শ্রী হয়গ্রীব হলেন ভগবান শ্রীবিষ্ণুর অবতার।তিনি হিন্দু ধর্মের জনপ্রিয় দেবতা।ভারতের বিভিন্ন স্থানে তার পূজা করা হয় ।আসামের হয়গ্রীব মাধব মন্দির তার মধ্যে অন্যতম।তার নামে হয়গ্রীব উপনিষদ রয়েছে।
'মধু' এবং 'কৈটভ' নামের দুটি অসুর বেদের সৃষ্টির সময়ে ব্রহ্মার থেকে সেগুলি চুরি করে নেয়। ব্রহ্মা বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগিয়ে বেদ উদ্ধারের জন্য অনুরোধ করেন। তখন বিষ্ণু 'হয়গ্রীবে'র রূপ ধারণ করে রসাতলে যান এবং বেদসমূহ উদ্ধার করে এনে ব্রহ্মাকে দেন। এর পরে বিষ্ণু উত্তর-পূর্বে এসে হয়গ্রীব রূপে শুয়ে পড়েন। মধু এবং কৈটভ ঘুরে এসে বিষ্ণুকে যুদ্ধ করতে বলে। সেই যুদ্ধে বিষ্ণু অসুর দুজনকে পরাস্ত করে প্রাণনাশ করেন।
আরেক মতে ভগবান বিষ্ণু ঔর্বঋষির তপস্যা ভঙ্গকারী জ্বরাসুর, হয়াসুর ইত্যাদি পাঁচজন অসুরকে বধ করে হয়গ্রীব মাধব নামের পর্বতে অবস্থান করে আছেন। কালিকা পুরাণ মতে, এই তীর্থস্থানের প্রতিষ্ঠাতা ঔর্বঋষি।।
দেবীভাগবত পুরাণেও এক আশ্চর্য কাহিনির সন্ধান মেলে। সূর্যের ছেলে রেবন্ত কোনো এক সময় উচ্চৈঃশ্রবা নামক ঘোড়ায় চড়ে বৈকুণ্ঠে বেড়াতে এসেছিলেন। উচ্চৈঃশ্রবা একে অশ্বরাজ, সে ও লক্ষ্মীর মতোই সমুদ্রমন্থনের সময় উদ্ভূত। ঘোড়াটিকে লক্ষ্মী নিজের ভাইয়ের মতো দেখতেন। তাই উচ্চৈঃশ্রবা বৈকুণ্ঠে আসতেই তিনি স্বামীকে ছেড়ে ঘোড়ার আদরযত্ন নিয়ে পড়লেন। ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা রেবন্তকে দেখে অবাক হলেন নারায়ণও। তিনি লক্ষ্মীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই ছেলেটি কে?” লক্ষ্মী তখন ঘোড়ার আপ্যায়নে ব্যস্ত। কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেও কথার উত্তর না পেয়ে লক্ষ্মীর উপর বেজায় খাপ্পা হয়ে উঠলেন নারায়ণ। স্ত্রীকে অভিশাপ দিয়ে বসলেন, “ঘোড়া নিয়ে এত আদিখ্যেতা যখন, তখন মর্ত্যে মাদীঘোড়া হয়ে জন্মাও গে!” যতই হোক, নারায়ণ লক্ষ্মীর স্বামী; লক্ষ্মীও নারায়ণের স্ত্রী। অভিশাপ শুনে লক্ষ্মীর খুব কষ্ট হল। নারায়ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিভাবে তিনি শাপমুক্ত হয়ে আবার বৈকুণ্ঠে ফিরতে পারবেন। নারায়ণ বললেন, মর্ত্যে গিয়ে লক্ষ্মীর নারায়ণ-তুল্য এক ছেলে হবে। তারপরই লক্ষ্মী বৈকুণ্ঠে ফিরতে পারবেন। এরপর যথারীতি মর্ত্যে মাদী ঘোড়া হয়ে জন্মালেন লক্ষ্মী। মর্ত্যে গিয়ে তিনি শিবের তপস্যা করলেন। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব বর দিতে এলে লক্ষ্মী বললেন, তার সন্তান যেন নারায়ণের ঔরসেই জন্মায়। শিবের পরামর্শে নারায়ণ হয়গ্রীব অবতার গ্রহণ করে ঘোটকীরূপিণী লক্ষ্মীকে বিয়ে করলেন। তাদের ছেলে হলে লক্ষ্মী শাপমুক্ত হয়ে বৈকুণ্ঠে ফিরে গেলেন।
অন্যমতে, ঋষি কশ্যপ ও দনুর পুত্র হয়গ্রীব আদ্যাশক্তি মহামায়ার বরে বলীয়ান হয়ে ইন্দ্রের অমরাবতী আক্রমণ করে। দেবীর বরে অন্য কোনো হয়গ্রীবই তাকে হত্যা করতে পারবে। তখন দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর কাছে যান। ভগবান বিষ্ণু মধু -কৈটভের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে ধনুকের উপর মাথা রেখে নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। তখন ব্রহ্মা ভম্রিদের আদেশ দেন ভগবান বিষ্ণুর ধনুকটির জ্যা কর্তন করার। পরিবর্তে, ভম্রিরা যজ্ঞের বেদির বাহিরে পরে থাকা আহুতি পাবে। তখন জ্যা কাটতেই ভগবান বিষ্ণুর মস্তক কেটে লবণ সাগরে পড়ল। দেবতারা তখন দেবী মহামায়ার স্তব করলে দেবী মহামায়া বলেন যে তার মায়াতেই এসব ঘটেছে। পূর্বে বিষ্ণু দেবী লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে হাসলে দেবী লক্ষ্মী মনে করেন যে বিষ্ণু তার রূপকে অবহেলা করছেন। দেবী লক্ষ্মী তখন ভগবান বিষ্ণুকে অভিশাপ দিয়ে বসেন যে তার এই সুন্দর মস্তক কেটে যাবে। সে অভিশাপই সত্য হয়েছে। তখন তিনি ব্রহ্মাকে বিষ্ণুর মস্তকে হয় বা অশ্বের মস্তক লাগাতে বলেন। ব্রহ্মা তা-ই করলেন। তখন বিষ্ণুর নাম হয় হয়গ্রীব। ভগবান হয়গ্রীব তখন দানব হয়গ্রীবকে যুদ্ধে পরাস্ত খরে তাকে হত্যা করেন। হয়গ্রীব ছিলেন মহাজ্ঞানী। তিনি মহর্ষি অগস্ত্যকে ললিতোপাখ্যান শ্রবণ করান ।
হয়গ্রীব উপনিষদ্
হয়গ্রীব উপনিষদ্ বা হয়গ্রীবোপনিষদ্ (সংস্কৃত: हयग्रीव उपनिषत्) হল একটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। এটি ১০৮টি উপনিষদের অন্যতম। হয়গ্রীব উপনিষদ্ সংস্কৃত ভাষায় রচিত এবং বিষ্ণুর অশ্বমস্তক-বিশিষ্ট অবতার হয়গ্রীবের প্রতি উৎসর্গিত। এটি বিষ্ণু-উপাসক বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ এবং অথর্ববেদের সঙ্গে যুক্ত। যে হয়গ্রীব বেদের মূর্তস্বরূপ চিত্ত বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী, সেই হয়গ্রীবের পূজার মন্ত্রগুলি এই উপনিষদের প্রধান আলোচ্য।
কথিত আছে, বিষ্ণুর বাহন গরুড় তিরুবন্তিপুরমে শ্রী বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সন্ত ও গুরু বেদান্ত দেশিকাকে হয়গ্রীব মন্ত্রগুলি শিখিয়েছিলেন।
হয়গ্রীব উপনিষদ্ দুটি অধ্যায়ে বিভক্ত। এই উপনিষদে মোট শ্লোকের সংখ্যা ২০। ব্রহ্মা তার পুত্র ঋষি নারদকে শিক্ষা দিচ্ছেন - এই আকারে এই উপনিষদ্টি রচিত হয়েছে। গ্রন্থের শুরুতেই বিষ্ণুকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর রূপে বন্দনা করা হয়েছে এবং তার কাছে তার সকল ভক্তের কল্যাণকামনা করা হয়েছে। সকলের কল্যাণের জন্য ইন্দ্র, গরুড়, সূর্য ও বৃহস্পতিকেও বন্দনা করা হয়েছে।
নারদ তার পিতা ব্রহ্মাকে সকল পাপ নির্মূলকারী এবং জাগতিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদ বিতরণকারী ব্রহ্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছেন। ব্রহ্মা বলছেন, যে হয়গ্রীবের মন্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে পারে, সে শ্রুতি, স্মৃতি, ইতিহাস ও পুরাণ শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং ধনবান হতে পারেন। এরপর ব্রহ্মা হয়গ্রীব পূজার বিভিন্ন মন্ত্র বর্ণনা করতে শুরু করেন।
প্রথম মন্ত্রে বিষ্ণুকে হয়গ্রীব রূপে জাগতিক বিশ্বের বাইরে অবস্থানকারী ও ত্রাণকর্তারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রে হয়গ্রীবকে ঋক্, সাম, যজুর্বেদ ও ওঙ্কারের মূর্তি বলা হয়েছে। তাকে পৃথিবীতে বেদ-আনয়নকারী অশ্বমস্তক-বিশিষ্ট অবতার বলা হয়েছে। তৃতীয় মন্ত্রে বেদের মূর্তি হয়গ্রীবের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে তিনি যেন এই উপনিষদের পাঠকের কাছে বেদজ্ঞান প্রকাশ করেন এবং বলা হয়েছে এই দেবতার গুণকীর্তন করেন ওঙ্কার ও বেদসমূহ। মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষির নাম হিসেবে ব্রহ্মা, অত্রি, রবি, সবিতা ও ভার্গবের নাম করা হয়েছে। এই মন্ত্রগুলির ছন্দ হল গায়ত্রী, ত্রিষ্টুভ ও অনুষ্টুভ এবং দেবতা হলেন হয়গ্রীব। বীজমন্ত্রটি হল হ্লৌঁ, শক্তি হল সোহম, কীলক হল হ্লুঁ, বিনিয়োগ হল ভোগ ও মোক্ষ। শেষে অ, উ ও ম এই তিন অক্ষরের সাহায্যে অঙ্গন্যাসের কথা বলা হয়েছে। এরপর ধ্যানমন্ত্রটি বর্ণিত হয়েছে। এই ধ্যানমন্ত্রের সাহায্যে পূজক দেবতার মূর্তিটি মনে মনে কল্পনা করতে পারেন। এই মন্ত্রে হয়গ্রীবকে চতুর্ভূজ বলা হয়েছে। তার চার হাতের তিনটিতে রয়েছে শঙ্খ, সুদর্শন চক্র ও গ্রন্থ এবং চতুর্থ হাতে রয়েছে মহামুদ্রা। ২৯-অক্ষরবিশিষ্ট মন্ত্র (ওঁ শ্রীঁ হ্লৌঁ ওঁ নমো ভগবতে হয়গ্রীবায় বিষ্ণবে মহ্যং মেধাং প্রজ্ঞাং প্রয়চ্চ স্বাহা) ও ২৮-অক্ষরবিশিষ্ট মন্ত্র (ওঁ শ্রীঁ হ্রীঁ ঐঁ ঐঁ ঐঁ ক্লীঁ ক্লীঁ সৌহ্ সৌহ্ হ্রীঁ ওঁ নমো ভগবতে হয়গ্রীবায় মহ্যং মেধাং প্রজ্ঞাং প্রয়চ্চ স্বাহা) - এই দুই মন্ত্রের কথা বলে প্রথম অধ্যায় শেষ হচ্ছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুতে ব্রহ্মে হয়গ্রীবের বীজমন্ত্রটির কথা বলছেন। তিনি এই মন্ত্রটি প্রথমে শিবকে শিখিয়েছিলেন। শিব এই মন্ত্র সঙ্কর্ষণকে, সঙ্কর্ষণ নারদকে এবং নারদ ব্যাসকে শেখান। ব্যাসকে জগতকে এই মন্ত্র শিক্ষা দেন। হয়গ্রীবের বীজমন্ত্রটিকে এই উপনিষদে "মন্ত্ররাজ" বলা হয়েছে। এই মন্ত্র সূর্য ও অন্যান্য দেবতারা জপ করেন এবং এই মন্ত্রই হয়গ্রীবের বাণীমূর্তি। যিনি এই মন্ত্র জপ করেন, তিনি সর্বোচ্চ জ্ঞান এবং দিকপাল, রাজন্যবর্গ ও নাগের অধিপতি হন।
কথিত আছে অন্য একটি মন্ত্র অমৃতং কুরু কুরু স্বাহা (অনুগ্রহ করে আমাকে অমর করুন) জপকারীকে জ্ঞান, ধন ও অষ্ট সিদ্ধ প্রদান করে। আরও বলা হয়েছে হ্লৌঁ সকলসম্রাজ্ঞেন সিদ্ধিং কুরু কুরু স্বাহা এই সকল মন্ত্রগুলি জানতে সাহায্য করে। যারা এই মন্ত্রগুলি জপ করে, তাদের সব পাপ ধুয়ে যায় এবং তারা আনুষ্ঠানিকভাবে পবিত্র হয়। জীবনে সে দেহের উপর কর্তত্ব করে এবং মৃত্যুর পর মোক্ষ লাভ করে। প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম, (জ্ঞানই ব্রহ্ম), তত্ত্বমসি (তুমিই সে), অয়মাত্মা ব্রহ্ম (আমার আত্মাই ব্রহ্ম) এবং অহং ব্রহ্মাস্মি (আমিই ব্রহ্ম) - এই চারটি বৈদিক মহাবাক্যের অর্থ সে অনুধাবন করতে সমর্থ হয়। এরপর চারটি বৈদিক মন্ত্র পাঠ করা হয়। এগুলি হল : (১) যদ্ বাক্ বদন্তি, (২) গৌরিমিমায়া, (৩) ওষ্টাপিধান ও (৪) সা সর্পরীরাতিম।
উপনিষদ্ গ্রন্থাবলির রীতি অনুসারে, হয়গ্রীব উপনিষদের শেষে এই গ্রন্থটির মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে। একাদশী তিথিতে এই উপনিষদ পাঠ করলে হয়গ্রীবের আশীর্বাদ পাওয়া যায় এবং বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়ে জীবনের শেষে মোক্ষ লাভও হয়ে থাকে। গ্রন্থের শেষে একটি প্রার্থনায় বলা হয়েছে এই মন্ত্রগুলি ব্রহজ্ঞান এবং এই ভক্ত যেন হয়গ্রীব এবং এই মন্ত্রগুলিকে কখনও না ভুলে যান।
তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন