শ্রী গৌর হরির পিতা জগন্নাথ মিশ্র ও মাতা শচী দেবী। জগন্নাথ মিশ্রের পরপর আট কন্যা হয়। কিন্তু কেহই জীবিত ছিলনা। তার পরে এক পুত্র হয়। নাম তার বিশ্বরূপ। পুত্রের বয়স যখন আট বছর তখন জগন্নাথ মিশ্রের বাবা-মায়ের নিকট হতে একটা পত্র আসল। তাতে লেখাছিল যে, সত্বর যেন স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সিলেট তাঁদের কাছে আসেন। পিতার মাতার এই আজ্ঞা পেয়ে শচী দেবী ও জগন্নাথ মিশ্র শ্রীহট্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং কিছুদিন পর নিজ গৃহে মাতা-পিতার নিকট পৌছান।
১৪০৬ শকাব্দের মাঘ মাসে শচী দেবী আবার গর্ভস্ত হলেন। শোভা দেবী (শাশুড়ীমাতা) রাত্রিতে স্বপ্ন দেখেন যে, কোন মহাপুরুষ তাঁকে বলছেন যে, পুত্রবধুর গর্ভে স্বয়ং ভগবান প্রবেশ করেছেন এবং শচীদেবীকে নবদ্বীপ পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য বলেন। এইজন্য জগন্নাথকে শচীদেবীসহ নবদ্বীপে যাওয়ার জন্য শোভা দেবী আদেশ করলেন। জগন্নাথ মিশ্র মহাশয় শচীদেবীকে নিয়ে নবদ্বীপের বাড়ীতে আসলেন। শচীর দেবীর গর্ভ দশমাস উত্তীর্ণ হল তবু পুত্র কন্যা কিছুই হল না। ক্রমে একাদশমাস, দ্বাদশ মাস উত্তীর্ণ হল তবুও সন্তানের জন্ম হল না। ১৪০৭ শকাব্দের ফাল্গুন মাস আসল জগন্নাথ মিশ্র ব্যস্ত হয়ে শ্বশুর নীলাম্বর চক্রবর্তীকে ডাকালেন।
নীলাম্বর পন্ডিত গননা করে বললেন অতি সত্বর শচীর সন্তান হবে। তার গর্ভে কোন এক মহাপুরুষ জন্ম নেবেন। একথা শুনিয়া সকলে স্বস্তি পেলেন।
চৌদ্দশত সাত শকে মাস যে ফাল্গুন।
পৌর্নমাসী সন্ধ্যাকালে হৈল শুভক্ষণ,
সিংহ রাশী, সিংহ লগ্ন উচ্চ প্রহসন।
ষড়বর্গ অষ্টবর্গ সবর্ব শুভক্ষণ।
অর্থাৎ ১৪০৭ শকাব্দে জাহ্নবী তীরস্থ পরীশোভিত নবদ্বীপ নগরে। মনোহর ফাল্গুন মাসে, নির্মল পূর্ণিমা সন্ধ্যায় শ্রী গৌরাঙ্গদেব অবতীর্ণ হলেন। যখন পূর্ণিমা সন্ধ্যায় পূর্বদিকে একখানা উজ্জ্বল থালার মত চন্দ্র উদিত হল। অমনি গৌরাঙ্গ সিংহ রাশিতে পূবর্বফাল্গুনী লক্ষত্রে মাতৃগর্ভ হতে অবির্ভত হলেন। নবদ্বীপবাসী প্রফুল্ল মনে হরিধ্বনি করতে লাগলেন। এভাবে হরিধ্বনির সহিত গৌরাঙ্গ দেব অবিভূত হয়ে ছিলেন। নীম বৃক্ষের তলে জন্ম হয়েছিল বলে শচীমাতা ছেলের নাম নিমাই রাখলেন।
সেসময় নবদ্বীপ বুদ্ধিমান ও নৈয়ায়িক পন্ডিত দ্বারা পূর্ণছিল। ভক্তির লেশ ছিল না। এমনই সময় শ্রী গৌরহরি ভক্তিরস বিতরণের জন্য নদীয়ায় অবর্তীর্ণ হলেন।
কলোহ প্রথম সন্ধ্যায়ং গৌরাঙ্গ অহর মহীতটে।
ভাগীরথী তটে ভূবী ভবিষ্যামী সনাতন। --- ব্রহ্ম পূরাণ, অর্থাৎ কলির প্রথম সন্ধ্যায় গৌরাঙ্গরূপে এই ধরাতলে ভগীরথী তীরে আবির্ভূত হব।
চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি দোলপূর্ণিমার রাত্রে চন্দ্রগ্রহণের সময় নদিয়ার মায়াপুরে চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম। তাঁর পিতামাতা ছিলেন অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার অন্তর্গত নবদ্বীপের অধিবাসী জগন্নাথ মিশ্র ও শচী দেবী। চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ওড়িশার জাজপুরের আদি বাসিন্দা। তাঁর পিতামহ মধুকর মিশ্র ওড়িশা থেকে বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেন।
চৈতন্যদেবের পিতৃদত্ত নাম ছিল বিশ্বম্ভর মিশ্র। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন স্বনামধন্য পণ্ডিত। তর্কশাস্ত্রে নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিতের খ্যাতি ছিল অবিসংবাদিত। জপ ও কৃষ্ণের নাম কীর্তনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ যে ছেলেবেলা থেকেই বজায় ছিল, তা জানা যায় তাঁর জীবনের নানা কাহিনি থেকে। কিন্তু তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয় ছিল সংস্কৃত গ্রন্থাদি পাঠ ও জ্ঞানার্জন।
পিতার মৃত্যুর পর গয়ায় পিণ্ডদান করতে গিয়ে নিমাই তাঁর গুরু ঈশ্বর পুরীর সাক্ষাৎ পান। ঈশ্বর পুরীর নিকট তিনি গোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত হন। এই ঘটনা নিমাইয়ের পরবর্তী জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর পণ্ডিত থেকে ভক্ত রূপে তাঁর অপ্রত্যাশিত মন পরিবর্তন দেখে অদ্বৈত আচার্যের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় বৈষ্ণব সমাজ আশ্চর্য হয়ে যান। অনতিবিলম্বে নিমাই নদিয়ার বৈষ্ণব সমাজের এক অগ্রণী নেতায় পরিণত হন।
কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষিত হওয়ার পর নিমাই 'শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য' নাম গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি জন্মভূমি বাংলা ত্যাগ করে কয়েক বছর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান পর্যটন করেন। এই সময় তিনি অবিরত কৃষ্ণনাম জপ করতেন। জীবনের শেষ চব্বিশ বছর তিনি অতিবাহিত করেন জগন্নাথধাম পুরীতে। ওড়িশার সূর্যবংশীয় সম্রাট গজপতি মহারাজা প্রতাপরুদ্র দেব চৈতন্যমহাপ্রভুকে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ অবতার মনে করতেন। মহারাজা প্রতাপরুদ্র চৈতন্যদেব ও তাঁর সংকীর্তন দলের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিলেন। জীবনের শেষপর্বে চৈতন্যদেব ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতেন এবং অধিকাংশ সময়েই ভাবসমাধিস্থ থাকতেন।
তিনি শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণাবতার। শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য ছিলেন ভাগবত পুরাণ ও ভগবদ্গীতা-য় উল্লিখিত দর্শনের ভিত্তিতে সৃষ্ট বৈষ্ণব ভক্তিযোগ মতবাদের একজন বিশিষ্ট প্রবক্তা। তিনি বিশেষত রাধা ও কৃষ্ণ রূপে ঈশ্বরের পূজা প্রচার করেন এবং 'হরে কৃষ্ণ' মহামন্ত্রটি জনপ্রিয় করে তোলেন। সংস্কৃত ভাষায় 'শিক্ষাষ্টক' নামক প্রসিদ্ধ স্তোত্রটিও তাঁরই রচনা। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতানুসারে, ভাগবত পুরাণের শেষের দিকের শ্লোকগুলিতে রাধারানির ভাবকান্তি সংবলিত শ্রীকৃষ্ণের চৈতন্য রূপে অবতার গ্রহণের কথা বর্ণিত হয়েছে।
চৈতন্য মহাপ্রভুর পূর্বাশ্রমের নাম গৌরাঙ্গ বা নিমাই। তাঁর গাত্রবর্ণ স্বর্ণালি আভাযুক্ত ছিল বলে তাঁকে গৌরাঙ্গ বা গৌর নামে অভিহিত করা হত। অন্যদিকে নিম বৃক্ষের নিচে জন্ম বলে তাঁর নামকরণ হয়েছিল নিমাই। ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী সাহিত্য বাংলা সন্তজীবনী ধারায় এক নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়েছিল। সেযুগে একাধিক কবি চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করে গিয়েছেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর চৈতন্য চরিতামৃত, বৃন্দাবন দাস ঠাকুরের চৈতন্য ভাগবত, এবং লোচন দাস ঠাকুরের চৈতন্যমঙ্গল।
ছেলেবেলায় দুষ্টুমি করাটা সকলেরই মজ্জাগত। দুষ্টুমী না করলে ছেলেবেলা সার্থক হয় না। এবার এমন একজন বিখ্যাত মানুষের নাম শোনাব, যাঁর দুষ্টুমিতে সারা নবদ্বীপ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিল।
ঠাকুরদা, মধুকর মিশ্র ওড়িশার যাজপুর থেকে রাজা ভ্রমরের অত্যাচারের ভয়ে ,অবিভক্ত বাংলার শ্রীহট্টে এসে বসবাস শুরু করেন। এই শ্রীহট্টই হলো এখনকার সিলেট। পরে, মধুকর মিশ্রের ছেলে জগন্নাথ মিশ্র সংস্কৃত শেখার জন্য নদীয়া জেলার নবদ্বীপে এসে সেখানেই থেকে যান।
পড়াশুনো শেষ হলে, জগন্নাথ মিশ্র, নীলাম্বর চক্রবর্তীর মেয়ে শচীদেবীকে বিয়ে করেন। এঁদের পরপর সাত মেয়ে হলেও সব কটা অকালে মারা যায়। পরে, দুই ছেলে -- বিশ্বরূপ আর বিশ্বম্ভর কিন্তু অকালে মারা যান নি। সেকালে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যেত সবার। ষোলো বছরে বিশ্বরূপের বিয়ের কথা হলে, তিনি সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ছেড়ে চলে যান।
জগন্নাথ মিশ্র ভাবলেন- অল্প বয়সে বেশী পড়াশোনার করার ফলেই বড় ছেলের এই হাল! একে তো সাত মেয়ে মারা গেছে, তার ওপর বড় ছেলে বিবাগী হয়ে চলে গেল, ফলে বিশ্বম্ভর কে আর পড়াশোনা করতেই পাঠালেন না!
বিশ্বম্ভরের ডাক নাম ছিল নিমাই!
কিন্তু, মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক! দুষ্টু নিমাই পরে কি হয়েছিল, সেটা বলছি!
তার আগে ওর ছেলেবেলার কথা বলে নিই! খুব মজা পাবে।
ওহো! নিমাইয়ের জন্ম তারিখটা তো বলতেই ভুলে গেছি। ১৪৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ ই ফেব্রুয়ারি দোলপূর্ণিমার সন্ধে ৬ টা থেকে ৭টার মধ্যে চন্দ্রগ্রহণের সময় নদিয়ার মায়াপুরে নিমাইয়ের জন্ম।
পাঁচ বছর থেকেই মহা দুষ্টুমি শুরু করেছিল এই নিমাই। তখনকার সব লোক গঙ্গাতে স্নান করতে যেতেন। একটা বিশ্বাস তখনও ছিল, এখনও আছে! গঙ্গাতে স্নান করলে নাকি সব পাপ দূর হয়। তাছাড়া, তখন তো আর ঘরে ঘরে স্নানঘরে শাওয়ার, বাথটাব ছিল না! ফলে লোকে গঙ্গাতেই স্নান করত। আর সেখানেই শুরু হত নিমাইয়ের দুষ্টুমি! ব্রাহ্মণরা স্নান করে উঠলেই গায়ে গোবোর মেশান কাদা ছুঁড়ে দিতেন। কারও শিবঠাকুর নিয়ে পালিয়ে যেতেন। বাচ্চা মেয়েদের চুলে ওকরা নামের একটা কাঁটা ওয়ালা ফলের বীচি ছুঁড়ে দিতেন। চুল জট পাকিয়ে যেত। সে এক কেলেঙ্কারী!
জগন্নাথ মিশ্র সাধে কি, দুঃখ করে লিখেছিলেন --
“এহি যদি সর্বশাস্ত্রে হবে গুণবান্।
ছাড়িয়া সংসার সুখ করিবে পয়ান।।
অতএব ইহার পড়িয়া কার্য্য নাই।
মূর্খ হৈয়া ঘরে মোর থাকুক নিমাঞি।।”
তোমরা ভাবছ, আমি বানান ভুল করেছি? আরে না! এটা ১৪৭৩ সালে লেখা! তখনকার বানান গুলো এরকমই ছিল। আমি ওটা অবিকল তুলে দিয়েছি।
ওই বাচ্চা মেয়েরা নিজেদের বাবা মার কাছে গিয়ে বলত ---
“বলে মোরে চাহে বিভা* করিবারে”
*বিভা = বিবাহ বা বিয়ে।
পরে আর এক মেয়ে বলছে--
“পূর্বে শুনিলাম যেন নন্দের কুমার।
সেইমত কি তোমার পুত্রের ব্যাবহার।।”
আর একজন ব্রাহ্মণ জগন্নাথ মিশ্রকে বলছেন ---
“সন্ধ্যা করি যেই জলেতে নামিয়া।
ডুব দিয়া লৈয়া যায় চরণ ধরিয়া।।”
বোঝো কাণ্ড নিমাইয়ের!
ওই পাঁচ বছর বয়সেই ডুব সাঁতার শিখে গেছিল। ব্রাহ্মণ, স্নান সেরে জপ করছেন জলে নেমে আর নিমাই ডুব সাঁতার দিয়ে ব্রাহ্মণের পা টেনে আবার জলে ফেলে নাকানী চোবানী খাওয়াচ্ছেন!
“কেহ বলে মোর শিবলিঙ্গ করে চুরি।
কেহ বলে মোর লয়ে পলায়ে উত্তরী*।।”
*উত্তরী= উত্তরীয় বা গায়ে দেওয়ার চাদর!
এবার দিনে দিনে বেড়েই চলল, নিমাইয়ের দুষ্টুমী! একদিন এঁটো রান্নার হাঁড়ির ওপর বসে খালি দুলতে লাগল! আর সঙ্গে ঠন্ ঠনা ঠন্ আওয়াজ !!
মা, শচী দেবী বকলেন! বললেন -- ভদ্রতা জানিস না?
নিমাই নাকি এর উত্তরে বলেছিলেন -- (এটা পরে অন্য লোকে লিখেছেন)
“প্রভু বলে মোরে, না দিস পড়িতে।
ভদ্রাভদ্র মূর্খ বিপ্র জানিবে কি মতে।।
মূর্খ আমি না জানি যে ভাল মন্দ স্থান।
সর্বত্র আমার এক অদ্বিতীয় স্থান।।”
এখন আর জগন্নাথ বাবুর কোনো উপায় থাকল না! গ্রামের সকলের পরামর্শে, নিমাইকে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে পাঠিয়ে দিলেন পড়তে!
শচী দেবীর হলো বিপদ! ছেলে আর বই ছেড়ে ওঠে না! শচী দেবী ভাবলেন- ছেলে পাগল হয়ে গেছে!
এ ব্যাপারে লেখা আছে --
“কিবা স্নানে কি ভোজনে কিবা পর্যটনে।নাহিক প্রভুর আর চেষ্টা শাস্ত্র বিনে।।
আপনি করেন প্রভু সুত্রের টিপ্পনী।
ভুলিয়া পুস্তক রসে সর্বে দেবমণি।।
না ছাড়েন শ্রীহস্তে পুস্তক একক্ষণে।.....
পুঁথি ছাড়িয়া নিমাঞি না জানে কোনো কর্ম।
বিদ্যারস ইহার হয়েছে সর্বধর্ম।।
একবার যে সুত্র পড়িয়া প্রভু যায়।
আরবার উল্টিয়া প্রভু সবারে ঠেকায়।।”
এই দুষ্টু নিমাই কালে কালে হয়ে উঠলেন মস্ত পণ্ডিত! নাম হলো চৈতন্যদেব!
লিখেছেনঃ Prithwish Ghosh
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন