নির্বাণ কথাটির অর্থ হচ্ছে জড় জীবনের সমাপ্তি।এই জড় জীবনের সমাপ্তি হবার পরে আমাদের প্রকৃত জীবন শুরু হয়। এই জড়-জাগতিক জীবনধারা পরিসমাপ্ত করতে হবে, সেই কথাটি জানাই স্থূল জড়বাদীর পক্ষে যথেষ্ট, কিন্তু যিনি পারমার্থিক জ্ঞান অর্জন করেছেন তিনি জানেন যে, এই জড় জীবনের পরেও আর একটি জীবন আছে। এই জীবনের পরিসমাপ্তির পূর্বে, সৌভাগ্যক্রমে কেউ যদি কৃষ্ণভাবনাময় হয়, তবে সে তৎক্ষণাৎ ব্রহ্মনির্বাণ স্তর লাভ করে। ভগবৎ-ধাম ও ভগবৎসেবার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই যেহেতু উভয়ই চিন্ময়, তাই ভক্তিযোগে ভগবানের অপ্রাকৃত প্রেমময়ী সেবায় নিয়োজিত হওয়াই হচ্ছে ভগবৎ-ধাম প্রাপ্তি। জড় জগতের সমস্ত কর্মই ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য সাধিত হয়, কিন্তু চিন্ময় জগতের সমস্ত কর্মই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবার জন্য সাধিত হয়। এমন কি এই জীবনে কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মপ্রাপ্তি হয় এবং যিনি কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন, তিনি নিঃসন্দেহে ইতিমধ্যেই ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করেছেন। ব্রহ্ম হচ্ছে জড় বস্তুর ঠিক বিপরীত। ব্রাহ্মী স্থিতি বলতে বোঝায় 'জড়-জাগতিক স্তরের অতীত'। ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা নিবেদনকে ভগবদগীতায় মুক্ত স্তররূপে স্বীকার করা হয়েছে (স গুনান্ সমতীত্যৈতান্ ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে)। তাই, জড় বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে ব্রাহ্মী স্থিতি। এই ব্রাহ্মী স্থিতি সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
এষা ব্রাহ্মী স্থিতিঃ পার্থ নৈনাং প্রাপ্য বিমুহ্যতি ।
স্থিত্বাস্যামন্তকালেহপি ব্রহ্মনির্বাণমৃচ্ছতি।
অর্থাৎ যিনি ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ করেন, তিনি মোহপ্রাপ্ত হন না। জীবনের অন্তিম সময়ে এই স্থিতি লাভ করে, তিনি এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করেন।
ধারাবাহিক পর্বঃ- ৬০
নিষ্কাম হওয়ার অর্থ হচ্ছে নিজের ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য কোন কিছু কামনা না করা। পক্ষান্তরে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সেবা করার কামনাই হচ্ছে নিষ্কামনা। এই জড় দেহটিকে বৃথাই আমাদের প্রকৃত সত্তা বলে না ভেবে এবং জগতের কোনও কিছুর উপরে বৃথা মালিকানা দাবি না করে, শ্রীকৃষ্ণের নিত্যদাস রূপে নিজের যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধি করাটাই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনার পরিশুদ্ধ পর্যায়। এই পরিশুদ্ধ পর্যায়ে যে উন্নীত হতে পারে, সে বুঝতে পারে, যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সব কিছুর অধীশ্বর, তাই তাঁকে সন্তুষ্ট করবার জন্য সব কিছুই তাঁর সেবায় উৎসর্গ করা উচিত। কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের প্রারম্ভে অর্জুন নিজের ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করতে নারাজ হয়েছিলেন, কিন্তু ভগবানের কৃপার ফলে তিনি যখন পরিপূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময় হলেন, তখন ভগবানের ইচ্ছা অনুসারে তিনি যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলেন।
নিজের জন্য যুদ্ধ করার ইচ্ছা অর্জুনের ছিল না, কিন্তু ভগবানের ইচ্ছার কথা জেনে সেই একই অর্জুন যথাসাধ্য বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। ভগবানকে সন্তুষ্ট করার বাসনাই হচ্ছে বাসনা রহিত হওয়ার একমাত্র উপায়। কোন রকম কৃত্রিম উপায়ে কামনা-বাসনাগুলিকে জয় করা যায় না। জীব কখনই ইন্দ্রিয়ানুভূতিশূন্য অথবা বাসনা রহিত হতে পারে না। তবে ইন্দ্রিয়ানুভুতি ও কামনাবাসনার বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য সে তাদের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারে। জড়-জাগতিক বাসনাসূন্য মানুষ অবশ্যই বোঝেন যে, সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণের (ঈশাবাস্যমিদং সর্বম্) এবং সেই জন্য তিনি কোন কিছুর উপরেই মালিকানা দাবি করেন না। এই পারমার্থিক জ্ঞান আত্মউপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত । অর্থাৎ, তাখন যথাযথভাবে বোঝা যায় যে, চিন্ময় স্বরূপে প্রত্যেকটি জীব শ্রীকৃষ্ণের নিত্য অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তাই জীবের নিত্য স্থিতি কখনই শ্রীকৃষ্ণের সমকক্ষ বা তাঁর চেয়ে বড় নয়। কৃষ্ণভাবনামৃতের এই সত্য উপলব্ধি করাই হচ্ছে প্রকৃত শান্তি লাভের মূল নীতি।
সর্বশেষ মনুষ্য জাতিকে উদ্দেশ্য করে শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ- বিহায় কামান্ যঃ সর্বান্ পুমাংশ্চরতি নিঃস্পৃহঃ। নির্মমো নিরহঙ্কারঃ স শান্তিমধিগচ্ছতি।
অর্থাৎ যে ব্যক্তি সমস্ত কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করে জড় বিষয়ের প্রতি নিঃস্পৃহ, নিরহঙ্কার ও মমত্ত্ববোধ রহিত হয়ে বিচরণ করেন, তিনিই প্রকৃত শান্তি লাভ করে।
Courtesy by: Bappy Kuri
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন