অর্জ্জুনের আগমন–দ্বারকা দুর্দ্দশাদর্শনে বিলাপ
এ দিকে কৃষ্ণসারথি দারুক হস্তিনায় সমুপস্থিত হইয়া পাণ্ডবগণের নিকট যদুকুলের নিধনবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত কীর্ত্তন করিলে, পাণ্ডবগণ উহা শ্রবণ করিয়া নিতান্ত শোকসন্তপ্ত ও ব্যাকুলচিত্ত হইলেন। তখন বাসুদেবের প্রিয় সখা মহাবীর ধনঞ্জয় ভ্রাতৃগণকে আমন্ত্রণ পূর্ব্বক মাতুল বসুদেবের সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত দারুকের সহিত দ্বারকাভিমুখে যাত্রা করিলেন। অনন্তর তিনি দ্বারকায় সমুপস্থিত হইয়া দেখিলেন, ঐ নগরী অনাথা রমণীর ন্যায় নিতান্ত হীনদশা প্রাপ্ত হইয়াছে। ঐ সময় বাসুদেবের অন্তঃপুরস্থ রমণীগণ তাঁহার বিরহে নিতান্ত কাতর হইয়াছিলেন; তাঁহারা অর্জ্জুনকে দর্শন করিবামাত্র উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। বাসুদেবের যে ষোড়শসহস্র মহিষী ছিলেন, তাঁহারা অর্জ্জুনকে সমাগত দেখিয়া হাহাকার করিতে আরম্ভ করিলেন। সেই পতিপুত্ত্রবিহীনা রমণীগণের আর্ত্তনাদ শ্রবণে অর্জ্জুনের নয়নযুগল বাষ্পবারিতে পরিপূর্ণ হওয়াতে, তিনি তৎকালে কিছুমাত্র দর্শন করিতে সমর্থ হইলেন না।
যাদবগণের দুর্দ্দশাদর্শনে অর্জ্জুনের বিলাপ
ঐ সময় সেই বীরশূন্য দ্বারকাপুরীকে বৈতরণী নদীর ন্যায় তাঁহার বোধ হইতে লাগিল। তিনি বৃষ্ণি ও অন্ধকগণকে উহার জল, অশ্বসমুদায়কে মৎস্য, রথসমুদায়কে উড়ুপ, বাদিত্র ও রথনির্ঘোষকে তরঙ্গ, গৃহসোপানসমুদায়কে মহাহ্রদ, রত্নসমুদায়কে শৈবাল, পথসমুদায়কে আবর্ত্ত, চত্বরসমুদায়কে স্তিমিত হ্রদ এবং বলদেব ও বাসুদেবকে মহানক্র বলিয়া বোধ করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি সেই দ্বারকাপুরী ও বাসুদেবের বনিতাদিগকে হেমন্তকালীন নলিনীর ন্যায় নিতান্ত শ্রীভ্রষ্ট ও প্রভাশূন্য দর্শন করিয়া বাষ্পাকুলিত লোচনে রোদন করিতে করিতে ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তখন বাসুদেবমহিষী সত্যভামা, রুক্মিণী ও অন্যান্য রমণীগণ অর্জ্জুনের নিকট বেগে ধাবমান হইয়া তাঁহাকে পরিবেষ্টন পূর্ব্বক কিয়ৎক্ষণ রোদন করিলেন এবং তৎপরে তাঁহাকে ধরাতল হইতে উত্থাপন পূর্ব্বক কাঞ্চনময় পীঠে উপবেশন করাইয়া তাঁহার চতুর্দ্দিকে অবস্থান করিতে লাগিলেন।
যদুবংশধ্বংসে বসুদেবের বিলাপ
বৈশম্পায়ন বলিলেন, হে মহারাজ! অনন্তর মহাত্মা অর্জ্জুন মনে মনে বাসুদেবের স্তব করিয়া স্ত্রীগণকে আশ্বাস প্রদান পূর্ব্বক মাতুলের সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে তাঁহার গৃহে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলেন, মহাত্মা বসুদেব পুত্ত্রশোকে নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়া শয়ান রহিয়াছেন। তাঁহাকে তদবস্থ দেখিয়া ধনঞ্জয়ের দুঃখের আর পরিসীমা রহিল না। তখন তিনি বাষ্পপূর্ণনয়নে রোদন করিতে করিতে তাঁহার চরণযুগল বন্দনা করিলেন।
মহাত্মা বসুদেব ভাগিনেয় অর্জ্জুনকে সমাগত দেখিয়া নিতান্ত দৌর্ব্বল্যনিবন্ধন তাঁহার মস্তকাঘ্রাণ করিতে সমর্থ না হইয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন পূর্ব্বক পুত্ত্র, পৌত্ত্র, দৌহিত্র ও বান্ধবগণের নিমিত্ত রোদন করিতে করিতে কহিলেন, “ধনঞ্জয়! যাহারা অসংখ্য ভূপতি ও দানবগণকে পরাজিত করিয়াছিল, আজি আমি তাহাদিগকে না দেখিয়াও জীবিত রহিয়াছি! তুমি যে প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকিকে প্রিয়শিষ্য বলিয়া সর্ব্বদা প্রশংসা করিতে এবং যাহারা বৃষ্ণিবংশের অতিরথ বলিয়া বিখ্যাত ও বাসুদেবের নিতান্ত প্রিয়পাত্র ছিল, এক্ষণে তাহাদিগেরই দুর্নীতিনিবন্ধন এই যদুকুলের ক্ষয় হইয়াছে। অথবা উহাদের এ বিষয়ে দোষ কি? ব্রহ্মশাপই ইহার মূল কারণ।
“পূর্ব্বে যে কৃষ্ণ মহাবলপরাক্রান্ত কেশী, কংস, শিশুপাল, নিষাদরাজ একলব্য, কাশিরাজ, কালিঙ্গগণ, মাগধগণ, গান্ধারগণ এবং প্রাচ্য, দাক্ষিণাত্য ও পার্ব্বতীয় ভূপালগণকে নিহত করিয়াছিলেন, এক্ষণে তিনিও এই যদুকুল ক্ষয় হইতে দেখিয়া উপেক্ষা করিয়াছেন। তুমি, দেবর্ষি নারদ ও অন্যান্য মহর্ষিগণ তোমরা সকলেই যাঁহাকে সনাতন দেবদেব বলিয়া কীর্ত্তন করিয়া থাক, তিনি এক্ষণে স্বচক্ষে জ্ঞাতিবধ প্রত্যক্ষ করিয়া উপেক্ষা করিলেন। বোধ হয়, গান্ধারী ও ঋষিগণের বাক্য অন্যথা করিতে তাঁহার বাসনা হয় নাই।
“তোমার পৌত্র পরীক্ষিৎ অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র দ্বারা দগ্ধ হইলে, তিনিই তাঁহার জীবন দান করিয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে স্বীয় পরিজনদিগকে রক্ষা করিতে তাঁহার বাসনা হইল না। তাঁহার পুত্র, পৌত্র, সখা ও ভ্রাতৃগণ সকলে নিহত হইলে, তিনি আমার নিকট আগমন পূর্ব্বক আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘পিতঃ! আজি এই যদুকুল একবারে নিঃশেষিত হইল। আমার প্রিয় সখা অর্জ্জুন দ্বারকায় আগমন করিলে, আপনি তাঁহার নিকট এই কুলক্ষয়ের বিষয় আনুপূর্ব্বিক কীর্ত্তন করিবেন। আমি অর্জ্জুনের নিকট দূত প্রেরণ করিয়াছি। তিনি এই নিদারুণ সংবাদ শ্রবণ করিলে, কখনই হস্তিনায় অবস্থান করিতে পারিবেন না। অর্জ্জুনের সহিত আমার কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। অতএব ঐ মহাত্মা এ স্থানে আগমন করিয়া যাহা কহিবেন, আপনি অবিচারিতচিত্তে তাহার অনুষ্ঠান করিবেন। তাঁহা দ্বারাই আপনার ঔর্দ্ধ্বদেহিক কার্য্যসম্পাদন এবং এই বালক ও রমণীগণের রক্ষা হইবে। তিনি এই স্থান হইতে প্রতিগমন করিবমাত্র এই অসংখ্য প্রাচীর ও অট্টালিকাসম্পন্ন দ্বারকাপুরী সমুদ্রজলে প্লাবিত হইয়া যাইবে। আমি এক্ষণে বলদেবের সহিত কোন পবিত্র স্থানে সমুপস্থিত হইয়া কাল প্রতীক্ষায় অবস্থান করিব।’
“অচিন্ত্যপরাক্রম মহাত্মা হৃষীকেশ এই বলিয়া আমাকে বালকগণের সহিত এই স্থানে রাখিয়া যে কোথায় গমন করিয়াছেন, কিছুই বলিতে পারি না। আমি নিতান্ত শোকাকুল হইয়া দিবারাত্রি বলদেব, বাসুদেব ও জ্ঞাতিগণকে স্মরণ পূর্ব্বক অনাহারে কালহরণ করিতেছি। আর আমার জীবন ধারণ ও ভোজন করিতে প্রবৃত্তি নাই। এক্ষণে সৌভাগ্যবশতঃ তোমার সহিত আমার সাক্ষাৎকার লাভ হইল। অতএব তুমি অবিলম্বে বাসুদেবের বাক্যানুরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান কর। এক্ষণে এই রাজ্য, স্ত্রী ও রত্নসমুদায় তোমার অধিকৃত হইল। আমি অচিরাৎ তোমার সমক্ষেই প্রাণত্যাগ করিব।”
মহাত্মা বসুদেব ভাগিনেয় অর্জ্জুনকে সমাগত দেখিয়া নিতান্ত দৌর্ব্বল্যনিবন্ধন তাঁহার মস্তকাঘ্রাণ করিতে সমর্থ না হইয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন পূর্ব্বক পুত্ত্র, পৌত্ত্র, দৌহিত্র ও বান্ধবগণের নিমিত্ত রোদন করিতে করিতে কহিলেন, “ধনঞ্জয়! যাহারা অসংখ্য ভূপতি ও দানবগণকে পরাজিত করিয়াছিল, আজি আমি তাহাদিগকে না দেখিয়াও জীবিত রহিয়াছি! তুমি যে প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকিকে প্রিয়শিষ্য বলিয়া সর্ব্বদা প্রশংসা করিতে এবং যাহারা বৃষ্ণিবংশের অতিরথ বলিয়া বিখ্যাত ও বাসুদেবের নিতান্ত প্রিয়পাত্র ছিল, এক্ষণে তাহাদিগেরই দুর্নীতিনিবন্ধন এই যদুকুলের ক্ষয় হইয়াছে। অথবা উহাদের এ বিষয়ে দোষ কি? ব্রহ্মশাপই ইহার মূল কারণ।
“পূর্ব্বে যে কৃষ্ণ মহাবলপরাক্রান্ত কেশী, কংস, শিশুপাল, নিষাদরাজ একলব্য, কাশিরাজ, কালিঙ্গগণ, মাগধগণ, গান্ধারগণ এবং প্রাচ্য, দাক্ষিণাত্য ও পার্ব্বতীয় ভূপালগণকে নিহত করিয়াছিলেন, এক্ষণে তিনিও এই যদুকুল ক্ষয় হইতে দেখিয়া উপেক্ষা করিয়াছেন। তুমি, দেবর্ষি নারদ ও অন্যান্য মহর্ষিগণ তোমরা সকলেই যাঁহাকে সনাতন দেবদেব বলিয়া কীর্ত্তন করিয়া থাক, তিনি এক্ষণে স্বচক্ষে জ্ঞাতিবধ প্রত্যক্ষ করিয়া উপেক্ষা করিলেন। বোধ হয়, গান্ধারী ও ঋষিগণের বাক্য অন্যথা করিতে তাঁহার বাসনা হয় নাই।
“তোমার পৌত্র পরীক্ষিৎ অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র দ্বারা দগ্ধ হইলে, তিনিই তাঁহার জীবন দান করিয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে স্বীয় পরিজনদিগকে রক্ষা করিতে তাঁহার বাসনা হইল না। তাঁহার পুত্র, পৌত্র, সখা ও ভ্রাতৃগণ সকলে নিহত হইলে, তিনি আমার নিকট আগমন পূর্ব্বক আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘পিতঃ! আজি এই যদুকুল একবারে নিঃশেষিত হইল। আমার প্রিয় সখা অর্জ্জুন দ্বারকায় আগমন করিলে, আপনি তাঁহার নিকট এই কুলক্ষয়ের বিষয় আনুপূর্ব্বিক কীর্ত্তন করিবেন। আমি অর্জ্জুনের নিকট দূত প্রেরণ করিয়াছি। তিনি এই নিদারুণ সংবাদ শ্রবণ করিলে, কখনই হস্তিনায় অবস্থান করিতে পারিবেন না। অর্জ্জুনের সহিত আমার কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। অতএব ঐ মহাত্মা এ স্থানে আগমন করিয়া যাহা কহিবেন, আপনি অবিচারিতচিত্তে তাহার অনুষ্ঠান করিবেন। তাঁহা দ্বারাই আপনার ঔর্দ্ধ্বদেহিক কার্য্যসম্পাদন এবং এই বালক ও রমণীগণের রক্ষা হইবে। তিনি এই স্থান হইতে প্রতিগমন করিবমাত্র এই অসংখ্য প্রাচীর ও অট্টালিকাসম্পন্ন দ্বারকাপুরী সমুদ্রজলে প্লাবিত হইয়া যাইবে। আমি এক্ষণে বলদেবের সহিত কোন পবিত্র স্থানে সমুপস্থিত হইয়া কাল প্রতীক্ষায় অবস্থান করিব।’
“অচিন্ত্যপরাক্রম মহাত্মা হৃষীকেশ এই বলিয়া আমাকে বালকগণের সহিত এই স্থানে রাখিয়া যে কোথায় গমন করিয়াছেন, কিছুই বলিতে পারি না। আমি নিতান্ত শোকাকুল হইয়া দিবারাত্রি বলদেব, বাসুদেব ও জ্ঞাতিগণকে স্মরণ পূর্ব্বক অনাহারে কালহরণ করিতেছি। আর আমার জীবন ধারণ ও ভোজন করিতে প্রবৃত্তি নাই। এক্ষণে সৌভাগ্যবশতঃ তোমার সহিত আমার সাক্ষাৎকার লাভ হইল। অতএব তুমি অবিলম্বে বাসুদেবের বাক্যানুরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান কর। এক্ষণে এই রাজ্য, স্ত্রী ও রত্নসমুদায় তোমার অধিকৃত হইল। আমি অচিরাৎ তোমার সমক্ষেই প্রাণত্যাগ করিব।”
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন