শিবই সর্বভারতীয় প্রধান দেবতা। শিবের ইতিহাস কম বিস্ময়কর নয়। কেননা, শিব অনার্য দেবতা, বৈদিক দেবতা নন; ব্রহ্মা, বিষ্ণু-প্রমূখ বৈদিক দেবতাকে অপসারণ করে শিবের সর্বভারতীয় দেবতায় মর্যাদা লাভ যেন ভারতীয় অনার্য ভূমিপুত্রদের বিজয়েরই প্রতীক। শিবের স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে -- শিব ও দুর্গা। সুখতৃষ্ণার্ত মানুষের একান্ত মনের প্রতিচ্ছবি। এ রকম সুখি যুগল জীবন মানুষের জন্মজন্মান্তরের কামনা। দেবী দুর্গার পরিচয় দিতে গিয়ে সুধীরচন্দ্র সরকার লিখেছেন, ‘পরমাপ্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ ও শিবপত্নী।’
এই বাক্যটিতে যেন দেবী দুর্গার প্রকৃত পরিচয় অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে -- যে রূপসী মাতৃদেবী বাংলায় পূজিত হন শরত্কালে, যখন নীলাভ আকাশে ফুরফুরে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় সাদা সাদা মেঘের ভেলা, নদীর ধারে উজ্জ্বল রোদে ফুটে থাকে বাতাসে দোল খাওয়া শাদা শাদা কাশের ফুল আর গ্রামীণ জনপদে দেবীর আগমনী ঘোষনায় উন্মাতাল ঢাকের শব্দে বাঙালির আদিম রক্তস্রোতে জেগে ওঠে এক আদিম মাতৃভক্ত নিষাদ। অস্ট্রিকভাষী নিষাদেরা প্রাচীন বাংলার গভীর অরণ্যে ‘বোঙ্গা’ দেবতার পূজা করত। কোনও কোনও পন্ডিতের ধারণা ওই ‘বোঙ্গা’ থেকেই বাংলা শব্দের উদ্ভব। মনে রাখতে হবে - প্রাচীন বৈদিক আর্যরা করত যজ্ঞ। সে যজ্ঞে পশুবলি হত। বাংলা, প্রাচীন কাল থেকেই যজ্ঞ না করে করত 'পূজা'। বাংলা অবৈদিক আর অনার্য বলেই চিরকালই ছিল পূজার্চনার দেশ। বাঙালি সুপ্রাচীন কাল থেকেই বহু লোকায়ত দেবদেবীর পূজার্চনা করত। গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর "বাংলার লৌকিক দেবতা" বইটি থেকে আমরা প্রায় পঁয়ত্রিশটি লৌকিক দেব-দেবীর নাম জানতে পেরেছি। এরা আসলে ছিল বৌদ্ধধর্মের দেবদেবী, বাংলায় বৌদ্ধযুগের অবসানকালে শিবের পক্ষভুক্ত হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, বাংলার হিন্দুধর্মটি হল তান্ত্রিক হিন্দুধর্ম। তন্ত্র হল বেদবিরোধী এবং সাধনার বিষয়। যে কারণে বাঙালি তান্ত্রিকেরা দুর্গাকে পরমাপ্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর পৌরাণিক আর্যদের মতে দুর্গা ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণু কর্তৃক সৃষ্ট দেবী ! সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আজ বাঙলার 'তন্ত্র-সাধনায়' দুর্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে 'মার্কেণ্ডেয় পুরাণ'-এর রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য-এর হাত ধরে আর সেই ঘটনাচক্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন মেধস মুনি। এই ভাবেই আদিম শুদ্র জনজাতি তথাকথিত ব্রাহ্মণ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল।
লেখকঃ প্রীথিশ ঘোষ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন