জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার যোগই ভারতীয় সনাতন সাধনার মূল প্রতিপাদ্য। ভারতীয় ঋষিরা যোগচর্চার বেশ কয়েকটি পথের কথা উল্লেখ করেছেন। এই পথগুলিকে যোগমার্গ বা সাধনমার্গ বলা হয়। এর সংখ্যা নিয়ে মতান্তর আছে। সাধারণত যে যোগমার্গগুলির নাম পাওয়া যায়, সেগুলি হলো ----
* কর্মযোগ
-- কর্মেই মুক্তি- এই বিশ্বাস থেকে কর্মযোগের সৃষ্টি। কর্মযোগের সূত্র ক্রিয়াযোগ ও জ্ঞানযোগের বিকাশ ঘটে। কর্মযোগের দ্বারা পাপক্ষয় হলে- জ্ঞানের উদ্ভব হয়। কর্মযোগের মূল লক্ষ্য ব্রহ্মজ্ঞান লাভ। কর্মের প্রকৃতি অনুসারে কর্মযোগকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগ দুটি হলো―
১। নিষ্কাম কর্মযোগ -- এর দ্বারা মোক্ষ লাভ হয়।
২। সকাম কর্মযোগ -- স্বর্গ লাভ হয়।
* ক্রিয়াযোগ -- কর্মযোগ সম্পন্ন করার জন্য ক্রিয়াত্বক উদ্যোগ থাকে তাই হলো- ক্রিয়াযোগ। এই যোগানুশীলনের সকল কর্মযোগই ক্রিয়াযোগ দ্বারা সম্পন্ন হয়।
* জ্ঞানযোগ -- পরম ব্রহ্মকে পাওয়া বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার জন্য যে যোগানুশীলন করা হয়, তাই হলো- জ্ঞানযোগ। এক্ষেত্রে অন্তজ্ঞানকে বাস্তব জ্ঞানে পরিণত করা হয়। প্রকৃতি ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভিতর এর মানব ধর্মের অন্বেষণ করার প্রক্রিয়ার ভিতরই জ্ঞানযোগের মূল সূত্র নিহিত। যোগীর মনে উদ্ভুত বিভিন্ন প্রশ্নের সদুত্তর অন্বেষণ এবং এরই ভিতর পরম সত্যে পৌছার জন্য ধ্যানই হলো জ্ঞানযোগ। এর জন্য কোন প্রচলিত পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট নেই। বিভিন্ন পরিস্থিতি সাপেক্ষে এর বিচার ও সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হয়। জ্ঞানযোগে বিশ্বাসের চেয়ে উপলব্ধিকে বড় করে দেখা হয়। সেই কারণে এই যোগে আত্ম-জিজ্ঞাসা এবং তাঁর সদুত্তর খুঁজতে হয়। এই দুটি প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যে অভিজ্ঞতা লাভ হয়, তাই হলো জ্ঞানযোগের সঞ্চয়। জ্ঞানযোগ দ্বারা সঞ্চিত জ্ঞানের সাহায্যে বাস্তব সমস্যার সমাধান করা হয়। এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে জ্ঞানযোগী নিজেকে সমৃদ্ধ করে থাকেন।
* ব্যক্তিযোগ -- বিশ্বাস স্থাপন করে নিজেকে নিবেদন করা বা নিজ ব্যক্তিত্ব বিলীন করার প্রক্রিয়াই হলো ব্যক্তিযোগ। সাধারণত বিভিন্ন ধর্মালবলম্বী আল্লাহ, পরমেশ্বর বা কোন দেবতার প্রতি বিশ্বাস রেখে নিজ ব্যক্তিত্বকে সমর্পণ করেন। এক্ষেত্রে কখনো কখনো এই বিশ্বাস সরাসরি ঈশ্বর হতে পারেন বা তার কোন প্রতীকীরূপ হতে পারে। যেমন পরমব্রহ্ম হবেন সরাসরি ঈশ্বর, কিন্তু রাম বা কৃষ্ণ হবে বিষ্ণুর অবতার হিসাবে। খ্রীষ্টধর্মালম্বীরা যেমন ত্রিত্ববাদের সূত্রে যিশুর আরাধনা করেন। কোন ব্যক্তি বিশেষের প্রবর্তিত পথ অনুসারে, উক্ত ব্যক্তিকে সম্মান করা বা তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুসরণও ব্যক্তিযোগের পর্যায়ে পড়ে। ব্যক্তিযোগের পর্যায়ে কোন মহান শিক্ষক বা গুরু হতে পারেন। এক্ষেত্রে এই আরাধনা গুরু-ভজনা হিসাবে অভিহিত করা হয়।
* মন্ত্রযোগ -- মন্ত্রের সাধারণ সমার্থ হলো- পরামর্শ, বিচার ইত্যাদি অন্যদিকে বেদের উপাসনার উপযোগী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলো (বাক্য বা পদ) মন্ত্র নামে অভিহিত করা হয় শাস্ত্র মোতাবেক মন্ত্র ও ঈশ্বর নাম জপ করতে করতে, নিজেকে ঈশ্বরে বিলীন করার পদ্ধতিই হলো মন্ত্রযোগ এই পথ ধরেই পরমব্রহ্মের সাথে সাধকের মিলন ঘটে এবং অনন্ত মুক্তিলাভ ঘটে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে- মহাদেব এই যোগের সাধনা করেছিলেন।
* রাজযোগ -- যোগ-চর্চার জন্য যতগুলি পথ বা মার্গ রয়েছে, তার ভিতরে রাজযোগ একটি। মন ও শরীরকে স্থির বা সমাধিস্থ করে যে যোগ-প্রক্রিয়া সাধিত হয়, তাকে রাজযোগ বলে। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে পতঞ্জলি, দত্তাদেয় প্রমুখ ঋষিরা এই যোগ সাধনার দ্বারা সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। যম ও নিয়মের অনুশীলনের দ্বারা মানুষের আচরণ এবং ব্যক্তিত্বের সংশোধন বিকাশ করার প্রক্রিয়ার ভিতর রাজযোগ প্রতিষ্ঠা পায়। সেই কারণে, সুস্থ মন ও শরীরের চর্চা এই যোগের বিষয় হিসাবে মূখ্য স্থান অধিকার করে আছে।
* লয়যোগ -- শরীরের নাড়িগ্রন্থিস্থানে মন বা চিত্তকে বিলীন করে যোগ সাধন করা এবং এর সাহায্যে মোক্ষ লাভ করার পথ হলো লয়যোগ। কথিত অাছে প্রখ্যাত মহর্ষি বেদব্যাস এই পথ অনুসরণে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
* হঠযোগ -- পিঙ্গল ও ইড়াকে অবলম্বন করে যে যোগ চর্চা বা সাধনা করা হয়, তাকেই হঠযোগ বলা হয়। দেহ থেকে শরীর পৃথক করে, মনকে ঈশ্বর বা পরমাত্মার সাথে মিলনের প্রক্রিয়াই হলো হঠযোগ। বর্তমানে হঠ্ যোগকে দেহচর্চার পদ্ধতি হিসাবেই বিবেচনা করা হয়। এই যোগ সাধনাকে কার্যকরী করার প্রক্রিয়াকে অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই অঙ্গের প্রকারভেদ নিয়ে কিছুটা মত পার্থক্য আছে। গোরক্ষ মুনির মতে যোগাঙ্গ ছয়টি। এগুলো হলো― আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণ, ধ্যান ও সমাধি। পক্ষান্তরে মার্কেণ্ডয় মুনির মতে― যোগাঙ্গের সংখ্যা আটটি। এগুলো হলো― যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণ, ধ্যান ও সমাধি।
মনের ইচ্ছা ও একাগ্রতা দিয়ে কোন বিশেষ শক্তি বা ক্ষমতাকে আয়ত্ব করার প্রক্রিয়াই হলো সাধনা। পতঞ্জলির যোগসূত্র গ্রন্থের সাধনপাদ অংশে, সাধনা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণ, ধ্যান, শোধন ও সমাধি দ্বারা সাধনা করতে হয় সম্পন্ন হয়। আবার সাধনাকে চরিতার্থ করার জন্য রয়েছে সাধনবিধি। এই বিধিগুলো হলো শোধন, দৃঢ়তা, স্থৈর্য, ধৈর্য, লাঘব, প্রত্যক্ষ ও নির্লিপ্ত।
Written by: Prithwish Ghosh
* কর্মযোগ
-- কর্মেই মুক্তি- এই বিশ্বাস থেকে কর্মযোগের সৃষ্টি। কর্মযোগের সূত্র ক্রিয়াযোগ ও জ্ঞানযোগের বিকাশ ঘটে। কর্মযোগের দ্বারা পাপক্ষয় হলে- জ্ঞানের উদ্ভব হয়। কর্মযোগের মূল লক্ষ্য ব্রহ্মজ্ঞান লাভ। কর্মের প্রকৃতি অনুসারে কর্মযোগকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগ দুটি হলো―
১। নিষ্কাম কর্মযোগ -- এর দ্বারা মোক্ষ লাভ হয়।
২। সকাম কর্মযোগ -- স্বর্গ লাভ হয়।
* ক্রিয়াযোগ -- কর্মযোগ সম্পন্ন করার জন্য ক্রিয়াত্বক উদ্যোগ থাকে তাই হলো- ক্রিয়াযোগ। এই যোগানুশীলনের সকল কর্মযোগই ক্রিয়াযোগ দ্বারা সম্পন্ন হয়।
* জ্ঞানযোগ -- পরম ব্রহ্মকে পাওয়া বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার জন্য যে যোগানুশীলন করা হয়, তাই হলো- জ্ঞানযোগ। এক্ষেত্রে অন্তজ্ঞানকে বাস্তব জ্ঞানে পরিণত করা হয়। প্রকৃতি ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভিতর এর মানব ধর্মের অন্বেষণ করার প্রক্রিয়ার ভিতরই জ্ঞানযোগের মূল সূত্র নিহিত। যোগীর মনে উদ্ভুত বিভিন্ন প্রশ্নের সদুত্তর অন্বেষণ এবং এরই ভিতর পরম সত্যে পৌছার জন্য ধ্যানই হলো জ্ঞানযোগ। এর জন্য কোন প্রচলিত পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট নেই। বিভিন্ন পরিস্থিতি সাপেক্ষে এর বিচার ও সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হয়। জ্ঞানযোগে বিশ্বাসের চেয়ে উপলব্ধিকে বড় করে দেখা হয়। সেই কারণে এই যোগে আত্ম-জিজ্ঞাসা এবং তাঁর সদুত্তর খুঁজতে হয়। এই দুটি প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যে অভিজ্ঞতা লাভ হয়, তাই হলো জ্ঞানযোগের সঞ্চয়। জ্ঞানযোগ দ্বারা সঞ্চিত জ্ঞানের সাহায্যে বাস্তব সমস্যার সমাধান করা হয়। এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে জ্ঞানযোগী নিজেকে সমৃদ্ধ করে থাকেন।
* ব্যক্তিযোগ -- বিশ্বাস স্থাপন করে নিজেকে নিবেদন করা বা নিজ ব্যক্তিত্ব বিলীন করার প্রক্রিয়াই হলো ব্যক্তিযোগ। সাধারণত বিভিন্ন ধর্মালবলম্বী আল্লাহ, পরমেশ্বর বা কোন দেবতার প্রতি বিশ্বাস রেখে নিজ ব্যক্তিত্বকে সমর্পণ করেন। এক্ষেত্রে কখনো কখনো এই বিশ্বাস সরাসরি ঈশ্বর হতে পারেন বা তার কোন প্রতীকীরূপ হতে পারে। যেমন পরমব্রহ্ম হবেন সরাসরি ঈশ্বর, কিন্তু রাম বা কৃষ্ণ হবে বিষ্ণুর অবতার হিসাবে। খ্রীষ্টধর্মালম্বীরা যেমন ত্রিত্ববাদের সূত্রে যিশুর আরাধনা করেন। কোন ব্যক্তি বিশেষের প্রবর্তিত পথ অনুসারে, উক্ত ব্যক্তিকে সম্মান করা বা তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুসরণও ব্যক্তিযোগের পর্যায়ে পড়ে। ব্যক্তিযোগের পর্যায়ে কোন মহান শিক্ষক বা গুরু হতে পারেন। এক্ষেত্রে এই আরাধনা গুরু-ভজনা হিসাবে অভিহিত করা হয়।
* মন্ত্রযোগ -- মন্ত্রের সাধারণ সমার্থ হলো- পরামর্শ, বিচার ইত্যাদি অন্যদিকে বেদের উপাসনার উপযোগী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলো (বাক্য বা পদ) মন্ত্র নামে অভিহিত করা হয় শাস্ত্র মোতাবেক মন্ত্র ও ঈশ্বর নাম জপ করতে করতে, নিজেকে ঈশ্বরে বিলীন করার পদ্ধতিই হলো মন্ত্রযোগ এই পথ ধরেই পরমব্রহ্মের সাথে সাধকের মিলন ঘটে এবং অনন্ত মুক্তিলাভ ঘটে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে- মহাদেব এই যোগের সাধনা করেছিলেন।
* রাজযোগ -- যোগ-চর্চার জন্য যতগুলি পথ বা মার্গ রয়েছে, তার ভিতরে রাজযোগ একটি। মন ও শরীরকে স্থির বা সমাধিস্থ করে যে যোগ-প্রক্রিয়া সাধিত হয়, তাকে রাজযোগ বলে। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে পতঞ্জলি, দত্তাদেয় প্রমুখ ঋষিরা এই যোগ সাধনার দ্বারা সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। যম ও নিয়মের অনুশীলনের দ্বারা মানুষের আচরণ এবং ব্যক্তিত্বের সংশোধন বিকাশ করার প্রক্রিয়ার ভিতর রাজযোগ প্রতিষ্ঠা পায়। সেই কারণে, সুস্থ মন ও শরীরের চর্চা এই যোগের বিষয় হিসাবে মূখ্য স্থান অধিকার করে আছে।
* লয়যোগ -- শরীরের নাড়িগ্রন্থিস্থানে মন বা চিত্তকে বিলীন করে যোগ সাধন করা এবং এর সাহায্যে মোক্ষ লাভ করার পথ হলো লয়যোগ। কথিত অাছে প্রখ্যাত মহর্ষি বেদব্যাস এই পথ অনুসরণে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
* হঠযোগ -- পিঙ্গল ও ইড়াকে অবলম্বন করে যে যোগ চর্চা বা সাধনা করা হয়, তাকেই হঠযোগ বলা হয়। দেহ থেকে শরীর পৃথক করে, মনকে ঈশ্বর বা পরমাত্মার সাথে মিলনের প্রক্রিয়াই হলো হঠযোগ। বর্তমানে হঠ্ যোগকে দেহচর্চার পদ্ধতি হিসাবেই বিবেচনা করা হয়। এই যোগ সাধনাকে কার্যকরী করার প্রক্রিয়াকে অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই অঙ্গের প্রকারভেদ নিয়ে কিছুটা মত পার্থক্য আছে। গোরক্ষ মুনির মতে যোগাঙ্গ ছয়টি। এগুলো হলো― আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণ, ধ্যান ও সমাধি। পক্ষান্তরে মার্কেণ্ডয় মুনির মতে― যোগাঙ্গের সংখ্যা আটটি। এগুলো হলো― যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণ, ধ্যান ও সমাধি।
মনের ইচ্ছা ও একাগ্রতা দিয়ে কোন বিশেষ শক্তি বা ক্ষমতাকে আয়ত্ব করার প্রক্রিয়াই হলো সাধনা। পতঞ্জলির যোগসূত্র গ্রন্থের সাধনপাদ অংশে, সাধনা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণ, ধ্যান, শোধন ও সমাধি দ্বারা সাধনা করতে হয় সম্পন্ন হয়। আবার সাধনাকে চরিতার্থ করার জন্য রয়েছে সাধনবিধি। এই বিধিগুলো হলো শোধন, দৃঢ়তা, স্থৈর্য, ধৈর্য, লাঘব, প্রত্যক্ষ ও নির্লিপ্ত।
Written by: Prithwish Ghosh
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন