০২ জুলাই ২০১৮

মহাপ্রভুর গুণ্ডিচা মার্জন

শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব আরম্ভের পূর্বদিন ‘গুণ্ডিচা মার্জন’ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। গৌড়ীয়া মতে রথযাত্রায় প্রভু জগন্নাথ তাঁর মন্দির ছেড়ে গুণ্ডিচা মন্দিরে আগমন করেন । এটা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মথুরা নগর ছেড়ে বৃন্দাবনে আগমনের মতো । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রজে ফিরবেন , এই কথা শ্রবন করে সবচেয়ে আনন্দিত হয়েছিলেন গোপিনীগণ ও ব্রজেশ্বরী শ্রীমতী রাইকিশোরী । মহাপ্রভুর মধ্যে রাধাভাব প্রকট, তিনি পার্ষদগণকে নিয়ে স্বহস্তে গুন্ডিচা মন্দির মার্জন করতেন। শ্রী চৈতন্য চরিতামৃতে শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী এই সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন ।

মহাপ্রভু ভক্তগণের সঙ্গে নিরন্তর কীৰ্ত্তন-রঙ্গে ক্রীড়া করেন। আচাৰ্য্যাদি ভক্তগণ মহাপ্রভুকে নিমন্ত্রণ করেন, মহাপ্ৰভু সেই সেই স্থানে ভক্তগণকে নিয়ে ভিক্ষা করেন। এই মত নানা রঙ্গে কিছুদিন যাপন করলেন । ক্রমে শ্ৰীজগন্নাথ দেবের রথযাত্রার দিন উপস্থিত হল। তখন মহাপ্রভু প্রথমে কাশীমিশ্রকে ডেকে এনে তাকে দিয়ে পড়িছা পাত্র ও সার্বভৌমকে ডাকিয়ে আনলেন। মহাপ্রভু হেসে তিনজনকে বললেন — “ আপনারা আমাকে গুণ্ডিচা মন্দির মার্জনের সেবা দিন ” । মহাপ্রভু এই সেবা প্রার্থনা করলে পড়িছা বললেন, “আমরা সকলে আপনার সেবক, আপনার যা ইচ্ছা , সেই অনুযায়ী কাজ করা আমার কর্তব্য, বিশেষতঃ মহারাজ আমাকে আদেশ করেছেন , আপনার ইচ্ছার যেন যথাযথ পালন হয় । তবে প্রভু ! মন্দির-মার্জন আপনার যোগ্য সেবা নয় , এটি আপনার একটি লীলা । গুণ্ডিচা মার্জনের জন্য কলসী ও ঝাড়ু অনেক আবশ্যক , — তবে আজ্ঞা দিন আজ সেই সব জিনিস এই স্থানে নিয়ে আসি ” । এই কথা বলে পড়িছা নূতন একশত মাটির কলসী ও একশত ঝাড়ু এনে প্রভুর সামনে অপর্ণ করলেন।

পর দিন প্রাতঃকালে প্ৰভু শ্রীহস্তে নিজ ভক্তগণের অঙ্গে চন্দন লেপন করলেন । প্রত্যেকের হাতে এক একটি মার্জনী দিয়ে সকলকে সঙ্গে নিয়ে গুণ্ডিচা মন্দিরে গেলেন । গুণ্ডিচা মন্দির মার্জন করতে গিয়ে প্রথমে ঝাড়ু দিয়ে মার্জন করতে লাগলেন । ভিতর মন্দির এবং উপরিভাগ সব পরিস্কার করে সিংহাসন মার্জন করে চারি ভিত শোধন করার পর শ্রীজগমোহন পরিস্কার করলেন । চারপাশে শত ভক্ত হাতে ঝাড়ু নিয়েছেন , মহাপ্রভু নিজে ভালমতে শোধন করে সকলকে শিক্ষা দিতে লাগলেন, মহাপ্ৰভু প্রেমোল্লাসে গৃহ শোধন ও কৃষ্ণ নাম করছেন এবং ভক্তগণও কৃষ্ণ নাম উচ্চারণ করতে করতে নিজেদের কাজ করতে লাগলেন । মহাপ্রভুর ধূলায় ধূসর তনু দেখতে অতীব সুন্দর, কোন কোন ভক্ত অশ্রু জলে মার্জন করছেন। অনন্তর ভক্তগণ ভোগমণ্ডপ শোধন করে প্রাঙ্গণ শোধন করলেন। ক্রমে সমুদায় গৃহ শোধন করে তৃণ, ধূলি ও কাঁকর একত্র করে ভক্তগণ নিজেদের বস্ত্রে করে পরমানন্দে তৃণ ও ধূলি সকল বাইরে ফেলতে লাগলেন ।

তখন প্রভু বললেন , কে কত মার্জন করেছ, খড়কুটা ও ধূলির পরিমাণ দেখে পরিশ্রম বিচার করব । এই বলে সকলের ঝাড়ু দেওয়া বোঝা একত্র করলেন। সবচেয়ে মহাপ্রভুর বোঝাই অধিক হল । গৃহ মধ্যে মার্জন করার পর পুনৰ্ব্বার সকলকে কাজ বণ্টন করে দিয়ে বললেন , “তোমরা সকলে সূক্ষ্ম ধূলি ও কাঁকর দূর করে ভাল করে পরিস্কার কর ” । সমস্ত বৈষ্ণব দুইবার শোধন করলেন, তা দেখে মহাপ্রভূর মন সস্তুষ্ট হল। তখন অন্য শত জন শত ঘট পূর্ণ করে এনে রাখলেন । যখন মহাপ্ৰভু বললেন ‘জল আন’ তখন ভক্তগণ মহাপ্রভুর সামনে জলপূর্ণ শত ঘট এনে দিলেন । মহাপ্রভু প্রথমে মন্দির প্রক্ষালন করলেন, তারপরে, গৃহের উর্দ্ধ, অধঃ, ভিত, গৃহের মধ্য ও সিংহাসন ধৌত করলেন, তৎপশ্চাৎ খাপরা (খোলা) ভরে জল উর্দ্ধদেশে নিক্ষেপ করে সেইজলে উৰ্দ্ধ শোধন করে ভিত প্রক্ষালন করলেন । প্রভু প্রথমে মন্দির প্রক্ষালন, তারপরে শ্রীহস্তে সিংহাসনের মার্জন করলেন। ভক্তগণ গৃহ -মধ্য প্রক্ষালন এবং নিজ নিজ হস্তে মন্দির মার্জন করতে লাগলেন । নিত্যানন্দ প্রভু, অদ্বৈতাচার্য্য, স্বরূপ ভারতী আর পুরী বিনা আর সকলে জল বয়ে আনে ।

কোন ভক্ত মহাপ্রভুর হস্তে জলঘট দেয় , কেহবা মহাপ্রভুর চরণ উপরে জল নিক্ষেপ করে গোপনে সেই জল পান করে , কেহ বা সেই জল প্রার্থনা করে এবং কেহবা সেই জল অন্যকে দান করতে লাগলেন । তাতে সমস্ত প্রাঙ্গণ জলে পরিপূর্ণ হয়ে রইল। ভক্তগণ নিজ নিজ বস্ত্রে গৃহ সংসাজ্জন এবং প্রভু নিজ বস্ত্রে সিংহাসন মাৰ্জ্জন করলেন । শত ঘট জলে মন্দির মার্জিত হল । নিজেদের মনের মত করে মন্দির শোধন করলেন , মন্দিরকে নিৰ্ম্মল শীতল ও স্নিগ্ধ করে আপনার হৃদয়কে যেন প্রকাশিত করলেন । শতশত লোক সরোবরে জল ভরেন, ঘাটে স্থান না পেয়ে কেহবা কূপে জল ভরতে লাগলেন, একশত ভক্ত পূর্ণ কুম্ভ নিয়ে আসতে লাগলেন, অার শত ভক্ত শূন্য ঘট নিয়ে যেতে লাগলেন । ঘটে ঘটে ঠোকর লেগে কত ঘট ভেঙ্গে গেল, লোকেরা আবার শত শত ঘট এনে উপস্থিত করল ।

 ভক্তগণ জল ভরেন , গৃহধৌত করেন এবং হরিধ্বনি করেন । কৃষ্ণ ও হরিধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাওয়া যায় না । ভক্তগণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে ঘট সমপর্ণ এবং কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে ঘট প্রার্থনা করতে লাগলেন । সকল কৰ্ম্মেই কৃষ্ণনাম সঙ্কেত হয়ে উঠল । মহাপ্ৰভু প্রেমাবেশে কৃষ্ণ কৃষ্ণ নাম উচ্চারণ করতে করতে একাকী শত লোকের কৰ্ম্ম করতে লাগলেন, শত হস্তে যেন ক্ষালন ও মার্জন করেন এবং প্রত্যেক লোকের নিকট গিয়ে তাদেরকে কার্য্যের শিক্ষা প্রদান করেন । যে ব্যক্তি ভাল কৰ্ম্ম করেন, তাকে প্রশংসা এবং মনোমত না হলে তাকে মিষ্ট ভর্ৎসনা করেন । অন্যকে বলেন ,_“ তুমি ভাল কাজ করছ , প্রভু জগন্নাথের সেবাকার্য্য কিভাবে উত্তমরূপে করতে হয় , অন্যকেও শিখিয়ে দাও ”। এই কথা শুনে সকলে সঙ্কুচিত হয়ে মনোনিবেশ সহকারে ভালভাবে কাজ করতে লাগল ৷ এর পর মহাপ্রভু জগমোহন (মন্দিরের নিকট ক্ষুদ্র মন্দির ) প্রক্ষালন করে ভোগমণ্ডপ প্রক্ষালন করলেন । তারপর নাটশালা ধুয়ে চত্বর ও প্রাঙ্গণ ধুলেন, পাকশাল , মন্দিরের চতুর্দিক এবং সমুদায় অন্তঃপুর উত্তম রূপে ধৌত করালেন ।

এই সময়ে একজন সরল বুদ্ধি গৌড়ীয়া মহাপ্রভুর চরণে এক ঘট জল অর্পণ করে সেই জল নিজে পান করল, তা দেখে মহাপ্রভুর মনে দুঃখ ও রোষ উৎপন্ন হল । যদিও মহাপ্রভু তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, তথাপি শিক্ষার জন্য বাইরে রোষ প্রকাশ করলেন ৷ 

Collected: Dolon Das
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।