০৪ জুলাই ২০১৪

সর্পরক্ষার সংক্ষিপ্ত কথা,অরুণ ও গরুড়ের জন্ম, সমুদ্রমন্থনের প্রশ্ন, সমুদ্রমন্থনারম্ভ, রাহুর মস্তকচ্ছেদ । দেবাসুর-সংগ্রাম, নাগগণের প্রতি অভিশাপ, সমুদ্রবর্ণন, কদ্রু-বিনতার সাগরতীরে গমন,


পঞ্চদশ অধ্যায়
সর্পরক্ষার সংক্ষিপ্ত কথা
উগ্রশ্রবাঃ মহর্ষি শৌনককে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে ব্রহ্মজ্ঞানপারদর্শিন্! পূর্ব্বকালে সর্পগণ স্বীয় জননীর নিকট এইরূপ শাপগ্রস্ত হইয়াছিল যে, রাজা জনমেজয়ের যজ্ঞে অগ্নি তাহাদিগকে দগ্ধ করিবেন। ভুজঙ্গরাজ বাসুকি সেই শাপবিমোচনের অভিসন্ধি করিয়া মহাত্মা জরৎকারুকে স্বীয় ভগিনী প্রদান করেন। জরৎকারু বিধিপূর্ব্বক তাঁহার পাণিগ্রহণ করিয়া তদ্‌গর্ভে আস্তীক নামে পুৎত্র উৎপাদন করেন। মহাত্মা আস্তীক বেদবেদাঙ্গশাস্ত্রে পারদর্শী, সর্ব্বভূতে সমদৃষ্টি ও তপশ্চর্য্যায় নিতান্ত অনুরক্ত ছিলেন। তিনি পিতৃকুল মাতৃকুল উভয় কুলের দাহভয় নিবারণ করেন। পাণ্ডুকুলোদ্ভব রাজা জনমেজয় বহুকালের পর সর্পসত্র নামে এক মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। সেই সর্পকুলকালান্তক যজ্ঞ আরব্ধ হইলে মহাতপ আস্তীক ভ্রাতৃগণ, মাতুলগণ ও অন্যান্য সর্পগণকে রক্ষা করিয়াছিলেন।
জরৎকারু পুৎত্রোৎপাদন ও তপশ্চর্য্যা দ্বারা পিতৃলোকের উদ্ধারসাধন, বিবিধ ব্রতানুষ্ঠান ও বেদাধ্যয়ন দ্বারা মুনিগণের তুষ্টি সম্পাদন এবং নানাবিধ যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা দেবগণের পরিতোষ সমাধান করিলেন। তিনি এইরূপে পুৎত্রোৎপাদন, ব্রহ্মচর্য্য ও যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা পিতৃঋণ, ঋষিঋণ ও দেবঋণ স্বরূপ গুরুতর ভার হইতে মুক্ত হইয়া পূর্ব্বপুরুষগণের সহিত স্বর্গে আরোহণ করেন। হে ভৃগুবংশাবতংস! আমি যথাক্রমে এই আস্তীকোপাখ্যান কহিলাম, এক্ষণে আর কি কহিতে হইবে, আজ্ঞা করুন।

ষোড়শ অধ্যায়
অরুণ ও গরুড়ের জন্ম
শৌনক কহিলেন, হে সূতনন্দন! তুমি যাহা কীর্ত্তন করিলে, পুনর্ব্বার তাহাই সবিস্তরে বর্ণন কর; আস্তীকবৃত্তান্ত বিশেষরূপে শ্রবণ করিতে আমাদিগের নিতান্ত ঔৎসুক্য হইয়াছে। আস্তীকোপাখ্যানটি অতি সুললিত ও সুমধুর বোধ হইল। ইহা শুনিয়া আমার পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইয়াছি। ফলতঃ তুমি পুরাণকীর্ত্তনবিষয়ে স্বীয় পিতার ন্যায় পাণ্ডিত্য প্রকাশ করিয়াছ। তোমার পিতা যেমন অনন্য বিষয়ানুরক্ত হইয়া প্রত্যহ আমাদিগকে পুরাণ শ্রবণ করাইতেন, এক্ষণে তুমিও সেইরূপ অনন্যমনা ও অনন্যকর্ম্মা হইয়া আমাদিগকে পুরাণ শ্রবণ করাও।
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে মহাত্মন্! আমি পিতার নিকট আস্তীকোপখ্যান যেরূপ শুনিয়াছি, অবিকল সেইরূপ কহিতেছি, শ্রবণ করুন। সত্যযুগে দক্ষপ্রজাপতির কদ্রু ও বিনতা নামে দুই পরমাসুন্দরী কন্যা ছিলেন। মহর্ষি কশ্যপ ঐ দুই কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। একদা তিনি সেই ধর্ম্মপত্নীদ্বয়ের প্রতি অতিমাত্র প্রসন্ন হইয়া তাঁহাদিগকে বরপ্রদান করিতে চাহিলেন। “পরস্পর সমান-পরাক্রান্ত, এইরূপ সহস্রনাগ আমার পুৎত্র হউক” বলিয়া কদ্রু বর প্রার্থনা করিলেন; কিন্তু বিনতা এই বর চাহিলেন, “আমার দুইটি মাত্র পুৎত্র হউক, কিন্তু তাহারা যেন বল, বিক্রম ও শরীরে কদ্রু-পুৎত্র অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হয়।” মহর্ষি কশ্যপ “তথাস্তু” বলিয়া তাঁহাদিগকে সেই অভিলষিত বর প্রদান করিলেন। বিনতা স্বামিসন্নিধানে স্বাভিলষিত বর সংপ্রাপ্ত হইয়া সাতিশয় সন্তুষ্টা ও কৃতার্থম্মন্যা হইলেন। কদ্রু তুল্যতেজস্বী পুৎত্র-সহস্র-লাভে আপনাকে কৃতকৃত্য জ্ঞান করিলেন। মহাতপা কশ্যপ পত্নীদিগকে “তোমরা স্বীয় প্রযত্নে গর্ভধারণ করিও” এই আদেশ দিয়া অরণ্যানী প্রবেশ করিলেন।
বহুকালের পর কদ্রু অণ্ড-সহস্র ও বিনতা অণ্ডদ্বয় প্রসব করিলেন। পরিচারিকাগণ সেই সমুদয় অণ্ড উপস্বেদযুক্ত [তাপসংযুক্ত– ডিমে তা দেওয়া হয় এইরূপ।] ভাণ্ডমধ্যে পঞ্চশত বৎসর রাখিলেন। তৎপরে কদ্রু-প্রসূত অণ্ডসহস্র হইতে এক একটি পুৎত্র বহির্গত হইল। কিন্তু বিনতার অণ্ডদ্বয় তদবস্থই রহিল। পুৎত্রার্থিনী বিনতা তদ্দর্শনে সাতিশয় লজ্জিতা হইয়া স্ব-প্রসূত অণ্ডদ্বয়ের অন্যতর ভেদ করিয়া দেখিলেন যে, পুৎত্রের পূর্ব্বার্দ্ধকায়মাত্র সুসঙ্ঘটিত হইয়াছে, অন্যার্দ্ধ অতিশয় অপক্কাবস্থায় রহিয়াছে। তখন সেই সদ্যঃ-প্রসূত পুৎত্র সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া স্বীয় জননীকে অভিসম্পাত করিলেন, “লোভ-পরতন্ত্র হইয়া অপক্কাবস্থায় অণ্ড-ভেদনপূর্ব্বক আমাকে তন্মধ্য হইতে বাহির করা তোমার নিতান্ত অসদৃশ কর্ম্ম হইয়াছে; অতত্রব তুমি যে সপত্নীর সহিত স্পর্দ্ধাপ্রযুক্ত এই অন্যায্য কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে, পঞ্চাশৎ বৎসর তোমাকে সেই সপত্নীর দাসী হইয়া থাকিতে হইবে।” আরও বলিলেন, “এই অপর অণ্ডমধ্যে তোমার যে পুৎত্র আছে, যদি অকালে অণ্ডভেদ না কর এবং তাহাকেও আমার ন্যায় হীনাঙ্গ বা বিকলাঙ্গ না কর, তবে সেই তোমাকে দাসীত্ব হইতে মোচন করিবে। যদি তুমি আপন পুৎত্রকে বিশিষ্টরূপে বল বিক্রমশালী করিতে চাও, তবে ধৈর্য্যধারণপূর্ব্বক ইহার জন্মকাল প্রতীক্ষা কর। ইহার জন্মের আরও পঞ্চশত বৎসরকাল বিলম্ব আছে।”
অরুণ এইরূপে জননীকে শাপ প্রদান করিয়া আকাশপথে আরোহণপূর্ব্বক সূর্য্যদেবের সারথ্যকার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। সর্পভোজী গরুড়ও যথাকালে জন্মিলেন। তিনি জন্মিবামাত্র ক্ষুধাতুর হইয়া স্বীয় জননী বিনতাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক বিধাতৃবিহিত স্বকীয় আহার-সংগ্রহার্থে আকাশমণ্ডলে উড্ডীয়মান হইলেন।

সপ্তদশ অধ্যায়
সমুদ্রমন্থনের প্রশ্ন
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে তপোধন! ঐ সময়ে উচ্চৈঃশ্রবা কদ্রু ও বিনতার সমীপ দিয়া গমন করিতেছিল। দেবগণ অমৃতমন্থনকালে উৎপন্ন সেই সর্ব্বোৎকৃষ্ট ও সর্ব্ব-সুলক্ষণ-সম্পন্ন হয়-রত্নকে গমন করিতে দেখিয়া প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
শৌনক কহিলেন, হে সূতপুৎত্র! তুমি কহিলে, সেই মহাবীর্য্য অশ্বরাজ সুধা-মন্থনসময়ে উৎপন্ন হয়; অতএব জিজ্ঞাসা করিতেছি, বল, দেবগণ কি কারণে ও কোন্ স্থানে অমৃত-মন্থন করিয়াছিলেন?
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, সুমেরু নামে এক পরম রমণীয় মহীধর আছে। যাহার সুবর্ণময় শৃঙ্গ-পরম্পরার প্রভাজাল প্রদীপ্ত সূর্য্যের প্রভামণ্ডলকে তিরস্কৃত করে, যে অপ্রমেয় ভূধর দেবগণ ও গন্ধর্ব্বগণের আবাস-স্থান, যাহাতে দুর্দ্দান্ত হিংস্র-জন্তুগণ সর্ব্বদা বিচরণ করে, যে পর্ব্বত প্রতিদিন রজনীযোগে নানা প্রকার ওষধি দ্বারা আলোকময় হয় এবং যে পর্ব্বত উন্নতি দ্বারা অমরলোক আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছে, নানাবিধ নদ নদী ও তরুলতাগণ যাহাকে সুরভিত করিয়াছে, মনোহর বিহঙ্গমগণ যাহার বৃক্ষশাখায় বসিয়া সর্ব্বদা সুমধুরস্বরে কলরব করিতেছে, যে সুবর্ণময় মহীধর প্রাকৃত-জনসমূহের মনেরও অগোচর, একদা, তপোনিয়মানুরক্ত, প্রবলপরাক্রান্ত দেবগণ সেই পর্ব্বতের নানারত্ন সুশোভিত শিখরদেশে উপবেশনপূর্ব্বক অমৃতপ্রাপ্তিবিষয়ক মন্ত্রণা করিতেছিলেন। ভগবান্ ভূতভাবন নারায়ণ দেবতাদিগকে এইরূপে মন্ত্রণা করিতে ব্যাসক্ত দেখিয়া ব্রহ্মাকে কহিলেন, “দেবগণ ও অসুরগণ একত্র হইয়া জলধিমন্থন করিতে আরম্ভ করুন। মন্থন করিলে সমুদ্র হইতে অমৃত উত্থিত হইবে।” তদনন্তর দেবগণকে কহিলেন, “হে সুরগণ! তোমরা সমুদ্র-মন্থন কর, কিন্তু বহুবিধ ওষধি এবং রত্নসমূহ পাইয়াও মন্থনে ক্ষান্ত হইও না। ধৈর্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক অনবরতই মন্থন করিতে থাকিবে, তাহা হইলেই তোমাদের অমৃতলাভ হইবে, সন্দেহ নাই।”

অষ্টাদশ অধ্যায়
সমুদ্রমন্থনারম্ভ
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, দেবগণ অমৃত-মন্থনে আদেশ পাইয়া মন্থর-ভূধরকে মন্থনদণ্ড করিতে মনস্থ করিলেন, কিন্তু গগনস্পর্শী শিখরমালায় সুশোভিত, বহুতর লতাজালে জড়িত, নানাজাতীয় বিহঙ্গমনিনাদে নিনাদিত, বহুবিধ-ব্যালকুল [সর্পসমূহ] সমাকীর্ণ, অপ্সরাগণ ও কিন্নরগণ কর্ত্তৃক নিরন্তর সেবিত, একাদশ সহস্র যোজন উন্নত এবং তৎপরিমাণে ভূগর্ভে নিখাত [প্রোথিত- যতটুকু পোঁতা] গিরিবর মন্দরের উত্তোলনে অশক্ত হইয়া ব্রহ্মা ও নারায়ণের সমীপে গিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, “আপনারা আমাদিগের হিতসাধনার্থে কোন সদুপায় নির্দ্ধারণ ও মন্দরোদ্ধরণে প্রযত্ন করুন।”
অপ্রমেয়াত্মা ভগবান্ বিষ্ণু ও ব্রহ্মা দেবতাদিগের প্রার্থনায় সম্মতিপ্রকাশপূর্ব্বক ভুজঙ্গাধিপতি অনন্তদেবকে মন্দরোত্তোলনে অনুমতি করিলেন। মহাবল-পরাক্রান্ত অনন্ত তাঁহাদের আদেশ পাইয়া সমস্ত বন ও বনবাসিগণের সহিত সেই গিরিবরের উদ্ধরণ করিলেন। অনন্তর দেবগণ অনন্তদেবের সহিত নীরনিধিতীরে সমুপস্থিত হইয়া সমুদ্রকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “আমরা অমৃতলাভের জন্য তোমার জল মন্থন করিব।” অর্ণব কহিলেন, “মন্দর-ভ্রমণ দ্বারা আমাকে অনেক ক্লেশ সহ্য করিতে হইবে, অতএব আমিও যেন লাভের অংশ পাই।” তদনন্তর সমস্ত দেবগণ ও অসুরগণ কূর্ম্মরাজকে কহিলেন, “তুমি এই গিরিবরের অধিষ্ঠান [আধার] হও।” কূর্ম্মরাজ তথাস্তু বলিয়া স্বীয়পৃষ্ঠে মন্দরগিরি ধারণ করিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র কূর্ম্মরাজ-পৃষ্ঠে অধিষ্ঠিত গিরিরাজকে যন্ত্রসহকারে চালিত করিলেন।
এইরূপে দেবগণ মন্দর-গিরিকে মন্থনদণ্ড ও বাসুকিকে মন্থন-রজ্জু করিয়া অম্ভোনিধিমন্থন করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবল-পরাক্রান্ত দানবদল রজ্জুভূত বাসুকির মুখদেশ ও সুরগণ পুচ্ছদেশ ধারণ করিলেন। ভগবান্ অনন্তদেব সাক্ষাৎ নারায়ণের অংশস্বরূপ, এই নিমিত্ত তিনি আপন দুঃসহ বিষবেগ সংবরণ করিলেন। মন্থনকালে দেবগণ নাগরাজকে এমত বলপূর্ব্বক আকর্ষণ করিতে লাগিলেন যে তাঁহার মুখ হইতে নিরন্তর অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সহিত নিঃশ্বাসবায়ু নির্গত হইতে লাগিল। ঐ ধূমাগ্নি-সহিত নিশ্বাসবায়ু সচপলা মেঘমালারূপে পরিণত হইয়া, নিতান্ত শ্রান্ত ও একান্ত সন্তপ্ত দেবাসুরগণের উপর বারিবর্ষণ করিতে লাগিল এবং সেই গিরিবরের শৃঙ্গ হইতে পুষ্পবৃষ্টি হইতে লাগিল।
দেবাসুরগণ মন্দর-ভূধর দ্বারা এইরূপে সমুদ্রমন্থনে প্রবৃত্ত হইলেন। মথ্যমান মহোদধি হইতে ঘোরতর ঘনঘটার গভীর গর্জ্জনের ন্যায় ভয়ঙ্কর শব্দ উঠিল। মন্দরাদ্রির মর্দ্দনে সমুদ্রস্থ শত শত জলচরগণ বিনিষ্পিষ্ট হইয়া পঞ্চত্ব পাইল এবং পাতাল তলস্থ অন্যান্য নানাবিধ জলজন্তুগণও প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল। সেই গিরিরাজ অনবরত ভ্রাম্যমাণ হওয়াতে তাহার শিখরস্থ প্রকাণ্ড বৃক্ষ-সকল পরস্পর সংঘৃষ্ট হইয়া বিহঙ্গকুলের সহিত ভূতলে পতিত হইতে লাগিল। মন্দরগিরি সেই সকল তরুগণের পরস্পর সঙ্ঘর্ষণে সমুদ্ভুত হুতাশন-শিখা দ্বারা সমাবৃত হইয়া তড়িৎপটলাবৃত [বিদ্যুৎশ্রেণীবেষ্টিত] নবীন নীরদের ন্যায় সাতিশয় শোভমান হইল। পরে ঐ অনল ক্রমে ক্রমে প্রবল হইয়া অরণ্যানীবিনির্গত কুঞ্জর, কেশরিগণ ও অন্যান্য বন্যজন্তুগণকে দগ্ধ করিতে লাগিল। সঙ্ঘর্ষণজ হুতাশন এইরূপে পর্ব্বতস্থ সমস্ত জীবজন্তুগণকে দগ্ধ করিতে আরম্ভ করিলে সুরপতি ইন্দ্র মেঘ সমুদ্ভুত সলিল-সেচন দ্বারা তাহা নির্ব্বাণ করিলেন।
অনন্তর নানাবিধ মহীরুহগণের নির্য্যাস ও মহৌষধিরস গলিয়া সমুদ্রে পতিত হইতে লাগিল। অমৃতসম-গুণসম্পন্ন সেই সমস্ত বৃক্ষনির্য্যাস ও কাঞ্চননিস্রাবের [গলিত সোনার ধারা- সোনার কস] প্রভাবে দেবগণ অমরত্ব প্রাপ্ত হইলেন। সমুদ্রজল পূর্ব্বোক্ত বহুবিধ উৎকৃষ্ট রস দ্বারা মিশ্রিত হইয়া ক্ষীররূপে পরিণত হইল। সেই ক্ষীর হইতে ঘৃত উৎপন্ন হয়।
তদনন্তর দেবগণ পদ্মাসনস্থ ব্রহ্মার নিকট উপস্থিত হইয়া নিবেদন করিলেন, “ভগবান্! নারায়ণ ব্যতিরেকে আমরা সকলে নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়াছি। কোন্ কালে মন্থন আরম্ভ করিয়াছিলেন, কিন্তু এ পর্য্যন্ত অমৃত সমুত্থিত হয় নাই।” তখন ব্রহ্মা নারায়ণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “তুমি ইহাদের বলাধান কর; তুমি ব্যতিরেকে এ বিষয়ে আর গত্যন্তর নাই।” নারায়ণ কহিলেন, “যাঁহারা এই কার্য্যে ব্যাপৃত আছেন, আমি তাঁহাদের সকলকেই বল প্রদান করিতেছি, তাঁহারা সকলে একত্রিত হইয়া অম্ভোনিধিকে আলোড়িত করুন।”
সমস্ত দেব-দানবগণ বিষ্ণুর এই বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র বলপ্রাপ্ত হইলেন এবং সকলে একত্র হইয়া পুনর্ব্বার পূর্ব্বাপেক্ষা প্রবলরূপে জলনিধি মন্থন করিতে আরম্ভ করিলেন। তদনন্তর মথ্যমান মহাসাগর হইতে সুশীতলরশ্মি-সম্পন্ন, সৌম্যমূর্ত্তি, নির্ম্মল শীতাংশু [চন্দ্র] উৎপন্ন হইলেন। তৎপরে ঘৃত হইতে শ্বেত পদ্মোপবিষ্টা লক্ষ্মী ও সুরাদেবী উঠিলেন। উচ্চৈঃশ্রবা নামে শ্বেতবর্ণ হয়-রত্ন ও ঘৃত হইতে উৎপন্ন হইল। পরে মহোজ্জল কৌস্তুভ-মণি ঘৃত হইতে সমুৎপন্ন হইয়া নারায়ণের বক্ষঃস্থলে লম্বমান হইল। লক্ষ্মী, সুরাদেবী, চন্দ্র ও মনোজব [মনের ন্যায় গতিশীল] অশ্বোত্তম উচ্চৈঃশ্রবা সূর্য্যমার্গাবলম্বনপূর্ব্বক সুরপক্ষে গমন করিলেন। পরিশেষে মূর্ত্তিমান্ ধন্বন্তরি অমৃত-পূর্ণ শ্বেতবর্ণ কমণ্ডলু হস্তে লইয়া সমুদ্র হইতে আবির্ভূত হইলেন। দৈত্যগণ এই অদ্ভুত ব্যাপার নিরীক্ষণ করিয়া “এই অমৃত আমার, এই অমৃত আমার” এই বলিয়া ঘোরতর কোলাহল করিতে আরম্ভ করিল। তদনন্তর শ্বেতকায়, দন্তচতুষ্টয়-বিশিষ্ট ঐরাবত নামে মহাগজ সমুৎপন্ন হইল। বজ্রধর ইন্দ্র তাহাকে অধিকার করিলেন। সুরাসুর তথাপি ক্ষান্ত না হইয়া অনবরতই মন্থন করিতে লাগিলেন। তাহাতে কালকুট গরল উৎপন্ন হইল। সধূম জ্বলদগ্নির ন্যায় সেই ভয়ঙ্কর গরল ধরণীতল আকুল করিল। কালকূটের কটুগন্ধ আঘ্রাণ করিয়া ত্রিলোকী মূর্চ্ছিত হইল। ব্রহ্মা তদবলোকনে ভীত হইয়া অনুরোধ করাতে সাক্ষাৎ মন্ত্রমূর্ত্তি ভগবান্ ভবানীপতি তৎক্ষণাৎ ঐ বিষম বিষরাশি পান করিয়া কণ্ঠে ধারণপূর্ব্বক ত্রৈলোক্য রক্ষা করিলেন। তদবধি তিনি নীলকণ্ঠ নামে খ্যাত হইয়াছেন।
দানবগণ এই অদ্ভুত ব্যাপার-নিরীক্ষণে হতাশ হইয়া অমৃত ও লক্ষ্মীলাভার্থ দেবতাদিগের সহিত ভয়ঙ্কর বিরোধ আরম্ভ করিল। তখন ভগবান্ নারায়ণ মোহিনী-মায়া আশ্রয় করিয়া নারীরূপ ধারণপূর্ব্বক অসুরসমূহের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। মূঢ়মতি দানবদল মোহিনীরূপধারী ভগবানের অপূর্ব্ব রূপলাবণ্যদর্শনে মোহিত ও তদ্‌গতচিত্ত হইয়া তাঁহাকে অমৃত সমর্পণ করিল।

ঊনবিংশ অধ্যায়
রাহুর মস্তকচ্ছেদ
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, অনন্তর সমস্ত দৈত্যগণ একত্রিত হইয়া নানাপ্রকার অস্ত্র-শস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক দেবগণকে আক্রমণ করিল। তদবলোকনে মহাপ্রভাবশালী ভগবান নারায়ণ নরদেব সমভিব্যাহারে দানবেন্দ্রদিগকে বঞ্চনা করিয়া অমৃত হরণ করিলেন। অনন্তর দেবগণ বিষ্ণুর নিকট হইতে সেই অমৃত লইয়া পরমাহ্লাদে পান করিতে বসিলেন। দেবগণ অমৃত পান করিতে আরম্ভ করিলে রাহু নামে এক দুষ্ট দানব অবসর বুঝিয়া দেবরূপ ধারণপূর্ব্বক সুরগণের সহিত অমৃতপান করিতে বসিয়াছিল। অমৃত রাহুর কণ্ঠদেশমাত্র গমন করিয়াছে, এমত সময়ে চন্দ্র ও সূর্য্য দেবতাদিগের হিতসাধনার্থে ঐ গুপ্তবিষয় ব্যক্ত করিয়া দিলেন। ভগবান্ চক্রপাণি স্বীয় সুদর্শনাস্ত্র দ্বারা তৎক্ষণাৎ সেই দুষ্ট দানবের শিরচ্ছেদন করিলেন।
রাহুর পর্ব্বত-শিখরাকার প্রকাণ্ড মস্তক ছেদনমাত্রে গগনমণ্ডলে আরোহণ করিয়া ভীষণ-নাদে গর্জ্জন করিতে লাগিল। তাহার কবন্ধকলেবর সকাননা, সদ্বীপা, সপর্ব্বতা বসুন্ধরাকে কম্পিত করিয়া ভূপৃষ্ঠে পতিত হইল। তদবধি চন্দ্র ও সূর্য্যের সহিত রাহুমুখের চিরশত্রুতা জন্মিল। এই নিমিত্তই অদ্যাপি ঐ রাহু মুখ তাঁহাদিগকে গ্রাস করিয়া থাকে। পরিশেষে ভগবান্ নারায়ণ মোহিনীবেশ পরিত্যাগ করিয়া অস্ত্র-শস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক দানবগণকে আক্রমণ করিলেন।
দেবাসুর-সংগ্রাম
তদনন্তর লবণার্ণব-তীরে দেবাসুরগণের ঘোরতর সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। প্রাস, তোমর, ভিন্দিপাল প্রভৃতি সহস্র সহস্র তীক্ষ্মাগ্র শস্ত্রবর্ষণে রণস্থল আচ্ছন্ন হইল। খড়্গ, চক্র, গদা, শক্তি প্রভৃতি শস্ত্রাঘাতে দানবগণ রুধির বমনপূর্ব্বক মূর্চ্ছিত হইয়া রণশায়ী হইল। তাহাদিগের তপ্ত-কাঞ্চনাকার মস্তক কপাল পট্টিশাঘাতে ছিন্নভিন্ন হইয়া অনবরত ধরণীতলে পতিত হইতে লাগিল। যুদ্ধে হত দানবগণ রুধিরাক্ত-কলেবর হইয়া ধাতুরাগরঞ্জিত গিরিকূটের [পর্ব্বতশৃঙ্গের] ন্যায় ভূমিশয্যায় শয়ান রহিল। পরস্পরের শস্ত্র প্রহার দেখিয়া রণস্থলে হাহাকার শব্দ উঠিল। দেবগণ দূর হইতে লৌহময় পরিঘাঘাত ও নিকটে দৃঢ়মুষ্টি প্রহার করিয়া রণ করিতে আরম্ভ করিলেন। দানবেরাও ঐরূপ যুদ্ধ করিতে লাগিল। সংগ্রামের কলকলধ্বনি গগনমণ্ডল আচ্ছাদিত করিল। চারিদিকে কেবল ‘ছিন্ধি, ভিন্ধি, প্রধাব ঘাতয়, পাতয়, মারয়’ [ছেদন কর, ভগ্ন কর, বেগে দৌড়াইয়া অগ্রসর হও, আঘাত কর, পাতিত কর, বধ কর] ইত্যাদি ঘোরতর শব্দমাত্র শ্রুত হইতে লাগিল।
এইরূপে ভয়ঙ্কর সংগ্রাম হইতেছে, এমত সময়ে নর ও নারায়ণ রণস্থলে আগমন করিলেন। ভগবান্ নারায়ণ নরদেবের হস্তে দিব্য ধনুঃ সন্দর্শন করিয়া দানবকুল-ধূমকেতু স্বীয় চক্রাস্ত্র স্মরণ করিলেন। মহাপ্রভাবশালী, সূর্য্যসম-তেজস্বী, অপ্রতিহতবীর্য্য, ভীমদর্শন সেই অরিনিসূদন সুদর্শনচক্র স্মরণ মাত্রে নভোমণ্ডল হইতে অবতীর্ণ হইল। আজানুলম্বিতবাহু, ভগবান চক্রপাণি সেই প্রজ্বলিত হুতাশনাকার, ভয়ঙ্কর চক্র বিপক্ষপক্ষে প্রক্ষেপ করিলেন। নারায়ণ-বিক্ষিপ্ত ভীষণ সুদর্শনাস্ত্র মহাবেগে ধাবমান হইয়া সহস্র সহস্র দানবদলের প্রাণসংহার করিল। কোন স্থলে সমুজ্জ্বল হুতাসনের ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া দৈত্যকুল নিপাত করিল, কোথাও বা আকাশমণ্ডলে ও ধরাতলে পরিভ্রমণপূর্ব্বক পিশাচের ন্যায় তাহাদিগের রুধির পান করিতে লাগিল।
নবমেঘাকৃতি, মহাবল-পরাক্রান্ত দানবেরাও আকাশে উত্থিত হইয়া সহস্র সহস্র পর্ব্বত-নিক্ষেপ দ্বারা দেবগণকে আকুলিত করিল। তৎকালে ভগ্নসানু অতি প্রকাণ্ড মহীধরগণ পরস্পরাভিঘাতে ভয়ঙ্কর শব্দ করিয়া ঘোরতর মেঘের ন্যায় চতুর্দ্দিকে পতিত হইতে লাগিল। দুর্দ্দান্ত দানবগণ এইরূপ গভীর গর্জ্জনপূর্ব্বক নিরন্তর পর্ব্বত-বর্ষণ করিয়া সকাননা, সদ্বীপা মেদিনীকে কম্পান্বিত করিল। তখন নরদেব সুবর্ণমুখ শিলীমুখ [শাণিত শর– চোখা বাণ ] দ্বারা দানববিক্ষিপ্ত পর্ব্বতসমূহ বিদারণপূর্ব্বক নভোমণ্ডল ব্যাপ্ত করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত দানবগণ দেবগণ কর্ত্তৃক ভগ্নবল হইয়া এবং আকাশমণ্ডলে জ্বলন্তাগ্নিসদৃশ সুদর্শন-চক্রকে ক্রুদ্ধ দেখিয়া কেহ ভূগর্ভে, কেহ বা লবণার্ণগর্ভে প্রবিষ্ট হইল।
সুরগণ এইরূপে জয়লাভ করিয়া যথোচিত সৎকারপুবঃসর মন্দরগিরিকে স্বস্থানে সংস্থাপন করিলেন। জলধরগণ নভোমণ্ডল এবং সুরলোক নিনাদিত করিয়া যথাস্থানে প্রতিগমন করিল। অনন্তর ইন্দ্রাদি দেবগণ আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া সেই অমৃতপূর্ণ কমণ্ডলু সুরক্ষিত করিয়া নারায়ণের নিকট সমর্পণ করিলেন।

বিংশ অধ্যায়
নাগগণের প্রতি অভিশাপ
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে ঋষিবর! অমৃতমন্থনসময়ে শ্রীমান্ অতুলতেজা উচ্চৈঃশ্রবানামক যে অশ্বরাজ জলনিধি হইতে সমুত্থিত হয়, তাহার সমস্ত বিবরণ বিশেষরূপে বর্ণিত হইল। কদ্রু সেই অশ্বরাজকে অবলোকন করিয়া স্বীয় সপত্নী বিনতাকে কহিলেন, “বিনতে! বল দেখি, উচ্চৈঃশ্রবাঃ অশ্বের কিরূপ বর্ণ?” বিনতা কহিলেন, “উচ্চৈঃশ্রবাঃ শুক্লবর্ণ; তোমার কি বোধ হয়? আইস, এ বিষয়ে দুইজনে পণ করি।” কদ্রু কহিলেন, “হে মধুরহাসিনি! আমি বোধ করি, এই অশ্বের পুচ্ছ কৃষ্ণবর্ণ; আইস, এ বিষয়ে এই পণ করা যাউক যে, যাহার অনুমান মিথ্যা হইবে, সে দাসী হইয়া থাকিবে।” তাঁহারা এইরূপে পরস্পর দাস্যবৃত্তি অবলম্বনে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইয়া “কল্য এই অশ্বকে দেখিব” এই বলিয়া স্ব স্ব আবাসে প্রত্যাগমন করিলেন। কদ্রু নিজ নিকেতনে আগমন করিয়া কৌটিল্য [কুটিলতা –গুপ্ত ষড়যন্ত্র] করিবার মানসে স্বীয় সহস্র পুৎত্রের প্রতি আজ্ঞা করিলেন, “তোমাদিগকে কৃষ্ণরূপ ধারণপূর্ব্বক উচ্চৈঃশ্রবাঃ অশ্বের পুচ্ছদেশে লম্বমান হইয়া তৎপুচ্ছের কৃষ্ণত্ব সম্পাদন করিতে হইবে। দেখিও যেন, আমাকে দাসীত্ব-শৃঙ্খলে বদ্ধ হইতে না হয়।” যে-সকল ভূজঙ্গম তদীয় আজ্ঞা-প্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হইল, তিনি তাহাদিগকে এই অভিসম্পাত করিলেন, “তোমরা পাণ্ডুবংশাবতংস রাজর্ষি জনমেজয়ের সর্পসত্রে অগ্নিতে দগ্ধ হইবে।” সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা কদ্রুদত্ত সেই অতি নিষ্ঠুর শাপ স্বকর্ণে শ্রবণ করিলেন। পরে সর্পসংখ্যার আতিশষ্যপ্রযুক্ত কদ্রুদত্ত শাপ প্রজাবর্গের পরম শ্রেয়স্কর হইয়াছে বিবেচনা করিয়া অন্যান্য দেবগণের সহিত সাতিশয় আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিলেন এবং কহিলেন, “এই সকল মহাবল হিংস্র সর্পগণের বিষ অতিশয় তীব্র ও বীর্য্যশালী; সেই তীব্র বিষে প্রজাগণের সর্ব্বদাই অনিষ্ট-ঘটনা হইয়া থাকে; অতএব কদ্রু ইহাদিগকে এই শাপ দিয়া উত্তম কর্ম্ম করিয়াছেন। তাহারা যেমন সর্ব্বদা প্রজাগণের অহিতাচরণ করে, তেমনি দৈব তাহাদিগের উপর প্রাণান্তিক দণ্ডপাত করিয়াছেন।”
ব্রহ্মা দেবগণের সহিত এইরূপ আনন্দ প্রকাশ করিয়া কদ্রুকে সমুচিত সম্মান প্রদান করিলেন এবং মহর্ষি কশ্যপকে স্বীয় সন্নিধানে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন, “হে পুণ্যশালিন্! যে সকল তীক্ষ্মবিষ মহাফণ ভুজঙ্গমগণ তোমার ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, কদ্রু তাহাদিগকে শাপ প্রদান করিয়াছেন, অতএব হে বৎস! এ বিষয়ে তোমার ক্রোধ করা বিধেয় নহে। যজ্ঞে সর্পকুল বিনষ্ট হইবে, ইহা পূর্ব্বাপর বর্ণিত আছে।” ব্রহ্মা কশ্যপ প্রজাপতিকে এইরূপে প্রসন্ন করিয়া তাঁহাকে বিষহরী বিদ্যা প্রদান করিলেন।

একবিংশ অধ্যায়
সমুদ্রবর্ণন
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, কদ্রু ও বিনতা এইরূপে পরস্পর দাস্যবৃত্তি পণ করিয়া এবং তজ্জন্য সাতিশয় অমর্ষাবিষ্ট ও রোষপরবশ হইয়া সেই রাত্রি অতিবাহিত করিলেন। পরদিবস প্রভাতে সূর্য্যোদয় হইবামাত্র তাঁহারা দুইজনে অনতিদূরবর্ত্তী উচ্চৈঃশ্রবাঃ তুরঙ্গমকে দেখিবার মানসে কিয়দ্দুর গমন করিয়া অপ্রমেয়, অচিন্তনীয়, অগাধ, সর্ব্বভূতভয়াবহ, পরমপবিত্র অম্ভোনিধি অবলোকন করিলেন। যে জলধি তিমি [সমুদ্রের সুবৃহৎ মৎস্য], তিমিঙ্গিল [তিমিকে যে গিলিয়া থাকে– তিমি অপেক্ষাও বড় মাছ], মৎস্য, কচ্ছপ, মকর, নক্র-চক্র [দলবদ্ধ কুম্ভীর] প্রভৃতি সহস্র সহস্র ভয়ঙ্কর, বিকৃতাকার জলচরগণে এবং ভীষণাকার সর্পগণে নিরন্তর সমাকীর্ণ; চন্দ্র, লক্ষ্মী, উচ্চৈঃশ্রবাঃ অশ্ব, পাঞ্চজন্য শঙ্খ, অমৃত, বাড়বানল ও সর্ব্বপ্রকার রত্ন যাহা হইতে উৎপন্ন; পর্ব্বতাধিরাজ মৈনাক ও জলাধিরাজ বরুণদেব যাহাতে সতত বাস করেন, যে সমুদ্র দানবগণের পরম মিত্র ও স্থলচর জন্তুগণের সাতিশয় ভয়াবহ শত্রু; যাহাতে ভয়ঙ্কর জলজন্তুসকল সর্ব্বদা ঘোরতর শব্দ করিতেছে এবং বায়ুবেগে অনবরত পর্ব্বতাকার তরঙ্গমালা সমুত্থিত হইতেছে, দেখিলে বোধ হয় যেন, সমুদ্র তরঙ্গরূপ হস্ত উত্তোলনপূর্ব্বক নিরন্তর নৃত্য করিতেছে; চন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধি অনুসারে যাহার হ্রাস বৃদ্ধি হইয়া থাকে; অমিততেজাঃ ভগবান্ নারায়ণ বরাহরূপ ধারণপূর্ব্বক মধ্যে প্রবেশ করিয়া যাহার জল বিক্ষোভিত ও আবিল করিয়াছিলেন এবং যাহাতে যোগনিদ্রা অনুভব করিয়াছিলেন; ব্রত পরায়ণ ব্রহ্মর্ষি অত্রি শতবৎসরেও যাহার তলস্পর্শ করিতে পারেন নাই; অসুরগণ অরাজক যুদ্ধে পরাভূত হইয়া যাহার মধ্যে বাস করে; যে সমুদ্র স্বীয় গর্ভস্থ বাড়বানলকে সর্ব্বদা তোয়রূপ হবিঃ প্রদান করিতেছে, সহস্র সহস্র মহানদী পরস্পর স্পর্দ্ধা করিয়া যেন অভিসারিকার ন্যায় যাহাতে সতত সমাবেশ করিতেছে।

দ্বাবিংশ অধ্যায়
কদ্রু-বিনতার সাগরতীরে গমন
সৌতি কহিলেন, নাগগণ মাতৃশাপ শ্রবণানন্তর পরামর্শ করিল, “আমাদিগের জননীর অন্তঃকরণে স্নেহের লেশমাত্র নাই, সুতরাং তাঁহার মনোভিলাষ সফল না হইলে রোষপরবশ হইয়া আমাদিগকে ভস্মসাৎ করিবেন; কিন্তু মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইলে প্রসন্না হইয়া আমাদিগের শাপ-বিমোচন করিতে পারেন। অতএব চল, সকলে একমত হইয়া উচ্চৈঃশ্রবার পুচ্ছ কৃষ্ণবর্ণ করি।” নাগেরা এই অভিসন্ধি করিয়া ঐ অশ্বের পুচ্ছদেশে কৃষ্ণকেশরূপে পরিণত হইল। ইত্যবসরে দক্ষতনয়া কদ্রু ও বিনতা গগনমার্গে উঠিয়া বায়ুবেগে বিচলিত, গভীর নিনাদযুক্ত, তিমিঙ্গিলমকর-সার্থ [শ্রেণী– দল–ঝাঁক] সঙ্কুল, বহুবিধ ভীষণ জন্তুগণে সমাকীর্ণ, সকল রত্নের আকর, বরুণদেবের আবাসস্থান, নাগগণের বাসভবন, স্থানে স্থানে স্রোতস্বতীগণে পরিপূর্য্যমান, অপ্রমেয়, অচিন্তনীয়, অগাধ, অতি দুর্দ্ধর্ষ, অক্ষোভ্য, পবিত্রজলবিশিষ্ট, রমণীয় জলনিধি দর্শন করিতে করিতে পরম প্রীতি সহকারে তাহার অপর পারে উপস্থিত হইলেন।



Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।