১৫ নভেম্বর ২০১৩

“মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ”- শ্রী জয় রায় ( last part)

এই ধারাবাহিকের পূর্বের লেখাগুলো পড়ুনঃ
http://sonatonvabona.blogspot.com/2013/11/blog-post_14.html    
  


মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ” (পর্ব ১)
-----------------------------
কর্ণের মৃত্যুর পর যুদ্ধের ১৮তম দিনে কৌরবদের শেষ সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত হয় শল্য। মদ্ররাজ শল্য ছিল মাদ্রীর ভাই অর্থাৎ সম্পর্কের দিক থেকে পঞ্চ-পাণ্ডবদের মামা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে যুধিষ্ঠির কৌরবদের শেষ সেনাপতি শল্যকে বধ করে।


অন্যদিকে, সহদেবের হাতে শকুনি নিহত হয়। শকুনিই ছিল মহাভারতের প্রধান খল-নায়ক।  ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর বিয়ের পর থেকেই তিনি হস্তিনাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা এবং প্রথম থেকেই দুর্যোধনের সব কাজে নিত্য সহচর ও সহায়ক ছিল। শকুনি ছোটবেলা থেকেই দুর্যোধন ও তাঁর ভাইদের মনে পঞ্চ-পাণ্ডবদের প্রতি বিদ্বেষের বিষবাষ্প তৈরি করে। মহাভারতের যুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে শকুনি, যে ছিল অত্যন্ত চতুর ও কুটিল। যুদ্ধের ১৮তম দিনে সহদেব শকুনির শিরচ্ছেদ করে তাকে বধ করে।



শল্য ও নিজ মামা শকুনির মৃত্যুর পর ভীত দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হৃদে আত্মগোপন করে। ভীম দুর্যোধনকে গদাযুদ্ধে আহ্বান জানায়। কিন্তু, গদাযুদ্ধের নিয়ম ভঙ্গ করে ভীম দুর্যোধনের উরুভঙ্গ করায় বলরাম রেগে যায়। বলরাম ভীমকে বধ করার জন্য উদ্যত হয়। শ্রীকৃষ্ণের হস্তক্ষেপে ভীম রক্ষা পায়।

দুর্যোধনের উরুভঙ্গের পর অশ্বত্থামা আহত দুর্যোধনের সাথে দেখা করতে যায় দুর্যোধনের সকল কুকর্মের সহায়ক ছিল এই অশ্বত্থামা শল্যের মৃত্যুর পর যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে দুর্যোধন অশ্বত্থামাকেও সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ করে। বনের মধ্য একটি গাছে প্যাঁচা কর্তৃক কিছু ঘুমন্ত কাক কে হত্যার দৃশ্য দেখে অশ্বত্থামার মাথায় দুর্বুদ্ধি আসেতিনি নিজেও পাণ্ডবদের ঘুমন্ত অবস্থায় মারার সংকল্প নেয়গভীর রাতে পাণ্ডব শিবিরে প্রবেশ করে অশ্বত্থামা পাণ্ডবদের সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডিনী সহ দ্রৌপদীর সকল সন্তানকে নির্মম ভাবে হত্যা করে পরবর্তীতে অশ্বত্থামার কাছে এই সংবাদ শুনে দুর্যোধনের আনন্দের সীমা ছিল নাএরপরই দুর্যোধন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে

অশ্বত্থামার এই নিষ্ঠুর আচরণে শ্রীকৃষ্ণ তাকে অভিশাপ দেয় যে, “অশ্বত্থামাকে জীবনে অশেষ দুর্গতি ভোগ করতে হবেঅশ্বত্থামা তিন হাজার বছর কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে একাকী জীবনযাপন করতে হবেঅনুশোচনার জন্য অশ্বত্থামা শ্রীকৃষ্ণের এই অভিশাপ মেনে নিয়ে বনে চলে যায়পরবর্তিতে অশ্বত্থামার শেষ পরিণতি কি হয়, এটা মহাভারতে স্পষ্ট উল্লেখ নেই

মহাভারতের একটি বিখ্যাত শ্লোক হচ্ছে, যতো ধর্মস্তত কৃষ্ণো, যতঃ কৃষ্ণস্ততো জয়ঃ।  এর অর্থ হচ্ছে, ধর্ম যেখানে শ্রীকৃষ্ণ সেখানে, শ্রীকৃষ্ণ যেখানে জয় সেখানে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চেয়েছিলেন ধর্মের প্রতিষ্ঠা। আর সেইজন্যই কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে যুদ্ধমত্ত অধার্মিক শক্তিকে ধ্বংস করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সব সময়ই পাণ্ডবদের সহায় ছিলেন।


কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে সাধুদের পরিত্রাণ এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্যই প্রয়োজনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছলনা বা মায়ার আশ্রয় নিয়েছেন। তাই তিনি বারবার বলেছেন, “তুমি সকল ধর্মকে অর্থাৎ সকল কর্তব্যকর্মকে আমাতে ত্যাগ করে আমার শরণাপন্ন হও। আমি তোমাকে সকল পাপ থেকে মুক্ত করে দেব।”- পাণ্ডবদের প্রতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই প্রতিজ্ঞাই মহাভারতীয় রাজনীতির শেষ কথা.........

 
(পর্ব ১)
-------------------------------
মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন একজন আদর্শ ধর্ম-সাম্রাজ্য-সংগঠক। কুরুক্ষেত্রের সেই যুদ্ধ শুধুমাত্র কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ ছিল না; সেটা ছিল ধর্ম ও অধর্মের যুদ্ধ। তাই, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধ ও এর পরিণতিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রগাঢ় প্রভাব ছিল তিনি পাণ্ডব এবং কৌরবদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করতে যথাসম্ভব উদ্যোগী হয়েছিলেন কিন্তু যখন তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন তিনি  দক্ষ কূটনীতিকের ভূমিকা গ্রহণ করেন

আমাদের হিন্দুদের সকল শাস্ত্র ও মহান ব্যক্তিদের আচরণ থেকে এটাই সিদ্ধ হয় যে, “এই জগত সংসার ধর্মেই উপরেই প্রতিষ্ঠিত। ধর্মের দ্বারাই মানুষের জীবনের সার্থকতা আসে। ধর্মই চরিত্র গঠনের একমাত্র সহায়ক।”


পাণ্ডবদের কাছে সৈন্যবল অপেক্ষা ধর্মবল বেশি ছিল, সেইজন্যই তাঁরা স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের  অতুলনীয় অপ্রতিরোধ্য কৌশলের সাহায্যে জয়লাভ করে। অন্যদিকে, অস্ত্র-শস্ত্রের দ্বারা সর্বরকমে সুসজ্জিত বিপুল সেনার অধিকারী হয়েও ধর্মত্যাগের ফলে কৌরবদের অধঃপতন হয়েছিল।  দুর্যোধনের বন্ধু কর্ণ; যিনি সূর্য দেবতার পুত্র হিসেবে যথেষ্ট ধার্মিক, সাহসী, দানবীর ও বীরযোদ্ধা ছিল। কিন্তু, সারাজীবন ধর্মচর্চা করেও জীবনের শেষ মুহূর্তে সূর্যপুত্র কর্ণ সামাজিক মর্যাদা লাভ ও নিজের সকল প্রতিভাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অধর্মের পথ বেছে নিয়েছিলো। তাই, কর্ণকেও ধর্মযুদ্ধে মৃত্যুবরণ স্বীকার করতে হয়েছিল।

রামায়ণে রাবন, কুম্ভকর্ণ, মেঘনাদ প্রভৃতি অসুরেরাও ধন-জনে সম্পন্ন ছিল। তাদের কাছেও যুদ্ধের অসাধারণ উপকরণ মজুদ ছিল। কিন্তু, পাপ ও অধর্মের ফলেই ভগবানের কৃপায় বলীয়ান সাধারণ বানর সেনাদের দ্বারা রাবনের সৈন্য পরাস্ত হয়েছিল।   

হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্র, যার দুর্বলতাই ছিল সমস্ত ধ্বংসের কারন। ধৃতরাষ্ট্রের জীবনে ধর্মবোধ ও ঈর্ষা সমানভাবে কাজ করেছে। গান্ধারীর মত ধার্মিক স্ত্রী এবং ভীষ্ম, বিদুর বা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও ধৃতরাষ্ট্রকে সৎপথে আনতে পারে নি। পুত্রস্নেহে আসক্ত, অধর্মের অদৃশ্য আগুন ও ঈর্ষার জ্বালায় সদা তপ্ত এবং অন্তরের অশান্তির জন্য তিনি সারাজীবন দুঃখ পেয়েছেন।


কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ফলে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী কে একশত পুত্রের মৃত্যুর শোক সহ্য করতে হয়েছিল। দুর্যোধনের মৃত্যুর পর শ্রীকৃষ্ণ গান্ধারীর নিকট শোকজ্ঞাপন করতে যান  কিন্তু শোকাহত গান্ধারী ভেবেছিলেন যে শ্রীকৃষ্ণ ইচ্ছাকৃত ভাবে যুদ্ধের অবসানের জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি শোকে দুঃখে কাতর হয়ে তিনি  শ্রীকৃষ্ণকে এই বলে শাপ দেন যে, “ যাদববংশও  বছর পরে এভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে

ধর্মস্থাপন করতে গিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেইদিন হাসিমুখে গান্ধারীর অভিশাপ স্বীকার করে নেয়। কারণ, শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন বহুজনসুখায় বহুজনহিতায় কর্মে লিপ্ত, অথচ নির্বিকার ও আসক্তিহীন। মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণে যে সামাজিক কর্তব্যবোধ ও বিচক্ষণ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, পরবর্তীতে সেই আদর্শেই অনুপ্রানিত হয়েই মহারাণা প্রতাপ ও ছত্রপতি শিবাজির মত হিন্দুবীররা ধর্মরক্ষার নিমিত্তে নির্দ্বিধায় আত্মবলিদান দিয়েছেন......



(পর্ব ১৬)
-----------------------------
মহাভারত আমাদের হিন্দুদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এক অতুলনীয় সম্পদ। হস্তিনাপুর (বর্তমানে ভারতের উত্তর প্রদেশের মীরাট নগর থেকে ৩৫ কিমি উত্তর-পশ্চিমে দিল্লী ও থানেশ্বরের নিকটে) নামে একটি রাজ্যের পারিবারিক উত্তরাধিকার বিবাদ নিয়ে কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধই হলো মহাভারতের পটভূমিএখানে ভীষ্ম, বিদুর, যুধিষ্ঠির চরিত্র যেমন বাস্তব ও সত্য; তেমনি শকুনি, দুর্যোধন, দুঃশাসন চরিত্রের মানুষও আজও আমাদের সমাজে বর্তমান।


 মহাভারতের নারী চরিত্রের গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা তাঁদের নারীসুলভ প্রেম-ভালবাসা-মাতৃত্ব-স্নেহের অতুলনীয় দৃষ্টান্তের মাধ্যমের আজও অমর হয়ে আছেবর্তমান সমাজের চিন্তাধারা ও স্বাভাবিক দৃষ্টি দিয়ে মহাভারতের নারী চরিত্রগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব

 মহাভারতের তাৎপর্যে ব্যাসদেব বলেছেন যে, “দুর্যোধন হচ্ছে অহঙ্কাররূপ মহাবৃক্ষ, কর্ণ সেই বৃক্ষের স্কন্দ, শকুনি তার শাখা, দুঃশাসন সেই বৃক্ষের ফুল ও ফল, আর বৃক্ষটির মূল প্রজ্ঞাহীন রাজা ধৃতরাষ্ট্র (যার দুর্বলতাই সমস্ত ধ্বংসের কারন)।” অন্যদিকে, “যুধিষ্ঠির হচ্ছে ধর্মময় মহাবৃক্ষ, অর্জুন সেই বৃক্ষের স্কন্দ, ভীম এর শাখা, নকুল ও সহদেব এই বৃক্ষের ফুল ও ফল এবং এই বৃক্ষের মূল হচ্ছে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।” 


এই মহাভারতেই রয়েছে ব্যাবহারিক বেদান্তের এক সুবিশাল ভাণ্ডার –“শ্রীমদ্ভগবদগীতা”, যা বর্তমান দিল্লীর ১০০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মাধ্যমে সমগ্র মানব জাতিকে দান করেছে। ই গীতাই আমাদের আর্য হিন্দু জাতির অহংকার ও একমাত্র সার্বভৌম ধর্মগ্রন্থ। গীতা এতই উচ্চমানের দর্শন; যার জন্য “শ্রীমদ্ভগবদগীতা”কে অক্সফ্রোর্ড থেকে শুরু করে আধুনিক বিশ্বের অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম দর্শন শাস্ত্র হিসেবে শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক ভাবে পাঠ্য করা হয়েছে। এছাড়াও  বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ গ্রন্থ বিক্রির রেকর্ড হিসেবে “শ্রীমদ্ভগবদগীতা (যথাযথ)” ১৯৯৫ সালে গিনেজ বুকে স্থান লাভ করেছে।    


সুতরাং এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ধর্মের নামে প্রচলিত বিশ্বের সকল ধর্মগ্রন্থের মধ্য গীতার স্থান অদ্বিতীয়। গীতার প্রতিটি শ্লোক আমাদের আন্তরিক যুদ্ধ আরাধনায়প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য আহ্বান করে। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের মতো  গীতা আমাদের স্বর্গ অথবা নরকপ্রাপ্তির লোভ দেখিয়ে ভ্রান্ত করে না; বরং সনাতনের সেই অমরত্বের উপলব্ধি করায়, যারপর আর জন্ম-মৃত্যুর কোন বন্ধন থাকে না। এই জন্য আমাদের সকলের উচিত অর্থ ভাবসহ গীতাকে অনুধাবন করে তাঁর শিক্ষানুসারে নিজেদের জীবন তৈরি করা।  গীতার বানীই সমস্ত মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।


স্বামী বিবেকানন্দ তার রচনাবলীতে মহাভারত প্রসঙ্গে বলেছেন যে, “মহাভারত হচ্ছে প্রাচীন আর্যদের জীবনচরিত এবং জ্ঞানরাশির সুবিশাল বিশ্বকোষ। মহাভারতের চরিত্রগুলো হাজার হাজার বছর যাবৎ হিন্দুদের লালিত ভাবধারা ও চরিত্রনীতির ভিত্তি। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে তিন সহস্রাধিক বছর পূর্বে সংঘটিত ঘটনা-প্রবাহের এক জীবন্ত দলিল এই “মহাভারতে” শাশ্বত হিন্দু সভ্যতার যে আদর্শ চিত্রিত হয়েছে, তা লাভ করার জন্য আমাদের সমগ্র মানবজাতিকে এখনো বহুদিন চেষ্টা করতে হবে.........” 

 

মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ (শেষ পর্ব)
-----------------------------
মহাভারত আমাদের হিন্দুদের ধর্ম ও সভ্যতার উৎস। সেইজন্য মহাভারতকে বলা হয় হিন্দুর পঞ্চম বেদ। মহাভারতের প্রতিটি চরিত্রই আমাদের সমাজের এক একটা দিকের বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছে। এখানে, ভাল ও মন্দ চরিত্রগুলোর দ্বন্দ্বের মধ্যই সত্যধর্মকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

কিন্তু, এই মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ একটি সাধারণ চরিত্র নয়। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণকে স্বয়ং ভগবানরূপেই বর্ণনা করা আছে। মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করে গেছেন- তার সঠিক বিশ্লেষণ আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য। মহাভারতে পাণ্ডবরা ছিল বীর, ধর্মপ্রাণ, ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ। সেজন্যই তাঁদের বন্ধু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। সেজন্যই তাঁদের জয়লাভ।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয়লাভের পর যুধিষ্ঠির সিংহাসনে আরোহণ করে শ্রীকৃষ্ণের অনুগ্রহের কথা বারবার কৃতজ্ঞচিত্তে প্রকাশ করে। ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের  রাজসিংহাসনে বসিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভারতে একটি দৃঢ় রাষ্ট্রবাবস্থা প্রবর্তন করেছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ফলেই সত্য ও ধর্ম প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

শ্রীঅরবিন্দ বলেছিলেন যে, -কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ আসুরিক বল বিনাশ করে ব্রহ্মতেজ ও ক্ষত্রিয়তেজ উভয়কেই রক্ষা করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেই ব্রহ্মতেজে অনুপ্রনিত হয়েই হিন্দুবীররা পরবর্তীতে দুই-হাজার বছর ভারতবর্ষকে বাঁচিয়ে রাখে। চন্দ্রগুপ্ত, পুষ্যমিত্র, সমুদ্রগুপ্ত, বিক্রমাদিত্য, সংগ্রাম সিংহ, রাজসিংহ, প্রতাপাদিত্য, শিবাজী এই সকল হিন্দুবীররা সেই ক্ষত্রিয়তেজের বলেই দেশের দুর্ভাগ্যর সাথে সংগ্রাম করেছে।

-যেই দিন গুজরাট যুদ্ধে ও লক্ষ্মীবাঈয়ের চিতায় তার শেষ স্ফুলিঙ্গ নির্বাপিত হলো; তখন শ্রীকৃষ্ণের রাজনৈতিক কাজের সুফল পুণ্য ক্ষয় হয়ে গেল। ভারতকে ও জগতকে রক্ষা করবার জন্য আবারো পূর্ণ অবতারের আবশ্যকতা হলো।

মহাভারতের প্রধান মর্মবানী ধর্মের জয় ও অধর্মের বিনাশ। এই বানী আজও আমাদের হিন্দুদের জীবনে অমর হয়ে আছে। অধর্মের মাধ্যমে যে জয়, তা কোনদিন চিরস্থায়ী হয় না। মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই চিরন্তন সত্যটিই আমাদের সামনে বারবার তুলে ধরেছেন।          

এই ধারাবাহিক লেখায় আমি চেষ্টা করেছি, একজন দক্ষ রাজনীতিজ্ঞ, দণ্ডদাতা, বীর যোদ্ধা, ধর্মপ্রচারক ও ধর্মসংস্থাপক হিসেবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে। আমার এই প্রচেষ্টা আপনাদের যদি সামান্যতমও ভাল লেগে থাকে, তাহলে আমার পরিশ্রম সার্থক।


আজ সকলের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে, “আপনার সন্তানকে শিশুকাল থেকেই প্রগতিশীল শিক্ষার সাথে সাথে ধর্ম শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলুন। সন্তানকে রূপকথার গল্প না শুনিয়ে রামায়ণ ও মহাভারতের গল্পের মাধ্যমে ছোটবেলা থেকেই তার মনে ধর্মীয় চেতনার বীজ বপন করুন।” ভবিষ্যতে আপনার সন্তান মিথ্যা মোহে পা দিয়ে যেন নিজ ধর্ম ত্যাগ না করে সেজন্য আজ থেকেই সচেতনতা গ্রহন করুন। আজকের শিশুরাই যেন ভবিষ্যতে সুন্দর ও শক্তিশালী সনাতনী সমাজ গঠন করতে পারে, সেই দায়িত্ব আমাদের। তাই, আধুনিকতার নামে নিজের ধর্মীয় পরিচয় বিসর্জন দিবেন না।



পরিশেষে, কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শ্রীশ্রীগীতার মাধ্যমে যে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল, বর্তমান যুব-সমাজ সেই মন্ত্রেই দীক্ষিত হোক- এই কামনায় আমি আমার এই ধারাবাহিক লেখা এখানের শেষ করছি। জয় শ্রীকৃষ্ণ।।       

                                          - সমাপ্ত - 

  # শ্রী জয় রায়, সনাতন ভাবনা ও সংস্কৃতি
Share:

1 Comments:

Unknown বলেছেন...

খুব ভালোলাগল আমার এই ধারাবাহিক পড়ে।
ধন্যবাদ আপনাকে।

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।