১২ এপ্রিল ২০১৬

রামায়ণ কথা (অযোধ্যাকাণ্ড পর্ব – ৩)


রাণী কৌশল্যা, সুমিত্রা , মন্ত্রী সুমন্ত্র ও রাজার পাত্র মিত্র দেখলেন রাজা অসুস্থ । হঠাত এত খুশীর সময়ে রাজা অসুস্থ কেন হলেন বুঝলেন না । অপরদিকে কৈকয়ীর অদ্ভুত রূপ, আচরণ দেখে রাজবাটির সকলেই অবাক আশ্চর্য হলেন। কৈকয়ী কারো সাথে কথা বলে না। কেবল দ্বার এটে মন্থরার সাথে পরামর্শ করে । সম্পূর্ণ অলঙ্কার বিবর্জিতা অলক্ষ্মীর ন্যায় কৈকয়ীকে দেখে এক হিংস্র সর্বগ্রাসীর ন্যায় বোধ হয় । কৌশল্যা, রাণী সুমিত্রা সকলে রাজার কাছে জানতে চান কি হয়েছে ? রাজা দশরথ আর কতক্ষণ চুপচাপ থাকেন। একসময় বলেই দিলেন তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা, কৈকয়ীর ইচ্ছা । কৌশল্যা, সুমিত্রা রাজার মন্ত্রী সেনাপতি এই ভেবে অবাক হন । কুলগুরু বশিষ্ঠ এই শুনে আশ্চর্য হলেন । শুনে সকলেই ভয়গ্রস্ত হয়। রামচন্দ্র তো নয়নের মণি । নয়ন আছে দেখেই পৃথিবী সুন্দর, নয়নহীনের কাছে সব অন্ধকার। রামচন্দ্র অযোধ্যা ত্যাগ করলে এই অন্ধকার জীবন রেখে কি লাভ ? দুর্ভাগা সে যে নয়ন থাকতেও রামচন্দ্রকে দর্শন করে না। অন্ধ যদি রামচন্দ্রের স্পর্শ, বাক্য শ্রবণের সান্নিধ্যে আসে তবে সে ধন্য আর ভাগ্যবাণ- সেই যথার্থ জীবিত । কৈকয়ী কেন সকলের প্রাণ কে কেড়ে নিয়ে ‘জীবিত শবদেহ’ বানাতে চাইছে ? কৈকয়ী কেন সকলকে অন্ধ বানাতে চাইছে ? কৈকয়ী সুস্থ তো, নাকি কৈকয়ীর ছদ্দবেশে রঘুবংশের কোন প্রাচীন শত্রু ? নাকি নিশাচর রাক্ষসী কৈকয়ীর ছদ্দবেশে? নাকি কোন দুষ্ট মায়াবলে কৈকয়ীর মধ্যে থেকে সকল প্রকার শুভ চিন্তা হরণ করেছে? কৌশল্যা, সুমিত্রা বোঝাতে গেলো কৈকয়ীকে । রাণী দ্বয় বলল- “কৈকয়ী। তুমি সর্বদা রামকে নিজ পুত্র বলে আদর স্নেহ করতে ? আজ তোমার সেই আদর যত্ন কোথায় লুপ্ত হল? তবে সেগুলো কি কেবল তোমার অভিনয়?”

কৈকয়ী বলল- “নিজ পুত্রের সুরক্ষা করা মাতার প্রধান কর্তব্য ? আমি কি এমন অন্যায় আবদার করেছি ? ভরতের সুরক্ষা প্রদান করা আমার প্রধান কর্তব্য । কেন রাম রাজা হবে? ভরত কোন অংশে কম ? ভরত কি যোগোত্যাহীন ? কেন কৌশল্যা তুমি রাজমাতা হবে? আমি হবো না কেন? আমি নিজ পুত্রের জীবন সুরক্ষিত করবার কর্ম করেছি। আমি কোনরূপ আন্যায় আবদার করি নি।” রাজা দশরথ অনেক বোঝালো, “এমন অন্যায় আবদার ফিরিয়ে নাও । এমন কদাপি করো না। রাম তোমাকেই মা রূপে নিজ গর্ভধারিণী কৌশল্যা থেকেও অধিক উচ্চাসনে স্থাপন করে, সেই রামের সাথে অন্যায় করতে তোমার বিবেকে বাধে না ?” কৈকয়ী বলল- “মহারাজ ! আমাকে ভুললে চলবে না ভরত আমার গর্ভজাত। রাম যতই আমাকে মাতৃভক্তি করুক, কিন্তু ভরত আমার গর্ভের। আমি রামকে গর্ভে ধারন করি নি। সে আমার সতীনের গর্ভজাত- একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না? তবে সতীনের পুত্রের উপর ভরসা কি? যদি রাজা হবার পর যদি সে আমাকে আর আমার গর্ভের সন্তান ভরতকে বিতারিত করে তবে আমাদের গতি কি হবে? আপনি নিজেও তো অন্যায় করেছেন। আপনি রামকে এতই স্নেহ করেন যে ভরত আপনার পুত্র – এটা বিস্মৃত হয়েছেন। কেন আপনি ভরতের অনুপস্থিতিতে রামের রাজ্যাভিষেক করালেন ? এর অর্থ কি? আপনি জীবিত থাকতেই যদি এমন অন্যায় হয় , তবে আগামীকালে আমার আর আমার গর্ভজাত পুত্র ভরতের জীবন যে অন্ধকারময় হবে- এতে সন্দেহ কি? ভরত আমার গর্ভজাত, রাম নয় ।” রাজা দশরথ বললেন- “কুটিল নাগিনী। তোমার গর্ভ থেকে ভরতের ন্যায় সর্প উৎপন্ন হবে, এতে আর সন্দেহ কি? রামের ন্যায় রত্ন কদাপি তোমার গর্ভ থেকে উৎপন্ন হতে পারে না। বোধ হয় ভরত মাতুলালয়ে যাবার পূর্বে তোমাকে কুবুদ্ধি দিয়েছে। সেও কি বিস্মৃত হয়েছে যে রামচন্দ্র তার ভ্রাতা ভরতকে কত স্নেহ করে? তোমরা জননী- পুত্র উভয়েই সর্বনাশের হোতা। ভুল করেছি আমি তোমাকে বর দেবার প্রতিজ্ঞা করে। তোমাদের শাস্তি প্রদান করা উচিৎ।”

পুনঃ দশরথ শান্ত হয়ে বললেন- “হে কৈকয়ী! তোমার প্রথম ইচ্ছা আমি পূর্ণ করবো। কিন্তু রামকে বনবাসে প্রেরণ করতে বোলো না। রাম বিনা অযোধ্যা অন্ধকার, এই রাজমহল অন্ধকার, আমি অন্ধকার। সে বরং এখানেই থাক।” কৈকয়ী বলল- “মহারাজ। সেও সম্ভব না। আমি জানি এতে আপনার এবং আপনার বড় রাণীর কষ্ট হবে। ক্লেশ আমিও ভোগ করবো। কারণ রামচন্দ্র আমারও সন্তান । কিন্তু মহারাজ আমি ভরতের রাজ আসন নিষ্কণ্টক করতে চাই। আমি চাই না রাম বিদ্রোহ ঘটিয়ে ভরতকে হত্যা করে পুনঃ সিংহাসন অধিষ্ঠান করুন। অযোধ্যা, মিথিলা, নিষাদ রাজ্যে রামচন্দ্রের জনপ্রিয়তা অত্যাধিক। এই অবস্থায় গোপোনে ষড়যন্ত্র করে রামচন্দ্র যে কোন মুহূর্তে আমার সন্তানকে হত্যা করতে পারে। মহারাজ! সিংহাসন এমন , যাঁর জন্য মানুষ তো দূর দেবতারাও অপরাধ করেন। আপনি কি বিস্মৃত হয়েছেন স্বয়ং দেবতাদের সম্রাট ইন্দ্র , তাঁর বিমাতা দিতির গর্ভস্থ সন্তান কে হত্যা করেছিলো। সেজন্য এই সব ব্যবস্থা । অতএব আপনি রামচন্দ্রকে সব বলে এখুনি বনে প্রেরণ করুন। আর ভরতকে মাতুলালয় থেকে এনে রাজা করে দিন। আপনার বয়স হয়েছে। এবার আপনি আপনার পুত্র ভরতকে রাজা বানিয়ে বিশ্রাম নিন। ” শুনে কৌশল্যা, সুমিত্রা কৈকয়ীকে অনেক বকা ঝকা করতে লাগলো। অনেক কাকুতি মিনতি করলো। কৈকয়ী নিজ জেদে অটল। কিছুতেই মানলো না । দশরথ কৈকয়ীকে বলল- “তুমি মহাপাপিষ্ঠা। তোমার মনে বিষ। বিষাক্ত নাগিনী যেভাবে বিষ উদ্গীরন করে, সেইভাবেই তুমি বিষবাক্য নির্গত করছ। আমি তোমাকে রানীদিগের মধ্যে সর্বাধিক প্রেম নিবেদন করতাম। আজ জানলাম আমি মহামূর্খ । তোমার ন্যায় কুটিলা রমণীকে বিবাহ করাই আমার সব থেকে বড় ভুল। তুমি দূর হও। তোমার মুখ যে দেখবে তার হৃদয়ের সকল মানবতা ধ্বংস হবে।”

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।