সৃষ্টিকর্তা একজন আছেন এবং তিনি নিরাকার, তিনি সর্বত্রই বিরাজমান এ বিশ্বাস সকল মানুষই পোষণ করে। তিনি করুনাময় জীব-জগতের পালন কর্তা। কিন্তু মানুষের মন অতি চঞ্চল, কল্পনায় অবগাহন করে চোখের নিমিষে কেউ বিশ্বব্রহ্মান্ড ঘুরে আসে, কেউ গাড়ি, বাড়ি, বিত্ত, বৈভব বৃত্তি গড়ে তোলে, আবার কেউ সেই নিরাকারের নির্দিষ্ট রুপ কল্পনার মধ্য দিয়ে গুনসম্পন্ন দেব-মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলে। অন্তরের খাঁটি বিশ্বাস দ্বারা ধর্ম জেগে ওঠে কর্মের মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে নিরাকার সৃষ্টিকর্তার আরাধনার লক্ষ্যে তাঁর একটি রূপ বা মুর্তি স্থাপনের মাধ্যমে শ্রদ্ধাভরে পূজো অর্চনা, গুনগান করে সাধনায় সিদ্ধি লাভের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সাধারণ ভক্তগণ প্রতিমা পূজা করে থাকেন।
ঈশ্বর, ভগবান বা পরমপিতার শক্তি সর্বত্রই বিরাজমান। অদৃশ্য সেই মহাশক্তিকে নিরাকার ভাবনা, ধ্যান বা যজ্ঞের দ্বারা আয়ত্ব করা সাধারণ ভক্তের জন্য দুসাধ্য ব্যাপার। কেননা সংসারে স্বাত্ত্বিক রাজসিক, তামসিক এই তিন গুণের মানুষ আছেন। বর্তমান সময়ে তামসিক ও রাজসিক মানুষের সংখ্যা বেশি। তাই দেব-দেবীর মুর্তি বা প্রতিমা স্থাপনের মাধ্যমে সাধন ভজনে দ্রুততার সাথে নিবিষ্ট হওয়া বা মনোনিবেশ করা সম্ভব।
তন্ত্রশাস্ত্র বলেছেন ---- ‘ গাভীর দুগ্ধ তাহার রক্ত হইতে সম্ভুত। রক্ত গাভীর সর্বাঙ্গেই বিরাজিত তাই বলিয়া গাভীর যে কোন অঙ্গে হস্তার্পণ করিলেই দুগ্ধ পাওয়া যায় না। একমাত্র স্তন হইতেই উহা ক্ষরিত হয়। সেই শ্রী ভগবানের উপস্থিতি সর্বত্র সকল সময়ে থাকিলেও তাঁহার স্বরূপ উপলদ্ধি প্রতিমাতেই সর্বাঙ্গসুন্দররূপে হইয়া থাকে।’.
প্রাচীন কাল থেকেই সনাতনী হিন্দু সংস্কৃতিতে তন্ত্রশাস্ত্রমত প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করে আছে। তান্ত্রিক মতে পূজায় প্রতীক বা প্রতিমা থাকা আবশ্যক। এক্ষেত্রে পূজার সকল অর্ঘ প্রতিমা বা মুর্তিকে অবলম্বন করে আবর্তমান। আর বৈদিক মতে, অগ্নিকে সকল শক্তি বা দেবতার উৎস বিশ্বাস ধারণ করে অগ্নিতে দেবতার উদ্দেশ্যে যজ্ঞাহুতি প্রদান করা হয়। আগুন বা অগ্নিকে পবিত্র বা নির্মল শক্তি হিসেবে গন্য করা হয়। অগ্নিতে সকল মোহ, দ্বেষ, কাম-ক্রোধ বিসর্জ্জন দিলে আত্মশুদ্ধি ঘটে।
শ্রীমদ্ভাগবত শাস্ত্রে আট প্রকার বিগ্রহের কথা বলা হয়েছে ----
‘শৈলী দারুময়ী লৌহ লেপ্যা লেখ্যা সৈকতী।
মনোময়ী মনিময়ী প্রতিমাষ্টবিধা স্মৃতা॥’
------- শিলাময়ী, কাষ্ঠময়ী, লৌহ (সুবর্ণাদিময়ী) লেপ্যা, (মৎচন্দনাদিময়ী) লেখ্যা (চিত্রপটময়ী) বালুকাময়ী, মনোময়ী ও মনিময়ী এই আট প্রকার প্রতিমা হইতে পারে।’
তাই মানবজীবনকে স্বার্থক করে তুলতে স্ব স্ব আরাধ্য দেবতা, ঈশ্বর, ভগবান, পরমপিতা যে যে নামেই সম্বোধন করুন না কেন সেই নিরাকার অসীমকে একটি রূপকল্পের গন্ডিতে এনে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে সাধন-ভজন করলে তাঁকে পাওয়ার উচ্ছাসে জীবন আন্দময় হয়ে ওঠে এবং সেখানেই প্রতিমা পূজা বা যজ্ঞের সার্থকতা।
ভগবদ্ গীতায় বলা হয়েছে ---- ‘ময়া তশুমিদং সবং জগদব্যক্ত মুর্তিন।’ ----- অর্থাৎ আমি অব্যক্তরূপে জগৎ সংসার ব্যপিয়া আছি। যিনি ব্যক্ত সাকার; তিনিই অবতার, আবার অব্যক্ত অবস্থায় নিরাকার। অর্থাৎ প্রতীক বা প্রতিমা অব্যক্ত নিরাকার ব্রহ্ম বা আরাধ্য দেবতার প্রতিনিধি।
সনাতনী শাক্ত বিশ্বাস করে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মের শক্তি হলেন ব্রহ্মময়ী কালী।
আর কয়েকদিন আগেই কার্তিক অমাবস্যায় হল সেই কালীর বৃহৎ পূজা। মনের অন্ধকার দূর করতে প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করে সেখানে কালীমুর্তি স্থাপন করা ছিল এই দিনের মুখ্যকর্ম আর সেই কর্মেই ভৌতিক জীবনের সাফল্যতা।
এই কালীপূজা বাংলায় প্রগৈতিহাসিক কাল থেকেই চলে আসছে। রাজা থেকে প্রজা, ধনী থেকে দরিদ্র, কেউই বাদ নেই, শক্তিমান হতে সবাই আশা করে। তাই দেখি -- বার ভূঁইয়াদের অন্যতম যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে 'যশোরেশ্বরী' কালিকা মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে এবং শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে প্রতাপশালী হয়ে ওঠেন। ভারতচন্দ্র রায় গুনকর তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে লিখেছেন ---
'যশোর নগর ধাম .... প্রতাপ আদিত্য নাম
মহারাজা বঙ্গজ কায়স্থ ।
নাহি মানে বাদশায় .... কেহন নাহি আটে তায়
ভয়ে সব ভূপতি দ্বারস্থ ।।
বরপুত্র ভবানীর .... প্রিয়তম পৃথিবীর
বাহান্ন হাজার যার ঢালী ।
ষোড়ষ হলকা হাতি .... অযুত তুরঙ্গ সাথী
যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী ॥
.
এই আদ্যাশক্তি পরমাপ্রকৃতি যদিও তত্ত্বত অসঙ্গা নির্বিকারা ব্রহ্মচৈতন্যস্বরূপা তবুও নিজ শক্তিবলে তিনিই জগৎ রূপে প্রকাশিত হয়েছেন। সেই আদ্যাশক্তি সূক্ষ্মা, স্থূলা, ব্যক্ত ও অব্যক্ত স্বরূপিণী। নিরাকারা হয়েও সাকারা। তিনি কৃপা না করলে কে তাঁকে জানতে পারে?
-----
স্থানটির নাম ঈশ্বরীপুর। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী। এখন এলাকাটি বংশীপুর হিসেবে পরিচিত। সাতক্ষীরা শহর থেকে সাতক্ষীরা-মুন্সীগঞ্জ সড়ক ধরে প্রায় ৫০ কিলোমিটার গেলে শ্যামনগর। এই উপজেলা সদর থেকে সুন্দরবনের দিকে সোজা আরও ৫ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই বংশীপুর বাজার। এর কিছু দূরেই সুন্দরবন। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের স্মৃতি বিজড়িত এই এলাকার অনেক ইমারত এখন হয়েছে পোড়ো বাড়ি। পঞ্চদশ শতকে যে জনপদ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন সেই এলাকা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে, অতীত স্মৃতিতে। অতীতের স্মৃতি হিসেবে যশোরেশ্বরী কালী মন্দির, দুর্গ, নগর প্রাচীরের কিছু অংশ। বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া এক কালের আদি যমুনা নদীর পাশেই এ ইতিহাস আর ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে কালের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজ্যের রাজধানী ঈশ্বরীপুর।
১৫৭৩ সালে সিংহাসনে বসেন দাউদশাহ। তার দুই বাল্যবন্ধু শ্রী হরিকে “বিক্রমাদিত্য” এবং জানকিকে ‘বসন্তরায়’ উপাধি দিয়ে তিনি তাদের মন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন। বর্তমানে সুন্দরবন ঘেরা এই এলাকার জলদস্যু, মগ, পর্তুগীজদের লুটতরাজ এবং অত্যাচার দমনের জন্য নবাব দাউদ শাহ বিক্রমাদিত্য ও বসন্তরায়কে দায়িত্ব দেন। বসন্তরায় সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের বসন্তপুর এসে ঘাঁটি গাড়েন। এ কারণে এখানকার নাম হয় বসন্তপুর। এখনও এই এলাকাটি বসন্তপুর নামে পরিচিত। বিক্রমাদিত্যকে দেয়া হয় অন্য এক এলাকার দায়িত্ব।
বিক্রমাদিত্যের পুত্র প্রতাপাদিত্য পিতার জীবদ্দশায় একটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন। এ সময়ে নবাব দাউদ শাহের সাথে বিরোধ দেখা দেয় সম্রাট আকবরের। সম্রাট আকবর নবাব দাউদ শাহকে শিক্ষা দেয়ার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। তিনি বিরাট এক রণতরী ও সৈন্য বহর নিয়ে যুদ্ধে চলে আসেন। ইতিহাসবিদদের মতে, ওই নৌবহরের নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং সম্রাট আকবর। সম্রাট আকবর ও নবাব দাউদ শাহের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় ‘রাজমহল’ নামক স্থানে। দীর্ঘ যুদ্ধে নবাব দাউদ শাহ পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে গোপনে তার সমুদয় ধনসম্পদ পাঠিযে দেন রাজা প্রতাপাদিত্যের কাছে। এ বিপুল ধনসম্পদ নিয়ে পরে প্রতাপাদিত্য ঈশ্বরীপুরে তৈরি করেন বিলাশ বহুল রাজধানী। এক স্থানের ‘যশ’ অন্যস্থানে এনে রাজ্য গড়ার কাহিনী লোকমুখে ফিরতে ফিরতে এ এলাকার নাম হয় যশোজুর বা যশোর।
রাজা প্রতাপাদিত্য নিজেকে ‘স্বাধীন রাজা’ হিসেবে ঘোষণা করেন ১৫৯৯ সালে। ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে সুবেদার ইসলাম খাঁর সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রতাপাদিত্য ঈশ্বরীপুরে নির্মাণ করেন বহু ইমারত ও দুর্গ। বহিশত্রু থেকে রাজ্য রক্ষা করার জন্য তিনি মুকুন্দপুর থেকে কালীগঞ্জ থানা হয়ে আশাশুনি থানা পর্যন্ত ‘গড়’ খনন করেন। ইতিহাসের স্মৃতিবিজড়িত ঈশ্বরীপুরের অনেক স্থান এখনও জঙ্গলাকীর্ণ ও পরিত্যক্ত। কিছু দূর গেলে চোখে পড়ে যশোরেশ্বরী কালী মন্দির। অনেকে এই মন্দিরকে যশোরেশ্বরী দেবীর মন্দির বলে থাকে। এ মন্দিরের কিছু দূরেই রয়েছে ভাঙ্গা বাড়ির মতো ছিল জাহাজঘাটা। এই দুদলি নামকরণেরও ইতিহাস রয়েছে। যমুনা নদীর তীরে ছিল যশোর রাজ্যের রাজধানীর নৌবাহিনীর সদর দফতর। রাজা প্রতাপাদিত্যের নৌবাহিনীর প্রধান ‘ফেডারিক ডুডলির’ নামানুসারে এলাকার নামকরণ হয় দুদলি। এখানকার চিহ্নটি মুছে গেছে। দখল হয়ে গেছে এই ঐতিহাসিক স্থানটি। ইতিহাস বিজড়িত আজকের জঙ্গলাকীর্ণ সুন্দরবন দেখে বিশ্বাস না হলেও এ কথা সত্য যে, এক সময় এখানে ছিল একটি রাজ্যের রাজধানী। ছিল জনবসতি। ছিল রাজা বাদশাহের পদচারণা। ইতিহাস ও ভগ্ন পুরাকীর্তির কিছু চিহ্ন এখন ও অতীত স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
(ছবি -- যশোরেশ্বরী কালী)
(সাতক্ষীরায় বাড়ী অধুনা ঢাকার প্রতিষ্ঠিত এডভোকেট, Arpan Chakraborty -র
পাঠানো ছবি ও বিবরণ অনুযায়ী Post-টা করলাম)
লিখেছেনঃ Prithwish Ghosh
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন