গত ১০ সেপ্টেম্বর এর “সমকাল” পত্রিকার উপসম্পাদকীয় তে বিশিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা “বীরেন্দ্রনাথ অধিকারী”র একটি লেখা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। লেখাটিতে তিনি আগামী মহালয়ার দিন শ্রী শ্রী রমনা কালী মন্দিরে আয়োজিত 'গণশ্রাদ্ধ-৭১' অনুষ্ঠানকে সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ ও উস্কানিমূলক আখ্যা দিয়ে অনুষ্ঠানটি আয়োজনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের জন্য সব অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিশীল শক্তির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা লেখাটির তীব্র প্রতিবাদ জানাই। এই লেখাটিতে তিনি কয়েকটি শাস্ত্রীয় আপত্তি উল্লেখ করেছেন।
সাধারনত প্রয়াত ব্যক্তির সাথে রক্ত সম্পর্ক হীন কেউ শ্রাদ্ধাদি করতে পারেন না। কিন্তু ওই প্রয়াত ব্যক্তির সাথে যদি কেউ আত্মিক ঐক্য অনুভব করেন ,তাহলে তিনি তার অন্ত্যেষ্টি করতে পারেন। মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান রামচন্দ্র নিজে তা আচরন করে প্রমান দিয়ে গেছেন । সীতা হরন ঠেকাতে গিয়ে পক্ষীরাজ জটায়ু যখন রাবনের হাতে নিহত হন , তখন রাম স্বহস্তে জটায়ুর দাহ সংস্কার করেন। বাল্মিকী রামায়নের ৬৮ সর্গে রাম বলছেন, "এখন এই জটায়ুর বিনাশে আমার যে কষ্ট হচ্ছে, সীতা হরনে তেমনটি হয় নি। ইনি স্রীমান রাজা দশ রথের মত আমার মাননীয় ও পূজ্য ।... মহাবল আমি স্বয়ং তোমার দাহ কর্ম করছি। তুমি এখন-ই উৎকৃষ্ট লোকে যাও। " এরপর রাম ব্রাহ্মনেরা প্রেতের উদ্দেশে যে মন্ত্র জপ করেন , জটায়ুর জন্য সেই স্বর্গ সাধন মন্ত্র জপ করলেন। এবং শেষে পিণ্ড, তর্পণ , জপ করে , জটায়ু যে কুলের জীব অর্থাৎ পক্ষী কুল কে আমন্ত্রন করে শ্রাদ্ধে ভোজন করিয়েছিলেন।
“গণ শ্রাদ্ধ” শব্দটি হিন্দু শাস্ত্রে না থাকলেও, প্রকারন্তরে গণ শ্রাদ্ধ হিন্দু সমাজে বহুদিন ধরেই আছে। কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ সেনা ও বীর জমায়েত হয়েছিল। পঞ্চ পাণ্ডব সমেত অল্প কিছু ব্যক্তি যুদ্ধ শেষে জীবিত ছিলেন। মহাভারতের স্ত্রী পর্বে দেখা যায় যে, ধৃত রাষ্ট্র , ধর্ম পুত্র যুধিষ্ঠির সমেত জীবিত কুরু গণ এইসব প্রয়াত সেনা ও বীরগণের অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন করেছিলেন। লীলা পুরুষোত্তম ভগবান কৃষ্ণ, ধর্মাত্মা বিদুর ও অখিল শাস্ত্র প্রনেতা ভগবান ব্যাসের উপস্থিতেই এই মহাভারতীয় গণ শ্রাদ্ধ ও দান ইত্যাদি অন্য ধর্মীয় আচার সম্পন্ন হয়েছিল।
রাম ও কৃষ্ণ চরিতের মত উৎকৃষ্ট প্রমান যেখানে বিদ্যমান ,সেখানে অযথা বিতর্ক বর্জনীয়।এই 'গণ শ্রাদ্ধ ৭১" বা "পিতৃ যজ্ঞ " কে যারা বিরোধিতা করছেন ,তাঁদের উদ্দেশ্য অসাধু। এ এক মঙ্গলময় অনুষ্ঠান ,যাতে বিদেহী আত্মা ও তাঁদের পরিবার এবং সেই সাথে দেশ ---সকলের মঙ্গল ঘটবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে যেহেতু ওইসব হিন্দু আত্ম বলিদান দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সরকারের ও উচিত এই গণ শ্রাদ্ধে ধর্ম পুত্র যুধিষ্ঠির -এর মতই রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা প্রদান করা। কোনও রকম প্ররোচনার ফাঁদে সরকার, রাজনৈতিক দল বা হিন্দুগন যাতে না পড়ে সেজন্য সজাগ থাকুন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রয়াত হিন্দুদের অনেকের-ই শাস্ত্রীয় রীতি মেনে দাহ ,অশৌচ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি অন্ত্যেষ্টি করা সম্ভব হয় নি। এর ফলে ওই প্রয়াত ব্যক্তি বর্গ ,যারা প্রেত দশায় কষ্ট পাচ্ছেন, তাঁদের উত্তরপুরুষ গণ-এর পরিবারের (বাংলাদেশ বা ভারত যে দেশেই থাকুন না কেন এখন ),পক্ষে পূর্বজদের এই অবস্থা হানিকর। তাই, গণশ্রাদ্ধের জন্য ‘মহালয়া’কে ধার্য করা হয়েছে। এ দিনে তো পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা অবশ্যই কল্যাণ। কুশপত্তলিকা দাহ করে শ্রাদ্ধ করা দোষণীয় নয়। উল্লেখ, সেখানে ষোড়শপিণ্ড দানের মাধ্যমে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হবে।
পরিশেষে যেসব হিন্দু এই গণ শ্রাদ্ধের আয়োজন করেছেন তাঁদের শ্রদ্ধা জানাই এই জন্য যে বিলম্বে হলেও বাঙালি হিন্দু জাতির পক্ষ থেকে তারা এই জরুরি , আবেগপূর্ণ এবং শাস্ত্র সম্মত সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে। এই অনুষ্ঠান টি সফল করার সময় শাস্ত্রীয় মর্যাদা যেন যথাযথ থাকে সেদিকেও তাঁদের নজর দিতে অনুরোধ করি। পশ্চিম বঙ্গের হিন্দুদের- ও উচিত এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা বা এমন উদ্যোগ কে সমর্থন করা। কারন ৭১-এর যুদ্ধে তাঁদের - ও অনেকের স্বজন নিহত হয়েছিলেন।
ঈশ্বর সকলের মঙ্গল করুন। হরি ওঁ। জয় মা। জয় প্রভু।
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ
১) শ্রী দেবাশিস সিনহা, কলকাতা
২) শ্রী গৌরমোহন দাশ, ঢাকা
৩) শ্রী জয় রায়, রাজশাহী
"সনাতন ভাবনা ও সংস্কৃতি" ব্লগ ও গ্রুপ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন