• মহাভারতের শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান

    মহাভারতে যে সময়ের এবং শহরগুলোর কথা বলা হয়েছে সেই শহরগুলোর বর্তমান অবস্থা কি, এবং ঠিক কোথায় এই শহরগুলো অবস্থিত সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। আর এই আলোচনার তাগিদে আমরা যেমন অতীতের অনেক ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসবো, তেমনি বর্তমানের পরিস্থিতির আলোকে শহরগুলোর অবস্থা বিচার করবো। আশা করি পাঠকেরা জেনে সুখী হবেন যে, মহাভারতের শহরগুলো কোনো কল্পিত শহর ছিল না। প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে সেই শহরগুলো আজও টিকে আছে এবং নতুন ইতিহাস ও আঙ্গিকে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।

  • মহাভারতেের উল্লেখিত প্রাচীন শহরগুলোর বর্তমান অবস্থান ও নিদর্শনসমুহ - পর্ব ০২ ( তক্ষশীলা )

    তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত শহর এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত এটি ভারতবর্ষের অর্ন্তগত ছিল।

  • প্রাচীন মন্দির ও শহর পরিচিতি (পর্ব-০৩)ঃ কৈলাশনাথ মন্দির ও ইলোরা গুহা

    ১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরা’র কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়। যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। যার আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ। প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর দেয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশাপ্সহ এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিব মন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী” –র ছবি আছে।

  • কোণারক

    ১৯ বছর পর আজ সেই দিন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সোমবার দেবতার মূর্তির ‘আত্মা পরিবর্তন’ করা হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ‘নব-কলেবর’ নামের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার পুরোনো মূর্তি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানো হবে। পুরোনো মূর্তির ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে সঞ্চারিত হবে, পূজারীদের বিশ্বাস। এ জন্য ইতিমধ্যেই জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের নতুন কাঠের মূর্তি তৈরী হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গর্ভগৃহ’ বা মূল কেন্দ্রস্থলে এই অতি গোপনীয় প্রথার সময়ে পুরোহিতদের চোখ আর হাত বাঁধা থাকে, যাতে পুরোনো মূর্তি থেকে ‘আত্মা’ নতুন মূর্তিতে গিয়ে ঢুকছে এটা তাঁরা দেখতে না পান। পুরীর বিখ্যাত রথযাত্রা পরিচালনা করেন পুরোহিতদের যে বংশ, নতুন বিগ্রহ তৈরী তাদেরই দায়িত্ব থাকে।

  • বৃন্দাবনের এই মন্দিরে আজও শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহন-বাঁশির সুর

    বৃন্দাবনের পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিধিবন মন্দির। এই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যা আজও পর্যটকদের সমান ভাবে আকর্ষিত করে। নিধিবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্য-ঘেরা সব গল্পের আদৌ কোনও সত্যভিত্তি আছে কিনা, তা জানা না গেলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে এসে আপনি মুগ্ধ হবেনই। চোখ টানবে মন্দিরের ভেতর অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্যে ভরা রাধা-কৃষ্ণের মুর্তি।

১৮ এপ্রিল ২০২৪

স্কন্দপুরাণে 'জ্ঞানবাপী' তীর্থের মাহাত্ম্য

জ্ঞানবাপী অত্যন্ত পবিত্র একটি তীর্থ। এর বর্ণনা স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডের পূর্বাদ্ধে সুস্পষ্টভাবে রয়েছে। সেখানে জ্ঞানবাপীর উৎপত্তির সাথে সাথে এর নামকরণের ইতিহাসও বর্ণিত হয়েছে। জ্ঞানবাপী দিঘির  জ্ঞানবাপী নামটি ভগবান শিব রাখেন। অগস্ত্য মুনি ভগবান কার্তিকের কাছে এই দিঘির  মাহাত্ম্য জানতে চান। তিনি ভগবান কার্তিককে জিজ্ঞাসা করেন যে,  জ্ঞানবাপী দিঘি কেন এত মাহাত্ম্যপূর্ণ যে এর প্রসংশা স্বর্গবাসী দেবতারাও করেন ?

অগস্ত মুনির এ প্রশ্নের উত্তরে জ্ঞানোদ তীর্থের মহিমা বর্ণনা করে ভগবান কার্তিক। তিনি বলেন:

 আমি জীবের সকল কলুষনাশিনী জ্ঞানবাপী দিঘির  উৎপত্তি এবং মাহাত্ম্যকথা বর্ণনা করছি। আপনি শ্রবণ করুন।হে মুনে! বহুপূর্বে  দেবযুগে এই আবহমান সংসারে মেঘ বৃষ্টিপাত করত না; নদীর  উৎপত্তি হয়নি; স্নান-দানাদি কাৰ্য্যে কেউ জল ধর চাইত না; লবণ ও ক্ষীরসমুদ্রেই কেবল জল বৃষ্টি দেখা যেত। পৃথিবীর সর্বত্র মনুষ্যবসতি ছিল না। কদাচিৎ কোথাও কোথাও মনুষ্য বসবাস করত। এমন সময়ে দিকপাল ঈশান মনের ইচ্ছায় ইতস্তত  বিচরণ করতে করতে  সমস্ত কর্মবীজের উষয়ক্ষেত্রে মহানিদ্রায় নিদ্রিত জীবগণের প্রতিবোধক, সংসারসমুদ্রাবর্তে পতিত জন্তুর অবলম্বনতরণী, যাতায়াতে খিন্নজীবের বিশ্রামভবন, বহুজন্মসঞ্চিত কৰ্ম্মসূত্রের ছেদনশস্ত্র, নির্বাণলক্ষ্মীধাম, সচ্চিদানন্দনিলয়, পরব্রহ্মরসায়ন, সুখসন্তানজনক, মোক্ষসাধন-সিদ্ধিপ্রদ মহাশ্মশান শ্রীআনন্দকাননে উপস্থিত হলেন। অর্থাৎ সিদ্ধিপ্রদ মহাশ্মশান সমন্বিত কাশীক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন।  জটিল ঈশান কাশীক্ষেত্রে প্রবেশ করে দেখতে পেলেন,  ভগবান শিবের  ত্রিশূলের জ্যোতি সূর্যের ন্যায় দশদিক আলোকিত করে আছে। সেই ত্রিশুলের  বিমল রশ্মিজালে আকুল হয়ে তিনি জ্যোতির্মালামণ্ডিত ভগবান শিবের জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন করলেন। এ জ্যোতির্লিঙ্গ দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের প্রধানতম।অমর দেবতাগণ, সিদ্ধ, যোগী, ঋষি ও প্রমথগণ নিরন্তর ভগবান শিবের সেই লিঙ্গমূর্তির অর্চ্চনা করছে। গন্ধর্বরা বিবিধ বাদ্যাদি সহযোগে সংগীত করছে।  চারণগণ শিব স্তব করছে; অপ্সরাগণ নৃত্য করছে; নাগকন্যাগণ হাতে মণিময় প্রদীপ নিয়ে আরতি করছে; বিদ্যাধরবধূ ও কিন্নরীগণ ত্রিকালীন মঙ্গল প্রার্থনা করছে। দেবনারীগণ ইতস্ততঃ চামরব্যজন করছে। মুক্তিক্ষেত্র কাশীতে ভগবান শিবের জ্যোতির্ময় লিঙ্গ দেখে  ঈশানের ইচ্ছা হল যে, তিনি কলশীতে শীতল জল এনে সেই জল দ্বারা ভগবান শিবের  মহালিঙ্গকে স্নান  অভিষেক করাবেন।

অস্যেশানস্য তল্লিঙ্গং দৃষ্ট্বেচ্ছেত্যভবত্তদা।

স্নপয়ামি মহল্লিঙ্গং কলশৈঃ শীতলৈর্জলেঃ।।

চখান চ ত্রিশুলেন দক্ষিণাংশোপকণ্ঠতঃ।

কুণ্ডং প্রচণ্ডবেগেন রুদ্রো রুদ্রবপূর্দ্ধরঃ।।

(স্কন্দপুরাণ: কাশীখণ্ড, পূর্বাদ্ধখণ্ড, ৩৩.১৬-১৭)

তখন শিবের অংশভূত রুদ্রমূর্তি ঈশান ত্রিশূল দ্বারা বিশ্বনাথ শিবের মন্দিরের দক্ষিণ ভাগের অনতিদূরে এক কুণ্ড বা কুপ খনন করলেন। সেই কুণ্ড হলে অজস্রধারায় সুপেয় জলরাশি এই ভূমণ্ডলের বহিরাবরণে নির্গত হল।সেই ঈশান তখন সেই জলদ্বারা শিবকে স্নান করালেন। সেই কুণ্ডের জলের বৈশিষ্ট্য হল :

সকলের এই জল স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয় না; সজ্জনচিত্তের স্থায় স্বচ্ছ; এই জল সকলের ঊর্ধ্বে, তাই আকাশমার্গের ন্যায় অত্যুচ্চ;  জ্যোৎস্নার ন্যায় উজ্জ্বল এবং শ্বেতকায়; শিবনামের ন্যায় মহাপবিত্র; অমৃতবৎ পরম সুস্বাদু ; বৃষাঙ্গের ন্যায় সুখস্পর্শ;  নিষ্পাপজনের স্থায় ধীর এবং গম্ভীয়; পাপিগণের মত চঞ্চল; পদ্মগন্ধ যুক্ত; লাল পারুল ফুলের সুগন্ধীযুক্ত;  সকালের দর্শনমাত্রই নয়নমনোহারী; অজ্ঞানতাপতপ্ত জীবের স্নিগ্ধতা প্রদানকারী;  পঞ্চামৃত স্নানের অপেক্ষা অতি ফলদায়ী;  শ্রদ্ধাপূর্বক স্পর্শ করলে হৃদয়ে লিঙ্গত্রিতয়েয় জনক; অজ্ঞানতিমিরের জ্যোতির্ময় সূর্যতুল্য; জ্ঞানদানের নিদান; উমাস্পর্শ অপেক্ষা বিশ্বেশ্বরের অতি সুখকারী; অবভৃত স্নান হতেও শুদ্ধিবিধায়ক; অত্যন্ত সুশীতল; মূর্খতা বিনাশকারী সেই পবিত্র জল দ্বারা সহস্ৰধারায় কলসে করে হৃষ্টচিত্তে সহস্রবার সেই লিঙ্গমূর্তিকে স্নান করালেন।সেই পবিত্র কুণ্ডের জলে অভিষিক্ত হয়ে বিশ্বলোচন বিশ্বাত্মা  রুদ্রমূর্তিধারী ভগবান শিব ঈশানের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। তিনি অত্যন্ত প্রসন্নহৃদয়ে ঈশানকে বললেন:

"হে সুব্রত ঈশান! অতি প্রীতিকর, অনন্যকৃতপূর্ব গুরুতর তোমার এই মঙ্গলময় কর্মে আমি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছি। তোমায় কি বর প্রদান করতে হবে বল, তোমাকে আমার অদেয় কিছু নেই।" ভগবান শিবের আবির্ভাব এবং বরদানের প্রতিশ্রুতিতে ঈশান অভিভূত হয়ে যায়। সে তখন বলেন :

 "হে দেবেশ ! যদি প্রসন্ন হয়ে থাকেন ও আমি যদি আপনার বরলাভের যোগ্যপাত্রমধ্যে গণ্য হই, তবে হে শঙ্কর! এই তীর্থ অতুলনীয় হয়ে আপনার নামে প্রসিদ্ধ হোক এই আমার ক্ষুদ্র চাওয়া।" ঈশানের বাক্যে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান বিশ্বেশ্বর বললেন: 

ত্রিলোক্যাং যানি তীর্থানি ভূভুবঃস্বঃস্থিতান্যপি।

তেভ্যোঽখিলেভ্যস্তীর্থেভ্যঃ শিবতীর্থমিদং পরম্।।

শিবং জ্ঞানমিতি ব্রূয়ুঃ শিবশব্দার্থচিন্তকাঃ।

তচ্চ জ্ঞানং দ্রবীভূতমিহ মে মহিমোদয়াৎ।।

অতো জ্ঞানোদনামৈতীর্থং তৈলোক্যবিশ্রুতম্।

অস্য স্পর্শমাত্রেণ সর্বপাপৈঃ প্রমুচ্যতে।।

জ্ঞানোদতীর্থসংস্পর্শাদশ্বমেধফলং লভেৎ।

স্পর্শনাচমনাভ্যাঞ্চ রাজসূয়াশ্বমেধয়োঃ।।

(স্কন্দপুরাণ: কাশীখণ্ড, পূর্বাদ্ধখণ্ড, ৩৩.৩১-৩৪)

ত্রিভুবন বা ভূলোক, অন্তরিক্ষলোক এবং স্বর্গলোক মধ্যে যত তীর্থ আছে, সেই সকল তীর্থ হতে প্রধান এই তীর্থ  শিবতীর্থ নামে  নামে খ্যাত হবে। শিবশব্দার্থজ্ঞ পণ্ডিতগণ শিব শব্দের অর্থ 'জ্ঞান' বলে অভিহিত করে থাকেন। এই তীর্থে সেই জ্ঞান আমার মহিমাবলে জলের মধ্যে দ্রবীভূত রয়েছে। অতএব এই তীর্থ 'জ্ঞানোদ' নামে ত্রিলোকের মধ্যে বিখ্যাত হবে। এই কুণ্ডতীর্থের দর্শনে সর্বপাপ মোচন হয়ে যায়। স্পর্শনে অশ্বমেধের ফল লাভ হয়। এবং আচমন ও পানে রাজসুয় ও অশ্বমেধের ফলপ্রাপ্তি হবে। ফল্গুতীর্থে স্নান ও পিতৃলোকের তর্পণ করে মনুষ্যের যে ফল লাভ হয়, এই তীর্থে শ্রাদ্ধ করলে, সে সকল ফলই লাভ  হবে। বৃহস্পতিবার  পুষ্যানক্ষত্রযুক্ত শুক্লপক্ষীয় অষ্টমীতে ব্যতীপাতযোগ হলে কেউ এই কুণ্ডতীর্থে শ্রাদ্ধ করে, তবে গয়াশ্রাদ্ধ অপেক্ষা তাঁর কোটিগুণ ফল লাভ হবে। পুষ্করতীর্থে পিতৃতর্পণে যে পুণ্য, এই তীর্থে তিলতর্পণে তা অপেক্ষা কোটিগুণ পুণ্য লাভ হবে। কুরুক্ষেত্রে রামহ্রদে সূর্যগ্রহণকালে পিণ্ডদানে যে ফল হয়, এই তীর্থে প্রতাহ সেই ফল লাভ হবে। যাঁদের পুত্র এই স্থানে পিণ্ডদান করবে, তাঁরা  প্রলয়কাল যাবৎ শিবলোকে বাস করবে। অষ্টমী ও চতুৰ্দ্দশীতে উপবাস করে এই তীর্থে প্রাতঃস্নান ও এর জলপান করলে, মনুষ্যের হৃদয় দ্রুতই  শিবময় হয়ে যাবে । একাদশীতে উপবাস করে এর তিন গণ্ডুষ বা হাতের তিন কোষ জল যে পান করে, নিশ্চিতভাবে তাঁর  হৃদয়ে শিবলিঙ্গত্রয় উৎপন্ন হবে। বিশেষ করে  সোমবারে যে ব্যক্তি এই শিবতীর্থে স্নান এবং ঋষি, দেব ও পিতৃতর্পণ করে যথাসম্ভব দান করে ষোড়শোপচারে বিশ্বেশ্বর শিবের পূজা করে, তাঁর মনোরথ দ্রুতই পূর্ণ হয়। ত্রিসন্ধ্যাকালে সন্ধ্যা না করলে যে পাপ হয়, এ তীর্থে সন্ধ্যোপাসনা করলে, সেই পাপ থেকে তৎক্ষণাৎ মুক্ত হওয়া যায়। এ তীর্থে এসে নিষ্ঠাবান  দ্বিজগণ জ্ঞানলাভ করবে। এর নাম 'শিবতীর্থ', 'জ্ঞানতীর্থ', 'তারকতীর্থ' এবং নিঃসন্দেহে জীবের অত্যন্ত মোক্ষপ্রদ 'মোক্ষতীর্থ'। এ তীর্থকে মনেমনে স্মরণ করলেও জীবের পাপরাশি বিনষ্ট হয়ে যায়। এর দর্শন, স্পর্শন, জলপান ও এতে স্নান করলে মনুষ্য চতুৰ্বর্গ ফল প্রাপ্ত হয়। এর জল দর্শনে ডাকিনী, শাকিনী, ভূত, প্রেত, বেতাল, রাক্ষস, গ্রহ, কুষ্মাণ্ড, খেটিঙ্গ, কালকর্ণী, বালগ্রহ, জ্বর, অপস্মার, বিস্ফোট প্রভৃতি সমূদয় থেকে কোন বিপদের আশঙ্কা থাকে না। যে ব্যক্তি এই তীর্থের জল দ্বারা শিবলিঙ্গকে স্নান করায়, তাঁর সৰ্বতীর্থজল দ্বারা স্নান করানোর পুণ্যফল লাভ হয়। জ্ঞানরূপী হয়ে জ্ঞানমূর্তিতে এই জ্ঞানবাপীতে আমি দ্রবমূর্তি বা জলমূর্তি ধারণ করে জীবের সকল জড়তা বিনাশ করে  জ্ঞান উপদেশ প্রদান করব। ভগবান্ শিব ঈশানকে এমন বর প্রদান করে অন্তর্হিত হয়ে গেলেন। শিবভক্ত ত্রিশুলধারী জটিল নামক ঈশানও শিবদর্শনে নিজেকে কৃতার্থ বোধ করলেন। তিনি পরম পবিত্র জ্ঞানবাপীর পরম পবিত্র  জল পান করে পরমজ্ঞান লাভ করলেন।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়



Share:

১০ জানুয়ারী ২০২৩

হিন্দুরা কি সত্যিই বিজ্ঞানমনস্ক?

 আমরা কি সত্যই বিজ্ঞানমনস্ক?

পৃথিবীতে ধর্ম একটাই আর সেটি হল সনাতনী হিন্দু ধর্ম, বাকিগুলো মনুষ্য প্রচারিত বিশেষ উপাসনা পদ্ধতি বা ধর্মমত। আমরা অনেকসময়ই এই ধর্ম আর ধর্মমত শব্দদুটি নিয়ে বিভ্রান্ত হই। আমরা লক্ষ্য করলে দেখব, বিশেষ মনুষ্য প্রচারিত 'ধর্মমত'-এর ক্ষেত্রে ঐ বিশেষ মানুষকে 'পূজা' করা হয় বা বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। হিন্দু ধর্মে কিন্তু তা হয় না। যদি আপনি 'গুরুদেব'-এর বিষয়ে এমন বলেন তে আমি বলব যে, শাস্ত্রে কিন্তু গুরুদেবকে 'শিব' জ্ঞানে ধারণা করতে ও মেনে চলতে বলা হয়েছে। সারা পৃথিবীতে মানুষ যখন সভ্য হতে শিখল, গুহা ছেড়ে বাড়ীঘর বানিয়ে বাস করতে শুরু করল বা গাছের ছাল-পাতা দিয়ে লজ্জা নিবারণ না করে কাপড় পরতে শিখল, তার বহু আগেই সনাতনী মানুষ বর্ণলিপি তৈরী করল ও ধর্মগ্রন্থ 'বেদ' রচনা করল। তাই, সনাতনী হিন্দুধর্মের অনুসরণ সকল ধর্মমতই করে থাকে। আসুন, সনাতনী হিন্দুধর্মের বিজ্ঞানসম্মত কিছু আবিস্কার সম্পর্কে জেনে নিই।

=> হিন্দু ধর্ম যখন বলে সৃষ্টি শুরু হয়েছিল জলে -- তখন তা আমরা বিশ্বাস করি না অথচ জড় বিজ্ঞান যখন বলে, কিন্তু পৃথিবীর বুকে প্রথম প্রাণসৃষ্টি হয়েছিল জলে -- তখন তা আমরা বিশ্বাস করি।

-

=> হিন্দু ধর্ম যখন মৎস > কূর্ম > বরাহ > নৃসিংহেরকথা বলে -- তখন তা আমরা বিশ্বাস করি না অথচ জড় বিজ্ঞান যখন বলে, পৃথিবীতে প্রাণী জগতের বিবর্তন হয়েছে জলজ প্রাণী > উভচর > স্থলজ >চতুষ্পদ তৃণভোজী > মাংশাসী > দ্বিপদী প্রাণীতে -- তখন তা আমরা বিশ্বাস করি।



=> হিন্দু ধর্ম যখন দেখায়, শিবের কপালে তৃতীয় নয়ন আছে -- তখন তা আমরা বিশ্বাস করি না অথচ জড় বিজ্ঞান যখন দেখায়, মানুষের মস্তিষ্কে দুটি চোখের মাঝখান বরাবর পিছন দিকে পিনিয়াল নামক এক গ্রন্থি আছে যা আমাদের ইনটিউশনের সহায়ক -- তখন তা আমরা বিশ্বাস করি।

-

=> হিন্দু ধর্ম যখন গণেশের কাটা মাথা জোড়া দেওয়ার কাহিনী বলে -- তখন তা আমরা বিশ্বাস করি না অথচ জড় বিজ্ঞান যখন অর্গ্যান ট্রান্সপ্ল্যান্ট, সার্জারির কথা বলে -- তখন তা আপনি বিশ্বাস করেন। 


=> হিন্দু ধর্ম যখন আপনাকে ব্রহ্মাস্ত্র, পাশুপাতাস্ত্রের মত ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের কথা বলে -- তখন তা আমরা বিশ্বাস করি না কিন্তু বিজ্ঞান যখন অ্যাটমিক ওয়েপন, নিউক্লিয়ার ওয়েপন নামক ভয়ঙ্কর অস্ত্রের কথা বলে -- তখন তা আমরা বিশ্বাস করি। 

-

হায়রে আমাদের সমাজ, মানুষ সেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন আদিম যুগেই পড়ে রয়েছে, এদের জীবনে এখনও সনাতন নামক বিজ্ঞানের ছোঁয়া লাগেনি -- হয় এরা প্রত্যেকই ভাবের ঘরে চুরি করে 'প্রগতিশীল' সাজে অথবা সত্যিই অজ্ঞান। 

তাই 'প্রগতিশীল' সেকু, ফেকু, মাকু ও কাটা নেড়েদের বলছি -- পাঁচ হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতার আস্তে আস্তে সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে ভারতের শিক্ষার যে বিরাট ব্যাপ্তি, যার ৯৯%  আজকের প্রজন্ম যে জানে না তার জন্য আপনারা কি করেছেন?

জেনে নিন --

১. জ্যোতির্বিদ্যার জনক -- আর্যভট্ট; অবদান-  আর্যভট্টিয়াম

২. জ্যোতিষের জনক -- বরাহমিহির, অবদান- পঞ্চসিদ্ধান্তিকা, বৃহৎসংহিতা 

৩. অস্ত্রোপচারের জনক --  সুশ্রুত, অবদান:  সুশ্রুতসংহিতা

৪. যোগের জনক -- পতঞ্জলি, অবদান: যোগসুত্র

৫. অর্থনীতির জনক -- চাণক্য, অবদান: অর্থশাস্ত্র

৬. কূটনীতির /রাজনীতির জনক -- চাণক্য, অবদান: চানক্যনীতি 

৭. পরমাণু তত্ত্বের জনক -- ঋষি কনাদ্ , অবদান- পদার্থবিদ্যা 

৮. চিকিৎসাশাস্ত্রের  জনক -- ধন্বান্তরি, প্রথম আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ব্যাখ্যা করেন 

৯.ব্যাকরণের পিতা -- পানিনি, কাজ: অষ্টাধয়ী, পানিনি ব্যাকরণ

১০.কাব্যর জনক (সাহিত্য) -- কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন (বেদব্যাস) অবদান:- মহাভারত, 

১১. নাট্য (Play writing) রচনার জনক -- কালিদাস, অবদান:- মেঘধূতম, রঘুবংশম, কুমার সম্ভব প্রভৃতি।

১২. গণিতের পিতা -- দ্বিতীয় ভাস্কর, অবদান:- লীলাবতী।

১৩. নীতি গল্প লেখার জনক -- বিষ্ণু শর্মা, রচনা:- পঞ্চতন্ত্র

১৪. কামশাস্ত্র শিক্ষার  জনক -- বাৎসায়ণ, অবদান:- কামসূত্র।

১৫. আলকেমির জনক -- নাগার্জুন, রচনা: প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র।

উপরের তালিকাটা কেবলমাত্র একটা হিমশৈলের  চূড়া। আসুন আমাদের পূর্বপুরুষেরা যা করেছে তা বিশ্বকে ভাগ করে নেওয়ার এবং শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে গর্ব বোধ করি। তবুও আমাদের পূর্বপুরুষরা তাদের বিনীত "নমস্তে" নিয়ে বিশ্বের কাছে মাথা নত করেছিলেন। গর্ব করে বলুন -- 'আমি হিন্দু'। মনে রাখবেন, 'ধর্মনিরপেক্ষ' আর 'সর্বধর্মসমন্বয়' বলে কিছু হয় না। অহেতুক অসাধু রাজনৈতিক নেতানেত্রী, বুদ্ধিজীবীদের ছলনায় ভুলবেন না।

লেখকঃ শ্রী পৃথ্বীষ ঘোষ

Share:

০৮ মে ২০২২

ভক্তি-পথ

চতুর্বিধ যোগসাধনার অন্যতম ভক্তি। বর্তমানে 'ভক্তি' কিংবা 'ভক্ত' শব্দটির কিছুটা ভুল অর্থে প্রয়োগ আমরা শুনতে পাই। যেমন কোনও মঠ বা মন্দিরে সমাগত সকল দর্শনার্থীদেরকে একসঙ্গে বিশেষায়িত করতে 'ভক্ত' শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়, কিংবা 'সাধু ও ভক্ত' বলে দুটি পৃথক শ্রেণির উল্লেখ করা হয়, গেরুয়া পরলে তিনি সাধু, আর সাধারণ জামা-প্যান্ট পরলে তিনি ভক্ত।

যেন সাধু ও ভক্ত আলাদা দুটি গোষ্ঠী। যেন সাধু যিনি তিনি ভক্তগোষ্ঠীর নন আবার গেরুয়া না পরলে তিনি যেন 'সাধু' বা সাধক নন।

ঠাকুর-স্বামীজির অনুধ্যানে আমাদের মনে হয়েছে 'ভক্তি' ও 'ভক্ত' শব্দের এহেন প্রয়োগ বিভ্রান্তিকর।

ভক্তি একটি আধ্যাত্মিক সাধন-পথ। যিনি ভক্ত তিনি অবশ্যই সাধক বা সাধু। সুতরাং ভক্ত ও সাধু আলাদা লাইনে দাঁড়ানো 'পৃথক শ্রেণি' নয়।

অধ্যাত্ম-সাধনপথ বা যোগ চারপ্রকার :

জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, রাজযোগ এবং ভক্তিযোগ। সাধক তাঁর ক্ষমতা ও রুচি অনুযায়ী এই চারটি পথের এক বা একাধিক পথে সাধনা করতে পারেন। তবে এগুলির মধ্যে ভক্তিযোগ সহজতম ও মধুরতম পন্থা।

স্বামী বিবেকানন্দের মতে ভক্তিযোগে ভক্তিই একাধারে উদ্দেশ্য এবং উপায় দুইই। অপরপক্ষে অন্যান্য যোগের পদ্ধতিগুলি শুধু উপায়মাত্র, উদ্দেশ্য নয়।

অর্থাৎ ভক্তিযোগে সাধক চান ইষ্টের প্রতি নিবিড় ভক্তি। আবার এই ভক্তিলাভের উপায়ও ভক্তি

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ শেখান, 'ভক্তিকামনা কামনার মধ্যে নয়।'

অর্থাৎ অন্য কামনায় মানুষের বদ্ধতা বাড়ে, মানুষ জাগতিক মোহের জালে ছটফট করে; কিন্তু 'ভক্তি-কামনা কামনার মধ্যে নয়', কারণ এই কামনার তীব্রতায় মানুষের স্বরূপের জাগতিক আচ্ছাদন ক্ষীয়মাণ হয়।

ভক্তি খুব মন্থর পদ্ধতি কিন্তু ভক্তি থেকে উৎপন্ন আনন্দ সাধককে সাধনার মধ্যে ডুবিয়ে রাখে, তাই এক্ষেত্রে সাধককে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বা কষ্ট করে সাধনা করতে হয়না।

সাধনার আনন্দই নেশার মত সাধককে সাধনায় ডুবিয়ে রাখে।

ভক্তিপথে জোর করে ইন্দ্রিয়দমন করতে হয়না। কারণ ভক্তের জাগতিক উদ্দীপনাগুলির অভিমুখ ঈশ্বরের দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় ভক্তিযোগে।

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষা দেন কামকে ঈশ্বরীয় প্রেমে পরিণত করতে, ক্রোধকে আধ্যাত্মিক তেজে পরিণত করতে।

ভক্তরাজ প্রহ্লাদ প্রার্থনা করছেন, 'হে প্রভু বিষয়ী লোকের যেমন জাগতিক ভোগ্যবিষয়ে তীব্র আসক্তি, তোমার প্রতি আমার সেইরূপ আসক্তি দাও।'

- এই হল ভক্তের প্রার্থনা।

ভক্ত আসক্তি ত্যাগ করেননা, শুধু সেই আসক্তিকে ঈশ্বরের অভিমুখী করে দেন।

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন :

'এমনি মিষ্টি খেলে অসুখ হয়, কিন্তু মিছরির মিষ্টি মিষ্টির মধ্যে নয়।'

ঠিক তেমনই কামনা-বাসনা ঈশ্বরীয় পথের প্রতিবন্ধক, কিন্তু 'ভক্তি-কামনা' কামনার মধ্যে নয়।

ভক্তিপথে জাগতিক আসক্তিকে ঈশ্বরীয় প্রেমে রূপান্তরিত করতে হয়। ঈশ্বরে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ভয়মুক্ত হতে হয়।

শ্রীম (মহেন্দ্র নাথ গুপ্ত) বলতেন, 'সর্বদা বাপ-মা ওয়ালা ছেলের মতো নির্ভয়ে থাকো।'

এভাবেই ভক্ত ঈশ্বরে শরণাগতির মাধ্যমে জাগতিক ভয় ও দুশ্চিন্তার ঊর্ধ্বে এক আনন্দঘন জগতে বিরাজ করেন।

অর্থাৎ সর্বদা সর্বভাবে ঈশ্বরের সাথে যুক্ত থাকাই ভক্তিপথের সাধনা।

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ শেখাচ্ছেন, একটি পাত্র থেকে আরেকটি পাত্রে তেল ঢাললে যেমন নিরবচ্ছিন্নভাবে তেলের ধারা পতিত হয় , তেমনি নিরবচ্ছিন্নভাবে ঈশ্বরের স্মরণ-মনন করতে হয়। খুব সহজ উপমা দিয়ে তিনি বোঝাচ্ছেন : যেমন যার দাঁতে ব্যাথা হয়েছে সে সব কাজ করে, সবার সাথে কথা বলে; কিন্তু মনটি সর্বক্ষণ ওই ব্যাথার দিকে পড়ে থাকে। ঠিক তেমনি সব অবস্থায় ভক্ত নিজেকে ঈশ্বরের সাথে যুক্ত রাখেন।

সর্বদা ইষ্টের স্মরণ ভক্তের স্বাভাবিক অবস্থা। কোনও প্রিয় মানুষের বিচ্ছেদে যেমন সর্বদাই সেই মানুষটিকে মনে পড়ে, ঠিক তেমনই ভক্ত সর্বদা ইষ্টস্মরণে নিয়োজিত না থেকে পারেন না। তিনি সংসারে থাকেন, সব কাজ করেন কিন্তু অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো প্রিয়তমের রূপ ও তাঁর নাম সর্বদাই স্মরণপথে উদিত হয়।

স্বাভাবিক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো ইষ্টমন্ত্র তাঁর মনে উচ্চারিত হয়ে চলে। ডুবন্ত ব্যক্তি যেমন প্রাণপণে কোনও অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করে, ভক্তও তেমনি ইষ্টের নাম ও রূপকে আঁকড়ে ধরে জীবনযাপন করেন।

ক্রমে তাঁর নিজের সকল জাগতিক সত্তা-বোধ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে, কেবল 'আমি ঈশ্বরের অংশ, আমি তাঁর' এই পরিচয়টুকুই অবশিষ্ট থাকে।

এই হ'ল ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণকথিত

'ভক্তের আমি'।

প্রাচীন ভারতে নারদ নামে একজন ঋষি ছিলেন। মহর্ষি নারদ 'ভক্তিসূত্রম্' নামক আধ্যাত্মিক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি তাঁর এই গ্রন্থে লিখেছেন :

'নারদস্তু তদর্পিতাখিলাচারতা

তদ্বিস্মরণে পরমব্যাকুলতেতি।'

অর্থাৎ ঋষি নারদের মতে সকল কর্ম ঈশ্বরে অর্পণ করা এবং ঈশ্বরের সামান্যতম বিস্মরণেও তীব্র ব্যাকুলতার উদ্ভব

-- এই অবস্থা লাভই 'ভক্তি'।

ভক্তি ত্রিমাত্রিক। এর প্রথম মাত্রা হ'ল :

ঈশ্বরের প্রতি ভয়হীনতা। ভয় যেখানে, ভালোবাসা সেখানে থাকেনা।

দ্বিতীয় মাত্রা :

'নিষ্ঠা', অর্থাৎ এককেন্দ্রিকতা। মহাবীর হনুমানের উক্তি : 'শ্রীনাথে জানকিনাথে অভেদ পরমাত্মনি, তথাপি মম সর্বস্ব রাম: কমললোচন।' অর্থাৎ 'আমি জানি শ্রীনাথ বা লক্ষ্মীপতি নারায়ণ এবং জানকিনাথ বা রামচন্দ্র এঁরা পারমার্থিক ভাবে অভেদ, তথাপি সেই কমললোচন রামই আমার সর্বস্ব।'

-- এই হল নিষ্ঠা। একে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন 'অব্যভিচারিণী ভক্তি'।

তৃতীয় মাত্রা : 'প্রত্যাশাহীনতা'। প্রকৃত ভক্ত কখনো বলেননা, 'এত পুজো, জপ করলাম তবু আমার কী হ'ল!' ভক্ত ভালোবাসার জন্যই ভালোবাসেন।

না ভালোবেসে থাকতে পারেননা, তাই ভালোবাসেন। বিনিময়ে কোনও প্রত্যাশা করেননা। একে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন 'অহৈতুকী ভক্তি'।


✍️ লেখক : তাপস কুমার ঘোষ

Share:

দেবী গঙ্গা

স্বামী বিবেকানন্দ তখন ব্রিটেনে। তাঁর এক ব্রিটিশ অনুগামী স্বামীজিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'স্বামীজি, কোন নদীর জল আপনার সবচেয়ে বেশি পছন্দ?'

স্বামীজি ওই ব্যক্তির দিকে ফিরে উত্তর দিলেন,

'টেমস নদীর জল।'

টেমস হল ব্রিটেনের একটি বিখ্যাত নদী। ওই ব্যক্তি বললেন,

 'স্বামীজি, আমরা তো ভেবেছিলাম আপনি বলবেন - গঙ্গা নদীর জল।' স্বামীজি বললেন,

 'গঙ্গায় জল কোথায়! ও তো অমৃত। জলের সাথে কি তার তুলনা হয়?'

গঙ্গার উৎসস্থল গঙ্গোত্রী ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের উত্তরকাশী জেলাতে অবস্থিত। এটি ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। এই স্থান হিমাদ্রি হিমালয়ে ৩,১০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। গঙ্গোত্রীর নিকট গোমুখে গঙ্গার উৎস। এটি গঙ্গোত্রী শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে গঙ্গোত্রী হিমবাহের উপর অবস্থিত। এখানে দেবী গঙ্গার মন্দির আছে।

পুরাণ অনুসারে, রাজা ভগীরথের পূর্বপুরুষের পাপস্খালনের জন্য গঙ্গা অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁর অবতরণের আগে রাজা ভগীরথ এখানে অনেকদিন তপস্যা করেছিলেন। এখানে ভগীরথ শিলা আজও রয়েছে, যেখানে রাজা ভগীরথ ভগবান শিবের তপস্যা করেছিলেন।


 

গঙ্গোত্রী থেকে ১.৫ কিমি দুরত্বে রয়েছে পঞ্চ-পাণ্ডবের স্মৃতি বিজড়িত পাণ্ডব-গুহা। মহাভারত অনুসারে এখানে পাণ্ডবরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। 

গঙ্গোত্রী ছোট চার ধাম তীর্থ-চতুষ্টয়ের একটি। এখানে গঙ্গা নদীর নাম ভাগীরথী নদী। গঙ্গোত্রী থেকে দেবপ্রয়াগ পর্যন্ত গঙ্গা ভাগীরথী নামে প্রবাহিত, তারপর অলকানন্দা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে গঙ্গা নাম ধারণ।  

গঙ্গা সনাতন হিন্দু-ধর্মে পূজিতা হন দেবীরূপে। মনে করা হয় যে ভগবান শ্রীহরিই গঙ্গারূপে আবির্ভূত হয়েছেন। বেদান্তে বলা হয়েছে 'সর্বং খলু ইদং ব্রহ্ম।' কিন্তু সব কিছুতেই ব্রহ্মের প্রকাশ হলেও কোনও কোনও বস্তুতে তাঁর বিশেষ প্রকাশ। গঙ্গা-জলেও ব্রহ্মের বিশেষ প্রকাশ। তাই গঙ্গা-জল ভারতে অত্যন্ত পবিত্র বস্তুরূপে গণ্য হয়। গঙ্গাজলের বিশেষত্ব হল যে এই জল দীর্ঘদিন ধরে জমিয়ে রাখলেও নষ্ট হয়না। এর নিশ্চয় কোনও বৈজ্ঞানিক কারণ আছে, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস গঙ্গাজল চির পবিত্র। এই জলের ছোঁয়ায় তাই আমাদের দেহ-মন শুদ্ধ হয়। ভারতীয় সনাতন ধর্মের সাধকগণ গঙ্গা-স্নান, গঙ্গা-দর্শন এগুলোর মধ্যে দিয়ে অনাবিল শান্তি ও শুদ্ধতা অনুভব করেন। 

মহাভারতে পাই, মহর্ষি পুলস্ত্য কুরুপিতামহ ভীষ্মকে বলছেন- 'গঙ্গে' 'গঙ্গে'  এরূপ নাম স্মরণে সকল পাপ খণ্ডিত হয়, গঙ্গা দর্শনে মঙ্গল প্রাপ্তি ঘটে। গঙ্গাবারি পানে কূল ধন্য হয়।  মহর্ষি পুলস্ত্য আরও বলেছেন,  'যেথায় গঙ্গা আছে সেটাই দেশ, গঙ্গা তীরের   তপোবন সিদ্ধভূমি।'


© লেখক : তাপস কুমার ঘোষ 

Share:

০৫ মে ২০২২

রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়

 রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়

(১৮৮৫ সালের ১২ এপ্রিল - ১৯৩০ সালের ২৩ মে)

ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও লিপিবিশারদ রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার মুর্শিদাবাদের বাহরামপুরে ১৮৮৫ সালের ১২ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তাকে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের অগ্রনায়ক হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কারক হিসাবে বেশি পরিচিত।

তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের মহেঞ্জোদারো সভ্যতা ও হরপ্পা সভ্যতার প্রধান স্থানগুলো আবিষ্কার করেন। এ সভ্যতার বিশদ ব্যাখ্যা করে কয়েকটি প্রবন্ধ ও বই লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে- ‘অ্যান ইন্ডিয়ান সিটি ফাইভ থাউজেন্ড ইয়ার্স এগো’ (১৯২৮), ‘মোহেন-জোদারো’, ‘প্রিহিস্ট্রিক, অ্যানসিয়েন্ট অ্যান্ড হিন্দু ইন্ডিয়া’ (১৯৩৪) এবং ‘মহেঞ্জোদারো- এ ফরগোটেন রিপোর্ট’ (১৯৮৪)। ‘দ্য অরিজিন অব দ্য বেঙ্গলি স্ক্রিপ্ট’ (১৯১৯) বইয়ের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবিলি রিসার্চ প্রাইজ লাভ করেন। তিনিই প্রথমবারের মতো বাংলা লিপির মুল উৎস প্রোটো-বাংলা লিপি নিয়ে কাজ করেন। তার ধ্রুপদী কাজের মধ্যে রয়েছে মধ্যযুগীর ভারতের মুদ্রা এবং ভারতের মূর্তিশিল্প বিশেষ করে গুপ্ত ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের ওপর গবেষণা। তার সবচেয়ে বিখ্যাত বই ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত ‘ইস্টার্ন ইন্ডিয়ান মিডায়েভ্যাল স্কুল অব স্কালর্চার’।


তিনি ‘হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ (১৯২৪) ও ‘এ জুনিয়র হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ (১৯২৮) নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দুটি পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন। ১৯২৪ সালে দেওয়া বক্তৃতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘দ্য এজ অব দ্য ইম্পেরিয়াল গুপ্তস’ (১৯৩৩)। দুই খণ্ডে লিখেছেন ‘বাংলার ইতিহাস’ (১৯১৪ ও ১৯১৭)। এটি বাংলা ইতিহাস নিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লেখা প্রথম দিকের কাজগুলোর একটি। দুই খণ্ডে লিখেছেন ‘হিস্ট্রি অব উড়িষ্যা : ফ্রম দ্য আর্লিয়েস্ট টাইমস টু দ্য ব্রিটিশ পিরিয়ড’ (১৯৩০ ও ১৯৩১)। গবেষণামুলক আরও কিছু বই হলো- ‘প্রাচীন মুদ্রা’ (১৯১৫), ‘দ্য পালাস অব বেঙ্গল’ (১৯১৫), ‘দ্য টেম্পল অব দ্য শিবা অ্যাট ভূমারা’ (১৯২৪), ‘দ্য পালিওগ্রাফি অব হাতি গুম্পা অ্যান্ড নানাঘাট ইন্সক্রিপ্টশনস’ (১৯২৪), ‘বাস রিলিফস অব বাদামি’ (১৯২৮) এবং ‘দ্য হায়হাইয়াস অব ত্রিপুরা অ্যান্ড দেয়ার মনুমেন্টস’ (১৯৩১)। এ ছাড়া তিনি কিছু উপন্যাস লিখেছেন। এর মধ্যে কিছু উপন্যাস ইতিহাস আশ্রয়ী।

রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় ১৯৩০ সালের ২৩ মে মৃত্যুবরণ করেন।


Written by: Prithwish Ghosh

Share:

নীল ষষ্ঠী, জেনে নিন, কেন এই দিন পালনের রীতি রয়েছে মহিলাদের মধ্যে।

 “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে” -- সন্তানের মঙ্গলকামনা করে শিবের কাছে ব্রত করার উৎসবই নীল ষষ্ঠী। বারো মাসে তেরো পার্বণে অভ্যস্ত বাঙালির কাছে কৌলিন্যের আদরে এই ব্রতের ভূমিকা কিছুটা হারালেও, গ্রাম বাংলায় এখনও বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই নীল ষষ্ঠী পালনের রেওয়াজ রয়েছে। অথচ আগেকার দিনে কত ব্রতই না পালিত হত বাংলায়! অশোক ষষ্ঠী ব্রত, আদর সিংহাসন ব্রত, আদা-হলুদ ব্রত, ইতু ব্রত, কালকুমারি পূজা ব্রত, কুলুই পূজা ব্রত, তুষ তুলসী ব্রত, দশ পুতুল ব্রত, পুন্যিপুকুর ব্রত, বানব্রতের উৎসব ব্রত, মাঘ মন্ডল ব্রত, মেছেনী ব্রত, মেঘারানীর ব্রত, যমপুকুর ব্রত, ষষ্ঠী ব্রত, সবুজ পাতার ব্রত, সাবিত্রী ব্রত, সেঁজুতি ব্রত, হরিচরণ ব্রত, হেলেনা ব্রত, অরন্য ষষ্ঠী ব্রত, নীল ষষ্ঠী ব্রত, পাটাই ষষ্ঠী ব্রত, দুর্গা ষষ্ঠী ব্রত, রাধাষ্ঠমী ব্রত, জন্মাষ্ঠমী ব্রত, অক্ষয় তৃতীয়া ব্রত, জিতাষ্টমী ব্রত, পৃথিবী ব্রত, চাঁপাচন্দন ব্রত, নখ ছুটের ব্রত, সুবচনী ব্রত, বসন্তবুড়ী ব্রত, মাকাল ব্রত, ওলাই চন্ডী ব্রত, মঙ্গল চন্ডী ব্রত, নাগপঞ্চমী ব্রত, মধুসংক্রান্তি ব্রত, বিবিঞ্চি ব্রত, ডেঁপু ব্রত, কার্তিক ব্রত, কুলকুলাতি ব্রত, গাড়ু ব্রত, গিন্নিপালন ব্রত, গোকুল ব্রত, ঘাঁটো ব্রত, জামাই ষষ্ঠী ব্রত, বিপত্তারিনী ব্রত, রাম নবমী ব্রত, শনি দেবের ব্রত, সত্যনারায়ণ ব্রত, জয় মঙ্গলবার ব্রত, শিবরাত্রির ব্রত, সন্তেষীমার ব্রত, বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুজার ব্রত, শীতলা ষষ্ঠী ব্রত --- আমার ছোটবেলায় এ'রকম অনেক ব্রত উদযাপন করতে দেখেছি। তবে, আধুনিক কালে আর দেখি না। আর এই চৈত্র মাসের এই ব্রতকে অনেকে নীল পুজোও বলে থাকেন। নীলপূজা পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, হুগলী, বর্ধমান, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, হাওড়া, বাংলাদেশ এবং ত্রিপুরায় বাঙালি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়। নদিয়া জেলার নবদ্বীপের গাজন উৎসবের একটি অংশ হিসাবে বাসন্তী পুজোর দশমীর ভোরে শিবের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।


অশোকষষ্ঠী বা বাসন্তীদুর্গাপুজো হয় চৈত্রমাসের শুক্লাতিথিতে। তবে মহাদেবের নীলের পুজোর দিনটা বরাদ্দ চড়ক বা গাজনের দিনক্ষণ অনুযায়ী, বর্ষশেষের সংক্রান্তির আগের দিনে। সনাতন হিন্দু ধর্মে এই উৎসবকে শিব-দুর্গার বিয়ে নামেও অভিহিত করা হয়।


নীল বা নীলকণ্ঠ মহাদেব শিবের অপর নাম। সেই নীল বা শিবের সাথে নীলচণ্ডিকা বা নীলাবতী পরমেশ্বরীর বিয়েই নীল-পুজো। গ্রাম বাংলায় এখনও শিব-দুর্গা সেজে নীলের গান বা অষ্টক গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করতে দেখা যায় নীলসন্ন্যাসীদের। অনেকে আার নিম বা বেল কাঠ দিয়ে তৈরি করেন নীলের মূর্তি। সেই মূর্তি সাজিয়ে শুরু হয় উৎসব। পরনে লাল বা গেরুয়া কাপড়, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে ত্রিশূল নিয়ে ব্রত রাখা নীলসন্ন্যাসীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। তাঁদের সঙ্গ দেন শিব-দুর্গা বেশের সঙেরা। গৃহস্থ মহিলারা বা গর্ভবতী মহিলারা এই নীলের মিছিল দেখলেই তাঁদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে আনেন। নীলের মাথায় তেল-সিঁদুর লেপে শুরু হয় পুজো। তারপরই নীলের গানে মেতে ওঠেন সকল নীলসন্ন্যাসীরা --


"শুন সবে মন দিয়ে হইবে শিবের বিয়ে

কৈলাসেতে হবে অধিবাস।

(ও) তাতে নারদ করে আনাগোনা

কৈলাসে বিয়ার ঘটনা

বাজে কাঁসী বাঁশী, মোহন বাঁশরী।"

"(ও) নারদ চলল গিরি রাজের গৃহেতে।।


আর একদিনেতে শূলপাণি,

নারদকে বলেন বাণী

শুনো নারদ শুনো আমার সাধ,

আমি দুই পাশে দুই বালিশ দিয়ে,

মধ্যিখানে থাকি শুয়ে

উশিপুসি করে কাটাই রাত।।

(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।


আর ওই শিব কয় কৈলাসে যেয়ে,

দেখে এসেছি মেয়ে

শীঘ্র করো বিয়ের আয়োজন,

(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।


চলিলেন নারদ মুনি, চলিলেন নারদ ধনি

উপনীত গিরি পুরে যেয়ে।

কইলেন মেনকা রানী, আইলেন নারদ মুনি

দেখা পেয়ে এল মুনির ঠাঁই।।

(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।


শোনো ওগো গিরি রাজা, হইবা আমার আজা

জামাই তোমার হবে দিগম্বর।।"


বিয়ের ঘটক ভাগিনেয় নারদ মুনির কাছে শিব আর্তি জানান,


"ভাইগনা যদি উপকারী হও।

তবে বিয়া দিয়া আমার প্রাণ বাঁচাও।।"


--- এমন নানা গান এখনও নীল-ষষ্ঠীর দিন শোনা যায় গ্রাম বাংলায়।


এই নীল ষষ্ঠী নিয়ে ব্রতকথাও রয়েছে। কাহিনী বহু কাল আগের। এক স্থানে বাস করত এক ব্রাহ্মণ আর এক ব্রাহ্মণী। তাঁদের সন্তান ভাগ্য ছিল খুব খারাপ। ছেলেমেয়ে জন্মালেই মারা যেত। অনেক বার- অনেক ব্রত করেও কোনও ফল না হওয়ায় তারা ঠিক করলো সব ছেড়ে কাশী চলে যাবে।


একদিন নানা তীর্থ ঘুরতে ঘুরতে কাশীর গঙ্গা ঘাটে বসে তাঁরা দু’জনে যখন বিলাপ করছে, তখন মা ষষ্ঠী বৃদ্ধার বেশে এসে তাঁদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘হ্যাঁ গা, তোরা কাঁদছিস কেন?’ মনের দুঃখে ব্রাহ্মণী জানায়, “আমাদের সব সন্তান মারা গেছে। কেউ বেঁচে নেই। অনেক পুজো করেও ফল মেলেনি। তুমি বলো এখন কী করি?” সব শুনে বৃদ্ধা বলেন, “এ সব হয়েছে তোমাদের অহঙ্কারের জন্য। শুধু বার-ব্রত করলেই হয় না। ভগবানে বিশ্বাস থাকা চাই। মন দিয়ে তাঁকে ডাকতে হবে।’


ব্রাহ্মণী তখন তাঁর পা ধরে বললেন -- “কে তুমি, বল মা।”

বৃদ্ধা বললেন -- “আমিই মা ষষ্ঠী। শোন, এই চৈত্র মাসে সন্ন্যাস করবি এবং সেই সঙ্গে শিবপুজো করবি। সংক্রান্তির আগের দিন উপবাস করে নীলাবতীর পুজো করে নীলকন্ঠ শিবের ঘরে বাতি জ্বেলে দিবি। আর তারপর আমাকে প্রণাম করে জল খাবি। একে বলে নীল ষষ্ঠী।”


মা ষষ্ঠী এই কথা বলেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এর পর দেশে ফিরে ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী নীলের দিন খুব ভক্তি আর নিষ্ঠার সঙ্গে নীলষষ্ঠী ব্রত পালন করেন। তার কিছু দিন পরেই তাঁদের সুন্দর ছেলে জন্মায়। নীল ষষ্ঠী ব্রতের এই মাহাত্ম্য দেখে দেশে দেশে সবাই তখন এই ব্রত পালন করতে আরম্ভ করে।


পূজার রীতি বলতে -- চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিন সারা দিন উপোস করার পর সন্ধ্যাবেলা শিবের মাথায় জল ঢেলে শিবকে প্রণাম করে গর্ভবতী মহিলারা বা মায়েরা। অনেকে নির্জলা থেকেও ব্রত পালন করেন। সন্ধেয় প্রদীপ জ্বালিয়ে শিবের মাথায় জল ঢালার পরেই ব্রত ভঙ্গ হয়। কথায় বলে, নীলের ব্রত নিষ্ঠামতো পালন করলে কোনওদিন সন্তানের অমঙ্গল হয় না। সন্তান দীর্ঘজীবন লাভ করে।


তাই সন্তান লাভ ও সন্তানের মঙ্গল কামনা করে চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন পালন করা হয় নীল ষষ্ঠী। এই দিন মায়েরা সারাদিন ধরে উপোস করে থাকেন। বিকেলে পুজো দিয়ে তবেই কিছু মুখে দেন তাঁরা। বাঙালি গৃহিণীরা নিজের সন্তান এর মঙ্গল কামনায় নীরোগ সুস্থ জীবন কামনা করে নীলষষ্ঠীর ব্রত পালন করেন। আজ ঘরে ঘরে মায়েরা তাঁদের সন্তানদের মঙ্গলকামনায় তাঁরা বলেন --


"নীলের ঘরে দিলাম বাতি,

সাক্ষী থেকো মা ভগবতী।"


ওঁ নমঃ শিবায়,

ওঁ নমঃ চণ্ডিকায়ৈ।


Written by: Prithwish Ghosh

Share:

সাত বারের বার-দেবতা

 একবার তারাপীঠে এক বয়োবৃদ্ধ সাধকের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমার লেখা বই -- 'তান্ত্রিক ও তন্ত্রসাধনা' বইয়ের প্রথম ভাগে বেশ ভালোভাবে উপস্থাপনা করেছি। আমি তাঁর কাছে 'কুলকুণ্ডলিনী' সম্পর্কে জানতে চাইলে বৃদ্ধ সাধক বললেন -- শোন তবে। কুণ্ডলিনী বলতে গেলে আগে হিন্দুর তেত্রিশ কোটি দেবতা নিয়ে বলতে হবে। আমি নয়, ঋকবেদ অনুযায়ী ৩৩ জন দেবতা আছেন কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকের নামের উল্লেখ নেই। শতপথ ব্রাহ্মণে, মহাভারতে, রামায়ণ ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও ৩৩ জন দেবতার কথাই বলা আছে।


আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁকে প্রশ্ন করলাম -- তাহলে প্রশ্ন হল এই ৩৩ জন কী করে তেত্রিশ কোটিতে পরিণত হল, তার সঙ্গত উত্তরই বা কি?


তিনি বললেন -- ঠিক বলেছ তুমি, তবে ৩৩ জন দেবতার কথা ঠিক ভাবে ঋকবেদে উল্লেখ নেই। কিন্তু, শতপথ ব্রাহ্মণে ও মহাভারতে এদের শ্রেণীবিভাগ ও নাম পাওয়া যায়।


শ্রেণীবিভাগটি হল এই রকম ---- ১২ জন আদিত্য (অংশ, ভগ, মিত্র, জলেশ্বর, বরুণ, ধাতা, অর্যমা, জয়ন্ত, ভাস্কর, ত্বষ্টা, পূষা, ইন্দ্র, বিষ্ণু), ১১ জন রুদ্র (অজ, একপদ, অহিব্রধু, পিণাকী, ঋত, পিতৃরূপ, ত্র্যম্বক, বৃষকপি, শম্ভু, হবন, ঈশ্বর) এবং আটজন বসু (ধর, ধ্রুব, সোম, সবিতা, অনিল, অনল, প্রত্যুষ, প্রভাস)।


'আদিত্য', 'রুদ্র' এবং 'বসু' বিশেষ এক দেবতার নাম নয়, দেবতার জাতি বা শ্রেণীবাচক মাত্র। এ ভাবে আমরা ৩১ জন দেবতার হিসেব পাই; ইন্দ্র ও প্রজাপতি এই দুটি নিয়ে মোট ৩৩ জন হয়। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে এঁদের নামোল্লেখ আছে। পৌরাণিক গল্পে ও কথকতায় এরাই তেত্রিশ কোটি হয়েছেন খুব সম্ভবতঃ। এই তেত্রিশ কোটি দেবদেবীই হলেন কুলকুণ্ডলিনীর বা পরমেশ্বরীর বা ঈশ্বরের চালিকাশক্তি।


আমি আগেই বললাম যে হিন্দুধর্মে তেত্রিশ কোটি দেবতা আছেন। কিন্তু, এটা আসলে কতটা ঠিক তা কেউ কখনও যাচাই করেনি। আসলে এটা এতটুকুও যে ভ্রান্ত ধারণা নয়, তার প্রমাণ আপনারা দেখলেন। আসলে এটা সঠিক তথ্য। 'কোটি' শব্দের প্রচলিত অর্থ সংখ্যাসূচক (crore) হলেও সংস্কৃত ভাষায় এর আরেকটি অর্থ হল 'ধরণ' বা 'প্রকার'। তাই তেত্রিশ কোটি দেবতা মানে হল 'তেত্রিশ প্রকার দেবতা'।


তাই হিন্দুধর্মাবলম্বীরা ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপের পূজা করে থাকেন। ঈশ্বরের এই বিভিন্ন রূপগুলিকেই বলা হয় দেবতা -- কারণ এই রূপগুলি হল ঈশ্বরের দিব্য (ধাতু দিব্ ধাতু +ষ্ণ প্রত্যয়) রূপ তাঁর বিভিন্ন গুণাবলী। এই দেবদেবীদের সন্তুষ্ট করার জন্য হিন্দুরা বিশেষ আচার অনুষ্ঠানও পালন করেন।


তবে আপনি কি জানেন যে, হিন্দু পুরাণে সপ্তাহের প্রতিটি দিনও বিভিন্ন ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গ করা হয়? এছাড়া, প্রতিদিন ঈশ্বরের উপাসনা এবং তাদের সন্তুষ্ট করার আলাদা আলাদা আচার, পদ্ধতিও রয়েছে। আসুন, এই বিষয়ে কিছু জেনে নিই।


রবিবার

-------------------

এই দিনটি ভগবান সূর্য-এর প্রতি উৎসর্গিত। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, ভগবান সূর্য একটি মহান গুরুত্ব বহন করে। ভক্তরা বিশ্বাস করে যে, ভগবান সূর্য পৃথিবীতে জীবন, স্বাস্থ্য এবং সমৃদ্ধি দান করেন। এছাড়াও, বিশ্বাস করা হয় যে, সূর্য তাঁর ভক্তদের সুস্বাস্থ্য, ইতিবাচকতা প্রদান করে এবং চর্মরোগ নিরাময় করে।

রবিবার ভগবান সূর্যকে পূজা করার আগে প্রথমে আপনার দেহ এবং আপনার চারপাশের জায়গাটি ভালভাবে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। ঘর পরিষ্কার করার পরে, খুব সকালে স্নান করতে হবে এবং গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার সময় অর্ঘ্য (জল উৎসর্গ) প্রদান করতে হবে। মন্ত্রটি হল - 'ওঁ ভূর্ভুবস্ব তৎসবিতুর্বরেণ্যং ভর্গোদেবস্য ধীমহি ধীয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ'।

ভগবান সূর্যের উপাসনা করার সময়, কপালে কুমকুম ও লাল চন্দন কাঠের মিশ্রিত পেস্ট লাগান। এই দিনে আপনি উপবাসও করতে পারেন। নিয়মের একটা অংশ হিসেবে, আপনি কেবলমাত্র দিনে একবারই খেতে পারেন, তবে সূর্যাস্তের আগে। খেয়াল রাখবেন যাতে খাবারটিতে রসুন, পেঁয়াজ এবং লবণ থাকে না।

শুভ লাল রঙ ভগবান সূর্যের সাথে সংযুক্ত বলে বিশ্বাস করা হয় তাই, সূর্যের উপাসনা করার সময় লাল পোশাক পরতে পারেন। এছাড়া, ভগবান সূর্যকে আপনি লাল রঙের ফুলও দিতে পারেন।


সোমবার

--------------------

এই দিনটি ভগবান শিব-কে উৎসর্গ করা হয়। শিব-কে ভোলেনাথ নামেও ডাকা হয়। এই দিন ভক্তরা শিবের মন্দিরে যান এবং তাঁর উপাসনা করেন। ভগবান শিব এবং দেবী পার্বতী মিলে মহাবিশ্বের সৃষ্টির প্রতিনিধিত্ব করেন। ভগবানকে সন্তুষ্ট করতে ভক্তরা প্রায়ই সোমবার উপবাস পালন করে থাকেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, শিব তাঁর ভক্তদের অনন্ত শান্তি, দীর্ঘজীবন এবং স্বাস্থ্যের আশীর্বাদ করেন।

সোমবার ভগবান শিবের উপাসনা করার জন্য খুব সকালে স্নান সেরে পরিষ্কার সাদা বা হালকা রঙের পোশাক পরুন। গঙ্গাজল এবং ঠান্ডা কাঁচা দুধ দিয়ে শিবলিঙ্গকে স্নান করান। 'ওঁ নমঃ শিবায়' জপ করার সময় শিবলিঙ্গে সাদা চন্দন কাঠের পেস্ট, সাদা ফুল এবং বেল পাতা দিন। ভগবান শিবের বিবিন্ন স্তবস্তোত্রম্ পাঠ করুন। দরিদ্রদের দান করুন -- ভগবান শিব আপনারবপ্তি প্রসন্ন হবেন।

শিব সাদা বর্ণ পছন্দ করেন তাই, আপনি এই দিনে সাদা রঙের পোশাক পরতে পারেন। তবে কালো রঙের পোশাক কখনই পরবেন না কারণ, বিশ্বাস করা হয় যে, ভোলানাথ কালো রঙ পছন্দ করেন না।


মঙ্গলবার

----------------------

এই দিনটি বজরঙ্গবলী হনুমানের প্রতি উৎসর্গিত। দিনটির নামকরণ করা হয়েছে মঙ্গল গ্রহের নামে। হিন্দু পুরাণে, হনুমানকে শিবের অবতার বলে মনে করা হয়। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, ভগবান হনুমান প্রত্যেকের জীবন থেকে বাধা ও ভয় দূর করেন। তাই, ভক্তরা এই দিনে ভগবান হনুমানের উপাসনা করেন এবং উপবাসও করেন।

খুব সকালে স্নান করে পরিষ্কার রক্তবর্ণের পোশাক পরতে হবে। ভগবান সূর্যকে অর্ঘ্য অর্পণ করুন এবং হনুমান চালিশা জপ করুন। হনুমান চালিশা জপ করার সময় লাল ফুল প্রদান করুন এবং প্রদীপ জ্বালান। আপনি হনুমানকে সিঁদুরও দিতে পারেন। এছাড়াও, লাল এবং কমলা রঙের ফুলও দিতে পারেন। হনুমানের মন্ত্র -- 'ওঁম্ হং হনুমতে রুদ্রাত্মকায় হুং ফট্' ১০৮ বা ১০০৮ বার জপ করুন। এবার ১০ বার শ্রীরামচন্দ্রের মন্ত্র -- 'শ্রীরাম জয় রাম জয় জয় রাম' জপ করুন।

লাল রঙ ভগবান হনুমানের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। সুতরাং, লাল রঙের পোশাক পরা এবং লাল রঙের ফুল- ফল দেওয়া আপনার জন্য উপকারি হতে পারে।


বুধবার

-------------

বুধ বালক গ্রহ। বুধ গ্রহ আমাদের বুদ্ধি, বিবেচনা, বাক্য, স্বর, ব্যবসা, স্মৃতিশক্তি, খেলাধুলা ইত্যাদি বিষয়কে প্রভাবিত করে। এই দিনটি বুদ্ধির দেবতা গণেশকে উৎসর্গ করা হয়। তিনি তাঁর ভক্তদের জীবন থেকে নেতিবাচকতা এবং প্রতিবন্ধকতা দূর করেন। কোনও শুভ কাজ শুরুর আগে হিন্দুরা প্রায়ই গণেশের পূজা করে থাকেন।

গণেশের পূজায়, দূর্বা ঘাস, হলুদ এবং সাদা ফুল, কলা এবং মিষ্টি দিতে পারেন। তবে, নৈবেদ্যগুলি একটি পরিষ্কার কলার পাতায় রাখবেন। 'ওঁ গণেশায় নমঃ' জপ করতে পারেন। সিঁদুর ও মোদক (এক ধরণের মিষ্টি) অর্পণ করেও ভগবান গণেশকে সন্তুষ্ট করতে পারেন। কখনই তুলসীপাতার ব্যবহার করবেন না।

ভগবান গণেশ সবুজ এবং হলুদ বর্ণ খুব পছন্দ করেন। অতএব, আপনি এই দিনে সবুজ রঙের পোশাক পরার কথা ভাবতে পারেন।


বৃহস্পতিবার

---------------------

এইদিনটি 'গুরুবার' নামেও পরিচিত এবং ভগবান বিষ্ণু এবং গুরু বৃহস্পতির প্রতি উৎসর্গ করা হয়। এছাড়া অনেকেই এই দিনে সাঁই বাবাকে পূজা করেন এবং সাঁই মন্দিরে যান। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, গুরু বৃহস্পতি জুপিটার এবং এই দিনটিকে তিনিই চালিত করেন। বিশ্বাস করা হয় যে, এই দিনে ভগবান বিষ্ণুর উপাসনা করলে বৈবাহিক জীবনে সুখ আসে এবং পরিবারের মধ্যে সমস্যাগুলির সমাধান হয়।

ভগবান বিষ্ণু ও বৃহস্পতিকে সন্তুষ্ট করতে আপনি কলা গাছের নীচে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে কলাগাছের কাণ্ডে কুমকুম লাগাতে পারেন। এছাড়াও নারায়ণ দেবের কাছে ঘি, দুধ, হলুদ ফুল এবং গুড় অর্পণ করুন। শ্রীমদ্ভাগবত গীতা পাঠ করাও আপনার পক্ষে অত্যন্ত উপকারী হতে পারে। আপনি 'ওঁ জয় জগদীশ হরে' বা 'ওঁম্ নমো নারায়ণায়' মন্ত্রও জপ করতে পারেন। এই দিন তারাপীঠে যেতে পারেন বা ঘরে তারামায়ের পূজাও করতে পারেন।

যেহেতু ভগবান বিষ্ণু এবং বৃহস্পতিকে প্রায়শই পীত বা হলুদ রঙের পোশাক পরে থাকতে দেখা যায়, তাই আপনিও এই একই পোশাক পরতে পারেন।


শুক্রবার

-----------------

এটি শুক্রকে উৎসর্গ করা হয় যা দেবী মহালক্ষ্মী, দুর্গা এবং অন্নপূর্ণার প্রতীক। হিন্দু পুরাণে এই তিনটি দেবদেবীর একটি পৃথক তাৎপর্য রয়েছে। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, এই দিনে উপবাস করলে এবং এই তিন দেবীর উপাসনা করলে জীবনে সমৃদ্ধি, সম্পদ, ইতিবাচকতা এবং তৃপ্তি আসতে পারে।

ভক্তদের সকালে খুব সকালে উঠে স্নান করা উচিত এবং সাদা ফুল ও নৈবেদ্য উৎসর্গ করে দেবদেবীদের পূজা করা উচিত। গুড়, ছোলা, ঘি এবং দুধজাতীয় পণ্য (দই বাদে) দিতে পারেন। লবণ, রসুন এবং পেঁয়াজ ছাড়া প্রস্তুত খাবার খান। এছাড়াও, সূর্যাস্তের পরে খাবার খাওয়া উচিত।

আপনি এই দিনে সাদা এবং হালকা আকাশী রঙের পোশাক পরতে পারেন।



শনিবার

----------------

এইদিনটি ভগবান শনি-কে উৎসর্গ করা হয়। বলা হয় যে, কারও কর্মের উপর নির্ভর করে ভগবান শনি তাকে পুরস্কৃত করেন বা শাস্তি দেন। তাই সাধারণতঃ যারা জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসী তারা এই দিনটি পালন করেন। কথিত আছে যে, এই দিনে শনিদেবের পূজা করলে সুখ, সম্পদ ও শান্তির আকারে ভগবান শনি-এর কাছ থেকে সৌভাগ্য ও আশীর্বাদ আসতে পারে।

ভগবান শনিকে সন্তুষ্ট করতে এবং যে কোনও ধরনের বাধা এড়াতে এই দিনটি পালন করা যায়। ভগবান শনির উপাসনা করতে আপনি পিপল এবং শামি গাছের নীচে একটি প্রদীপ জ্বালাতে পারেন। এছাড়াও, দরিদ্রদের দান করুন। আপনি এইদিনে শনিদেবকে কালো সরিষা, ধুপ, পঞ্চমৃত এবং ফুল দিতে পারেন। এছাড়াও, আপনি পূজা সম্পন্ন করার পরে শনি আরতি করতে পারেন।

ভগবান শনি কালো রঙ পছন্দ করেন তাই, এই দিনে কালো রঙের পোশাক পরা আপনার পক্ষে সহায়ক হতে পারে।


-----------------------------------------------

সনাতনী শ্রী পৃথ্বীশ ঘোষ

Share:

প্রদীপ ও ভাগ্যোন্নতি

আমাদের নিত্য পুজোয় প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকি। বিশ্বাস করা হয় যে প্রদীপ না জ্বালিয়ে কোনও পুজোই শেষ হয় না। কিন্তু একথা কি জানা আছে যে বিশেষ কিছু দেব-দেবীর সামনে নিয়মিত সকাল-বিকাল প্রদীপ জ্বালালে এই জীবনে যে যে সমস্যার কথা আমরা জানি বা শুনে এসেছি, তার কোনওটাই মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। শুধু তাই নয়, জীবন পথে চলতে চলতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠা যে কোনও বাধা সরে যেতেও সময় লাগে না। হিন্দু শাস্ত্রের উপর লেখা একাধিক বই অনুসারে বেশ কিছু দেব-দেবী আছেন, যারা প্রদীপের আলো পছন্দ করেন, তাই তো তাঁদের আরাধনা করার পর যদি প্রদীপ জ্বালানো হয়, তাহলে দারুন সব উপকার মেলে।

★ প্রতিদিন সূর্য দেবতার সামনে প্রদীপ জ্বালালে সূর্যদেব এতটাই প্রসন্ন হন যে ছোট-বড় কোনও রোগই ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। রবিবার হল সূর্য দেবের দিন। তাই এদিন সাকাল সকাল উঠে স্নান সেরে যদি সূর্যদেবকে জল দান করে পূজা করতে পারেন, তাহলে আরও অনেক উপকার মেলে।


★ একথা তো সবাই জানেন যে প্রতি সোমবার দেবাদিদেবকে দুধ দিয়ে স্নান করালে মনের মতো জীবনসঙ্গী পাওয়া যায় তেমনি প্রতিদিন রাধা-কৃষ্ণের সামনে প্রদীপ জ্বালালে মনের মতো জীবনসঙ্গীও মেলে আর সেই সঙ্গে বৈবাহিক জীবনে কোনও সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার আশঙ্কা হ্রাস পায়। তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, তা হল রাধা-কৃষ্ণের ছবির সামনে ভুলেও সকালবেলা প্রদীপ জ্বালাবেন না যেন! এক্ষেত্রে জ্বালাতে হবে সন্ধ্যাবেলায় -- এমনটা করলে তবেই কিন্তু উপকার মেলে।


★ পঞ্চমুখি হনুমানজির ছবি বা মূর্তির সামনে প্রদীপ জ্বালালে খারাপ স্বপ্ন আসার আশঙ্কা হ্রাস পাবে। সেই সঙ্গে মনের লুকিয়ে থাকা ভয় দূর হবে এবং বাড়ীর মধ্যে খারাপ শক্তির আগমণ ঘটার সম্ভাবনাও যাবে কমে। ফলে কোনও ধরনের খারাপ ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আর থাকবে না।


★ শত চেষ্টা করেও কি টাকা জমাতে পারছেন না? এদিকে প্রতিদিন যেন খরচের মাত্রা বেড়েই চলেছে? তাহলে আপনি উত্তর দিকে ধন দেবতা কুবেরের ছবি বা মূর্তি রেখে প্রতিদিন কুবের দেবের সামনে প্রদীপ জ্বালানো শুরু করুন। দেখবেন অর্থনৈতিক সমস্যা মিটে যাবে।

★ অল্প সময়ে কর্মক্ষেত্রে চরম উন্নতি লাভ করতে যদি চান, তাহলে বাড়ির ঠাকুর ঘরে রাখা গণেশ দেবের সামনে অফিস বেরনোর আগে প্রদীপ জ্বালানো শুরু করুন। দেখবেন মনের ইচ্ছা পূরণ হতে সময় লাগবে না। প্রসঙ্গত, গণেশ দেব হলেন সমৃদ্ধির দেবতা। তাই তো প্রতিদিন গণেশের সামনে প্রদীপ জ্বালালে দেবতা বেজায় প্রসন্ন হন। ফলে পরিবারে সুখ এবং সমৃদ্ধির ছোঁয়া লাগতে সময় লাগে না।


★ রাম, লক্ষণ, সীতা এবং হনুমানজি একসঙ্গে রয়েছেন এমন ছবির সামনে প্রতিদিন প্রদীপ জ্বালালে বাড়ীর মধ্যে উপস্থিত খারাপ শক্তি দূরে পালায়। ফলে পরিবারের মধ্যে কোনও কলহ বা বিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার আশঙ্কা যেমন হ্রাস পায়, তেমনি ভাইয়ে-ভাইয়ে হওয়া বিবাদ বা ঝগড়া মিটে যেতেও সময় লাগে না।


প্রসঙ্গত, দেব-দেবীদের সামনে প্রদীপ জ্বালানোর সময় কতগুলি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। কারণ এই নিয়মগুলি না মানলে কিন্তু কোনও সুফলই পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে যে যে বিষয়গুলি মাথায় রাখতে হবে, সেগুলি হল --


* প্রদীপ জ্বালানোর সময় কম করে দুটো এবং সর্বচ্চ তিনটি সেলতে জ্বালানো উচিত। কারণ এমনটা করলে দূর্গা, লক্ষ্মী এবং সরস্বতী দেবীর আশীর্বাদ লাভ করা সম্ভব হয়।


* খেয়াল করে দেখবেন অনেকেই প্রদীপ জ্বালানোর সময় হাতে লাগা তেল হয় পরে থাকা জামায় মুছে ফেলেন, নয়তো চুলে লাগিয়ে নেন। কিন্তু এমনটা করা একেবারেই উচিত নয়। কারণ এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে দিনের পর দিন এমনটা করলে মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। তাই যদি এমন ঘটনা এড়িয়ে চলতে চান, তাহলে ঠাকুর ঘরে হাত মোছার একটা পরিচ্ছন্ন কাপড় রাখতে ভুলবেন না যেন।


* প্রদীপ জ্বালানোর সময় কী ধরনের তেল ব্যবহার করা উচিত জানা আছে? বিশেষজ্ঞদের মতে দেবতাদের সামনে দিয়া জ্বালানোর সময় হয় তিল তেল, সরষের তেল অথবা ঘি ব্যবহার করা উচিত। কারণ এমনটা করলে পরিবারে সমৃদ্ধির ছোঁয়া লাগে। সেই সঙ্গে বাড়ীতে সুখ-শান্তির পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কাও হ্রাস পায়।

সনাতনী শ্রী পৃথ্বীশ ঘোষ

Share:

ভগবান, ঈশ্বর ও ব্রহ্ম --১

আজ সন্ধ্যা বেলায় এক সাধক ব্যক্তি আমায় ফোন করেছিলেন। তিনি যথেষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তি বলেই শুনেছি। আমার "সতীপীঠ" পোস্ট প্রসঙ্গে তিনি কথা বলছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন ভগবান ও ঈশ্বর দুটি পৃথক বিষয় এবং শ্রীকৃষ্ণ না কি ভগবান নয়। তিনি বেদের উদাহরণ সহ অনেক কথা বললেন। এবার এলেন দেবতা প্রসঙ্গে। আমি ৩৩ কোটি দেবতা বলাতে হে হে করে হেসে উঠে তাচ্ছিল্য করলেন বলে মনে হল। আমি কি আর করি, উনাকে বলেই ফোনকলটা কেটে দিলাম।

এই বার আসি ঈশ্বর প্রসঙ্গে। জেনে নিন৷ 'ঈশ্বর' শব্দের অর্থ কি ---

সংস্কৃত ব্যাকরণের 'ঈশ' ধাতুর সাথে 'বরচ্' প্রত্যয়যোগে 'ঈশ্বর' শব্দ নিস্পন্ন হয়েছে। ঈশ্ ধাতুর অর্থ কর্তত্ব করা। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থানুযায়ী যিনি সকলের কর্তা তিনিই 'ঈশ্বর'। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, সকল কিছুর নিয়ন্তা, এ কথা আমরা জানি। তিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের অধীশ্বর এবং সর্বত্র বিরাজিত। তিনিই সৃষ্টিকর্তা, তিনি পালনকর্তা আবার তিনিই সংহারকর্তা। তাঁর ব্যাপ্তি অনন্ত, নাম অনন্ত ও রূপও অনন্ত। তিনি বিরাট পুরুষ ও তাঁর স্ত্রীরূপ একমাত্র হিন্দুধর্মের কল্পনা, তিনি 'ঈশ্বরী'।

আগেই বলেছি ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজিত। তিনি অন্তর্যামী। তিনি আমাদের আত্মার আত্মা। তাঁকে পাওয়ার জন্য দূরে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। তিনি মানুষের অন্তরের অন্তস্থলেই অধিষ্ঠিত। সাধকের কাছে ঈশ্বর সাকার ও নিরাকার দুই-ই। তাঁকে যে-ভাবে ভজনা করে তিনি তাকে সেই ভাবেই অনুগ্রহ করেন। ভক্তের কাছে তিনি সাকার, জ্ঞানীর কাছে তিনি নিরাকার 'ব্রহ্ম'। ব্রহ্ম শব্দের অর্থ সর্ববৃহৎ। ব্রহ্মই জীবের মধ্যে পরমাত্মারূপে অবস্থান করেন। ঈশ্বরকে যখন পরিপূর্ণ বীর্য, ঐশ্বর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্যের অধীশ্বররূপে কল্পনা করা হয় তখন তিনি 'ভগবান'। ভগবান সৎ, চিৎময় ও আনন্দময়। ভক্তের কাঙ্খিত রূপ ধারন করে তিনি ভক্তের নিকট আবির্ভূত হন।

আমাদের মত সনাতন শাস্ত্রের গুণগ্রাহী ও বিশ্বাসীদের মতে ভগবান ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। আমরা, সাধারণ মানুষ, ভগবানকে পিতা-মাতা, বন্ধু, প্রিয়জন বা আপনজন রূপে শ্রদ্ধা নিবেদন করে, সাংসারিক দুঃখ-দুর্দশা, আপদ-বিপদ থেকে উদ্ধারের প্রর্থনা জানিয়ে থাকি। গীতা থেকে জানি -- 'ভগবান নিরপেক্ষ বিচারক। তাঁর নিকট কেউ প্রিয়ও নয়, অপ্রিয়ও নয়। কর্ম অনুসারে মানুষ ফলভোগ করে থাকে'। তাই ব্যবসা শুরু করলে, বিবাহ করলে, পড়াশুনা শুরুর আগে, বাড়ী তৈরীর আগে, জন্মগ্রহণ করলে বা মৃত্যু হলেও আমরা ভগবানকে ধন্যবাদ জানাই বা খারাপ কিছু হলে অভিমানও করি -- ভক্তির এইরকমই তো বহিঃপ্রকাশ হওয়া উচিত, না কি?

ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব তাই বলেছিলেন -- জ্ঞানীর কাছে ঈশ্বর 'ব্রহ্ম', যোগীর কাছে ঈশ্বর 'পরমাত্মা' আর ভক্তের কাছে ঈশ্বর হলেন 'ভগবান'।

সনাতন বৈষ্ণব শাস্ত্র বলছে -- সমস্ত অবতারেরা হচ্ছেন ভগবানের অংশ অথবা অংশের প্রকাশ, কিন্তু 'শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান' -- অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের আদিরূপ। তিনিই হচ্ছেন পরম সত্য, তিনিই হচ্ছেন পরমাত্মা ও নির্বিশেষ ব্রহ্মের উৎস। তাই তো শ্রীব্রহ্মসংহিতায় ব্রহ্মা বলছেন ---

'ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহ।

অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্॥'

অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হলেন একমাত্র ইশ্বর, তাঁর বিগ্রহ সৎ, চিৎ এবং আনন্দময়। তিনি সচ্চিদানন্দ, আদিপুরুষ গোবিন্দ এবং সর্বকারণের কারণ। পরবর্তী পোস্টে জানব যে কেন শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলব।

Written by: Prithwish Ghosh

Share:

ভগবান, ঈশ্বর ও ব্রহ্ম --২

 এই বার আসব শ্রীকৃষ্ণ যে ভগবান তার শাস্ত্রীয় কিছু সামান্য প্রমান দিয়ে ---


আমরা জানি যে 'যা নেই মহাভারতে তা নেই ভারতে', তাই প্রথমেই মহাভারতে চলুন, ভীষ্মপর্বে। ভীষ্মদেব দেহত্যাগ করবেন, শরশয্যায় শুয়ে আছেন, পাণ্ডবেরা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সকলে দাঁড়িয়ে। তাঁরা দেখলেন যে, ভীষ্মদেবের চোখ দিয়ে জল পড়ছে। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, ‘ভাই, কি অশ্চর্য! পিতামহ, যিনি স্বয়ং ভীষ্মদেব, সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয়, জ্ঞানী, অষ্টবসুর এক বসু, তিনিও দেহত্যাগের সময় মায়াতে কাঁদছেন।’

শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্মদেবকে এ-কথা বলাতে তিনি বললেন, ‘কৃষ্ণ, তুমি বেশ জানো, আমি সেজন্য কাঁদছি না! যখন ভাবছি যে, যে পাণ্ডবদের স্বয়ং ভগবান নিজে সারথি, তাদেরও দুঃখ-বিপদের শেষ নাই, তখন এই মনে করে কাঁদছি যে, ভগবানের কার্য কিছুই বুঝতে পারলাম না।’

তারপর বললেন --

যশ্চ মানুষমাত্রোহ‘য়মিতি ব্রুয়াৎ স মন্দধীঃ৷

হৃষীকেশমবিজ্ঞানাত্তমাহু পুরষাধমম্৷৷ --(মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৬৫/১৯)

—“যে লোক অজ্ঞানবশতঃ এই হৃষীকেশকে মানুষমাত্র বলিবে সে মন্দবুদ্ধি, সকলে তাকে ‘নরাধম’ বলিবে"৷ তো স্বয়ং গঙগাপূত্র, জ্ঞানী, ব্রহ্মচারী, বিবেচক মহাযোদ্ধা, জ্ঞানবৃদ্ধ ভীষ্মের উপলব্ধির কি কোনও মূল্য নেই!

আবার আসি মহাভারতের যুদ্ধকালীন একটি প্রসঙ্গে। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ তখন ভরষন গতিতে চলছে। এমন একটি দিন আসে যখন অর্জুন ও কর্ণ পরস্পরের সামনা সামনি হয়ে পড়ে।

যুদ্ধ চলাকালীন, অর্জুনের একটা তীর লেগে কর্ণের রথ ২৫/৩০ হাত পিছনে ছিটকে পড়ে। আর এদিকে কর্ণের একটা তীরের আঘাতে অর্জুনের রথ কেবল ২/৩ হাত পিছনে যায়।

আর তা দেখে শ্রীকৃষ্ণ দুহাত তুলে, "বাহ্ কর্ণ বাহ্" বলে কর্ণের লক্ষ্যভেদের প্রশংসা করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণের এরূপ আচরণে অর্জুনের মধ্যে জেদ চলে আসে। তিনি আরও দূর্বার বেগে আঘাত করতে থাকেন। বার বার আঘাত করে কর্ণের রথকে পিছে নিতে থাকেন। কিন্তু তাঁর এই পরাক্রম দেখা সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণ চুপ করে থাকেন। কিন্তু যেই কর্ণের তীর ছুঁড়ে অর্জুনের রথকে ২/৩ হাত পিছনে সরিয়ে দেয়, ঠিক তখনই শ্রীকৃষ্ণ অতি উৎসাহের সাথে বলে উঠেন, "বাহ্ কর্ণ বাহ্, তোমার লক্ষ্যভেদের তুলনা নেই"।

এভাবে বার বার শ্রীকৃষ্ণকে কর্ণের পক্ষে প্রশংসা করতে শুনে অর্জুন অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করেন, "হে কেশব! তুমি আমার এমন পরাক্রম দেখা সত্ত্বেও আমার প্রহারের প্রশংসা না করে কর্ণের ওই দুর্বল প্রহারের প্রশংসা করে চলেছ। কেন কেশব? কেন এমন পক্ষপাত করছ তুমি? তোমার এমন আচরণ আমার হৃদয়কে বড় ব্যথিত করে তুলেছে।"

শ্রীকৃষ্ণ মুচকি হেসে বললেন, "হে পার্থ! তোমার রথকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, রথের ধ্বজায় হনুমান, চক্র তথা চাকায় শেষনাগ আর সারথি রূপে স্বয়ং নারায়ণ আছে। তা সত্ত্বেও যদি কারও প্রহারের ফলে এই রথ এক চুল পরিমাণও নড়ে ওঠে, তবে তা কিন্তু কোন সাধারণ বিষয় নয়। আর এখানে তো কর্ণের একটি প্রহারের চোটে তা ২/৩ হাত পিছনে চলে যাচ্ছে, তবে কি কর্ণের প্রশংসা পাওয়া উচিত নয়? এমন বীরের তো প্রশংসা করতেই হয়।"

শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে তখনকার মত অর্জুন চুপ হয়ে গেলেও মন থেকে তা মেনে নিতে পারেননি। আর এদিকে অন্তর্যামী শ্রীকৃষ্ণ তা বুঝতে পেরেও চুপ করেছিলেন।

যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর যখন রথ থেকে নামার সময় হয় তখন শ্রীকৃষ্ণ সর্বপ্রথম অর্জুনকে রথ থেকে নামতে বলেন। অর্জুন নেমে যাওয়ার পর শ্রীকৃষ্ণ রথের ঘোড়াগুলিকে মুক্ত করে সর্বশেষ নিজে রথ থেকে অবতরণ করেন।

শ্রীকৃষ্ণ রথ থেকে নামার সাথে সাথেই রথে আগুন জ্বলে উঠে। তারপর মুহুর্তের মধ্যেই তা ভষ্ম হয়ে যায়।

প্রকৃতপক্ষে রথটি কিন্তু কর্ণের প্রহারে অনেক আগেই ভষ্ম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু রথের উপরে স্বয়ং ভগবান বিরাজমান ছিলেন, তাই ভষ্ম হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও রথটি চলমান ছিল।

এই দৃশ্য দেখার পর অর্জুন সমস্ত বিষয়টি বুঝতে পারেন, এবং তাঁর মনের সকল অহংকার মুহুর্তের মধ্যে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। অর্জুনের দর্প হরণ করেছিলেন বলে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের আরেক নাম রাখেন "দর্পহারী"।

এভাবে আমাদের দর্পহারী শ্রীহরি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কেবল বাইরের দৃশ্যমান শত্রুকেই নয় বরং অর্জুনের মনে দখল করে থাকা "দর্প" নামক শত্রুকেও বিনাশ করেন এবং আমরা তাঁর ভগবত্তা বুঝতে পারি।

এই বার আসুন ভাগবতে ---

অবতারা হ্যসংখ্যেয়া হরেঃ সত্ত্বনিধের্দ্ধিজাঃ ।

যথাবিদাসিনঃ কুল্যাঃ সরসঃ স্যুঃ সহস্রশঃ ।। (ভাগবত ১/৩/২৬)

অনুবাদ --- হে ব্রাহ্মণগণ! বিশাল জলাশয় থেকে যেমন অসংখ্য নদী প্রবাহিত হয়, ঠিক তেমনই ভগবানের থেকে অসংখ্য অবতার প্রকাশিত হন ।

আবার ভাগবতে দেখি --

“এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্

ইন্দ্রারিব্যাকুলং লােকং মৃড়য়ন্তি যুগে যুগে”॥ (ভাগবত ১/৩/২৮)

অনুবাদ --- পূর্বোল্লিখিত এই সমস্ত (বিষ্ণুর) অবতারেরা হচ্ছেন ভগবানের অংশ অথবা কলা অবতার, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং। যখন নাস্তিকদের অত্যাচার বেড়ে যায় তখন আস্তিকদের রক্ষা করার জন্য ভগবান এই ধরাধামে অবতীর্ণ হন ।

শ্রীব্রহ্মসংহিতায় ব্রহ্মা বলছেন---

ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহ।

অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্॥

অনুবাদ --- ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হলেন একমাত্র ইশ্বর, তাঁর বিগ্রহ সৎ, চিৎ এবং আনন্দময়। তিনি আদিপুরুষ গোবিন্দ এবং সর্বকারণের কারণ॥

মহাপ্রভু উল্লেখ করেছেন---

একেলা ঈশ্বর কৃষ্ণ আর সব ভৃত্য।

যারে যৈছে নাচায় সে তৈছে করে নৃত্য॥

পূর্ববর্তী মহাজনগণ শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলে স্বীকার করে আসছেন।

আর সমস্ত অবতারেরা হচ্ছেন ভগবানের অংশ অথবা অংশের প্রকাশ, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান। তাই শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের আদিরূপ। তিনিই হচ্ছেন পরম সত্য, তিনিই হচ্ছেন পরমাত্মা ও নির্বিশেষ ব্রহ্মের উৎস।

পরমহংস শিরোমণি শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে (২/৮৮) বলেছেন –

যাঁর ভগবত্তা হৈতে অন্যের ভগবত্তা।

‘স্বয়ং ভগবান’- শব্দের তাহাতেই সত্তা।। -- চৈতন্য চরিতামৃত (২/৮৮)

অর্থাৎ “যাঁর ভগবত্তা থেকে অন্যের ভগবত্তা প্রকাশ পায়, তাঁকেই ‘স্বয়ং ভগবান’ বলা যায় । তাঁর মধ্যেই সেই সত্তা বিরাজমান।”

পরমেশ্বর ভগবান বাসুদেব বা শ্রীকৃষ্ণ, যিনি বসুদেবের পুত্র অথবা নন্দ মহারাজের পুত্র বলে প্রসিদ্ধ, তিনি সর্ব ঐশ্বর্যে পূর্ণ -- তিনি সমগ্র ঐশ্বর্য, সমগ্র যশ, সমগ্র বীর্য, সমগ্র শ্রী, সমগ্র জ্ঞান এবং সমগ্র বৈরাগ্য তার মধ্যে পূর্ণরূপে বিরাজমান ছিল।

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্যের একটি অংশ নির্বিশেষ ব্রহ্মরূপে প্রকাশিত এবং অপর একটি অংশ পরমাত্মারূপে প্রকাশিত। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেই পুরুষ রূপ হচ্ছে আদি পরমাত্মা।

সনাতন দর্শনানুযায়ী জড় সৃষ্টিতে তিনটি পুরুষ রূপ রয়েছে, যারা কারণােদকশায়ী বিষ্ণু, গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু এবং ক্ষীরােদকশায়ী বিষ্ণু নামে পরিচিত। এই তিন বিষ্ণুই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অংশকলা। বিষ্ণু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্বাংশ অর্থাৎ স্বয়ং ভগবান তাই বিষ্ণু আর কৃষ্ণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

'এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্।' অর্থাৎ ভগবানের সমস্ত অবতারেরা হচ্ছেন পুরুষাবতারদের অংশ অথবা কলা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান।

উক্ত দুটি শ্লোকগুলিতে ব্যবহৃত ‘ভগবান্’ বলতে কি বুঝায় তা এবার আলোচনা করব। ‘ভগ’ শব্দের অর্থ ঐশ্বর্য বা গুণশক্তি।

ঐশ্বর্যস্য সমগ্রস্য বীর্যস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ।

জ্ঞানবৈরাগ্যয়োশ্চৈব ষন্নং ভগ ইতীঙ্গনা।। (বিষ্ণু পুরাণ ৬/৫/৭৪)

অর্থাৎ “সমগ্র ঐশ্বর্য্য, সমগ্র বীর্য, সমগ্র যশ, সমগ্র শ্রী (সৌন্দর্য ও সম্পত্তি) সমগ্র জ্ঞান, এবং সমগ্র বৈরাগ্য এই ছয়টি মহাশক্তির নাম ‘ভগ’। সুতরাং এই সকল মহাশক্তি যাতে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে বর্তমান তিনিই ভগবান।”

এই শ্লোক দ্বারা প্রমাণিত হয় যে ঐশ্বর্যাদি ষড়বিধ মহাশক্তিসম্পন্ন সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান। এই ঐশ্বর্যাদি বলতে কি বুঝায় তা আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করা নিই –


ঐশ্বর্য --- ঐশ্বর্য অর্থে সর্ববশীকারিতা – যে শক্তিতে কেবল ঈশ্বরের ভাব প্রকাশিত হয়। ঈশ্বর বলতে ‘কর্তুমকর্তুং অন্যথা কর্তুং সমর্থঃ।’ সুতরাং যে শক্তি সকলকে বশীভূত করতে পারে তারই নাম ঐশ্বর্য ।

শ্রীভগবানের কূর্ম, বরাহ, রাম, নৃসিংহাদি স্বাংশ স্বরূপের মধ্যে ঐশ্বর্যের প্রকাশ থাকলেও তাঁর পরিপূর্ণস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহে পূর্ণ মাধুর্যের প্রকাশ। তাঁর লীলায় এই মাধুর্য প্রকাশের আধিক্য থাকার জন্যই ভক্তরা তাঁর সম্বন্ধে ঐশ্বর্যজ্ঞানহীন শুদ্ধভক্তি দ্বারা তাতে প্রাণ মন ঢেলে সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। সেই জন্য যে লীলা তিনি নরলীলাভাবে প্রকাশ করেছেন এবং এই মনুষ্যভাবের যে লীলাতে মধুরভাবে প্রকাশ হয় সেটিই তাঁর মাধুর্য লীলা। আর

এই ‘মাধুর্য ভগবত্তা সার’। শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ, যিনি শাশ্বত কাল ধরে, সম্পূর্ণভাবে সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী। শ্রীকৃষ্ণই পূর্ণ ঐশ্বর্যসম্পন্ন পরমপুরুষ, পরমেশ্বর ভগবান। পূর্ণমাত্রায় ঐশ্বর্য সমূহের অধিকারী হওয়ার শ্রীকৃষ্ণ পরম আকর্ষক, তিনি সর্বাকর্ষক পরমপুরুষ, সেজন্যই তাঁর নাম ‘কৃষ্ণ’, যিনি সকলকে আকর্ষক-পূর্বক আনন্দ প্রদান করেন।


বীর্য (পরম শক্তিমান) --- বীর্য অর্থে শ্রীভগবানের অচিন্ত্য মহাশক্তি প্রকাশক পরাক্রমকে বুঝায়। এই পরাক্রম তাঁর মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, রাম, নৃসিংহাদি অবতারে প্রকৃষ্টরূপে প্রকাশিত হয়েছে। শ্রীরামচন্দ্র অবতারে তাঁর তাড়কাবধ, হরধনু ভঙ্গ, লঙ্কাবিজয় প্রভৃতিতে সম্পূর্ণ বীর্য অর্থাৎ পরাক্রমের প্রকাশ পেয়েছে। পরিপূর্ণ স্বরূপ কৃষ্ণ অবতারেও দাবাগ্নি ভক্ষণ, কংস রঙ্গালয় এবং অবশেষে তার দন্তোৎপাটন করে তা দ্বারা হস্তীপালকসহ হস্তীকে সংহার। প্রবল পরাক্রান্ত জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত করে রুক্ষ্মিণীকে রথে আরোহণ করিয়ে তাঁর পাণিগ্রহন-সবই শ্রীকৃষ্ণের অমিত পরাক্রমের পরিচয় । শ্রীকৃষ্ণের অন্যান্য লীলায়ও তাঁর অত্যদ্ভূত ঐশ্বর্য ও বীর্যের প্রকাশ থাকলেও অধিকাংশ

স্থলে তা মাধুর্যমন্ডিত-তাঁর নরলীলার অতিক্রম করেনি।

শ্রীভগবানের কৃষ্ণলীলায় যেমন পূতনা রাক্ষসী বধের বৃত্তান্ত পাওয়া যায়, তেমনই তাঁর রামলীলাতেও তাড়কা রাক্ষসীর বধের বৃত্তান্ত আছে। কিন্তু পূতনাবধে যে অচিন্ত্য মহাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায় অন্যলীলায় সেরকম নয় । দুই বৃত্তান্তেই রাক্ষসীবধ-কিন্তু রামলীলায় শ্রীরামচন্দ্র বিশ্বামিত্রের নিকট অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেছিলেন এবং সেই বজ্রতেজসম্পন্ন অস্ত্রদ্বারা তাড়কাকে নিহিত করেছিলেন।

কৃষ্ণলীলায় পূতনাবধকালে কোনো অস্ত্রশিক্ষার প্রয়োজন হয়নি; তিনি ৬ দিন মাত্র বয়সে শৈশব অবস্থায় স্তন চুষতে চুষতেই বিরাট দেহধারী পূতনাকে বধ করেছিলেন।

কৃষ্ণলীলায় যেমন গোবর্ধন ধারণ বৃত্তান্ত দেখা যায় তেমনই তাঁর কূর্মলীলায় কূর্ম-মূর্তিতে মন্দার পর্বতকে পৃষ্ঠে ধারণ করেছিলেন। কিন্তু কূর্মলীলায় সেই মন্দার পর্বতকে ধারণ করার জন্য তাঁর পৃষ্ঠদেশকে এক লক্ষ যোজন বিস্তৃত করতে হয়েছিল।

পক্ষান্তরে, কৃষ্ণলীলায় যখন তিনি মাত্র সাত বছর বয়স্ক বালক তখন তাঁর বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল দ্বারা ক্রমাগত ৭ দিন পর্যন্ত বিশাল গোবর্ধন পর্বতকে ধারণ করে দন্ডায়মান ছিলেন । রাসলীলা আরম্ভে শ্রীকৃষ্ণ বংশীধ্বনি করলেন। ঐ ধ্বনি ৮৪ ক্রোশ ব্যাপী ব্রজমন্ডলে ব্যাপ্ত হল। যেখানে যত প্রেমবতী ব্রজাঙ্গনা ছিলেন তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের মধুর বংশীধ্বনিতে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে এলেন।

‘জগৌ কলং বামদৃশাং মনোহরম’ -- (ভাগবত ১০/২৯/৩) অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ সুলোচনা ব্রজাঙ্গনাদের মনোহারী মধুর বেণুসঙ্গীত আরম্ভ করলেন। সুতরাং বুঝা যায় একমাত্র প্রেমবতী গোপাঙ্গনারাই কেবল সেই মধুর ধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন। সেটি শ্রীকৃষ্ণের অচিন্ত্য মাধুর্য, ঐশ্বর্য ও বীর্যশক্তির পরিচয়। কৃষ্ণ যখন মাতা যশোদাকে তার মুখের ভিতর অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ড বা বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু অনেকে বলে কিভাবে সম্ভব। অনন্তকোটি বিশ্বব্রহ্মান্ড ছোট্ট শিশুর মুখে! প্রকৃতপক্ষে এইসব কৃষ্ণের ভগবত্তা। উদাহরণ স্বরূপঃ একটি ছোট্ট মোবাইল স্ক্রীনে যদি ইন্টারনেট, টিভি, সিনেমা, গান মোটকথা পুরো বিশ্বের সব কিছুই দেখা যাই তাহলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখে কেন নই। শ্রীকৃষ্ণই যে একমাত্র পরমেশ্বর ভগবান তাঁর প্রমাণ তাঁর অদ্ভূত লীলার আলোকে প্রমাণ করা যায়।


যশ --- শ্রীভগবানের যশ, তাঁর সদগুণ, খ্যাতি, ভক্তবাৎসল্য, প্রেমাধীনতা প্রভৃতি বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণলীলায় এই যশ আরও মাধুর্যমন্ডিতভাবে প্রকাশিত। রাম নৃসিংহাদি লীলায় তিনি অসুর বিনাশ করেছিলেন। কিন্তু কাউকেও মুক্তি প্রদান করেননি। একমাত্র কৃষ্ণলীলায় তিনি তাঁর হাতে নিহত অসুরদেরকে মুক্তি প্রদান করে ‘হতারিগতি দায়কত্ব’ যশ লাভ করেছিলেন।

বিষ্ণুপুরাণে বর্ণিত আছে বৈকুন্ঠপার্ষদ জয়-বিজয়, সনক-সনাতনাদির অভিশাপে অসুর দেহ লাভ করে যথাক্রমে হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যাক্ষ, রাবণ ও কুম্ভকর্ণ এবং অবশেষে শিশুপাল ও দন্তবক্র রূপে জন্মগ্রহণ করেন। হিরণ্যকশিপু নৃসিংহদেবের হাতে নিহত হওয়ার সময় নৃসিংহদেবকে ভগবান বলে ধারণা করতে পারেনি, অদ্ভূত জীব বলেই ধারণা করেছিল। রজোগুণাক্রান্ত

চিত্তে নৃসিংহদেবের পরাক্রমমাত্র চিন্তা করতে করতে নিহিত হয়েছিল। তাই পরজন্মে রাবণ হয়ে জন্মগ্রহণ করে ত্রৈলোক্যের ঐশ্বর্য লাভ করতে পেরেছিল।

নৃসিংহদেবের ভগবত্তা চিত্তের আবেশ না হওয়ায় সংসার মুক্তিও লাভ করতে পারেনি। রাবণরূপে জন্মগ্রহণ করেও কামাসক্ত ছিল এবং শ্রীরামচন্দ্রের পত্নী জানকীকে সাধরণ জীব মনে করে ভোগ করবার জন্য প্রয়াসী হয়েছিল। তাই

শ্রীরামচন্দ্রের হাতে নিহিত হয়ও শিশুপাল রূপে চেদিরাজকুলে জন্মগ্রহণ করে অতুল ঐশ্বর্য ভোগেরই অধিকারী হল। কিন্তু এজন্মে শিশুপাল তার পূর্ব জন্মের সঞ্চিত দ্বেষবশতঃ নিরন্তর কৃষ্ণকে নিন্দা করত-শয়নে, স্বপনে, আহারে, বিহারে নিন্দাচ্ছলে কৃষ্ণনাম করে শ্রীভগবানের সর্ববিধ নাম গ্রহণ করত। শুধু নামগ্রহণ নয় নিরন্তর শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি তার হৃদয়ে উদ্ভাসিত থাকত। নিরন্তর এই কৃষ্ণনামোচ্চারণ ও কৃষ্ণের রূপচিন্তায় তার সর্ববিধ দোষ স্খলিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণেই বিলীন হয়ে গিয়েছিল। এতেই বুঝা যায় যে, শ্রীভগবানের সর্ববিধ মূর্তিতেই তাঁর ঐশ্বর্য বীর্যাদি মহাশক্তি বর্তমান থাকলেও একমাত্র স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মূর্তিতে সেইসবের পূর্ণ বিকাশ এবং এই লীলায় শ্রীভগবান অসুরদেরকে চিরতরে সংসার বন্ধন হতে মুক্তিদান করে হতারিগতিদায়করূপ অতুলনীয় অংশের প্রকাশ করেছিলেন।


শ্রী (রূপবত্তা) --- শ্রী অর্থে সৌন্দর্য ও সম্পদ দুই’ই হতে পারে। সমগ্র শ্রী অর্থে সৌন্দর্য বুঝালে শ্রীকৃষ্ণের সৌন্দর্য যে সর্ববিস্ময়কারিণী তা ভাগবতে (৩/১১/১২) বর্ণিত আছে।

যন্মর্ত্যলীলৌপয়িকং স্বযোগ-মায়াবলং দর্শয়তা গৃহীতম্।

বিস্মাপনং স্বস্য চ সৌভগর্দ্ধেঃ পরং পদং ভূষণভূষণাঙ্গম্ ।।

অর্থাৎ ভগবান এই জগতে স্বীয় যোগামায়াবলে প্রকটিত হয়েছেন। সেই মূর্তি মর্ত্যলীলার উপযোগী; তা এতই মনোরম যে, তাতে কৃষ্ণের নিজেরও বিস্ময় হয়-তা সৌভাগ্যের পরাকাষ্ঠা এবং সমস্ত সুন্দরের সুন্দর অর্থাৎ সমস্ত লৌকিক দৃশ্যের মধ্যে পরম অলৌকিক।

শ্রীচৈতণ্য চরিতামৃতে শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বর্ণনা করেছেন ---

সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য, মাধুর্য, বৈদগ্ধ্য-বিলাস।

ব্রজেন্দ্রনন্দনে ইহা অধিক উল্লাস।।

গোবিন্দের মাধুরী দেখি’ বাসুদেবের ক্ষোভ।

সে মাধুরী আস্বাদিতে উপজয় লোভ।।

মথুরায় যৈছে গন্ধর্বনৃত্য-দরশনে।

পুনঃ দ্বারকাতে যৈছে চিত্র-বিলোকনে।। (চৈঃ চঃ মধ্য লীলা ২০/১৭৮, ১৭৯, ১৮১)

অর্থাৎ সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য, মাধুর্য, বৈদগ্ধবিলাস আদি গুণগুলি বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ থেকে ব্রজন্দনন্দন কৃষ্ণে অধিক উপাদেয়। গোবিন্দের মাধুর্য দেখে বাসুদেবের ক্ষোভ হয় এবং সেই মাধুরী আস্বাদন করার জন্য তাঁর লোভ হয়। মথুরায়

গন্ধর্ব নৃত্য দর্শন করে এবং দ্বারকায় চিত্র দর্শন করে বাসুদেব গোবিন্দের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

আবার ‘শ্রী’ অর্থে যদি সম্পদ ধরা যায়, তাহলে তাতেও সর্বসম্পদ পরিপূর্ণভাবে শ্রীকৃষ্ণে বিকশিত । যেমন --

শ্রীব্রহ্মসংহিতায় (৫/৫৬) বলা হয়ছে ---

শ্রিয়ঃ কান্তাঃ কান্তঃ পরমপুরুষঃ কল্পতরবো

দ্রুমা ভূমিশ্চিন্তামমণি-গণময়ী তোয়মমৃতম্।

কথা গানং নাট্যং গমনমপি বংশী প্রিয়সখী

চিদানন্দং জ্যোতিঃ পরমপি তদাস্বাদ্যমপি চ।।

অর্থাৎ ব্রহ্মা নিজ ইষ্টদেব শ্রীগোবিন্দের নিজধাম বৃন্দাবনের সম্পদ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন – এই বৃন্দাবন ধামের কৃষ্ণকান্তাগণ সকলেই লক্ষী এবং কান্ত পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ, বৃক্ষসকল কল্পতরু, ভূমি চিন্তামণি, জল অমৃত, স্বাভাবিক

কথাই গান, সহজ গমনে নৃত্য, শ্রীকৃষ্ণের বংশীই প্রিয়সখী, চিদানন্দই পরমজ্যোতিঃ স্বরূপ চন্দ্র সূর্য এবং সেই চিদানন্দ বস্তুও আস্বাদ্য।

বৃন্দাবনের কৃষ্ণকান্তাগণ (গোপীগণ) স্বয়ং লহ্মী অপেক্ষা অনেক গুণবতী। (শ্রীরাধিকা লহ্মীগণের অংশনী, গোপীগণ তাঁর কায়ব্যূহ), বৃন্দাবনের বৃক্ষসকল সাধারন বৃক্ষের মতো নয় -কল্পবৃক্ষের মতো যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। বৃন্দাবনের ভূমি সাধারণ মাটি নয়-তা চিন্তামণিময়। চিন্তামণির নিকট যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। বৃন্দাবনের জল অমৃতের মত স্বাদবিশিষ্ট। বৃন্দাবনবাসীদের স্বাভাবিক কথাবার্তা গীতের মতো মধুর। তাঁদের স্বাভাবিক চলাফেরাই নৃত্যের মত সুন্দর। শ্রীবৃন্দাবনে চিদানন্দ জ্যোতিই চন্দ্র সূর্য রূপে মূর্তিমান হয়ে আস্বাদ্য হন। প্রাকৃত চন্দ্র সূর্য জড়বস্তু-সকল সময়ে আনন্দদায়ক নয়, চন্দ্র অপূর্ণ কলা-অবস্থায় আনন্দদায়ক নয়। মধ্যাহ্নকালীন সূর্য খরতাবশতঃ জ্বালাকর, কিন্তু শ্রীবৃন্দাবনের চন্দ্র, সূর্য জড়বস্তু নয় -- চিন্ময়, সর্বদাই আনন্দপ্রদ।


জ্ঞান -- জ্ঞানশক্তি বলে শ্রীভগবান সর্বজ্ঞ, স্বপ্রকাশ। জ্ঞান অর্থে জীবের ক্ষে কোনো বস্তু বিশেষ সম্বন্ধে চিত্তের ভাব। জীবের পক্ষে কোনো বস্তুকে দেখতে হলে, শুনতে হলে আঘ্রাণ করতে হলে, আস্বাদন করতে হলে, বা স্পর্শ করতে হলে যথাক্রমে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক-এই সব ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে নিতে হয়, কিন্তু শ্রীভগবানের পক্ষে তাঁর স্বরূপভূত জ্ঞান কোনো বস্তু বিশেষকে অপেক্ষা করে না । সেইজন্য তাঁকে অতীত বা ভবিষ্যতের সর্ববিষয়ে জ্ঞানবান বলা হয়-‘সঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিৎ’ (শ্রুতি)।

আবার গীতার ৭ম অধ্যায়ের ২৬নং শ্লোকে ভগবান নিজমুখে বলেছেন ---

'বেদাহং সমতীতানি বর্তমানানি চার্জুন।

ভবিষ্যানি চ ভূতানি মাং তু বেদ ন কশ্চন।।'

শ্রীকৃষ্ণের সর্বজ্ঞতার কথা চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাই, যখন তিনি মাত্র ৬ দিনের শিশু এবং মা যশোদার স্তন্যপান করেছেন সেই সময় পূতনা রাক্ষসী বাৎসল্যময়ী মাতৃমূর্তিবেশে উপস্থিত হলে চরাচরের অন্তর্যামীর নিকট পূতনারাক্ষসীর আগমনের উদ্দেশ্য অজানা ছিল না। তাই তাঁকে দেখে তার মুখ দর্শনে অনিচ্ছুক হয়ে চক্ষু বন্ধ করে রেখেছিলেন। “বিবুধ্য তাং বাক-মারিকাগ্রহং চরাচরাত্মা স নিমীলিতেক্ষণঃ।” আবার ব্রহ্মমোহন লীলায় দেখতে পাই ব্রহ্মা যখন শ্রীকৃষ্ণের ভগবত্তা পরীক্ষা করার জন্য গোবৎস ও গোপবালকদেরকে মায়ামুগ্ধ করে বহুদূরে স্থানান্তরিত করে রেখেছিলেন তখন পর্যন্ত সর্বজ্ঞ কৃষ্ণ মুগ্ধ বালকের মতো বনভূমির সর্বত্র সখাদের ও গোবৎসদেরকে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন । অবশেষে তাঁর সর্বজ্ঞতাশক্তির প্রভাবে জানতে পারলেন যে, ব্রহ্মাই ঐসকল সখা ও গোবৎসদেরকে স্থানান্তিরিত করেছেন।


বৈরাগ্য --- সাধারনতঃ মায়িক বস্তুতে আসক্ত না হওয়াকেই বৈরাগ্য বলা হয়। জীবের পক্ষে এই বৈরাগ্য সাধনার দ্বারা লাভ করতে হয়। কিন্তু শ্রীভগবানের পক্ষে কোনো সাধনের আবশ্যকতা হয় না। বৈরাগ্য তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ গো-গোপ ও গোপিদের সঙ্গে কত না ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন, তবুও হঠাৎ তাঁদেরকে ত্যাগ করে মথুরায় চলে গেলেন । মথুরায় থাকাকালেও তিনি যুধিষ্ঠিরাদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য কাম্যবনে এসেছিলেন। বৃন্দাবন সেখান থেকে বেশী দূরে নয়, অথচ তিনি সেখানে একবারও গেলেন না। ঠিক তেমনিই দ্বারকা-লীলাতেও তিনি পুত্র-পৌত্রাদি আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কতনা ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করেছেন, কিন্তু হঠাৎ ব্রহ্মশাপ-ছলে যদুকুল ধ্বংশ করলেন। এ থেকে বোঝা যায় তিনি কতটা অনাশক্ত। অতএব এ পর্যন্ত শ্রীভগবানের ষড়বিধ ‘ভগ’ অর্থাৎ ঐশ্বর্যের কথা আলোচনা করে আমরা এই সিধান্তে উপনীত হতে পারি যে, কেবল কৃষ্ণই একমাত্র পরমেশ্বর ভগবান আর কেউ নন ।


Written by: Prithwish Ghosh

Share:

প্রতিটি জীবই শিব

 অন্নদা মঙ্গলে দেবী স্বয়ং নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন -

গোত্রের প্রধান পিতা মুখবংশজাত।

পরমকুলীন স্বামী বন্দবংশখ্যাত।।

পিতামহ দিলা মোরে অন্নপূর্ণা নাম।

অনেকের পতি তেঁই পতি মোর বাম।।

অতিবড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ।

কোন গুণ নাহি তাঁর কপালে আগুন।।

কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠভরা বিষ।

কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।।

গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি।

জীবনস্বরূপা সে স্বামীর শিরোমণি।।

ভূত নাচাইয়া পতি ফেরে ঘরে ঘরে।

না মরে পাষাণ বাপ দিলা হেন বরে।।

অভিমানে সমুদ্রেতে ঝাঁপ দিলা ভাই।

যে মোরে আপনা ভাবে তারি ঘরে যাই।।

পড়তে এ সব বেশ লাগে, তবে ভাবি কি নিপুন ভাবে কত বড় এক তত্ব কথা কি সহজ ভাবে পরিবেশন করেছেন ভরত চন্দ্র রায় গুনাকর আবার ভাবি, শুধু রায় গুনাকর কেন? আঠারোটা পুরাণ আছে আমাদের... সবার মাঝেই তো তত্ব কথা এমনি ভাবেই লুকিয়ে আছে ।

মহাদেব শিব... অনাদি অনন্ত... কত রূপে বিরাজ করছেন তিনি

একধারে তিনি পঞ্চানন, পাঁচটি তাঁর আনন বা মুখ  আর নয়ন তিনটি, তৃতীয়টি তাঁর জ্ঞান নয়ন, জ্ঞান ত’ অগ্নি স্বরূপ, সব আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে চারিদিক আলোকিত করে তোলে। এই রূপে তিনি সগুণ ঈশ্বর ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা, জীবের নিয়ন্তা ।

দেবী তাই ত বললেন -- “ভূত নাচাইয়া পতি ফেরে ঘরে ঘরে”  পঞ্চভুত ত’ তাঁর ইঙ্গিতেই নাচছে

আরও বলছেন দেবী -- “অনেকের পতি তেঁই পতি মোর বাম।” বিশ্বনাথ তিনি; তিনি যে জগতের পতি, হলাহল পান করে তিনিই ত’ সৃষ্টি রক্ষা করেছিলেন, তাই ত তাঁর কণ্ঠ ভরা বিষ ।

“কুকথায় পঞ্চমুখ” – তারও যেন কি একটা অর্থ আছে, কুকথা মানে কিন্ত গালাগালি বা খারাপ কথা নয়. সেকি চতুর্বেদেরও ওপারে যে তত্ব আছে তারই ইঙ্গিতই করছে ? 

তবে, এইখানেই শেষ নয়, অন্য আরেক দিক দিয়ে দেখতে গেলে শিব নির্গুণ ব্রহ্মও বটেন। তাই ত দেবী বললেন, “অতিবড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ। কোন গুণ নাহি তাঁর কপালে আগুন” 


আবার জীব রূপে এই শিবই ত’ এই বিশ্বচরাচর ছেয়ে আছেন... আপন প্রকৃতিকে অবলম্বন করে তিনিই ত জীব সেজে হাসছেন, কাঁদছেন, নাচছেন... সংসার সংসার খেলা খেলে চলেছেন.......... অবশ্য জীব সাজতে গিয়ে শিব কে প্রকৃতির সাহায্য নিতে হয়েছে  শাস্ত্র বলে, প্রকৃতির দুইটি রূপ, পরা আর অপরা ।

গিরিরাজকন্যা পার্বতী, শান্ত সমাহিত সেই দৈবী পরা প্রকৃতির প্রতীক আর গঙ্গা তাঁর অপরা প্রকৃতির প্রতীক যাকে অবলম্বন করে শিবের জীবলীলা. তাই ত’ দেবী বলছেন, “গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি, জীবনস্বরূপা সে স্বামীর শিরোমণি” গঙ্গা যে উচ্ছল তরঙ্গায়িত, সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় সে চলার নেশায়, শিবের এই বিশ্বলীলার ধারক ও বাহক সে তাকেই অবলম্বন করে, যে স্বরূপত শিব, তার এই জীব জীব খেলা, এ খেলা খেলা হয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে... আরও কতদিন চলবে কে তা জানে?

-

তবে একদিন নিশ্চয়ই আসবে যেদিন হয়ত শিবের এই খেলা সাঙ্গ করার সাধ হবে

কিম্বা হয় ত এই সাধও এই খেলারই এক অঙ্গ

সে যাই হক... সেদিন শিবেরই জটা জালে আবদ্ধা হবে তরঙ্গময়ী উচ্ছল গঙ্গা

তাঁরই মঙ্গলময় স্পর্শে নিয়ন্ত্রিতা হবে তাঁর এই জীব প্রকৃতি

ধীরে ধীরে সেই চপলা প্রকৃতির মাঝে জেগে ওঠবে এক কল্যাণময় রূপ


পর্বত কন্দরে যার জন্ম

পার্বতীর সেই সতীন

কেমন করে যেন রূপান্তরিত হতে থাকবে

আসলে তার আর পার্বতীর মধ্যে স্বরূপত ত’ কোন ভেদ নেই 

তাই সাগরের বুকে নিজেকে বিলীন করে গঙ্গা আবার ফিরে যাবে সেই গিরি পর্বতের মাঝে

পার্বতীর সতীন তখন পার্বতীরই বুকের মাঝে লীন হয়ে যাবে

আর জীব হয়ে যাবে শিব

সেই জীবরূপী শিব তখন বলে ওঠবে  "অহম্ ব্রহ্মাস্মি"

-

ওঁ নমঃ শিবায়  ওঁ নমঃ শিবায় ওঁ নমঃ শিবায়


Written by Prithwish Ghosh

Share:

হিন্দুর একেশ্বরের ভাবনা

 জ্ঞানদৃষ্টিতে আমরা সকলেই একই পরমসত্তা - ঈশ্বরের প্রকাশ। আমাদের এই প্রকৃত 'আমিত্বের' সন্ধান পেয়েছিলেন প্রাচীন ভারতবর্ষের ঋষিরা তাঁদের সাধনার মধ্যে দিয়ে। জন্ম হয়েছিল বিশ্বের একমাত্র' ও প্রাচীনতম আধ্যাত্মিক দর্শনের। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যখন অজ্ঞানের মোহনিদ্রায় আচ্ছন্ন, সেই সুপ্রাচীন অতীতে হিমালয় শিখরে ধ্বনিত হয়েছিল - '

' শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্যপুত্রাঃ। 

আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থু।। 

বেদাহমেতাং পুরুষং মহান্তম্।

আদিত্য বর্ণং তমসো পরস্তাৎ।।

ত্বমেব বিদিত্বাহতি মৃত্যুমেতি।

নান্যং পন্থা বিদ্যতেহনায় ।। 

---------------------------''এই সনাতন চেতনা - সনাতন ধর্ম, যার বর্তমান প্রচলিত নাম ' হিন্দু ধর্ম'। বিশ্বে এমন কোনও ধর্মমত নেই যার মূল ভাব সনাতন ধর্মে নেই। কারণ সকল ধর্মমতই সনাতনের কাছে ঋণী।

-

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে যে মৌলিক প্রভেদ দেখা যায় , তা হল - প্রাচ্যবাসীরা অন্তর্জগতের অনুসন্ধানে তাঁদের অধিকাংশ শক্তি ব্যয় করেছেন। প্রাচীন ভারতবর্ষ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রভুত উন্নতি সাধন করা সত্ত্বেও সেগুলোকে 'অপরা বিদ্যা' বলে চিহ্নিত করে 'পরা বিদ্যা' অর্থাৎ অন্তর্জগতের সন্ধানে আত্মনিয়োগ করেছিল। অন্তর্জগত-সন্ধানী ঋষিরা ক্রমশঃ এই দৃশ্যমান জগতের অবাস্তবতা অনুধাবন করলেন। এই দৃশ্যমান জগৎ পরিবর্তনশীল , আর যা পরিবর্তনশীল তা নিত্য বা পরম ( absolute ) হতে পারে না। জগতের ঘটনাগুলি নির্দিষ্ট frame of reference এর সাপেক্ষেই সত্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। frame of reference বদলে গেলেই তা অন্যভাবে প্রতিভাত হবে। ঋষিগণ খুঁজতে চেয়েছেন এই পরিবর্তনশীল অনিত্যতার পিছনে কি সেই নিত্যবস্তু, যাকে পরম সত্য (absolute truth) বলে নির্দেশ করা যাবে? এই সন্ধানই ভারতে অধ্যাত্মবিদ্যার জন্ম দিয়েছে। অপরপক্ষে পাশ্চাত্য দেশের মানুষ জড়জগতের রহস্যভেদ করতে গিয়ে জড়বিজ্ঞানে ক্রমশঃ পারদর্শী হয়ে উঠেছে। পাশ্চাত্য সভ্যতা তাই বহির্মুখী এবং প্রাচ্য তথা ভারতীয় সভ্যতা অন্তর্মুখী। 

-

কোনও ধর্মমতের মানুষই প্রাথমিক ভাবে সীমাহীন অনন্তের ধারণা করতে পারেনা। অনন্তের ভাব অবলম্বন করতে সক্ষম হলে আর বিশেষ দিকনির্দেশের দরকার পড়তোনা। কারণ অনন্ত যিনি তিনি তো সর্ব দিকে সমভাবে বিরাজমান। 'হিন্দুরা' মানব মনের এই সীমাবদ্ধতার কথা জানে, কিন্তু অন্যদের মতো এটাকে এড়িয়ে যায়না। তাই ''নির্বিকল্প - নিরাকার - সচ্চিদানন্দঘন'' ঈশ্বরীয় সত্তার প্রথম আবিষ্কারক হয়েও হিন্দু ঋষিরা মূর্তি পূজার প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করেননি। সুদূর অতীতে সমগ্র জগত যখন অজ্ঞানের আদিম অন্ধকারে ঘুমাচ্ছে তখন ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মই আলোকবর্তিকা রূপে মানুষকে এই নিরাকার, অব্যক্ত, সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মর দিকে আকৃষ্ট করেছিল। হিন্দুরা কখনোই প্রতিমাকেই ঈশ্বর মনে করে না। হিন্দুরা মূর্তিতে দেবতাদের পূজা করে এবং পূজা শেষে জলে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। বহুতে এক এবং একের মধ্যে বহুর দর্শনই হিন্দুর দর্শন।

Written by: Prithwish Ghosh

Share:

‘রামের ইচ্ছা’ গল্পটি কি?

 একজন ভক্ত -- ‘রামের ইচ্ছা’ গল্পটি কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ -- “..........সমস্ত তাঁকে সমর্পণ করো -- তাঁকে আত্মসমর্পণ করো। তাহলে আর কোন গোল থাকবে না। তখন দেখবে, তিনিই সব করছেন। সবই রামের ইচ্ছা।” কোন এক গ্রামে একটি তাঁতী থাকে। বড় ধার্মিক, সকলেই তাকে বিশ্বাস করে আর ভালবাসে। তাঁতী হাটে গিয়ে কাপড় বিক্রি করে। খরিদ্দার দাম জিজ্ঞাসা করলে বলে, রামের ইচ্ছা, সুতার দাম একটাকা, রামের ইচ্ছা মেহন্নতের দাম চারি আনা, রামের ইচ্ছা, মুনাফা দুই আনা। কাপড়ের দাম রামের ইচ্ছা একটাকা ছয় আনা। লোকের এত বিশ্বাস যে তৎক্ষণাৎ দাম ফেলে দিয়ে কাপড় নিত। লোকটি ভারী ভক্ত, রাত্রিতে খাওয়াদাওয়ার পরে অনেকক্ষণ চণ্ডীমণ্ডপে বসে ঈশ্বরচিন্তা করে, তাঁর নামগুণকীর্তন করে। একদিন অনেক রাত হয়েছে, লোকটির ঘুম হচ্ছে না, বসে আছে, এক-একবার তামাক খাচ্ছে; এমন সময় সেই পথ দিয়ে একদল ডাকাত ডাকাতি করতে যাচ্ছে। তাদের মুটের অভাব হওয়াতে ওই তাঁতীকে এসে বললে, আয় আমাদের সঙ্গে -- এই বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। তারপর একজন গৃহস্থের বাড়ি গিয়ে ডাকাতি করলে। কতকগুলো জিনিস তাঁতীর মাথায় দিলে। এমন সময় পুলিশ এসে পড়ল। ডাকাতেরা পালাল, কেবল তাঁতীটি মাথায় মোট ধরা পড়ল। সে রাত্রি তাকে হাজতে রাখা হল। পরদিন ম্যাজিস্টার সাহেবের কাছে বিচার। গ্রামের লোক জানতে পেরে সব এসে উপস্থিত। তারা সকলে বললে, ‘হুজুর! এ-লোক কখনও ডাকাতি করতে পারে না’। সাহেব তখন তাঁতীকে জিজ্ঞাসা করলে, ‘কি গো, তোমার কি হয়েছে বল’। তাঁতী বললে, ‘হুজুর! রামের ইচ্ছা, আমি রাত্রিতে ভাত খেলুম। তারপরে রামের ইচ্ছা, আমি চণ্ডীমণ্ডপে বসে আছি, রামের ইচ্ছা অনেক রাত হল। আমি, রামের ইচ্ছা, তাঁর চিন্তা করছিলাম আর তাঁর নাম গুনগাণ করছিলাম। এমন সময়ে রামের ইচ্ছা, একদল ডাকাত সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। রামের ইচ্ছা তারা আমায় ধরে টেনে লয়ে গেল। রামের ইচ্ছা, তারা এক গৃহস্থের বাড়ি ডাকাতি করলে। রামের ইচ্ছা, আমার মাথায় মোট দিল। এমন সময় রামের ইচ্ছা, পুলিস এসে পড়ল। রামের ইচ্ছা, আমি ধরা পড়লুম। তখন রামের ইচ্ছা, পুলিসের লোকেরা হাজতে দিল। আজ সকালে রামের ইচ্ছা, হুজুরের কাছে এনেছে’।

“অমন ধার্মিক লোক দেখে, সাহেব তাঁতীটিকে ছেড়ে দিবার হুকুম দিলেন। তাঁতী রাস্তায় বন্ধুদের বললে, রামের ইচ্ছা, আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। সংসার করা, সন্ন্যাস করা, সবই রামের ইচ্ছা। তাই তাঁর উপর সব ফেলে দিয়ে সংসারে কাজ কর।

“তা না হলে আর কিই বা করবে?

“একজন কেরানি জেলে গিছিল। জেল খাটা শেষ হলে, সে জেল থেকে বেরিয়ে এল। এখন জেল থেকে এসে, সে কি কেবল ধেই ধেই করে নাচবে? না, কেরানিগিরিই করবে?

“সংসারী যদি জীবন্মুক্ত হয়, সে মনে করলে অনায়াসে সংসারে থাকতে পারে। জার জ্ঞানলাভ হয়েছে, তার এখান সেখান নাই। তার সব সমান। যার সেখানে আছে, তার এখানেও আছে।


Written by: Prithwish Ghosh

Share:

০৪ মে ২০২২

চণ্ডী পাঠ করব কেন?

 শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবী বলেছেন- তস্মান্মমৈতন্মাহাত্ম্যং পঠিতব্যং সমাহিতৈঃ।

শ্রোতব্যঞ্চ সদা ভক্তা পরং স্বস্ত্যয়নং হি তৎ ।। (১২/৭)

অর্থাৎ ‘অতএব আমার এই মাহাত্ম্য সমাহিতচিত্তে নিত্য ভক্তিপূর্বক পাঠ বা শ্রবণ করা কর্তব্য। কারণ তাহা অতিশয় মঙ্গলজনক’।‘অতিশয় মঙ্গলজনক’--এই চণ্ডীর কথা আলোচনা করলে আমাদের কী লাভ এখন তা দেখা যাক -------

প্রথম লাভ—কল্যাণ ( ঐহিক ও পারত্রিক )।

দ্বিতীয় লাভ—পাপনাশ ও পাপজনিত আপদ নাশ।

তৃতীয় লাভ—দারিদ্রনাশ।

চতুর্থ লাভ—প্রিয়বিয়োগ নাশ।

পঞ্চম লাভ—শত্রু, দস্যু, রাজা, শস্ত্র, অগ্নি ও জলপ্রবাহ থেকে সমস্ত ভয় নাশ।

ষষ্ঠ লাভ—মহামারীজনিত সর্বপ্রকার উপদ্রব ও ত্রিবিধ উৎপাত দমন।

সপ্তম লাভ—দেবীর প্রসন্নতা ও সন্নিধি।

অষ্টম লাভ—নির্ভীকতা।

নবম লাভ—শত্রুক্ষয়।

দশম লাভ—বংশের উন্নতি।

একাদশ লাভ—শান্তিকর্মে সিদ্ধি।

দ্বাদশ লাভ—গ্রহশান্তি।

ত্রয়োদশ লাভ—দুঃস্বপ্ন সুস্বপ্নে পরিণতি।

চতুর্দশ লাভ— ডাকিনী ও পূতনাদি বালগ্রহ দ্বারা আক্রান্ত শিশুগণের শান্তিলাভ ।

পঞ্চদশ লাভ—বৈরভাব দূরীকরণ ও মিত্রতা স্থাপন।

ষোড়শ লাভ—রাক্ষস, ভূত ও পিশাচগণের বিতাড়ন।

সপ্তদশ লাভ—আরোগ্য।

অষ্টাদশ লাভ—শুভ মতি লাভ অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধি হয় ।

ঊনবিংশ লাভ—সমস্ত সঙ্কট হতে মুক্তি।

এতগুলো লাভ আমাদের হবে। এ সকলই দেবীর শ্রীমুখের বাণী। যদি কোন ব্যক্তি ইহলোকের যাবতীয় উন্নতি চায়, তবে তার এই চণ্ডীতত্ত্ব আলোচনা করা কর্তব্য। রোগ, শোক, আপদ, বিপদ প্রভৃতির বিনাশ সাধন সকল জীবেরই কাম্য। আবার ভক্ত ও জ্ঞানী যারা তারা চায় মুক্তি অর্থাৎ জন্মান্তর নিবারণ। গৃহী কিংবা সন্ন্যাসী সকলেরই চণ্ডীতত্ত্ব আলোচনায় লাভ আছে। যদি আমরা বিশ্বাস করে থাকি, অতীন্দ্রিয় বস্তুকে বা ব্রহ্মকে আমাদের ঋষিরা লাভ করেছিলেন, তবে সেই ব্রহ্মকে অনুভূতিতে আনতে হলে ঋষি প্রদর্শিত পথেই যেতে হবে। তবেই চণ্ডীতত্ত্ব আলোচনা করে ফল পাওয়া যাবে।

Written by: Prithish Ghosh

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।