০৫ মে ২০২২

নীল ষষ্ঠী, জেনে নিন, কেন এই দিন পালনের রীতি রয়েছে মহিলাদের মধ্যে।

 “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে” -- সন্তানের মঙ্গলকামনা করে শিবের কাছে ব্রত করার উৎসবই নীল ষষ্ঠী। বারো মাসে তেরো পার্বণে অভ্যস্ত বাঙালির কাছে কৌলিন্যের আদরে এই ব্রতের ভূমিকা কিছুটা হারালেও, গ্রাম বাংলায় এখনও বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই নীল ষষ্ঠী পালনের রেওয়াজ রয়েছে। অথচ আগেকার দিনে কত ব্রতই না পালিত হত বাংলায়! অশোক ষষ্ঠী ব্রত, আদর সিংহাসন ব্রত, আদা-হলুদ ব্রত, ইতু ব্রত, কালকুমারি পূজা ব্রত, কুলুই পূজা ব্রত, তুষ তুলসী ব্রত, দশ পুতুল ব্রত, পুন্যিপুকুর ব্রত, বানব্রতের উৎসব ব্রত, মাঘ মন্ডল ব্রত, মেছেনী ব্রত, মেঘারানীর ব্রত, যমপুকুর ব্রত, ষষ্ঠী ব্রত, সবুজ পাতার ব্রত, সাবিত্রী ব্রত, সেঁজুতি ব্রত, হরিচরণ ব্রত, হেলেনা ব্রত, অরন্য ষষ্ঠী ব্রত, নীল ষষ্ঠী ব্রত, পাটাই ষষ্ঠী ব্রত, দুর্গা ষষ্ঠী ব্রত, রাধাষ্ঠমী ব্রত, জন্মাষ্ঠমী ব্রত, অক্ষয় তৃতীয়া ব্রত, জিতাষ্টমী ব্রত, পৃথিবী ব্রত, চাঁপাচন্দন ব্রত, নখ ছুটের ব্রত, সুবচনী ব্রত, বসন্তবুড়ী ব্রত, মাকাল ব্রত, ওলাই চন্ডী ব্রত, মঙ্গল চন্ডী ব্রত, নাগপঞ্চমী ব্রত, মধুসংক্রান্তি ব্রত, বিবিঞ্চি ব্রত, ডেঁপু ব্রত, কার্তিক ব্রত, কুলকুলাতি ব্রত, গাড়ু ব্রত, গিন্নিপালন ব্রত, গোকুল ব্রত, ঘাঁটো ব্রত, জামাই ষষ্ঠী ব্রত, বিপত্তারিনী ব্রত, রাম নবমী ব্রত, শনি দেবের ব্রত, সত্যনারায়ণ ব্রত, জয় মঙ্গলবার ব্রত, শিবরাত্রির ব্রত, সন্তেষীমার ব্রত, বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুজার ব্রত, শীতলা ষষ্ঠী ব্রত --- আমার ছোটবেলায় এ'রকম অনেক ব্রত উদযাপন করতে দেখেছি। তবে, আধুনিক কালে আর দেখি না। আর এই চৈত্র মাসের এই ব্রতকে অনেকে নীল পুজোও বলে থাকেন। নীলপূজা পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, হুগলী, বর্ধমান, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, হাওড়া, বাংলাদেশ এবং ত্রিপুরায় বাঙালি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়। নদিয়া জেলার নবদ্বীপের গাজন উৎসবের একটি অংশ হিসাবে বাসন্তী পুজোর দশমীর ভোরে শিবের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।


অশোকষষ্ঠী বা বাসন্তীদুর্গাপুজো হয় চৈত্রমাসের শুক্লাতিথিতে। তবে মহাদেবের নীলের পুজোর দিনটা বরাদ্দ চড়ক বা গাজনের দিনক্ষণ অনুযায়ী, বর্ষশেষের সংক্রান্তির আগের দিনে। সনাতন হিন্দু ধর্মে এই উৎসবকে শিব-দুর্গার বিয়ে নামেও অভিহিত করা হয়।


নীল বা নীলকণ্ঠ মহাদেব শিবের অপর নাম। সেই নীল বা শিবের সাথে নীলচণ্ডিকা বা নীলাবতী পরমেশ্বরীর বিয়েই নীল-পুজো। গ্রাম বাংলায় এখনও শিব-দুর্গা সেজে নীলের গান বা অষ্টক গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করতে দেখা যায় নীলসন্ন্যাসীদের। অনেকে আার নিম বা বেল কাঠ দিয়ে তৈরি করেন নীলের মূর্তি। সেই মূর্তি সাজিয়ে শুরু হয় উৎসব। পরনে লাল বা গেরুয়া কাপড়, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে ত্রিশূল নিয়ে ব্রত রাখা নীলসন্ন্যাসীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। তাঁদের সঙ্গ দেন শিব-দুর্গা বেশের সঙেরা। গৃহস্থ মহিলারা বা গর্ভবতী মহিলারা এই নীলের মিছিল দেখলেই তাঁদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে আনেন। নীলের মাথায় তেল-সিঁদুর লেপে শুরু হয় পুজো। তারপরই নীলের গানে মেতে ওঠেন সকল নীলসন্ন্যাসীরা --


"শুন সবে মন দিয়ে হইবে শিবের বিয়ে

কৈলাসেতে হবে অধিবাস।

(ও) তাতে নারদ করে আনাগোনা

কৈলাসে বিয়ার ঘটনা

বাজে কাঁসী বাঁশী, মোহন বাঁশরী।"

"(ও) নারদ চলল গিরি রাজের গৃহেতে।।


আর একদিনেতে শূলপাণি,

নারদকে বলেন বাণী

শুনো নারদ শুনো আমার সাধ,

আমি দুই পাশে দুই বালিশ দিয়ে,

মধ্যিখানে থাকি শুয়ে

উশিপুসি করে কাটাই রাত।।

(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।


আর ওই শিব কয় কৈলাসে যেয়ে,

দেখে এসেছি মেয়ে

শীঘ্র করো বিয়ের আয়োজন,

(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।


চলিলেন নারদ মুনি, চলিলেন নারদ ধনি

উপনীত গিরি পুরে যেয়ে।

কইলেন মেনকা রানী, আইলেন নারদ মুনি

দেখা পেয়ে এল মুনির ঠাঁই।।

(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।


শোনো ওগো গিরি রাজা, হইবা আমার আজা

জামাই তোমার হবে দিগম্বর।।"


বিয়ের ঘটক ভাগিনেয় নারদ মুনির কাছে শিব আর্তি জানান,


"ভাইগনা যদি উপকারী হও।

তবে বিয়া দিয়া আমার প্রাণ বাঁচাও।।"


--- এমন নানা গান এখনও নীল-ষষ্ঠীর দিন শোনা যায় গ্রাম বাংলায়।


এই নীল ষষ্ঠী নিয়ে ব্রতকথাও রয়েছে। কাহিনী বহু কাল আগের। এক স্থানে বাস করত এক ব্রাহ্মণ আর এক ব্রাহ্মণী। তাঁদের সন্তান ভাগ্য ছিল খুব খারাপ। ছেলেমেয়ে জন্মালেই মারা যেত। অনেক বার- অনেক ব্রত করেও কোনও ফল না হওয়ায় তারা ঠিক করলো সব ছেড়ে কাশী চলে যাবে।


একদিন নানা তীর্থ ঘুরতে ঘুরতে কাশীর গঙ্গা ঘাটে বসে তাঁরা দু’জনে যখন বিলাপ করছে, তখন মা ষষ্ঠী বৃদ্ধার বেশে এসে তাঁদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘হ্যাঁ গা, তোরা কাঁদছিস কেন?’ মনের দুঃখে ব্রাহ্মণী জানায়, “আমাদের সব সন্তান মারা গেছে। কেউ বেঁচে নেই। অনেক পুজো করেও ফল মেলেনি। তুমি বলো এখন কী করি?” সব শুনে বৃদ্ধা বলেন, “এ সব হয়েছে তোমাদের অহঙ্কারের জন্য। শুধু বার-ব্রত করলেই হয় না। ভগবানে বিশ্বাস থাকা চাই। মন দিয়ে তাঁকে ডাকতে হবে।’


ব্রাহ্মণী তখন তাঁর পা ধরে বললেন -- “কে তুমি, বল মা।”

বৃদ্ধা বললেন -- “আমিই মা ষষ্ঠী। শোন, এই চৈত্র মাসে সন্ন্যাস করবি এবং সেই সঙ্গে শিবপুজো করবি। সংক্রান্তির আগের দিন উপবাস করে নীলাবতীর পুজো করে নীলকন্ঠ শিবের ঘরে বাতি জ্বেলে দিবি। আর তারপর আমাকে প্রণাম করে জল খাবি। একে বলে নীল ষষ্ঠী।”


মা ষষ্ঠী এই কথা বলেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এর পর দেশে ফিরে ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী নীলের দিন খুব ভক্তি আর নিষ্ঠার সঙ্গে নীলষষ্ঠী ব্রত পালন করেন। তার কিছু দিন পরেই তাঁদের সুন্দর ছেলে জন্মায়। নীল ষষ্ঠী ব্রতের এই মাহাত্ম্য দেখে দেশে দেশে সবাই তখন এই ব্রত পালন করতে আরম্ভ করে।


পূজার রীতি বলতে -- চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিন সারা দিন উপোস করার পর সন্ধ্যাবেলা শিবের মাথায় জল ঢেলে শিবকে প্রণাম করে গর্ভবতী মহিলারা বা মায়েরা। অনেকে নির্জলা থেকেও ব্রত পালন করেন। সন্ধেয় প্রদীপ জ্বালিয়ে শিবের মাথায় জল ঢালার পরেই ব্রত ভঙ্গ হয়। কথায় বলে, নীলের ব্রত নিষ্ঠামতো পালন করলে কোনওদিন সন্তানের অমঙ্গল হয় না। সন্তান দীর্ঘজীবন লাভ করে।


তাই সন্তান লাভ ও সন্তানের মঙ্গল কামনা করে চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন পালন করা হয় নীল ষষ্ঠী। এই দিন মায়েরা সারাদিন ধরে উপোস করে থাকেন। বিকেলে পুজো দিয়ে তবেই কিছু মুখে দেন তাঁরা। বাঙালি গৃহিণীরা নিজের সন্তান এর মঙ্গল কামনায় নীরোগ সুস্থ জীবন কামনা করে নীলষষ্ঠীর ব্রত পালন করেন। আজ ঘরে ঘরে মায়েরা তাঁদের সন্তানদের মঙ্গলকামনায় তাঁরা বলেন --


"নীলের ঘরে দিলাম বাতি,

সাক্ষী থেকো মা ভগবতী।"


ওঁ নমঃ শিবায়,

ওঁ নমঃ চণ্ডিকায়ৈ।


Written by: Prithwish Ghosh

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।