১৯ জুন ২০২০

নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র, ধারাবাহিক পর্বঃ- ৬৫-৬৪

ধারাবাহিক পর্বঃ- ৬৫

দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্ত্ত বঃ ।
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ।।

যজ্ঞ দ্বারা তোমারা দেবগণকে (ঘৃতপ্রদানে) সংবর্ধনা কর, সেই দেবগণও (বৃষ্ট্যাদি দ্বারা) তোমাদিগকে সংবর্ধিত করুন; এই রূপে পরস্পরের সংবর্ধনা দ্বারা পরম মঙ্গল লাভ করিবে।


ভগবান জড় জগতের দেখাশোনার ভার ন্যস্ত করেছেন বিভিন্ন দেব-দেবীর উপর। এই জড় জগতের প্রতিটি জীবের জীবন ধারনের জন্য আলো, বাতাস, জল আদির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। ভগবানের তাই এই সমস্ত অকাতরে দান করেছেন এবং এই সমস্ত বিভিন্ন শক্তির তত্ত্বাবধান করার ভার তিনি দিয়েছেন বিভিন্ন দেব-দেবীর উপর, যাঁরা হচ্ছেন তাঁর দেহের বিভিন্ন অংশস্বরূপ। এই সমস্ত দেবদেবীর প্রসন্নতা ও অপ্রসন্নতা নির্ভর করে মানুষের যজ্ঞ অনুষ্টান করার উপর। ভিন্ন ভিন্ন যজ্ঞ ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবীর তুষ্টি সাধনের জন্য অনুষ্টিত হয়। সর্বোপরি আমরা আমাদের কর্ম-যজ্ঞে দেব দেবীর আরাধনা ও সন্তুষ্টির মাধ্যমে পরম মঙ্গল লাভ করতে পারি। যেমন শক্তি রূপে মা দুর্গা, বিদ্যা রূপে মা সরস্বতী এবং ধনসম্পদে মা লক্ষ্মী পূজিত হয়।

ধারাবাহিক পর্বঃ- ৬৪

সাধু সাবধান! গুরু গুরুর আসনে পূজিত হবে, গুরুকে ভগবানের আসনে নয়। চোখ খুলে ধর্ম করুন, অন্ধ বিশ্বাসে নয়।

♣ আচ্ছা, বলুনতো একজন সৎ গুরুকে আপনি কিভাবে চিনবেন?

♣ একজন সৎ গুরু তাঁর প্রাণ প্রিয় শিষ্যদের কিভাবে দিকনির্দেশনা দিবে?

♣ একজন সৎ গুরু কি নিজেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজকে ভগবানের আসনে বসিয়ে পূজিত হতে পারে?

গুরু=( 'গু'+ 'রু')।।
♦'গু' শব্দের অর্থ অজ্ঞানের অন্ধকার যার মধ্যে জীবজগত নিমজ্জমান।
♦'রু ' শব্দের অর্থ হলো জ্ঞানের আলো যা আমাদের অজ্ঞানের জগত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় জ্ঞানের আলোর জগতে।

সুতরাং গুরু হলেন সেই ব্যক্তিত্ব যিনি আমাদের ভিতরকার অজ্ঞানের অন্ধকার নাশ করে আমাদের মধ্যে শক্তিসঞ্চার করে এগিয়ে দেন মহা জীবনের পথে। সহজ বাংলায় সঠিক জীবন ও সাত্ত্বিক ধর্ম পালনের মাধ্যমে ভগবানের চরণাশ্রিত হওয়ার জন্য যিনি দিক নির্দেশনা দেয় (আধ্যাত্মিক জগতের পথ প্রদর্শক) তিনিই গুরু হিসেবে শিষ্যদের কাছে অখ্যায়িত।

ব্যক্তিগতভাবে খেয়াল করে দেখলাম যে, আমাদের সমাজে কিছু গুরু ও শিষ্যদের ধর্ম চর্চা যেন তাদের একটা নিজস্ব নিয়মে পরিচালিত। যেখানে ধর্ম সভা মানে গুরুর লেখা কিছু ভক্তিমূলক গান ও কিছু সাজানো নিয়মকানুন পালন, পাশাপাশি শিষ্যের লেখা গুরুর গান নিয়ে সাজানো টোটাল একটি প্যাকেজ। কথাটা অপ্রিয় হলেও সত্য যে তাদের ধর্ম সভায় না হয় গীতার আলোচনা, না হয় ভাগবতের আলোচনা কিংবা সঠিক ভাবে হরিনাম সংকীত্তন।

এবার আসুন শ্রীমদ্ভবদ্গীতায় দশম অধ্যায় 'বিভূতিযোগের' ৮, ৯, ১০, ১১ নং শ্লোকে ভাগবান শ্রীকৃষ্ণ কি বলেছেন- (শুধু অনুবাদ তুলে ধরলাম)

#শ্লোক ০৮ এর অনুবাদঃ
আমি জড় ও চেতন জগতের সব কিছুর উৎস। সব কিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়। সেই তত্ত্ব অবগত হয়ে পণ্ডিতগণ শুদ্ধ ভক্তি সহকারে আমার ভজনা করে।

#শ্লোক ০৯ এর অনুবাদঃ
যাঁদের চিত্ত ও প্র্রাণ সম্পূর্ণরূপে আমাতে সমর্পিত, তাঁরা পরস্পরের মধ্যে আমার কথা সর্বদাই আলাচনা করে এবং আমার সম্বন্ধে পরস্পরকে বুঝিয়ে পরম সন্তোষ ও অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করেন।

#শ্লোক ১০ এর অনুবাদঃ
আমার ভজনা করে নিত্যযুক্ত, আমি তাঁদের শুদ্ধ জ্ঞানজনিত বুদ্ধিযোগ দান করি, যার দ্বারা তাঁরা আমার কাছে ফিরে আসতে পারেন।

#শ্লোক ১১ এর অনুবাদঃ
তাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করার জন্য আমি তাঁদের হৃদয়ে অবস্থিত হয়ে, উজ্জ্বল জ্ঞান-প্রদীপের দ্বারা অজ্ঞান-জনিত অন্ধকার নাশ করি।

ক্ষমা করবেন, একবার ভাবুনতো ঐসব শিষ্যদের ধর্ম পালনের সাথে শ্রীমদ্ভবদ্গীতায় ভগবানের এসব উপদেশের কোন মিল পাওয়া যায়?

♦ এবার আসুন আরেকটি বিষয়ে আলোচনা করা যাক, আমাদের সনাতন সমাজে দেখা যায় যে বাবা-মা দেহত্যাগ করলে শ্রাদ্ধের পরে একটা ভালো দিন দেখে গোবিন্দের সেবা দিয়ে দু-চার জন সাধু গুরু বৈষ্ণবকে সাদর করে সেবা করানো হয়। এখন যদি গোবিন্দের সেবা না দিয়ে কিংবা গুরুর সেবাকে শুধু প্রাধান্য দেওয়া হয়, তাহলে বলুন তো সেটি আপনার কাছে কতটুকু গ্রহণ যোগ্যতা পাবে? আশাকরি আপনার উত্তর এমন হবে যে উক্ত দিবসে অবশ্যই বাবা-মায়ের গুরুর সেবা হবে তবে গোবিন্দের সেবা আগে হবে এবং সেটিকে প্রাধান্য দেওয়া আমাদের উচিত। অত্যান্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় যে কিছু গুরুর শিষ্যরা ঐ দিনটিতে শুধু গুরুর সেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এটাই নাকি তাদের গুরুর ধর্মাদেশ।

♦ধরুন, আপনার সন্তানের মুখে প্রসাদ (অন্নপ্রাশন) দিবেন। এখন আপনি কি ভগবানের সেবা দিয়ে আপনার সন্তানের মুখে প্রসাদ দিবেন নাকি আপনার গুরুর সেবা দিয়ে মুখে প্রসাদ দিবেন? এখন কথা হলো আপনি যদি সৎ গুরুর শিষ্য হন কিংবা আপনি সঠিক ধর্ম সম্পর্কে অবগত হন তাহলে আপনি কখনো ভগবানের সেবাকে বাদ দিয়ে গুরুর সেবা দিয়ে আপনার সন্তানের মুখে প্রসাদ দিবেন না। প্রসঙ্গত বলতে হয় বেশকিছুদিন পূর্বে আমার এক সম্পর্কিত লোকের ছেলের মুখে প্রসাদ (অন্নপ্রাশন) দেওয়া হয়। অনুষ্টানে আমার বেশ কিছু বন্ধু ও বড় ভাই আসে। আসার পর তাদের হাতে প্রসাদ মাখা দেওয়া হয়, স্বাভাবিক ভাবে, তারা প্রসাদ প্রণাম দিয়ে নিতে লাগলো আর প্রসাদ নেওয়ার মাঝখানে এক জনের মুখে মাছের কাটা পড়ল। পরের অবস্থা............... আর নাই বললাম।

এখন আপনার মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে, প্রসাদে মাছের কাটা আসলো কি করে? মূলবিষয়টি হলো যে গুরুর সেবা দেওয়া হলো অন্নপ্রাসনকে কেন্দ্র করে, সে গুরুর সেবা তার শিষ্যরা সচরাচর আমিষ দিয়ে করায় এবং সেটাকে প্রসাদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সন্তানের মুখে দেওয়া হয়। এখন আপনি বলুন, আপনার বিবেক কি বলে......?
আর আমি শুধু আপনাদের উদ্দেশ্য একটা প্রশ্ন রাখতে চাই যে আমিষ আহারে শুদ্ধাচার !!! বিষয়টি একটু বিশ্লেষণ করবেন কেউ দয়াকরে? যদি পারেন, তাহলে আমার দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে।

♦শেষ প্রসঙ্গ, গত সপ্তাহ ঐসব গুরুর এক শিষ্যের সাথে এই বিষয়ে আলাপ হয় এবং কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই, কিন্তু উনি আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিতে পারে নাই। উনাকে আমি সর্বশে
ষ প্রশ্নটা করলাম যে, আচ্ছা আপনাদের গুরুর কোন শিষ্য দেহত্যাগ করলে আপনারা কি উক্ত মৃতদেহের বুকের উপর গীতা রাখেন? উনি উত্তরে বললো হ্যাঁ রাখি, এমনকি শ্রাদ্ধদিবসেও গীতা পাঠ হয়; এটাই তো নিয়ম। আমি বললাম নিয়ম? কিসের নিয়ম! আপনাদের গুরু কি উনার শিশ্যদের মৃত্যুর পরে আর কি কি করতে হবে তার উপর আরেকটা নিয়ম তৈরি করতে পারে নাই???

হায়রে অন্ধ বিশ্বাসে পালিত ধর্ম! সারাটা জীবন গুরুর সেবাই করে গেলাম, উঠতে-বসতে, বিপদে-আপদে ভগবানের নাম স্মরণ না করে শুধু গুরুর নাম স্মরণ করলাম। কিন্তু মৃত্যুর সময় কানের পাশে হরির নাম সংকীত্তন, বুকের উপর গীতা, এমনকি শ্রাদ্ধদিবসে গীতা পাঠ। আমরা আর কবে বুঝবো কোনটা সঠিক ধর্ম আর কোনটা ধর্মের নামে...........................।।

ঐধরনের গুরু শিষ্যদের উদ্দেশ্যে শ্রীমদ্ভবদ্গীতার দ্বাদশ অধ্যায় ভক্তিযোগের সর্বশেষ শ্লোকটি তুলে ধরলাম-

যে তু ধর্মামৃতমিদং যথোক্তং পর্যুপাসতে ।
শ্রদ্দধানা মৎপরমা ভক্তাস্তেহতীব মে প্রিয়াঃ।।

অর্থাৎ যাঁরা আমার দ্বারা কথিত এই ধর্মামৃতের উপাসনা করেন, সেই সকল শ্রদ্ধাবান মৎপরায়্ণ ভক্তগণ আমার অত্যন্ত প্রিয়।

#অন্তলগ্নে সকল সৎ গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই যে এই লেখার উদ্দেশ্য কাউকে ছোট করার জন্য নয়, এই লেখার উদ্দেশ্য আমাদের বিবেকবোধকে জাগ্রত করা। আমরা কি আমাদের যার যার গুরুর কাছে থেকে সঠিক দিক নির্দেশনা পাচ্ছি? আমরা কি সঠিক পথে থেকে সঠিকভাবে ধর্ম পালন করছি?

Courtesy By: Bappy Kuri
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।