০১ ডিসেম্বর ২০১৫

তিলক ফোঁটা

তিলক [ tilaka ] বি. দেহের নানা স্হানে চন্দন প্রভৃতির ফোঁটা বা ছাপ (তিলক কাটা)।
☐ বিণ. তিলকের মতো অলংকারস্বরূপ, শ্রেষ্ঠ (কুলতিলক)।
[সং. তিল + ক]।
তিলক কাটা ক্রি. বি. গায়ে তিলক আঁকা।
তিলকমাটি বি. গঙ্গানদী বা অন্য তীর্থস্হানের যে মাটি দিয়ে তিলক আঁকা হয়।
তিলকসেবা, তিলকছাপা বি. বৈষ্ণবদের দেহের আটটি স্হানে তিলক এঁকে হরিনাম লেখা।
তিলকা বি. গায়ে তিল ফুলের মতো চিহ্ন (‘অলকা তিলকা ভালে’)।
তিলকী (-কিন্) বিণ. তিলকধারী (তিলকী বৈষ্ণব)।
________________________________________
তিলক বিভিন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের ভক্তগণ কর্তৃক ললাটাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অঙ্কিত চিহ্নবিশেষ। সম্প্রদায়ভেদে চন্দন, খড়িমাটি জাতীয় গুঁড়া, ভস্ম প্রভৃতি দিয়ে তিলক অঙ্কিত হয়। কবে কোথায় এর প্রথম প্রচলন হয় তা সঠিকভাবে বলা না গেলেও বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানে ললাটে হোমভস্মের টিকা ধারণ প্রথার সঙ্গে এর একটা সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। সপ্তম শতকে রচিত বাণভট্টের কাদম্বরী গ্রন্থে শিবভক্ত দৃঢ়দস্যু এবং জাবালি ঋষির বর্ণনায় ললাটে ভস্ম দ্বারা ত্রিপুন্ড্র অঙ্কনের কথা জানা যায়, যা থেকে পরবর্তীকালে শৈবদের কপালে তিনটি সমান্তরাল রেখার সমন্বয়ে তিলকচিহ্ন অঙ্কনের প্রথা প্রচলিত হয় বলে অনেকের ধারণা। ১০ম-১১শ শতকে রচিত বিভিন্ন পুরাণ ও উপপুরাণ থেকে জানা যায় যে, ওই সময় থেকে শৈবাদি সম্প্রদায়ের মধ্যে তিলক ধারণ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ সময়ের চর্যাপদেও ‘বাণচিহ্ন’ নামে এ তিলক ব্যবহারের পরিচয় পাওয়া যায়। গবেষকদের অনুমান, তিলক ধারণের প্রথা প্রথমে শৈবদের মধ্যে শুরু হয় এবং তদনুসরণে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও তা বিস্তার লাভ করে।
তিলক ধারণের প্রথম অনুপ্রেরণা কোথা থেকে এসেছিল তা সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে, শৈবাদি বিভিন্ন সম্প্রদায় যেসব ভঙ্গিতে তিলক ধারণ করে তার অনুপ্রেরণা এসেছে স্বস্ব ইষ্ট দেবদেবীর মূর্তিতে অঙ্কিত বিভিন্ন চিহ্ন থেকে। যেমন শৈবদের ললাটে অঙ্কিত ত্রিপুন্ড্র চিহ্ন শিবলিঙ্গ বা শিবের কপালে অঙ্কিত চিহ্নের অনুরূপ। আবার দক্ষিণ ভারতের বিষ্ণুমূর্তির ললাটে অঙ্কিত তিনটি ঊর্ধ্বাধ রেখার সমন্বয়ে অঙ্কিত তিরুনামম্ বা শ্রীনামম্ নামে যে চিহ্ন দেখা যায় তা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ব্যবহূত তিলকচিহ্নের অনুরূপ। শক্তিদেবীর ললাটস্থ ত্রিনয়নের নিম্নে যে রক্তবর্ণ বিন্দুচিহ্ন দেখা যায় তার অনুকরণে শাক্তরা কপালে ধারণ করে লাল বিন্দুচিহ্ন। এসব দৃষ্টান্ত থেকে বলা যায় যে, এ তিলকচিহ্ন অনেকাংশেই সম্প্রদায়গত বিশ্বাস, ভক্তি, চিন্তাভাবনা ও স্বাতন্ত্র্যের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয়েছে।
তিলকের ব্যবহার সকলের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। সাধারণত নিষ্ঠাবান হিন্দুরা নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্য এবং পৈত্র্যাদি কর্ম অনুষ্ঠানের পূর্বে তিলকচর্চা করে থাকেন। তবে শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, সৌর এবং গাণপত্য সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এটি একটি নিয়মিত আচার। এদের মধ্যে আবার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অধিক। স্নানের পর বৈষ্ণবরা বিষ্ণুর দ্বাদশ নাম স্মরণ করে দেহের দ্বাদশ অঙ্গে তিলক ধারণ করেন। এ দ্বাদশ অঙ্গ ও দ্বাদশ নাম হলো: ললাটে কেশব, উদরে নারায়ণ, বক্ষে মাধব, কণ্ঠে গোবিন্দ, দক্ষিণ পার্শ্বে বিষ্ণু, দক্ষিণ বাহুতে মধুসূদন, দক্ষিণ স্কন্ধে ত্রিবিক্রম, বাম পার্শ্বে বামন, বাম বাহুতে শ্রীধর, বাম স্কন্ধে হূষীকেশ, পৃষ্ঠে পদ্মনাভ এবং কটিতে দামোদর। বৈষ্ণবদের মধ্যে যে বিভিন্ন উপবিভাগ রয়েছে তাদের মধ্যে তিলকচিহ্নেরও রকমফের আছে। যেমন কেউ ইংরেজি ভি-অক্ষর, কেউ ইউ-অক্ষর, কেউবা একরেখ বা অধিকরেখ তিলকচিহ্ন ধারণ করে। এছাড়া অন্যান্য অঙ্গে তারা বিষ্ণুর শঙ্খ, চক্র, গদা ইত্যাদির চিহ্নও ধারণ করে।
শৈবরা ললাটে যে তিলকচিহ্ন ধারণ করে তার নাম ত্রিপুন্ড্র। এটি তিনটি সমান্তরাল রেখার সমন্বয়ে রচিত হয়; কখনও ঈষৎ বক্র ও খন্ডচন্দ্রের মতোও হয়। ত্রিপুন্ড্রধারণ শৈবদের জন্য অবশ্যকরণীয়। এতে গঙ্গাস্নান ও বিষ্ণু-মহেশ্বরের কোটি নাম জপের পুণ্য অর্জিত হয় বলে তাদের বিশ্বাস। শৈব তিলকচিহ্নের অন্যান্য রূপ হচ্ছে সবিন্দু অর্ধচন্দ্রাকৃতি, বিল্বপত্রাকৃতি, প্রস্তরগুটিকাকৃতি ইত্যাদি।
শাক্ত তিলকচিহ্ন শৈবচিহ্নের প্রায় অনুরূপ। এতে এক বা একাধিক বিন্দুচিহ্নের উপস্থিতি সাধারণ; সে সঙ্গে থাকতে পারে ত্রিপুন্ড্র চিহ্ন, ঈষৎ বক্র একটি রেখা কিংবা অন্য কোনো চিহ্ন। দক্ষিণাচারী, বামাচারী, মহাকালী, শৈব, শাক্ত প্রভৃতি উপসম্প্রদায়ভেদে শাক্ত তিলকচিহ্ন বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে।
সৌর ও গাণপত্য তিলকচিহ্নের সংখ্যা ও বৈচিত্র্য অপেক্ষাকৃত কম। সৌর সম্প্রদায়ের চিহ্ন দুটি স্থূল সরলরেখার সমন্বয়ে রচিত হয়। দ্বিতীয়টির দৈর্ঘ্য প্রথমটির এক-চতুর্থাংশের কম এবং এটি দুই ভ্রূর মধ্যস্থলে প্রথমটির নিচে কেন্দ্র বরাবর সংযুক্ত থাকে। গাণপত্যদের তিলকচিহ্ন ইংরেজি ইউ-অক্ষরের মতো এবং তার মধ্যস্থলে প্রদীপশিখার মতো একটি রেখা থাকে। তিলকচিহ্ন রচনার জন্য কাঠ বা ধাতু নির্মিত মুদ্রা অথবা অফুটন্ত গাঁদাফুল ব্যবহূত হয়।
উপর্যুক্ত তিলক চিহ্নসমূহের ব্যবহারে হিন্দুদের অনেক সামাজিক প্রথার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। তার মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য বর্ণপ্রথা। বর্ণনির্বিশেষে সকল হিন্দুই তিলক ধারণের অধিকারী হলেও বিভিন্ন পুরাণ ও তন্ত্রগ্রন্থে এ ব্যাপারে কিছু বিধান দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে: ব্রাহ্মণরা ঊর্ধ্বপুন্ড্র, ক্ষত্রিয়রা ত্রিপুন্ড্র, বৈশ্যরা অর্ধচন্দ্রাকৃতি তিলক এবং শূদ্ররা বর্তুলাকার তিলক ধারণ করবে। তবে এ বিধান অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের এবং বর্তমানে এর তেমন প্রয়োগ নেই। লৌকিক দেবতার পূজার্চনার সঙ্গেও কোনো কোনো তিলক চিহ্নের একটা দূরায়ত সংযোগ লক্ষ করা যায়। যেমন দক্ষিণ ভারতের গঙ্গম্মা দেবীর পূজায় ঘরের দেয়ালে যে চিহ্ন অঙ্কিত হয় তা শৈব ত্রিপুন্ড্রের প্রায় অনুরূপ। এ থেকে আর্য সংস্কৃতির সঙ্গে অনার্য সংস্কৃতির একটা সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়।

লিখেছেনঃ প্রীথিশ ঘোষ
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।