০৭ জুলাই ২০১৩

ধর্ম ও রিলিজিয়নের ভেদ



ধর্ম Religion সমার্থক নয়। কয়েক হাজার বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্ম শব্দটির প্রকৃত অর্থ নিয়ে বিপুল আলোচনা হয়েছেঅনুভবী ও সতর্ক ভারত তত্ত্ববিদের কাছে , এমন কি সনাতন পরম্পরা নিষ্ঠ সাধারন ভারতীয়ের কাছেও ধর্ম শব্দটির তাৎপর্য কখনই রিলিজিয়ানের সমান নয়এই শব্দ দুটিকে একাসনে বসানর কৃতিত্ব ব্রিটিশ শাসিত কালো সাহেবদের

রিলিজিওন --নিতান্তই সেমেটিক সংস্কৃতির অবদানঅন্যদিকে ধর্ম -- ভারতীয় সনাতন(অন্য অর্থে হিন্দু) কৃষ্টির ফসল। আদিতে রিলিজিওন খ্রিস্টানদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস বোঝাতে ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে জরাথ্রুস্তবাদী,ইহুদি,মুসলিম ক্ষেত্রেও তা প্রযুক্ত হল, এবং তা খাপ খেয়ে গেল কারন এই সব কটি রিলিজিওনের উৎপত্তির ভূগোল ও সামাজিক রীতিনীতি মোটামুটি এক। এই রিলিজিওন গুলোকে একত্রে বিদ্বতজনেরা তাই সেমেটিক রিলিজিওন বলেন

যে ল্যাটিন শব্দ হতে রেলিজিওন শব্দ সৃষ্ট ,সেই Religo সব্দের অর্থ ---বিশ্বাস বা প্রথাসেই বিশ্বাস কিসের প্রতি?

১) বিশ্বের স্রষ্টা এক অতীন্দ্রিয় শক্তির প্রতি, ২)সেই শক্তি প্রেরিত কোন এক প্রচারক বা রসুলের প্রতি এবং ৩)সেই প্রচারকের দ্বারা প্রচারিত কোন দৈবী পুস্তকের প্রতিএই ৩ টির কোন একটির প্রতি বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস বা অশ্রদ্ধা প্রকাশ করলে সে নাস্তিকতার একমাত্র শাস্তি মৃত্যু। এই রিলিজিওন গুলির আবির্ভাবের পর কম পক্ষে ৩০০০ বছর ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষ খুন হয়েছে নাস্তিকতার কারনেতাই নাস্তিক খ্রিস্টান , নাস্তিক ইহুদি বা নাস্তিক মুসলিম হয় নাএগুলো সোনার পাথর বাটি বা বন্ধ্যার পুত্রের মতই অবাস্তব
ধর্ম ও রিলিজিয়নের ভেদ



রিলিজিয়নগুলির মধ্যে জরাথ্রুস্তবাদীগন-এর আধ্যাত্মিক মত ভৌগলিক ভাবে সেমেটিক রিলিজিয়নের উৎপত্তি স্থলের অন্তর্গত হলেও ভাবগত ও সংস্কৃতি গত ভাবে সনাতন কৃষ্টির মুকুট স্বরুপ বেদ -এর ভাব ও ভাষার সাথে বহু অংশে একঐতিহাসিকগণ অনেকেই এদের ভারতীয় বৈদিক জনগোষ্ঠীর সাখা বলে মনে করেনতাই এই সম্প্রয়দায়কে রিলিজিওন-এর বর্গ থেকে বাদ দেয়া হল। এখন থেকে রিলিজিওন বলতে এই আলোচনায় আমরা ইহুদিখ্রিস্টান ও ইসলামকে ধরব

রিলিজিওন গুলি যে বিশ্ব স্রস্টার কথা বলে তিনি সাকার না নিরাকার আর তিনি এক না বহু তা নিয়ে সংশয় আছে, যদিও তারা দাবি করেন যে তাদের উপাস্য স্রষ্টা এক ও নিরাকারতিনি যা -ই হন না কেন, সেই স্রষ্টা একজন আধিপত্যকামি পুরুষ এবং নারী জাতির প্রতি খড়গ হস্ত
এই রিলিজিয়নগুলির উপাস্য স্রষ্টা সর্বজনীন নন,তিনি সেই সেই সম্প্রয়দায়ের মানুশের জন্য আবির্ভূত হএছেন এবং তাঁর বিরোধী অন্য মানব গোষ্ঠীর ও তাদের উপাস্য দেবতা বা স্রষ্টার প্রতি তিনি ঈর্ষা কাতর নেতার মতই ক্ষিপ্তবিরোধী সম্প্রয়দায় ও তাদের স্রষ্টাকে ধংস করবার আদেশ রিলিজিয়ন গুলির উপাস্য বিশ্বস্রষ্টার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য

উদাহরনঃ

১) জিহভা বা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বিশ্ব স্রস্টার আদেশ তাঁর অনুগামীদের প্রতি-

তোমরা তাদের ( অ-ইহুদি,অ খ্রিস্টান জাতির ) পূজাবেদি ভেঙে ফেলবে, স্তম্ভ খণ্ড খণ্ড করবে ও সেখানকার সব দেব মূর্তি কেটে ফেলবেতুমি অন্য দেবতার কাছে প্রনাম করবে না। ...কারন জেহভা হচ্ছেন ঈর্ষা কাতর বিশ্বস্রষ্টা ''(বাইবেল,যাত্রা পুস্তক৩৪ অধ্যায় ,১৩-১৪ বাণী)

২)আল্লাহ্‌ বা মুসলিমদের বিশ্ব স্রস্টার আদেশ তাঁর অনুগামীদের প্রতি -

"অতএব নিষিদ্ধ মাস যখন অতিবাহিত হয়ে যাবে, তখন অংশী বাদিদের (অ মুসলিমদের) যেখানে পাবে বধ করবেতাদের বন্দী করবে, অবরোধ করবে এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওঁত পেতে থাকবে।"( কোরানসুরা ৯,আয়াত ১২)

পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ এইসব সহিংস, অনুদার ,বিভেদ মূলক , খণ্ডিত বোধকে তাদের জীবনের অবলম্বন করেছে এবং তাকেই অধ্যাত্ম বলে স্রদ্ধা নিবেদন করে এসেছেযেটুকু শুভ বোধের কথা রিলিজিয়ন বলেছে তা রিলিজিয়নগুলির অনুগামীরা অনুসরন করতে প্রায়-ই ব্যর্থ হয়েছে। কারন শুভ কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে বিশ্ব চৈতন্য দরকার সেই" ভূমা" -এর বোধ রিলিজিয়ন -এ নেইফলে বিশ্ব দিন দিন আরও বেশি রক্তস্রোতে প্লাবিত হয়ে চলেছেরবীন্দ্রনাথের কথায় --"দেবতার নামে এ যে শয়তান ভজা।" এই রিলিজিয়নগুলির বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেছিলেন ,সেই নিন্দিত ,নির্যাতিত নাস্তিকরাই বরং রিলিজিয়ন অধ্যুষিত অঞ্চলে মানবাধিকারকে স্থাপন করেছেন। সনাতন ভারতীয় দৃষ্টিতে তাঁরা নাস্তিক হলেও মহাত্মাতাঁরা -ই যথার্থ "ধর্ম" পালন করেছেনতাঁরা আমাদের প্রনম্য


পূর্বে  আমরা রিলিজিওনের যে সামান্য বৈশিষ্ট্য দেখেছি তা অনুদার,উগ্র ,মনুষ্যত্ব -বিরোধী এক অন্ধকার সময়ের দিকে পৃথিবীকে নিয়ে যাবার জন্য যথেষ্টএর সাথে ভারতের ঋষি -মুনি-সন্ত ও অবতারগন প্রচারিত "ধর্ম " -এর কোন সংযোগ নেই। রিলিজিওনের সাথে প্রাচ্যের অন্যান্য আধ্যাত্মিক দর্শন যথা- জাপানী সিন্টো মত ,চীনা তাও ও কনফুসীয় মত প্রভৃতির -ও কোনও যোগাযোগ নেই বরং এই মতগুলির সাথে ভারতে প্রচলিত "ধর্ম" -এর অল্প বিস্তর মিল আছেএবার জগতের সেই মহত্তম ,গভীরতম ও প্রাচীনতম আদর্শ তথা "ধর্ম" সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু কথা আলোচনার চেষ্টা করব


ধর্ম কিন্তু রিলিজিওনের মত পৃথিবীতে কোনও এক বিশেষ ঐতিহাসিক কালে(১৫০০ বা ২০০০ বছর আগে) , কোনও এক বিশেষ জাতির জন্য(ইসরাইল বা সামুদ জাতি) ,কোনও এক বিশেষ প্রফেটের( যীশু বা মহম্মদ) মাধ্যমে আবির্ভূত হয় নি। ঋষিপরম্পরা বিশ্বাস করে "ধর্ম" স্বয়ং পরমেশ্বর হতে আবির্ভূত হয়ে সৃষ্টির প্রারম্ভ হতে এখনও বর্তমান আছে এবং এ সৃষ্টি বিনষ্ট হবার পর, নতুন সৃষ্টিতেও একই থাকবেএ তো গেল আস্তিকদের কথা নাস্তিক ঐতিহাসিকগণ ধর্মের উদ্ভবকাল বা এর প্রবর্তক সম্পর্কে নীরবকারন ইতিহাস জন্মের বহু আগে আগে ধর্ম আবির্ভূত হয়েছে, ঐতিহাসিক কালে তা আজও বিদ্যমান আছে ও শাস্ত্র অনুযায়ী তা ভবিষ্যতেও থাকবে । অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ --- এই তিন কালে অমর হবার জন্য ব্যাস প্রমুখ ঋষি গন "ধর্ম" শব্দের আগে একটি বিশেষণ যুক্ত করলেনসেই বিশেষণটি হল-- "সনাতন" বা চিরস্থায়ী


এই "সনাতন ধর্ম" শব্দটির সাথে ঋষি যুগের অবসানের বহু পরে' হিন্দু' শব্দটি যুক্ত হয়সিন্ধু নদ বিধৌত অঞ্চলের মানুষদের চিহ্ণিত করতে এককালে বিদেশি আরব ও পারস্যের অধিবাসীরা হিন্দু শব্দটি বলতে আরম্ভ করেপরে তা এই উপমহাদেশে বসবাসকারী সকলকে বোঝাতে প্রযুক্ত হতে থাকেএমনকি ব্রিটিশ শাসনের প্রথমার্ধেও মুসলিম সমেত নানা জাতি -বর্ণ- মত- পথে বিশ্বাসী সনাতন ধর্ম ও তার শাখা স্বরূপ বৌদ্ধ ,শিখ, জৈন ভারতবাসীকে 'হিন্দু' বলে উল্লেখ করা হত ঐতিহাসিক কালে রচিত "বৃহস্পতি তন্ত্র'-এর একটি শ্লোকে 'হিন্দু' শব্দের আর এক বুৎপত্তি দেখান হয়েছেতন্ত্রকারের মতে,

"হিমালয়ং সমারম্ভ্য যাবত ইন্দু সরোবরম /তং দেব নির্মিতং দেশং হিন্দুস্থানং প্রচকশ্যতে।"

অর্থাৎ, উত্তরে হিমালয় হতে দক্ষিনে ইন্দু বা দক্ষিন সমুদ্র অবধি ব্যাপ্ত ক্ষেত্রই হিন্দু ভূমি এইভাবে আর একটি ভৌগলিক পরিচয়বাচক বিশেষণ "ধর্ম" শব্দের সাথে জুড়ে গিয়ে"ধর্ম" -এর প্রাচীন ধারনাটি "সনাতন হিন্দু ধর্ম" নামে পরিচিতি পেতে লাগলো এবারে এই বিশেষণ গুলোকে একপাশে সরিয়ে রেখে আমরা মূল বিশেষ্য-- অর্থাৎ "ধর্ম" নিয়ে আলোচনা শুরু করব


copyright-Debasish Singha  (কলকাতা,ভারত)

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।