শ ইন্দ্রিয় বলছে আমি এটা চাই, ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় বলছে আমি এটা চাই, জিহ্বা ইন্দ্রিয় বলছে আমি এটা চাই এবং কর্ণ ইন্দ্রিয় বলছে আমি এটা চাই। এখন সেই বেচারা এই পাঁচ ব্যক্তির দাসত্ব করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। একজনের দাসত্ব করাই কঠিন, আর পাঁচজনের দাসত্ব করা, বিশেষ করে যখন পাঁচজন একসঙ্গে দাবী করতে থাকে, তখন তার অবস্থাটা কি রকম হয়?
অতএব আমরা কি ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করব, না ইন্দ্রিয়কে সংযত করব? ইন্দ্রিয় সংযম করার উপায়টি কি?
ইন্দ্রিয় সংযমের উপায়টি হচ্ছে যেমন - আমাদের দেহটিকে যদি একটি রথের সঙ্গে তুলনা করি, ইন্দ্রিয়গুলিকে যদি পাঁচটি ঘোড়ার সঙ্গে তুলনা করি, পঞ্চ ইন্দ্রিয় পাঁচটি ঘোড়া, তাহলে এই রথটি কিভাবে আমাদের চালাতে হবে? ঘোড়াগুলিকে সংযত করার জন্য লাগাম দরকার। লাগামটি কি? মন। তাহলে এই মন দিয়ে ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করতে হবে। লাগাম ছাড়া কি ঘোড়াগুলি সামলানো যায়? আবার লাগামটাকে সংযত করতে হলেও একজন সুদক্ষ সারথি বা চালক প্রয়োজন। তাহলে এখানে সারথি কে? বুদ্ধি হচ্ছে সারথি, আবার বুদ্ধি নিজে নিজেও যথার্থ সারথ্য করতে পারে না। বুদ্ধি কি করে? যথার্থ সারথি কে? কৃষ্ণ। আমাদের বুদ্ধিটি যদি কৃষ্ণকে অপর্ণ করি তাহলে ইন্দ্রিয়গুলি পরিচালিত হবে মনের দ্বারা।
তাই ভগবদ্গীতার নির্দেশপি কি পাচ্ছি আমরা? মনটাকে কৃষ্ণকে অর্পণ কর - “মন্মনা ভব” - তাহলে লাগামটা কৃষ্ণের হাতে তুলে দাও। লাগামটা যদি কৃষ্ণের হাতে তুলে দেওয়া হয় তাহলে ইন্দ্রিয়গুলি সংযত হবে। রথটা চলবে ঠিকমতো। দেহরূপ রথটা যদি ঠিকমতো চলে তাহলে আমাদের গন্তব্য স্থানটি কোথায়? ভগবদ্ধামে। অতএব প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ কি? লাগামটি কৃষ্ণের হাতে তুলে দেওয়া। অতএব সেই জন্যেই বলা হয়েছে মন্মনা। “মন্মনা” হতে হলে কি করতে হবে? “মদ্ভক্ত”- কৃষ্ণের ভক্ত না হলে মনটা শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মে অপর্ণ করা যাবে না। আবার যদি ভক্ত হই তাহলে কি হবে? “মদ্যাজি” - যাজনা করতে হবে। “মাম নমস্কুরু” - কৃষ্ণের চরণে প্রণতি নিবেদন করে নিজেকে সর্বোতভাবে শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে অর্পণ করতে হবে।
শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী মহারাজ
(জুন ২০০৭, শ্রীরাধাদেশ ধাম, বেলজিয়াম)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন