কৃষ্ণের প্রতি শোকসন্তপ্তা গান্ধারীর অভিশাপ
“হে কৃষ্ণ! ঐ দেখ, বৃষভস্কন্ধ দুর্দ্ধর্ষ কাম্বোজরাজ নিহত হইয়া ধূলিশয্যায় শয়ান রহিয়াছেন। উনি পূর্ব্বে কাম্বোজ দেশীয় মহার্হ আস্তরণমণ্ডিত শয্যায় শয়ন করিতেন। ঐ দেখ, উঁহার বনিতা প্রিয়তমের চন্দনচর্চ্চিত বাহুদ্বয় শোণিতলিপ্ত দেখিয়া শোকাকুলিত চিত্তে বিলাপ বাক্যে কহিতেছে, হা নাথ! তোমার এই সুন্দর অঙ্গুলিসমন্বিত বাহুদ্বয় পরিঘ তুল্য ছিল। পূর্ব্বে যখন আমি তোমার এই ভুজদ্বয়ের মধ্যে অবস্থান করিতাম, তখন রতি আমারে এক মুহূর্ত্তও পরিত্যাগ করিত না। এক্ষণে তোমার অভাবে আমার কি গতি হইবে! কাম্বোজরাজমহিষী এই বলিয়া অনাথার ন্যায় মধুর স্বরে রোদন করত বিকম্পিত হইতেছে। ঐ দেখ, কলিঙ্গরাজের উভয় পার্শ্বে সমবস্থিত কামিনীগণ দিব্য মাল্যের ন্যায় আতপতাপিত হইয়াও শ্রীভ্রষ্ট হইতেছে না। ঐ দেখ, মগধদেশীয় রমণীগণ প্রদীপ্তাঙ্গদধারী মগধরাজ জয়ৎসেনের চতুর্দ্দিক্ পরিবেষ্টন করিয়া রোদন করিতেছে। ঐ বিশাললোচনা সুস্বর সম্পন্না রমণীগণের শ্রুতিসুখকর মধুর নিনাদে আমার অন্তঃকরণ বিমোহিতপ্রায় হইতেছে। ঐ কামিনীগণ পূর্ব্বে মহামূল্য আস্তরণমণ্ডিত শয্যায় শয়ন করিত, এক্ষণে উহারা শোকাকুলিত চিত্তে আভরণ সকল ইতস্তত নিক্ষেপ করিয়া রোদন করিতে করিতে ধরাতলে নিপতিত হইতেছে। ঐ দেখ, কোশলরাজপুত্ত্র বৃহদ্বলের নারীগণ পতিরে পরিবেষ্টন পূর্ব্বক রোদন করিতেছে এবং ব্যাকুল মনে উঁহার হৃদয়গত শরজাল উদ্ধৃত করিতে করিতে বারংবার মূর্চ্ছিত হইতেছে। আতপতাপ ও পরিশ্রমে উহাদিগের মুখমণ্ডল ম্লান হইয়া গিয়াছে। ঐ দেখ, ধৃষ্টদ্যুম্নের সুবর্ণ মাল্যধারী অঙ্গদসমলঙ্কৃত অল্পবয়স্ক আত্মজগণ নিহত হইয়া সমরাঙ্গণে শয়ান রহিয়াছে। উহারা পাবক তুল্য প্রতাপশালী দ্রোণের বাণপথে পতিত হইয়া শলভের ন্যায় নিহত হইয়াছে। ঐ দেখ, রুচিরাঙ্গদধারী কেকয় দেশীয় পাঁচ ভ্রাতা দ্রোণশরে নিহত ও সমরশয্যায় শয়ান হইয়া প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় শোভা পাইতেছেন। উঁহাদের তপ্ত কাঞ্চন নির্ম্মিত বর্ম্ম, বিচিত্র ধ্বজ, রথ ও মাল্যের প্রভাবে সমরাঙ্গন দেদীপ্যমান হইয়াছে। ঐ দেখ, পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ অরণ্য মধ্যে সিংহনিপাতিত মত্ত মাতঙ্গের ন্যায় দ্রোণশরে নিহত হইয়া ধরাতলে শয়ান রহিয়াছেন। উঁহার সুনির্ম্মল পাণ্ডুবর্ণ আতপত্র শরৎকালীন নিশাকরের ন্যায় শোভা পাইতেছে। ঐ পাঞ্চালরাজের পুত্ত্রবধূ ও ভার্য্যারা দুঃখিত মনে উঁহার মৃতদেহ দগ্ধ করিয়া দক্ষিণ দিক্ গমন করিতেছে।
“ঐ দেখ, চেদিদেশাধিপতি মহাবীর ধৃষ্টকেতু অসংখ্য শত্রু সংহার পূর্ব্বক স্বয়ং দ্রোণশরে নিহত হইয়া সমরাঙ্গনে শয়ান রহিয়াছেন। বিহঙ্গেরা উঁহার কলেবর ছিন্ন ভিন্ন করিয়াছে। উঁহার ভার্য্যারা রণস্থলে উপস্থিত হইয়া উঁহারে অঙ্কে আরোপণ পূর্ব্বক অনবরত রোদন করিয়া স্থানান্তরিত করিতেছে। ঐ দেখ, উঁহার চারুকুণ্ডলমণ্ডিত মহাবল পরাক্রান্ত আত্মজ দ্রোণশরে ছিন্ন ভিন্ন হইয়া রণস্থলে নিপতিত রহিয়াছে। ঐ বীর অদ্যাপি স্বীয় পিতারে পরিত্যাগ করে নাই। আমার পৌত্ত্র লক্ষ্মণও ধৃষ্টকেতুর পুত্ত্রের ন্যায় স্বীয় পিতার অনুগমন করিয়াছে। ঐ দেখ, কাঞ্চনাঙ্গদ সমলঙ্কৃত কাঞ্চন বর্ম্মধারী বিমল মাল্যসুশোভিত বৃষভলোচন অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ বসন্তকালে বায়ুবেগবিপাটিত কুসুমপরিশোভিত শালবৃক্ষদ্বয়ের ন্যায় ভূতলে শয়ান রহিয়াছে। হে কৃষ্ণ! পাণ্ডবেরা যখন মহাবীর ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, দুর্য্যোধন, অশ্বত্থামা, জয়দ্রথ, সোমদত্ত, বিকর্ণ ও কৃতবর্ম্মার হস্ত হইতে বিমুক্ত হইয়াছে, তখন উহারা ও তুমি অবধ্য। ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতি মহাবীরগণ শস্ত্রবলে দেবগণকেও বিনাশ করিতে সমর্থ ছিলেন। কিন্তু কালের কি কুটিল গতি! আজি তাঁহারাই নিহত হইয়া সমরাঙ্গনে শয়ান রহিয়াছেন। দৈবের অসাধ্য কিছুই নাই। হে বাসুদেব! তুমি যখন শান্তিস্থাপনে অকৃতকার্য্য হইয়া বিরাট নগরে প্রত্যাগমন করিয়াছিলে, তখনই আমি স্থির করিয়াছিলাম যে, আমার পুত্ত্রগণ নিহত হইয়াছে। তৎকালে মহাত্মা ভীষ্ম ও বিদুর আমারে কহিয়াছিলেন, তুমি আপনার পুত্ত্রগণের প্রতি আর স্নেহ প্রদর্শন করিও না। সেই মহাত্মাদিগের বাক্য কদাপি মিথ্যা হইবার নহে। ঐ দেখ, আমার পুত্ত্রেরা পাণ্ডবগণের রোষানলে ভস্মসাৎ হইয়া গিয়াছে।”
হে মহারাজ! গান্ধারতনয়া এই বলিয়া দুঃখশোকে একান্ত অধীর ও হতজ্ঞান হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন এবং কিয়ৎক্ষণ পরে ক্রোধভরে বাসুদেবের প্রতি দোষারোপ করিয়া কহিলেন, “জনার্দ্দন! যখন কৌরব ও পাণ্ডবগণ পরস্পরের ক্রোধানলে পরস্পর দগ্ধ হয়, তৎকালে তুমি কি নিমিত্ত তদ্বিষয়ে উপেক্ষা প্রদর্শন করিলে? তোমার বহুসংখ্যক ভৃত্য ও সৈন্য বিদ্যমান আছে; তুমি শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন, বাক্যবিশারদ ও অসাধারণ বলবীর্য্যশালী, তথাপি ইচ্ছা পূর্ব্বক কৌরবগণের বিনাশে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছ। অতএব তোমারে অবশ্যই ইহার ফলভোগ করিতে হইবে। আমি পতিশুশ্রূষা দ্বারা যে কিছু তপঃসঞ্চয় করিয়াছি, সেই নিতান্ত দুর্লভ তপঃপ্রভাবে তোমারে অভিশাপ প্রদান করিতেছি যে, তুমি যেমন কৌরব ও পাণ্ডবগণের জ্ঞাতি বিনাশে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছ, তেমনি তোমার আপনার জ্ঞাতিবর্গও তোমা কর্ত্তৃক বিনষ্ট হইবে। অতঃপর ষট্ত্রিংশৎ বর্ষ সমুপস্থিত হইলে তুমি অমাত্য, জ্ঞাতি ও পুত্ত্রহীন এবং বনচারী হইয়া অতি কুৎসিত উপায় দ্বারা নিহত হইবে। তোমার কুলরমণীগণও ভরতবংশীয় মহিলাগণের ন্যায় পুত্ত্রহীন ও বন্ধুবান্ধব বিহীন হইয়া বিলাপ ও পরিতাপ করিবে।”
তখন মহামতি বাসুদেব গান্ধারীর মুখে এই কথা শ্রবণ করিয়া হাস্যমুখে তাঁহারে কহিলেন, “দেবি! আমা ব্যতিরেকে যদুবংশীয়দিগকে বিনাশ করে, এমন আর কেহই নাই। আমি যে যদুবংশ ধ্বংস করিব, তাহা বহুদিন অবধারণ করিয়া রাখিয়াছি। আমার যাহা অবশ্য কর্ত্তব্য, এক্ষণে আপনি তাহাই কহিলেন। যাদবেরা মনুষ্য বা দেব দানবগণের বধ্য নহে; সুতরাং তাঁহারা পরস্পর বিনষ্ট হইবেন।” বাসুদেব এই কথা কহিবামাত্র পাণ্ডবেরা ভীত ও উদ্বিগ্ন হইয়া প্রাণ ধারণ বিষয়ে এককালে হতাশ হইলেন।
“ঐ দেখ, চেদিদেশাধিপতি মহাবীর ধৃষ্টকেতু অসংখ্য শত্রু সংহার পূর্ব্বক স্বয়ং দ্রোণশরে নিহত হইয়া সমরাঙ্গনে শয়ান রহিয়াছেন। বিহঙ্গেরা উঁহার কলেবর ছিন্ন ভিন্ন করিয়াছে। উঁহার ভার্য্যারা রণস্থলে উপস্থিত হইয়া উঁহারে অঙ্কে আরোপণ পূর্ব্বক অনবরত রোদন করিয়া স্থানান্তরিত করিতেছে। ঐ দেখ, উঁহার চারুকুণ্ডলমণ্ডিত মহাবল পরাক্রান্ত আত্মজ দ্রোণশরে ছিন্ন ভিন্ন হইয়া রণস্থলে নিপতিত রহিয়াছে। ঐ বীর অদ্যাপি স্বীয় পিতারে পরিত্যাগ করে নাই। আমার পৌত্ত্র লক্ষ্মণও ধৃষ্টকেতুর পুত্ত্রের ন্যায় স্বীয় পিতার অনুগমন করিয়াছে। ঐ দেখ, কাঞ্চনাঙ্গদ সমলঙ্কৃত কাঞ্চন বর্ম্মধারী বিমল মাল্যসুশোভিত বৃষভলোচন অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ বসন্তকালে বায়ুবেগবিপাটিত কুসুমপরিশোভিত শালবৃক্ষদ্বয়ের ন্যায় ভূতলে শয়ান রহিয়াছে। হে কৃষ্ণ! পাণ্ডবেরা যখন মহাবীর ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, দুর্য্যোধন, অশ্বত্থামা, জয়দ্রথ, সোমদত্ত, বিকর্ণ ও কৃতবর্ম্মার হস্ত হইতে বিমুক্ত হইয়াছে, তখন উহারা ও তুমি অবধ্য। ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতি মহাবীরগণ শস্ত্রবলে দেবগণকেও বিনাশ করিতে সমর্থ ছিলেন। কিন্তু কালের কি কুটিল গতি! আজি তাঁহারাই নিহত হইয়া সমরাঙ্গনে শয়ান রহিয়াছেন। দৈবের অসাধ্য কিছুই নাই। হে বাসুদেব! তুমি যখন শান্তিস্থাপনে অকৃতকার্য্য হইয়া বিরাট নগরে প্রত্যাগমন করিয়াছিলে, তখনই আমি স্থির করিয়াছিলাম যে, আমার পুত্ত্রগণ নিহত হইয়াছে। তৎকালে মহাত্মা ভীষ্ম ও বিদুর আমারে কহিয়াছিলেন, তুমি আপনার পুত্ত্রগণের প্রতি আর স্নেহ প্রদর্শন করিও না। সেই মহাত্মাদিগের বাক্য কদাপি মিথ্যা হইবার নহে। ঐ দেখ, আমার পুত্ত্রেরা পাণ্ডবগণের রোষানলে ভস্মসাৎ হইয়া গিয়াছে।”
হে মহারাজ! গান্ধারতনয়া এই বলিয়া দুঃখশোকে একান্ত অধীর ও হতজ্ঞান হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন এবং কিয়ৎক্ষণ পরে ক্রোধভরে বাসুদেবের প্রতি দোষারোপ করিয়া কহিলেন, “জনার্দ্দন! যখন কৌরব ও পাণ্ডবগণ পরস্পরের ক্রোধানলে পরস্পর দগ্ধ হয়, তৎকালে তুমি কি নিমিত্ত তদ্বিষয়ে উপেক্ষা প্রদর্শন করিলে? তোমার বহুসংখ্যক ভৃত্য ও সৈন্য বিদ্যমান আছে; তুমি শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন, বাক্যবিশারদ ও অসাধারণ বলবীর্য্যশালী, তথাপি ইচ্ছা পূর্ব্বক কৌরবগণের বিনাশে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছ। অতএব তোমারে অবশ্যই ইহার ফলভোগ করিতে হইবে। আমি পতিশুশ্রূষা দ্বারা যে কিছু তপঃসঞ্চয় করিয়াছি, সেই নিতান্ত দুর্লভ তপঃপ্রভাবে তোমারে অভিশাপ প্রদান করিতেছি যে, তুমি যেমন কৌরব ও পাণ্ডবগণের জ্ঞাতি বিনাশে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছ, তেমনি তোমার আপনার জ্ঞাতিবর্গও তোমা কর্ত্তৃক বিনষ্ট হইবে। অতঃপর ষট্ত্রিংশৎ বর্ষ সমুপস্থিত হইলে তুমি অমাত্য, জ্ঞাতি ও পুত্ত্রহীন এবং বনচারী হইয়া অতি কুৎসিত উপায় দ্বারা নিহত হইবে। তোমার কুলরমণীগণও ভরতবংশীয় মহিলাগণের ন্যায় পুত্ত্রহীন ও বন্ধুবান্ধব বিহীন হইয়া বিলাপ ও পরিতাপ করিবে।”
তখন মহামতি বাসুদেব গান্ধারীর মুখে এই কথা শ্রবণ করিয়া হাস্যমুখে তাঁহারে কহিলেন, “দেবি! আমা ব্যতিরেকে যদুবংশীয়দিগকে বিনাশ করে, এমন আর কেহই নাই। আমি যে যদুবংশ ধ্বংস করিব, তাহা বহুদিন অবধারণ করিয়া রাখিয়াছি। আমার যাহা অবশ্য কর্ত্তব্য, এক্ষণে আপনি তাহাই কহিলেন। যাদবেরা মনুষ্য বা দেব দানবগণের বধ্য নহে; সুতরাং তাঁহারা পরস্পর বিনষ্ট হইবেন।” বাসুদেব এই কথা কহিবামাত্র পাণ্ডবেরা ভীত ও উদ্বিগ্ন হইয়া প্রাণ ধারণ বিষয়ে এককালে হতাশ হইলেন।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন