সংস্কৃত "যোগ" শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে। এটি সংস্কৃত "যুজ" ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন, যার অর্থ "নিয়ন্ত্রণ করা", "যুক্ত করা" বা "ঐক্যবদ্ধ করা"। "যোগ" শব্দটির আক্ষরিক অর্থ তাই "যুক্ত করা", "ঐক্যবদ্ধ করা", "সংযোগ" বা "পদ্ধতি"। যিনি যোগ অনুশীলন করেন বা দক্ষতার সহিত উচ্চমার্গের যোগ দর্শন অনুসরণ করেন, তাঁকে যোগী বা যোগিনী বলা হয়।
পতঞ্জলি তাঁর সাধনপাদের দ্বিতীয় সূত্রে যোগের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, সেটিকেই তাঁর সমগ্র গ্রন্থের সংজ্ঞামূলক সূত্র মনে করা হয়:
যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ।। যোগসূত্র ১.২
অর্থাৎ "যোগ হল মনের ("চিত্ত") পরিবর্তন ("বৃত্তি") নিবৃত্তি ("নিরোধ")। অর্থাৎ চিত্তকে বিভিন্ন প্রকার বৃত্তি বা পরিণাম গ্রহণ করিতে না দেওয়াই যোগ। স্বামী বিবেকানন্দ এই সূত্রটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন, "Yoga is restraining the mind-stuff (Citta) from taking various forms (Vrittis)."
স্বামী বিবেকানন্দ একে আরও উদাহরণের সাথে স্পষ্ট করেছেন তাঁর পাতঞ্জল যোগসূত্রে- মানুষ ঘুমিয়ে চক্ষু খুলে রাখলেও তার দর্শনের অনুভূতি হয় না। অর্থাৎ চক্ষুর সাথে চিত্তেরও সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। আবার তিনি বলেছেন- ‘আমরা হ্রদের তলদেশ দেখিতে পাই না, কারণ উহার উপরিভাগ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গে আবৃত। যখন তরঙ্গগুলি শান্ত হয়, জল স্থির হইয়া যায়, তখনই কেবল উহার তলদেশের ক্ষণিক দর্শন পাওয়া সম্ভব। যদি জল ঘোলা থাকে বা উহা ক্রমাগত নাড়িতে থাকে, তাহা হইলে উহার তলদেশ কখনই দেখা যাইবে না। যদি উহা নির্মল থাকে, এবং উহাতে একটিও তরঙ্গ না থাকে, তবেই আমরা উহার তলদেশ দেখিতে পাইব।.. যিনি মনের এই তরঙ্গগুলি নিজের আয়ত্তে আনিতে পারিয়াছেন, তিনিই শান্ত পুরুষ’।
সমাধিপাদের ২৯ সূত্রের ব্যাখ্যায় বিবেকানন্দ বলেছেন- ‘ক্রমাগত জপ ও চিন্তার ফল অনুভব করিবে- অন্তর্দৃষ্টি ক্রমশঃ বিকশিত হইতেছে এবং মানসিক ও শারীরিক যোগবিঘ্নসমূহ দূরীভূত হইতেছে’। এই কথাগুলোই কোয়ান্টাম নিজেদের মতো করে চালাচ্ছে অথচ তা বহু আগের কথা ও আমাদেরই কথা।
বৈদিক সংহিতায় তপস্বীদের উল্লেখ থাকলেও, তপস্যার (তপঃ) স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় বৈদিক ব্রাহ্মণ গ্রন্থে। সিন্ধু সভ্যতার (৩৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) বিভিন্ন প্রত্নস্থলে পাওয়া সিলমোহরে ধ্যানাসনে উপবিষ্ট ব্যক্তির ছবি পাওয়া গেছে। ধ্যানের মাধ্যমে চেতনার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হওয়ার পদ্ধতি হিন্দুধর্মের বৈদিক ধারায় বর্ণিত হয়েছে। নাসাদীয় সূক্ত এবং ঋগ্বৈদিক যুগেও ধ্যানপ্রণালীর অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে।
"যোগ" শব্দটি প্রথম উল্লিখিত হয়েছে কঠোপনিষদে। উক্ত গ্রন্থে "যোগ" শব্দটির অর্থ ইন্দ্রিয় সংযোগ ও মানসিক প্রবৃত্তিগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের মাধ্যমে চেতনার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হওয়া। যোগ ধারণার বিবর্তন যে সকল গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে, সেগুলি হল উপনিষদসমূহ, মহাভারত, (ভগবদ্গীতা) ও পতঞ্জলির যোগসূত্র । যোগের উল্লেখ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও আছে।
হিন্দু দর্শনে যোগ ছয়টি মূল দার্শনিক শাখার একটি। যোগ শাখাটি সাংখ্য শাখাটির সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। পতঞ্জলি বর্ণিত যোগদর্শন সাংখ্য দর্শনের মনস্তত্ত্ব, সৃষ্টি ও জ্ঞান-সংক্রান্ত দর্শন তত্ত্বকে গ্রহণ করলেও, সাংখ্য দর্শনের তুলনায় পতঞ্জলির যোগদর্শন অনেক বেশি ঈশ্বরমুখী।
পতঞ্জলি আনুষ্ঠানিক যোগ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের লোক। যোগসূত্রের সংকলক তিনি। পতঞ্জলির যোগ, যা মনকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি উপায়, তাকে রাজযোগ নামে চিহ্নিত করা হয়। মহর্ষি পতঞ্জলির যোগদর্শন চারটি পাদে (অধ্যায়) বিভক্ত। এগুলো হলো-
১. সমাধিপাদ : এই পাদে যোগের লক্ষণ, স্বরূপ ও প্রাপ্তির উপায় বর্ণনা করা হয়েছে।
২. সাধনপাদ : এই পাদে অবিদ্যাসহ বিভিন্ন প্রকার ক্লেশকে সমস্ত দুঃখের কারণ বলা হয়েছে। এই পাদেই যোগের আটটি অঙ্গের কথা তথা অষ্টাঙ্গ যোগের বর্ণনা রয়েছে।
৩. বিভূতিপাদ : অষ্টাঙ্গ যোগের মধ্যে ধারণা, ধ্যান এবং সমাধি একত্রে এই তিনটিকে সংযম বলা হয়েছে। সাধক যাতে ভুল করেও সিদ্ধিলাভের প্রলোভনে না পড়েন সেই দিকেও সতর্ক করা হয়েছে।
৪. কৈবল্যপাদ : মুক্তি প্রাপ্তিতে সক্ষম চিত্তের স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। যোগদর্শনের জন্য যে যে শঙ্কা তৈরি হতে পারে তার কথাও বলা হয়েছে এই অধ্যায়ে। শেষে সমাধিস্থ পুরুষের স্বরূপ বর্ণনা করে গন্থের শেষ হয়েছে।
রেচক ও কুম্ভক, পতঞ্জলি যোগসূত্র (১:৩৪), আসন, (২:৪৬), প্রাণায়াম (২:৪৯)। পতঞ্জলির পর অন্যান্য যোগীদের প্রধান তিনটি প্রাণ প্রবাহ- ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্মা এগুলো বহুলভাবে হিন্দুধর্ম ও দর্শনের আধ্যাত্মিক জীবনের সাথে জড়িত।
পতঞ্জলির রচনা "অষ্টাঙ্গ যোগ" নামে প্রচলিত ব্যবস্থাটির মূল ভিত্তি। এই অষ্টাঙ্গ যোগের ধারণাটি পাওয়া যায় যোগসূত্রের দ্বিতীয় খণ্ডের ২৯তম সূত্রে। অষ্টাঙ্গ যোগই বর্তমানে প্রচলিত রাজযোগের প্রতিটি প্রকারভেদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এই আটটি অঙ্গ হল:
১. যম (পাঁচটি "পরিহার")
অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ।
২. নিয়ম (পাঁচটি "ধার্মিক ক্রিয়া")
পবিত্রতা, সন্তুষ্টি, তপস্যা, সাধ্যায় ও ঈশ্বরের নিকট আত্মসমর্পণ। 'যম' ও 'নিয়ম' এ দুয়েরই উদ্দেশ্য হল ইন্দ্রিয় ও চিত্তবৃত্তিগুলিকে দমন করা এবং এগুলিকে অন্তর্মুখী করে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করা।
৩. আসন
যোগ অভ্যাস করার জন্য যে ভঙ্গিমায় শরীরকে রাখলে শরীর স্থির থাকে অথচ কোনোরূপ কষ্টের কারণ ঘটেনা তাকে আসন বলে। সংক্ষেপে স্থির ও সুখজনকভাবে অবস্থান করার নামই আসন।
৪. প্রাণায়ম ("প্রাণবায়ু নিয়ন্ত্রণ")
প্রাণস্বরূপ নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জীবনশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ।
৫. প্রত্যাহার
বাইরের বিষয়গুলি থেকে ইন্দ্রিয়কে সরিয়ে আনা। আসন ও প্রাণায়ামের সাহায্যে শরীরকে নিশ্চল করলেও ইন্দ্রিয় ও মনের চঞ্চলতা সম্পূর্ণ দূর নাও হতে পারে। এরূপ অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলোকে বাহ্যবিষয় থেকে প্রতিনিবৃত্ত করে চিত্তের অনুগত করাই হল প্রত্যাহার।
৬. ধারণা
কোনো একটি বিষয়ে মনকে স্থিত করা। কোনো বিশেষ বস্তুতে বা আধারে চিত্তকে নিবিষ্ট বা আবদ্ধ করে রাখাকে ধারণা বলে।
৭. ধ্যান
মনকে ধ্যেয় বিষয়ে বিলীন করা। যে বিষয়ে চিত্ত নিবিষ্ট হয়, সে বিষয়ে যদি চিত্তে একাত্মতা জন্মায় তাহলে তাকে ধ্যান বলে। এই একাত্মতার অর্থ অবিরতভাবে চিন্তা করতে থাকা।
৮. সমাধি
ধ্যেয়ের সঙ্গে চৈতন্যের বিলোপসাধন। ধ্যান যখন গাঢ় হয় তখন ধ্যানের বিষয়ে চিত্ত এমনভাবে নিবষ্ট হয়ে পড়ে যে, চিত্ত ধ্যানের বিষয়ে লীন হয়ে যায়। এ অবস্থায় ধ্যান রূপ প্রক্রিয়া ও ধ্যানের বিষয় উভয়ের প্রভেদ লুপ্ত হয়ে যায়। চিত্তের এই প্রকার অবস্থাকেই সমাধি বলে। এই সমাধি প্রকার - সবিকল্প এবং নির্বিকল্প। সাধকের ধ্যানের বস্তু ও নিজের মধ্যে পার্থক্যের অনুভূতি থাকলে, তাকে বলা হয় সবিকল্প সমাধি। আবার সাধক যখন ধ্যেয় বস্তুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান সে অবস্থাকে বলা হয় নির্বিকল্প সমধি। তখন তাঁর মনে চিন্তার কোনো লেশমাত্র থাকে না। এই সমাধি লাভ যোগসাধনার সর্বোচ্চ স্তর, যোগীর পরম প্রাপ্তি।
এই শাখার মতে, চৈতন্যের সর্বোচ্চ অবস্থায় উঠতে পারলে বৈচিত্র্যময় জগতকে আর মায়া বলে মনে হয় না। প্রতিদিনের জগতকে সত্য মনে হয়। এই অবস্থায় ব্যক্তি আত্মজ্ঞান লাভ করে। তাঁর আমিত্ব রহিত হয়।
যোগ দুই ভাগে বিভক্ত। যথা:
১। হঠযোগ
২। রাজযোগ
হঠযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে শরীরকে সুস্থ, সবল ও দীর্ঘায়ু করা। হঠযোগীর ধারণা কোনোরূপ শক্তিকে আয়ত্ত করতে হলেই শরীরকে নিয়ন্ত্রিত করা প্রয়োজন। সাধারণ লোক যোগ বলতে হঠযোগের ব্যায়াম বা আসনগুলোকে বুঝিয়ে থাকে।
রাজযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবাত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত করা। আর এই পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হওয়াই হচ্ছে জীবের মুক্তি বা মোক্ষলাভ।
তবে হঠযোগের সঙ্গে রাজযোগের ঘনিষ্ট সম্বন্ধও রয়েছে। সাধনার পূর্বশর্ত হচ্ছে শরীরকে সুস্থ রাখা। "শরীরমাদ্যং খলু ধর্মসাধনম"। অর্থাৎ, 'শরীর মন সুস্থ না থাকলে জাগতিক বা পারমার্থিক কোনো কর্মই সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব নয়'।
হিন্দুধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থে যোগের বর্ণনা রয়েছে। সেগুলো হলো-
বক্ষঃ, গ্রীবা ও শিরোদেশ উন্নতভাবে রাখিয়া, শরীরকে সমভাবে ধারণ করিয়া, ইন্দ্রিয়গুলিকে মনে স্থাপন করিয়া জ্ঞানী ব্যক্তি ব্রহ্মস্বরূপ ভেলা দ্বারা সকল ভয়াবহ স্রোত পার হইয়া যান। (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, ২:৮) এছাড়াও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৬, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ মন্ত্রসমূহে যোগ-ধ্যান সম্পর্কে বলা হয়েছে।
সমুদয় বৃত্তির নিরোধে ধ্যানসিদ্ধি হয়। (সাংখ্য-প্রবচন সূত্র ৩:৩১)
কারণ ধ্যানী পুরুষকে নিশ্চল পৃথিবীর সহিত তুলনা করা হয়। [ব্যাস (বেদান্ত) সূত্র, ৪র্থ অধ্যায়, ১, পাদ, ৯]
শেষ করছি গীতার বাণী দিয়ে। গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে যোগ-ধ্যান সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ণনা করেছেন-
‘মেরুদণ্ড, মস্তক, গ্রীবা সমান ও নিশ্চলভাবে স্থির করে নিজ নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টিস্থাপন করে, অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে, ব্রহ্মচর্যে স্থিত ও প্রশান্তচিত্ত যোগী সতর্কতার সাথে মনকে সংযত করবে।’ (গীতা, ৬:১৩-১৪)
গীতায় এমন আরও বহু শ্লোক আছে। মহাভারতের বিভিন্ন জায়গায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, গুরু দ্রোণাচার্য, ব্যাসদেব ও অনেকের ধ্যান ও যোগের উল্লেখ রয়েছে।
অতএব যোগ-ধ্যান-ব্যায়াম এগুলো বহু বহু প্রাচীন সময় থেকে হিন্দুদের জীবন ব্যবস্থার সাথে একীভূত হয়ে আছে। কিন্তু বর্তমানে আমরা এগুলো অবহেলায় দূরে রেখেছি। অথচ আধুনিক সময়ে স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ; জীবিতদের মধ্যে বাবা রামদেব, রবি শঙ্করসহ অনেক যোগগুরু এই যোগদর্শনকে বিশ্বের সম্পদ করে তুলেছেন। এমনকি অনেক তারকা ও খেলোয়াড়দের মধ্যে এই যোগদর্শনের প্রভাব থাকায় হিন্দুধর্মের এই সম্পদ বিশ্বসম্পদে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে জাতিসংঘ এই দিবসটিকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া ও আমাদের ঐতিহ্য, এমনকি এর ব্যবহারিক দিক খেয়াল রেখে এই মহান দর্শনকে লালন ও পালন করা হোক যোগ দিবসের মূল প্রেরণা।
__________________________
ঋণ স্বীকার:
১। স্বামী বিবেকানন্দ বাণী ও রচনা, ১ম খণ্ড
২। মহর্ষি পতঞ্জলিকৃত যোগ-দর্শন, গীতাপ্রেস গোরক্ষপুর
৩। উইকিপিডিয়া
Written by: Sanjoy Sarker
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন