একে একে জ্বলে উঠল ২৩ টি চিতার আগুন। এদের মধ্যে ৪টি শিশু। ন'জন মহিলা। ২৩টি চিতাতেই আগুন লাগাল একজনই। চোদ্দ বছর বয়সের বিনোদ ধর। কারণ গোটা গ্রামে কাশ্মীরি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওই একজনই বেঁচে গেছিল।
গ্রামের নাম ওয়াধামা। কাশ্মীরের গান্ধেরবালে অবস্হিত ছোট একটা জনপদ। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লার নির্বাচনী ক্ষেত্র।১৯৯০ এর রাজ্যব্যাপী কাশ্মীরি হিন্দু পন্ডিতদের ব্যাপক গণহত্যা, অবর্নণীয় নির্যাতন, হিন্দু মেয়েদের ধর্ষন ও লুন্ঠনের পর যে গণহারে কাশ্মীরি পন্ডিতদের নিষ্ক্রমন ঘটেছিল কাশ্মীর উপত্যকা থেকে, নিজেদের পুরুষের পর পুরুষ ধরে গড়ে তোলা কৃষ্টি, সভ্যতার, ভালবাসার, সাধনার ভূমি থেকে- তার পরেও মুষ্টিমেয় কিছু কাশ্মীরি হিন্দু পন্ডিত থেকে গেছিলেন ভিটে-মাটি খেতি-বাড়িকে আঁকড়ে ধরে। ওয়াধামা ছিল তেমনই একটা গ্রাম। চারটি মাত্র হিন্দু পন্ডিত পরিবারের বাস ছিল। চাষ বাস আর নিজেদের মহল্লার ছোট মন্দির। এর মধ্যেই আনাগোনা নির্বিবাদী মানুষগুলোর। তবু যেন ইসলামি খিলাফৎ গঠনের জন্য যে রক্তে ভেজা বুলডোজার চালানো হচ্ছিল কাশ্মীর জুড়ে তার পথে ছোট্ট কাঁটা হয়ে ছিল তারা।
প্রজাতন্ত্র দিবসের আগের রাত। ২৫ শে জানুয়ারী, ১৯৯৮। গ্রামে কিছুদিন ধরেই অস্ত্রধারী লোকজনের আনাগোনা বাড়ছিল। সেদিন সন্ধ্যায় বিনোদের মা যখন রান্না চাপিয়েছিলেন, বাড়িতে ঢুকে পড়ল তেমন চারজন জেহাদী। সন্ধ্যার মৃদু আলোতেও চকচক করছিল তাদের বন্দুকের নল। বিনোদের মা'কে তারা চা বানাতে নির্দেশ দিল।চা খেয়ে তারা দরজার বাইরে গেল। হঠাৎ ভেসে এল বন্দুকের কান ফাটানো শব্দ গ্রাম থেকে। বিনোদ তাড়াতাড়ি মা'কে টেনে আনতে গেল। পারল না। পিছন থেকে গুলি এসে ফেলে দিল ওর মা'কে।বিনোদ ছাদের দিকে লাগালো দৌড়।লুকিয়ে পড়ল জমিয়ে রাখা ঘুঁটের স্তূপের পিছনে।ক্রমাগত ভেসে আসছে বন্দুকের শব্দ চারপাশ থেকে ওদের বাড়ির দিকে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মসজিদের আজানের শব্দ। সেদিন ছিল শাব-এ-কদরের রাত। রমজান মাসের যে রাতে কিনা মহম্মদের কাছে কোরানের প্রথম আয়াত এসেছিল। ততক্ষনে আগুন দিয়ে দেওয়া হয়েছে ওদের একমাত্র মন্দিরটায়। কাশ্মীরের হাজার হাজার ধ্বংস হয়ে যাওয়া হিন্দু মন্দিরের তালিকায় আর একটা ছোট্ট সংযোজন। কয়েকজন অস্ত্রধারী জেহাদী উঠে এল ওপরে।খুঁজছে আর কেউ বেঁচে আছে কিনা। কোন কাফেরের আজ নিস্তার নেই। লুকিয়ে থাকা বিনোদের মুখের কাছ থেকে ঘুরে গেল তাদের বন্দুকের নল।
মাঝরাতের পর আর কোন শব্দ নেই। বিনোদ আস্তে আস্তে নেমে এল। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বাড়ির উঠোন। গ্রামের বাকি সব হিন্দু পন্ডিত পরিবারের সদস্যদের ২৩টা লাশ পড়ে আছে ।হাঁ করে দাড়িয়ে দেখল বছর ১৪র ছেলেটা। বাবা, মা, কাকা, দাদা....... আশ্চর্য এক যান্ত্রিকতায় ঘর থেকে কম্বলগুলো টেনে টেনে এনে শরীরগুলো ঢেকে দিল ছেলেটা। বাইরে তখন হিমঠান্ডা, নিস্তব্ধতা। তারপর ধীর পায়ে আবার ওপরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল ঘুঁটের স্তূপের পিছনে।
সকাল হল। আর্মি এল, পুলিশ এল। একে একে এল গ্রামবাসীরাও। মাঝখানে ২৩টা মৃতদেহের স্তূপ। ওপাশে যন্ত্রনায়, আতঙ্কে বোবা হয়ে যাওয়া এক কিশোর। চেঁচিয়ে উঠল গ্রামবাসীদের দিকে: ' এদের মধ্যে কোন হারামি যেন হাত না লাগায়'। ২৩টা চিতা জ্বালাল নিজের হাতে। তখন কাশ্মীরে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরাল। ফারুক আবদুল্লা আর সৈফুদ্দিন সোজের সাথে গুলমার্গের বর্ণাঢ্য জাতীয় গেমসের উদ্বোধন উপভোগ করতে এসেছিলেন। তিনি এলেন গ্রামে। দোষীদের সাজা দেবার প্রতিশ্রুতি এল যথারীতি। দিল্লীতে শরনার্থী কাশ্মীরি পন্ডিতরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন। তাদের ওপর নেমে এল জলকামান, লাঠি। না। কোন অপরাধী ধরা পড়েনি আজও। যেমনটা বরাবর হয়ে এসেছে কাশ্মীরে।
যে খবর হারিয়ে যায় বিস্মৃতির আড়ালে, তা কেঁদে মরে এখনও কাশ্মীরের উপত্যকায় চিনারের বনে, ঝিলামের স্রোতে। যে মানবাধিকারের বাতেলা দেওয়া বুদ্ধিজীবি, শিল্পজীবি, সংবাদজীবি ঈশরাত জাহান বা আফজাল গুরু বা বুরহান ওয়ানিদের জন্য মুখের রক্ত তুলে ফেলে, তারা কখনই তাদের প্রোপাগান্ডা মেশিনারিতে তুলে আনবে না এই নিষ্পাপ হিন্দু শিশুদের রক্তাক্ত মুখের ছবি। অনাথ হয়ে যাওয়া হিন্দু শিশুদের কথা, যারা একদিন ভারতের আর পাঁচটা শিক্ষিত পরিবারের মত বড় হবার স্বপ্ন দেখেছিল।
এই পোস্টেই বা ক'জন লাইক দেবেন। কারণ পলিটিকালি কারেক্ট থাকার কিছু অসাম্প্রদায়িক pre defined মাপকাঠি তো নির্ধারন করাই আছে এই দেশে। বিনোদের ঠাঁই হয় জম্মুর বি এস এফ ক্যাম্পে। চিরকালের মত পিছনে পড়ে থাকে চোদ্দ পুরুষের স্মৃতি বিজড়িত গ্রাম। রূপকথার দেশের মত যার সৌন্দর্য। সোনায় লেখা যে মাটির ইতিহাস।কণিষ্কের কাশ্মীর, ললিতাদিত্যের কাশ্মীর, জয়াপীড়ের কাশ্মীর।সেই কাশ্মীরি হিন্দুরা কিনা কাঁদছে নিদারুণ নিপীড়ন, নির্যাতনে। কারণ ইতিহাস বলে কাশ্মীরি হিন্দুরা কখনও অস্ত্র ধরতে শেখেনি। তাই তাতার লুঠেরা কাদির খাঁর কবলে পড়ে যে মৃত্যু ও লাঞ্ছনার পরম্পরা শুরু হয়েছিল তা যেন আজও দেখে চলেছে ডাল লেকের জল। তাই বিনোদ আর ফিরে যেতে ভরসা পায় না তাঁর গ্রামে। পড়াশুনার শেষে সরকারি চাকরির দৌলতে মাঝে মাঝে শ্রীনগরে আসতে হয় তাঁকে। কখনও কখনও ক্ষীর ভবানীর মন্দিরে গিয়ে দাঁড়ালে মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। চোখ ভরে আসে জলে। এটুকুই তার মন্দিরে গিয়ে পাওয়া। আর তো কিছুই পাওয়ার নেই। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের রুগী সে জীবনের মত। যেমনটা দেশ ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে দেশ-বিদেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা কাশ্মীরি পন্ডিতরা। যাদের কথা ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বারবার। যেমনটা আমরা বাঙালীরা ভুলে গেছি ফেলে আসা পূর্ববঙ্গের হিন্দু গণহত্যার মর্মান্তিক স্মৃতি। ভেবেছি ভুলে যাবার প্রাণপনে চেষ্টায় ইতিহাসকে বুঝি থমকে দেওয়া যায়। কিন্তু ইতিহাস জেনে রাখতে হয়, শত্রুকে চিনে রাখতে হয়। কাশ্মীরিরা ইতিহাস মনে রাখতে চায়নি। তার ফলে তাদের শুনতে হয়েছিল শেখ আবদুল্লার থেকে (মাত্র দু প্রজন্ম আগে ধর্মান্তরিত মুসলমান): রালিভ, চালিভ ইয়া গালিভ। আমাদের মত হয়ে যাও, নয় পালিয়ে যাও, নয়তো মরো।
কিন্তু শেখসাহেব ভুলে গিয়েছিলেন যে ইতিহাস পালায় না, সে তার যন্ত্রণা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। কালচক্রে সে আবার ফিরে আসে তার বদলা নিয়ে। ইতিহাস বড় বিচিত্র পথে প্রতিশোধ নেয়।
-----------
তথ্যসূত্র:
Mumbai mirror
Our moon has blood clot
দেবতাত্মা হিমালয়(প্রবোধ সান্যাল)
Exodus of Kashmiri Pandits: What happened on January 19, 26 years ago?
26 years ago on this day, Kashmiri Pandits had witnessed a hysteric, macabre night in the form of blaring threats and slogans, asking them to flee their homeland, convert or die.
Post-Curtesy by: Prithwish Ghosh
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন