দক্ষকন্যা সতীর কী সেই আবেদন, যা এক ইসলামি দেশের ধু-ধু মরুতেও এতকাল ধরে জাগিয়ে রাখতে পারে হিন্দুদের একটি মরূদ্যান? হাজার হাজার বছর পরেও এখনও স্বমহিমায় উজ্জ্বল তাঁর কিংবদন্তি। এমনকী, তালিবানি পাকিস্তানেও !
গল্পটি সুবিদিত। পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে আত্মাহুতি দিলেন সতী। ক্রোধে, শোকে জ্বলে উঠলেন স্বামী মহেশ্বর। সৃষ্টি বুঝি রসাতলে যায়। শেষ পর্যন্ত বিষ্ণুর চাতুরিতে রক্ষা পেল চরাচর। সুদর্শন চক্র সতীর দেহকে একান্ন টুকরোয় কেটে ছড়িয়ে দিল দশ দিকে। যে সব জায়গায় সেই দেহখণ্ডগুলি পড়ল, সেগুলি হল এক-একটি ‘পীঠ’। একান্ন পীঠ-এর মধ্যে ঊনপঞ্চাশটিই ভারতের বর্তমান ভূখণ্ডে, বাইরে মাত্র দু’টি। এক, তিব্বতে মানস ও দুই, বালুচিস্তানে হিংলাজ। এয়োস্ত্রীর সিঁদুর মাখা সিঁথি সহ সতীর ব্রহ্মরন্ধ্রটি পড়েছিল হিংলাজে। পুরাকথার সেই দেহাবশেষের উপরেই, অনেকটা বৌদ্ধ স্তূপের ধারণায় গড়ে উঠেছে একটি প্রার্থনাস্থল। বালুচিস্তানের রুক্ষ মরুপ্রান্তরে নিঃসঙ্গ হিন্দু তীর্থ।
হিংলাজে এই দেবী বহু প্রাচীন কাল থেকেই পরিচিত, তবে সে পরিচিতি ছিল নিতান্তই সীমিত— যেন কোনও আঞ্চলিক দলের মতো। সতীর একান্ন পীঠের অন্যতম বলে প্রচারিত হওয়ার পরে তাঁর মহিমা প্রসারিত হয়— আঞ্চলিক দল যেন এন ডি এ-র শরিক হল! জন্মসূত্রে অনার্য হিংলাজ স্থান পেলেন মহাশক্তির মহিমময় বলয়ে, ইতিহাসে দ্রুত হারিয়ে গেল তাঁর ক্ষুদ্র অতীত।
এমন ইতিহাস নিয়েও মরুতীর্থ হিংলাজ কিন্তু ততটা খ্যাতি পায়নি, যতটা তার পাওয়ার কথা ছিল। ভয়াল মরুভূমির মধ্য দিয়ে আড়াইশো কিলোমিটার যাত্রা মানে আসলে ভক্তির চূড়ান্ত পরীক্ষা (প্রতিটি তীর্থযাত্রীকেই সাহসিকতার জন্য ভারতরত্ন দেওয়া উচিত)। গোটা রাস্তাতেই ভয়ঙ্কর ডাকাতের উপদ্রব, আগে যেমন ছিল, এখনও তেমনই। তীর্থযাত্রী বলতে মূলত সিন্ধু এলাকার কিছু হিন্দু, তাঁরা নিয়মিত ভাবেই ডাকাতের হাতে পড়েন। দেবীর টানে আর যাঁরা আসতেন, তাঁরা বেশির ভাগই রাজপুত। রাজস্থান আর গুজরাতের রাজপুত। দেশভাগের পরে তীর্থযাত্রীদের সেই ধারাটাও স্বাভাবিক ভাবেই শুকিয়ে যায়। এর বাইরে আর যে অঞ্চলের মানুষের কাছে হিংলাজ কিছুটা পরিচিত ছিল, তার নাম বাংলা। তার কৃতিত্ব এক তান্ত্রিকের। নাম (কালিকানন্দ) অবধূত। তিনি দেশভাগের আগে হিংলাজ গিয়েছিলেন এবং সেই দীর্ঘ, কষ্টকর যাত্রার এক ভয়ানক বিবরণ লিখেছিলেন। তাঁর বইটি এই তীর্থযাত্রার একমাত্র আধুনিক বিবরণ। অবধূতের বইটি জনপ্রিয় হয়েছিল, পরে তা নিয়ে একটি খুব জনপ্রিয় সিনেমাও হয়, নায়কের ভূমিকায় ছিলেন উত্তমকুমার। তাই, বাঙালি মানসে ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ প্রবেশ করেছিল নিছক রোমান্টিক কারণে।
মূলত প্রাক্-আর্য জনজাতির সংস্কৃতি, যার শরীরে আর্যায়ণের ছাপ থাকলেও সেটা গভীরে ঢোকেনি। কিন্তু যে ভক্ত নয়, তাকেও স্বীকার করতে হবে, পরিবেশটি চমকপ্রদ। সঙ্কীর্ণ একটি পাহাড়ি গিরিখাত, তার মাঝে এক গুহা— প্রাকৃতিক গুহা, দীর্ঘদিন ধরে জল আর বাতাসের নিরন্তর অভিঘাতে যার সৃষ্টি। তার ভিতরেই দেবীর অবস্থান। গুহাটি অন্তত তিরিশ ফুট উঁচু, চওড়ায় কম করে ষাট থেকে সত্তর ফুট। গিরিসংকটের নীচে মৃদু গতিতে বয়ে চলেছে একটি নদী। এর উপস্থিতি, এবং মাঝে মাঝে অনুপস্থিতি দেখলে বিভ্রান্তি জাগতে পারে। ভারী বর্ষায় স্ফীত হয়ে ওঠে স্রোতস্বিনী। তখন এই গুহায় প্রবেশের পথ বন্ধ হয়ে যায়।গুহার ভিতরে সে অর্থে কোনও দেবীমূর্তি নেই। উপাস্য হিসাবে আছে একটি কাপড় জড়ানো, সিঁদুর মাখা প্রস্তরখণ্ড। দেখলে সম্ভ্রম জাগে। এখানেই পুজো দেয় লোকজন। দেবীর আসনের ঠিক নীচেই একটা অর্ধবৃত্তাকার সুড়ঙ্গ। তার মধ্যে হামাগুড়ি দিয়েই সারতে হয় প্রদক্ষিণ পর্ব। তবে হিংলাজের মাহাত্ম্য ঠিক কী, সেটা বোঝার জন্য পবিত্র ভক্তির প্রয়োজন।
জয় মা হিঙ্গুলা....... জয় মা হিঙ্গুলা....... জয় মা হিঙ্গুলা
লেখকঃ প্রীথিশ ঘোষ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন