০৮ মে ২০২২

ভক্তি-পথ

চতুর্বিধ যোগসাধনার অন্যতম ভক্তি। বর্তমানে 'ভক্তি' কিংবা 'ভক্ত' শব্দটির কিছুটা ভুল অর্থে প্রয়োগ আমরা শুনতে পাই। যেমন কোনও মঠ বা মন্দিরে সমাগত সকল দর্শনার্থীদেরকে একসঙ্গে বিশেষায়িত করতে 'ভক্ত' শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়, কিংবা 'সাধু ও ভক্ত' বলে দুটি পৃথক শ্রেণির উল্লেখ করা হয়, গেরুয়া পরলে তিনি সাধু, আর সাধারণ জামা-প্যান্ট পরলে তিনি ভক্ত।

যেন সাধু ও ভক্ত আলাদা দুটি গোষ্ঠী। যেন সাধু যিনি তিনি ভক্তগোষ্ঠীর নন আবার গেরুয়া না পরলে তিনি যেন 'সাধু' বা সাধক নন।

ঠাকুর-স্বামীজির অনুধ্যানে আমাদের মনে হয়েছে 'ভক্তি' ও 'ভক্ত' শব্দের এহেন প্রয়োগ বিভ্রান্তিকর।

ভক্তি একটি আধ্যাত্মিক সাধন-পথ। যিনি ভক্ত তিনি অবশ্যই সাধক বা সাধু। সুতরাং ভক্ত ও সাধু আলাদা লাইনে দাঁড়ানো 'পৃথক শ্রেণি' নয়।

অধ্যাত্ম-সাধনপথ বা যোগ চারপ্রকার :

জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, রাজযোগ এবং ভক্তিযোগ। সাধক তাঁর ক্ষমতা ও রুচি অনুযায়ী এই চারটি পথের এক বা একাধিক পথে সাধনা করতে পারেন। তবে এগুলির মধ্যে ভক্তিযোগ সহজতম ও মধুরতম পন্থা।

স্বামী বিবেকানন্দের মতে ভক্তিযোগে ভক্তিই একাধারে উদ্দেশ্য এবং উপায় দুইই। অপরপক্ষে অন্যান্য যোগের পদ্ধতিগুলি শুধু উপায়মাত্র, উদ্দেশ্য নয়।

অর্থাৎ ভক্তিযোগে সাধক চান ইষ্টের প্রতি নিবিড় ভক্তি। আবার এই ভক্তিলাভের উপায়ও ভক্তি

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ শেখান, 'ভক্তিকামনা কামনার মধ্যে নয়।'

অর্থাৎ অন্য কামনায় মানুষের বদ্ধতা বাড়ে, মানুষ জাগতিক মোহের জালে ছটফট করে; কিন্তু 'ভক্তি-কামনা কামনার মধ্যে নয়', কারণ এই কামনার তীব্রতায় মানুষের স্বরূপের জাগতিক আচ্ছাদন ক্ষীয়মাণ হয়।

ভক্তি খুব মন্থর পদ্ধতি কিন্তু ভক্তি থেকে উৎপন্ন আনন্দ সাধককে সাধনার মধ্যে ডুবিয়ে রাখে, তাই এক্ষেত্রে সাধককে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বা কষ্ট করে সাধনা করতে হয়না।

সাধনার আনন্দই নেশার মত সাধককে সাধনায় ডুবিয়ে রাখে।

ভক্তিপথে জোর করে ইন্দ্রিয়দমন করতে হয়না। কারণ ভক্তের জাগতিক উদ্দীপনাগুলির অভিমুখ ঈশ্বরের দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় ভক্তিযোগে।

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষা দেন কামকে ঈশ্বরীয় প্রেমে পরিণত করতে, ক্রোধকে আধ্যাত্মিক তেজে পরিণত করতে।

ভক্তরাজ প্রহ্লাদ প্রার্থনা করছেন, 'হে প্রভু বিষয়ী লোকের যেমন জাগতিক ভোগ্যবিষয়ে তীব্র আসক্তি, তোমার প্রতি আমার সেইরূপ আসক্তি দাও।'

- এই হল ভক্তের প্রার্থনা।

ভক্ত আসক্তি ত্যাগ করেননা, শুধু সেই আসক্তিকে ঈশ্বরের অভিমুখী করে দেন।

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন :

'এমনি মিষ্টি খেলে অসুখ হয়, কিন্তু মিছরির মিষ্টি মিষ্টির মধ্যে নয়।'

ঠিক তেমনই কামনা-বাসনা ঈশ্বরীয় পথের প্রতিবন্ধক, কিন্তু 'ভক্তি-কামনা' কামনার মধ্যে নয়।

ভক্তিপথে জাগতিক আসক্তিকে ঈশ্বরীয় প্রেমে রূপান্তরিত করতে হয়। ঈশ্বরে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ভয়মুক্ত হতে হয়।

শ্রীম (মহেন্দ্র নাথ গুপ্ত) বলতেন, 'সর্বদা বাপ-মা ওয়ালা ছেলের মতো নির্ভয়ে থাকো।'

এভাবেই ভক্ত ঈশ্বরে শরণাগতির মাধ্যমে জাগতিক ভয় ও দুশ্চিন্তার ঊর্ধ্বে এক আনন্দঘন জগতে বিরাজ করেন।

অর্থাৎ সর্বদা সর্বভাবে ঈশ্বরের সাথে যুক্ত থাকাই ভক্তিপথের সাধনা।

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ শেখাচ্ছেন, একটি পাত্র থেকে আরেকটি পাত্রে তেল ঢাললে যেমন নিরবচ্ছিন্নভাবে তেলের ধারা পতিত হয় , তেমনি নিরবচ্ছিন্নভাবে ঈশ্বরের স্মরণ-মনন করতে হয়। খুব সহজ উপমা দিয়ে তিনি বোঝাচ্ছেন : যেমন যার দাঁতে ব্যাথা হয়েছে সে সব কাজ করে, সবার সাথে কথা বলে; কিন্তু মনটি সর্বক্ষণ ওই ব্যাথার দিকে পড়ে থাকে। ঠিক তেমনি সব অবস্থায় ভক্ত নিজেকে ঈশ্বরের সাথে যুক্ত রাখেন।

সর্বদা ইষ্টের স্মরণ ভক্তের স্বাভাবিক অবস্থা। কোনও প্রিয় মানুষের বিচ্ছেদে যেমন সর্বদাই সেই মানুষটিকে মনে পড়ে, ঠিক তেমনই ভক্ত সর্বদা ইষ্টস্মরণে নিয়োজিত না থেকে পারেন না। তিনি সংসারে থাকেন, সব কাজ করেন কিন্তু অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো প্রিয়তমের রূপ ও তাঁর নাম সর্বদাই স্মরণপথে উদিত হয়।

স্বাভাবিক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো ইষ্টমন্ত্র তাঁর মনে উচ্চারিত হয়ে চলে। ডুবন্ত ব্যক্তি যেমন প্রাণপণে কোনও অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করে, ভক্তও তেমনি ইষ্টের নাম ও রূপকে আঁকড়ে ধরে জীবনযাপন করেন।

ক্রমে তাঁর নিজের সকল জাগতিক সত্তা-বোধ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে, কেবল 'আমি ঈশ্বরের অংশ, আমি তাঁর' এই পরিচয়টুকুই অবশিষ্ট থাকে।

এই হ'ল ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণকথিত

'ভক্তের আমি'।

প্রাচীন ভারতে নারদ নামে একজন ঋষি ছিলেন। মহর্ষি নারদ 'ভক্তিসূত্রম্' নামক আধ্যাত্মিক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি তাঁর এই গ্রন্থে লিখেছেন :

'নারদস্তু তদর্পিতাখিলাচারতা

তদ্বিস্মরণে পরমব্যাকুলতেতি।'

অর্থাৎ ঋষি নারদের মতে সকল কর্ম ঈশ্বরে অর্পণ করা এবং ঈশ্বরের সামান্যতম বিস্মরণেও তীব্র ব্যাকুলতার উদ্ভব

-- এই অবস্থা লাভই 'ভক্তি'।

ভক্তি ত্রিমাত্রিক। এর প্রথম মাত্রা হ'ল :

ঈশ্বরের প্রতি ভয়হীনতা। ভয় যেখানে, ভালোবাসা সেখানে থাকেনা।

দ্বিতীয় মাত্রা :

'নিষ্ঠা', অর্থাৎ এককেন্দ্রিকতা। মহাবীর হনুমানের উক্তি : 'শ্রীনাথে জানকিনাথে অভেদ পরমাত্মনি, তথাপি মম সর্বস্ব রাম: কমললোচন।' অর্থাৎ 'আমি জানি শ্রীনাথ বা লক্ষ্মীপতি নারায়ণ এবং জানকিনাথ বা রামচন্দ্র এঁরা পারমার্থিক ভাবে অভেদ, তথাপি সেই কমললোচন রামই আমার সর্বস্ব।'

-- এই হল নিষ্ঠা। একে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন 'অব্যভিচারিণী ভক্তি'।

তৃতীয় মাত্রা : 'প্রত্যাশাহীনতা'। প্রকৃত ভক্ত কখনো বলেননা, 'এত পুজো, জপ করলাম তবু আমার কী হ'ল!' ভক্ত ভালোবাসার জন্যই ভালোবাসেন।

না ভালোবেসে থাকতে পারেননা, তাই ভালোবাসেন। বিনিময়ে কোনও প্রত্যাশা করেননা। একে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন 'অহৈতুকী ভক্তি'।


✍️ লেখক : তাপস কুমার ঘোষ

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।