একবার তারাপীঠে এক বয়োবৃদ্ধ সাধকের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমার লেখা বই -- 'তান্ত্রিক ও তন্ত্রসাধনা' বইয়ের প্রথম ভাগে বেশ ভালোভাবে উপস্থাপনা করেছি। আমি তাঁর কাছে 'কুলকুণ্ডলিনী' সম্পর্কে জানতে চাইলে বৃদ্ধ সাধক বললেন -- শোন তবে। কুণ্ডলিনী বলতে গেলে আগে হিন্দুর তেত্রিশ কোটি দেবতা নিয়ে বলতে হবে। আমি নয়, ঋকবেদ অনুযায়ী ৩৩ জন দেবতা আছেন কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকের নামের উল্লেখ নেই। শতপথ ব্রাহ্মণে, মহাভারতে, রামায়ণ ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও ৩৩ জন দেবতার কথাই বলা আছে।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁকে প্রশ্ন করলাম -- তাহলে প্রশ্ন হল এই ৩৩ জন কী করে তেত্রিশ কোটিতে পরিণত হল, তার সঙ্গত উত্তরই বা কি?
তিনি বললেন -- ঠিক বলেছ তুমি, তবে ৩৩ জন দেবতার কথা ঠিক ভাবে ঋকবেদে উল্লেখ নেই। কিন্তু, শতপথ ব্রাহ্মণে ও মহাভারতে এদের শ্রেণীবিভাগ ও নাম পাওয়া যায়।
শ্রেণীবিভাগটি হল এই রকম ---- ১২ জন আদিত্য (অংশ, ভগ, মিত্র, জলেশ্বর, বরুণ, ধাতা, অর্যমা, জয়ন্ত, ভাস্কর, ত্বষ্টা, পূষা, ইন্দ্র, বিষ্ণু), ১১ জন রুদ্র (অজ, একপদ, অহিব্রধু, পিণাকী, ঋত, পিতৃরূপ, ত্র্যম্বক, বৃষকপি, শম্ভু, হবন, ঈশ্বর) এবং আটজন বসু (ধর, ধ্রুব, সোম, সবিতা, অনিল, অনল, প্রত্যুষ, প্রভাস)।
'আদিত্য', 'রুদ্র' এবং 'বসু' বিশেষ এক দেবতার নাম নয়, দেবতার জাতি বা শ্রেণীবাচক মাত্র। এ ভাবে আমরা ৩১ জন দেবতার হিসেব পাই; ইন্দ্র ও প্রজাপতি এই দুটি নিয়ে মোট ৩৩ জন হয়। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে এঁদের নামোল্লেখ আছে। পৌরাণিক গল্পে ও কথকতায় এরাই তেত্রিশ কোটি হয়েছেন খুব সম্ভবতঃ। এই তেত্রিশ কোটি দেবদেবীই হলেন কুলকুণ্ডলিনীর বা পরমেশ্বরীর বা ঈশ্বরের চালিকাশক্তি।
আমি আগেই বললাম যে হিন্দুধর্মে তেত্রিশ কোটি দেবতা আছেন। কিন্তু, এটা আসলে কতটা ঠিক তা কেউ কখনও যাচাই করেনি। আসলে এটা এতটুকুও যে ভ্রান্ত ধারণা নয়, তার প্রমাণ আপনারা দেখলেন। আসলে এটা সঠিক তথ্য। 'কোটি' শব্দের প্রচলিত অর্থ সংখ্যাসূচক (crore) হলেও সংস্কৃত ভাষায় এর আরেকটি অর্থ হল 'ধরণ' বা 'প্রকার'। তাই তেত্রিশ কোটি দেবতা মানে হল 'তেত্রিশ প্রকার দেবতা'।
তাই হিন্দুধর্মাবলম্বীরা ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপের পূজা করে থাকেন। ঈশ্বরের এই বিভিন্ন রূপগুলিকেই বলা হয় দেবতা -- কারণ এই রূপগুলি হল ঈশ্বরের দিব্য (ধাতু দিব্ ধাতু +ষ্ণ প্রত্যয়) রূপ তাঁর বিভিন্ন গুণাবলী। এই দেবদেবীদের সন্তুষ্ট করার জন্য হিন্দুরা বিশেষ আচার অনুষ্ঠানও পালন করেন।
তবে আপনি কি জানেন যে, হিন্দু পুরাণে সপ্তাহের প্রতিটি দিনও বিভিন্ন ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গ করা হয়? এছাড়া, প্রতিদিন ঈশ্বরের উপাসনা এবং তাদের সন্তুষ্ট করার আলাদা আলাদা আচার, পদ্ধতিও রয়েছে। আসুন, এই বিষয়ে কিছু জেনে নিই।
রবিবার
-------------------
এই দিনটি ভগবান সূর্য-এর প্রতি উৎসর্গিত। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, ভগবান সূর্য একটি মহান গুরুত্ব বহন করে। ভক্তরা বিশ্বাস করে যে, ভগবান সূর্য পৃথিবীতে জীবন, স্বাস্থ্য এবং সমৃদ্ধি দান করেন। এছাড়াও, বিশ্বাস করা হয় যে, সূর্য তাঁর ভক্তদের সুস্বাস্থ্য, ইতিবাচকতা প্রদান করে এবং চর্মরোগ নিরাময় করে।
রবিবার ভগবান সূর্যকে পূজা করার আগে প্রথমে আপনার দেহ এবং আপনার চারপাশের জায়গাটি ভালভাবে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। ঘর পরিষ্কার করার পরে, খুব সকালে স্নান করতে হবে এবং গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার সময় অর্ঘ্য (জল উৎসর্গ) প্রদান করতে হবে। মন্ত্রটি হল - 'ওঁ ভূর্ভুবস্ব তৎসবিতুর্বরেণ্যং ভর্গোদেবস্য ধীমহি ধীয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ'।
ভগবান সূর্যের উপাসনা করার সময়, কপালে কুমকুম ও লাল চন্দন কাঠের মিশ্রিত পেস্ট লাগান। এই দিনে আপনি উপবাসও করতে পারেন। নিয়মের একটা অংশ হিসেবে, আপনি কেবলমাত্র দিনে একবারই খেতে পারেন, তবে সূর্যাস্তের আগে। খেয়াল রাখবেন যাতে খাবারটিতে রসুন, পেঁয়াজ এবং লবণ থাকে না।
শুভ লাল রঙ ভগবান সূর্যের সাথে সংযুক্ত বলে বিশ্বাস করা হয় তাই, সূর্যের উপাসনা করার সময় লাল পোশাক পরতে পারেন। এছাড়া, ভগবান সূর্যকে আপনি লাল রঙের ফুলও দিতে পারেন।
সোমবার
--------------------
এই দিনটি ভগবান শিব-কে উৎসর্গ করা হয়। শিব-কে ভোলেনাথ নামেও ডাকা হয়। এই দিন ভক্তরা শিবের মন্দিরে যান এবং তাঁর উপাসনা করেন। ভগবান শিব এবং দেবী পার্বতী মিলে মহাবিশ্বের সৃষ্টির প্রতিনিধিত্ব করেন। ভগবানকে সন্তুষ্ট করতে ভক্তরা প্রায়ই সোমবার উপবাস পালন করে থাকেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, শিব তাঁর ভক্তদের অনন্ত শান্তি, দীর্ঘজীবন এবং স্বাস্থ্যের আশীর্বাদ করেন।
সোমবার ভগবান শিবের উপাসনা করার জন্য খুব সকালে স্নান সেরে পরিষ্কার সাদা বা হালকা রঙের পোশাক পরুন। গঙ্গাজল এবং ঠান্ডা কাঁচা দুধ দিয়ে শিবলিঙ্গকে স্নান করান। 'ওঁ নমঃ শিবায়' জপ করার সময় শিবলিঙ্গে সাদা চন্দন কাঠের পেস্ট, সাদা ফুল এবং বেল পাতা দিন। ভগবান শিবের বিবিন্ন স্তবস্তোত্রম্ পাঠ করুন। দরিদ্রদের দান করুন -- ভগবান শিব আপনারবপ্তি প্রসন্ন হবেন।
শিব সাদা বর্ণ পছন্দ করেন তাই, আপনি এই দিনে সাদা রঙের পোশাক পরতে পারেন। তবে কালো রঙের পোশাক কখনই পরবেন না কারণ, বিশ্বাস করা হয় যে, ভোলানাথ কালো রঙ পছন্দ করেন না।
মঙ্গলবার
----------------------
এই দিনটি বজরঙ্গবলী হনুমানের প্রতি উৎসর্গিত। দিনটির নামকরণ করা হয়েছে মঙ্গল গ্রহের নামে। হিন্দু পুরাণে, হনুমানকে শিবের অবতার বলে মনে করা হয়। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, ভগবান হনুমান প্রত্যেকের জীবন থেকে বাধা ও ভয় দূর করেন। তাই, ভক্তরা এই দিনে ভগবান হনুমানের উপাসনা করেন এবং উপবাসও করেন।
খুব সকালে স্নান করে পরিষ্কার রক্তবর্ণের পোশাক পরতে হবে। ভগবান সূর্যকে অর্ঘ্য অর্পণ করুন এবং হনুমান চালিশা জপ করুন। হনুমান চালিশা জপ করার সময় লাল ফুল প্রদান করুন এবং প্রদীপ জ্বালান। আপনি হনুমানকে সিঁদুরও দিতে পারেন। এছাড়াও, লাল এবং কমলা রঙের ফুলও দিতে পারেন। হনুমানের মন্ত্র -- 'ওঁম্ হং হনুমতে রুদ্রাত্মকায় হুং ফট্' ১০৮ বা ১০০৮ বার জপ করুন। এবার ১০ বার শ্রীরামচন্দ্রের মন্ত্র -- 'শ্রীরাম জয় রাম জয় জয় রাম' জপ করুন।
লাল রঙ ভগবান হনুমানের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। সুতরাং, লাল রঙের পোশাক পরা এবং লাল রঙের ফুল- ফল দেওয়া আপনার জন্য উপকারি হতে পারে।
বুধবার
-------------
বুধ বালক গ্রহ। বুধ গ্রহ আমাদের বুদ্ধি, বিবেচনা, বাক্য, স্বর, ব্যবসা, স্মৃতিশক্তি, খেলাধুলা ইত্যাদি বিষয়কে প্রভাবিত করে। এই দিনটি বুদ্ধির দেবতা গণেশকে উৎসর্গ করা হয়। তিনি তাঁর ভক্তদের জীবন থেকে নেতিবাচকতা এবং প্রতিবন্ধকতা দূর করেন। কোনও শুভ কাজ শুরুর আগে হিন্দুরা প্রায়ই গণেশের পূজা করে থাকেন।
গণেশের পূজায়, দূর্বা ঘাস, হলুদ এবং সাদা ফুল, কলা এবং মিষ্টি দিতে পারেন। তবে, নৈবেদ্যগুলি একটি পরিষ্কার কলার পাতায় রাখবেন। 'ওঁ গণেশায় নমঃ' জপ করতে পারেন। সিঁদুর ও মোদক (এক ধরণের মিষ্টি) অর্পণ করেও ভগবান গণেশকে সন্তুষ্ট করতে পারেন। কখনই তুলসীপাতার ব্যবহার করবেন না।
ভগবান গণেশ সবুজ এবং হলুদ বর্ণ খুব পছন্দ করেন। অতএব, আপনি এই দিনে সবুজ রঙের পোশাক পরার কথা ভাবতে পারেন।
বৃহস্পতিবার
---------------------
এইদিনটি 'গুরুবার' নামেও পরিচিত এবং ভগবান বিষ্ণু এবং গুরু বৃহস্পতির প্রতি উৎসর্গ করা হয়। এছাড়া অনেকেই এই দিনে সাঁই বাবাকে পূজা করেন এবং সাঁই মন্দিরে যান। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, গুরু বৃহস্পতি জুপিটার এবং এই দিনটিকে তিনিই চালিত করেন। বিশ্বাস করা হয় যে, এই দিনে ভগবান বিষ্ণুর উপাসনা করলে বৈবাহিক জীবনে সুখ আসে এবং পরিবারের মধ্যে সমস্যাগুলির সমাধান হয়।
ভগবান বিষ্ণু ও বৃহস্পতিকে সন্তুষ্ট করতে আপনি কলা গাছের নীচে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে কলাগাছের কাণ্ডে কুমকুম লাগাতে পারেন। এছাড়াও নারায়ণ দেবের কাছে ঘি, দুধ, হলুদ ফুল এবং গুড় অর্পণ করুন। শ্রীমদ্ভাগবত গীতা পাঠ করাও আপনার পক্ষে অত্যন্ত উপকারী হতে পারে। আপনি 'ওঁ জয় জগদীশ হরে' বা 'ওঁম্ নমো নারায়ণায়' মন্ত্রও জপ করতে পারেন। এই দিন তারাপীঠে যেতে পারেন বা ঘরে তারামায়ের পূজাও করতে পারেন।
যেহেতু ভগবান বিষ্ণু এবং বৃহস্পতিকে প্রায়শই পীত বা হলুদ রঙের পোশাক পরে থাকতে দেখা যায়, তাই আপনিও এই একই পোশাক পরতে পারেন।
শুক্রবার
-----------------
এটি শুক্রকে উৎসর্গ করা হয় যা দেবী মহালক্ষ্মী, দুর্গা এবং অন্নপূর্ণার প্রতীক। হিন্দু পুরাণে এই তিনটি দেবদেবীর একটি পৃথক তাৎপর্য রয়েছে। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, এই দিনে উপবাস করলে এবং এই তিন দেবীর উপাসনা করলে জীবনে সমৃদ্ধি, সম্পদ, ইতিবাচকতা এবং তৃপ্তি আসতে পারে।
ভক্তদের সকালে খুব সকালে উঠে স্নান করা উচিত এবং সাদা ফুল ও নৈবেদ্য উৎসর্গ করে দেবদেবীদের পূজা করা উচিত। গুড়, ছোলা, ঘি এবং দুধজাতীয় পণ্য (দই বাদে) দিতে পারেন। লবণ, রসুন এবং পেঁয়াজ ছাড়া প্রস্তুত খাবার খান। এছাড়াও, সূর্যাস্তের পরে খাবার খাওয়া উচিত।
আপনি এই দিনে সাদা এবং হালকা আকাশী রঙের পোশাক পরতে পারেন।
শনিবার
----------------
এইদিনটি ভগবান শনি-কে উৎসর্গ করা হয়। বলা হয় যে, কারও কর্মের উপর নির্ভর করে ভগবান শনি তাকে পুরস্কৃত করেন বা শাস্তি দেন। তাই সাধারণতঃ যারা জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসী তারা এই দিনটি পালন করেন। কথিত আছে যে, এই দিনে শনিদেবের পূজা করলে সুখ, সম্পদ ও শান্তির আকারে ভগবান শনি-এর কাছ থেকে সৌভাগ্য ও আশীর্বাদ আসতে পারে।ভগবান শনিকে সন্তুষ্ট করতে এবং যে কোনও ধরনের বাধা এড়াতে এই দিনটি পালন করা যায়। ভগবান শনির উপাসনা করতে আপনি পিপল এবং শামি গাছের নীচে একটি প্রদীপ জ্বালাতে পারেন। এছাড়াও, দরিদ্রদের দান করুন। আপনি এইদিনে শনিদেবকে কালো সরিষা, ধুপ, পঞ্চমৃত এবং ফুল দিতে পারেন। এছাড়াও, আপনি পূজা সম্পন্ন করার পরে শনি আরতি করতে পারেন।
ভগবান শনি কালো রঙ পছন্দ করেন তাই, এই দিনে কালো রঙের পোশাক পরা আপনার পক্ষে সহায়ক হতে পারে।
-----------------------------------------------
সনাতনী শ্রী পৃথ্বীশ ঘোষ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন