০১ এপ্রিল ২০১৬

রামায়ন কথা ( আদিকাণ্ড- ২০)

অযোধ্যা নগরীর নরপতি রাজা দশরথের কোন পুত্র সন্তান ছিলো না । তিনি তাঁর কন্যা শান্তার স্বামী ঋষশৃঙ্গ মুনিকে রাজা হতে অনুরোধ জানালে ঋষশৃঙ্গ মুনি মানা করলেন । কারন ঋষি তপ, যোগ, সাধনা নিয়েই সুখে ছিলেন । এই নিয়ে রাজা দশরথের চিন্তার শেষ ছিলো না। শেষে কি এই মহান ইক্ষাকু বংশ বিলুপ্ত হবে ? একদিনের কথা রাজা দশরথ মৃগয়াতে বনে গেছেন । পাত্র, মিত্র, সেনা নিয়ে জঙ্গলে মৃগ অন্বেষণ করছেন । মৃগ মাংস তৎকালীন আহার্য ছিলো। মৃগ চর্মে বসে সাধনা করা হত। এছাড়া মৃগ নাভি, মাংস যজ্ঞে আহুতি দেওয়া হত । অপরদিকে সেই তপবনে এসেছেন শ্রবন কুমার। তিনি তার বৃদ্ধ বয়স্ক মাতাপিতাকে নিয়ে তীর্থ ভ্রমণে বেড়িয়েছেন । শ্রবণকুমার তার পিতামাতাকে স্কন্ধে বহন করে বিভিন্ন তীর্থে গমন করতেন । তাঁর পিতামাতা বয়সের ভারে জরাজীর্ণ, তার উপর অন্ধ। শ্রবণকুমার এক আদর্শ হিন্দু পুত্র। আজকালকার যুগে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে । কোন কোন গুরুদেব আবার অল্প বয়সী ছেলে মেয়েদের সন্ন্যাস নিতে বলছেন পিতামাতার সেবা না করে । কেউ আবার পিতামাতার সেবা না করে ভগবানকে ছাপান্ন ভোগ দিচ্ছেন, তিনবেলা আরতি করছেন। কত সব নিয়ম । কেউ আবার জীবিতকালে পিতামাতাকে খেতে দেয় না, দেখে না, মরলে পড়ে ঘটা করে এলাহী ভোজ খাইয়ে শ্রাদ্ধ, বামন ভোজোন , বৈষ্ণব সেবা, কীর্তন দান ধ্যান আবার গয়াযাত্রা ইত্যাদি অনুষ্ঠান করেন ।

তাই বলে কেউ ধরে নেবেন না যে শাস্ত্রে লেখা ঐ সব কথা মিথ্যা। যে ব্যাক্তি শাস্ত্র মানে না- ইহলোকে সে শান্তি তো পায় না, মরেও মুক্তি পায় না। হ্যা শাস্ত্র নিয়ম অবশ্যই পালনীয়, কিন্তু জীবিত থাকাকালিন পিতামাতার সেবা করা, দেখাশোনা করাও শাস্ত্রের বিধান । গণেশ জী বিশ্ব পরিক্রমা করেছিলেন হরগৌরীকে পরিক্রমা করেই। পিতার অঙ্গীকার করা বচন রাখতে রামচন্দ্র বনবাস গেছিলেন । খালি শাস্ত্রের একদিকটা দেখলেই হয় না। যাই হোক শ্রবণ কুমার পীঠে দাঁড়িপাল্লার মতোন বাঁশের সাথে বাধা ঝুঁড়িতে পিতামাতাকে বসিয়ে তীর্থে যেতেন । একদা শ্রবণ কুমার অন্ধ পিতামাতাকে একস্থানে বসিয়ে দ্বিপ্রহরের ফল মূলাদি সংগ্রহ করতে বের হলেন। ত্রেতা যুগে ভারতবর্ষের বন আজকের মতো রুক্ষ ছিলো না। চারপাশে সবুজে সবুজ, এছাড়া গাছ গুলি নানাপ্রকার মিষ্ট ফলে বারোমাস ভরা থাকতো। মানুষ পশু পাখীর তুলনায় ত্রিনগুণ বৃক্ষ ছিলো। যত ইচ্ছা বনের ফল খাও – এমন ছিলো । শ্রবণ কুমার ফলমূলাদি আহরণ করে নদীতে জল নিতে গেলো। নদীর নিকটেই দশরথ রাজা ধনুর্বাণ নিয়ে মৃগ অন্বেষণ করছিলেন । শ্রবন কুমার যখন জল ভরছিলেন তাঁর শব্দে দশরথ রাজা ভাবলেন কোন মৃগ জল খাচ্ছে । তিনি আগেপিছে না দেখে অব্যর্থ শব্দেভেদী বাণ চালালেন । বাণ গিয়ে শ্রবন কুমারের বুক বিদ্ধ করল । মানবের চিৎকারে দশরথ রাজা ভয় পেয়ে গিয়ে দেখেন তার বাণ শ্রবণকুমারের বুক বিদ্ধ করছে। দশরথ রাজা মুনির সামনে গিয়ে বললেন- “হে মুনিকুমার । আমার দ্বারা অজান্তে মহাপাপ হয়েছে। আমি আপনাকে বধ করতে চাইনি। আমি মৃগ ভ্রমে বাণ নিক্ষেপ করেছিলাম। আপনি এই অধম দশরথকে ক্ষমা করুন।”

আহত শ্রবণকুমার বললেন- “হে রাজন! আমি শ্রবন কুমার। আমার পিতা অন্ধমুনির কাছে আমাকে শীঘ্র নিয়ে চলুন। আমার পিতামাতা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।” এই বলে শ্রবণকুমার দেহত্যাগ করলেন । রাজা মুনি কুমারের মৃতদেহ তার পিতামাতার কাছে নিয়ে গেলেন । মুনি আর মুনি পত্নী কে বললেন- “মুনিবর । আমি অযোধ্যার নৃপতি দশরথ । মৃগ ভ্রমে আমার নিক্ষেপিত শরে আপনাদের পুত্র শ্রবণ কুমারের প্রান গেছে। আমার দ্বারা অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটি হয়েছে । ” শুনে বৃদ্ধ পিতামাতা শোকে কেঁদে উঠলেন । বিশেষ করে শ্রবণকুমারের মা এই শোক সহ্য করতে না পেরে তখুনি প্রান ত্যাগ করলেন। বৃদ্ধ অন্ধ মুনি বললেন- “দশরথ। অগ্নিতে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হাত দিলে হাত পুড়েই যায়। তোমার অনিচ্ছাকৃত ভুলে আমরা পুত্র হারালাম। আমার স্ত্রী দেহ রেখেছেন। আমিও আর এই দেহ রাখবো না। আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি যেভাবে আমরা পুত্রশোকে দেহ ত্যাগ করলাম, তুমিও পুত্রশোকে ইহলোকে ত্যাগ করবে।” দশরথ বললেন- “মুনিন্দ্র আমি অপুত্রক। আমার কোন পুত্র নেই। কিভাবে আপনার শাপ বাস্তবায়িত হবে?” অন্ধ মুনি বললেন- “সম্রাট । ব্রাহ্মণের বাক্য কদাপি মিথ্যা হয় না। তুমি ঋষশৃঙ্গ মুনিকে এনে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ সম্পন্ন কর। তোমার অবশ্যই পুত্র হবে।” এই বলে অন্ধ মুনি প্রান ত্যাজিলেন । দশরথ তিনজনকে প্রনাম জানিয়ে বললেন- “আপনারা আশীর্বাদ দিলেন অভিশাপের ছলে।” এরপর রাজা তিনজনের দেহ সৎকার করলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।