দুর্গা মহা দেবী পরমা প্রকৃতি। তিনি ছিলেন শিবের স্ত্রী। মা দুর্গার আরেক
নাম শিবদূতী। মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ হতে তাড়িয়ে দিয়ে স্বর্গরাজ্য দখল
করলে দেবতারা বিপন্ন হয়ে ব্রক্ষ্মার কাছে গিয়ে তাদের দুর্দশার কথা বলেন এবং
তাদের এ মহা বিপদ থেকে যেভাবেই হোক রক্ষার পথ দেখাতে বলেন। ব্রক্ষ্মার
বলেই মহিষাধুর পুরুষদের অবাধ্য হয়েছিল। তিনি তখন বলেন এই অসুরকে বধ করতে
হলে প্রত্যেক দেবতার নিজ নিজ স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়ে নিজ নিজ তেজের কাছে
প্রার্থনা করতে হবে যেনো এই মিলিত এক নারীমূর্তি আবির্ভুত হন। এই শুনে
ব্রক্ষা, শিব ও অনান্য দেবতাদের তেজ থেকেই এক নারীমূর্তি আবির্ভুত হন। সকল
দেবতা তাদের অস্ত্রসমূহ সে দেবীকে দান করলে সেই দেবী মহিষাসুরকে তিনবার বধ
করেন। প্রথমবার অষ্টদশভুজা উগ্রচন্ডা রুপে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার মা
দূর্গারুপে। মহিষাসুর মা দূর্গার আরাধনা করলে দেবী মহিষাসুরের কাছে আসলে
তিনি বলেন ‘আপনার হাতে মৃত্যুর জন্য কোনো দুঃখ নেই , কিন্তু আপনার সাথে
আমিও যাতে সকলের পুজিত হই, তারই ব্যবস্থা করুন’। মা দুর্গা তখন বলেন
উগ্রচন্ডা, ভদ্রকালী ও দুর্গা এই তিন মূর্তিতে তুমি সব সময় আমার পদলগ্ন হয়ে
দেবতা, মানুষ ও রাক্ষসদের পূজ্য হবে। সুরথ রাজার সময় হতেই এই দুর্গা পূজা
চলে আসছে। সুরথ যুগে সত্য রাজাই প্রথম দূর্গা মূর্তি প্রস্তুত করে পূজা
অচর্না শুরু করেন। মুলত বসন্তকালে এ পূজা করা হত তাই এ পূজা বাসন্তী পূজা
হিসেবেও পরিচিত।
পরবর্তীকালে রামচন্দ লঙ্কেশ্বরের রাবনের বিনাশের
জন্য শরৎকালে ব্রক্ষার মাধ্যমে দেবীকে জাগ্রত করে তার পূজা করেছিলেন।
শরৎকালে দেব দেবীরা ঘুমন্ত থাকে বলেই তাকে মা দূর্গাকে জাগাতে হয়েছিলো। তা
থেকেই এ শরৎকালীন দুর্গা পূজার অভূদ্যয়।
বিভিন্ন সময় শ্রী শ্রী
চণ্ডী তার সর্বশক্তি দিয়ে বিভিন্ন নামে মানবকল্যাণ সাধন করেছেন। মহিষুর
নিধন করেছেন দুর্গা হয়ে, মধু কৈটভ বধ করেছেন বিষণ রূপে, শুম্ভ-নিশুম্ভ
সংহার করেছেন চামুণ্ডা তথা কালীরূপ ধারণ করে। শ্রী শ্রী দুর্গতিনাশিনী,
অসুর বিনাশিনীসহ হাজারও উপাধি। স্বর্গের রাজা ইন্দ্রাকে পরাজিত করে অসুররা
স্বর্গলাভ করায় দুর্গার আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। কারণ দেব-দেবী,
দেবতারা নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়েছিল অসুরদের হাতে। এই নির্যাতন-নিপীড়নের
হাত থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে পায় দেবী দুর্গার অসীম কৃপায়। ব্রহ্মরূপা
সনাতনী ত্রৈকোল্য জননী দুর্গা এলেন- গিরিরাজ ও মা মেনকার ঘর আলোকিত করে
হিমালয়ে অধিশ্বর হয়ে উমা নাম ধারণ করে। তিনি পার্বতী নামেও খ্যাত ছিলেন।
আবার কেউ কেউ তাকে গৌরীও বলতেন। ৮ বছর বয়সে উমা শিবের কঠোর তপস্যা করে
পতিরূপে গ্রহণ করেন। গৌরীদান কথাটি তখন থেকেই চালু রয়েছে।
এর আগের
কথা হলো_ সতীসাধ্বী কন্যা স্বামীনিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহ ত্যাগ করে
পরপারে চলে যান। মনের দুঃখে সতীপতি শিব সতীর মরদেহ কাঁধে নিয়ে এক বছর
ত্রিভুবন ভ্রমণ করেন। এ সময় সতীর দেবীর দেহ গলিত ছিন্নভিন্ন হয়ে পচে খসে
পড়তে থাকলেও কাঁধ থেকে না নামিয়ে বরং তার গলিত দেহাংশ শিব তার সারা দেহে
মেখে নেন। আর তখন থেকেই অকাল বোধন হিসেবে দুর্গাপূজা, যদিও বসন্তকালে
বাসন্তী পূজা হিসেবেই এর প্রচলন ছিল।
সম্রাট আকবর বাংলা-বিহারের
নাজা কংসনারায়ণকে দেওয়ান নিযুক্ত করেন। বয়সের কারণে দেওয়ানী ছেড়ে রাজশাহীর
তাহেরপুরে এসে কংসনারায়ণ ধর্মীয় ও সামাজিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাহেরপুরে
এসে তার জমিদারির ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মহাযজ্ঞের জন্য আহ্বান করেন। ওই সময়
নাটোরের বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্যরা বংশানুক্রমে তাহেরপুর রাজাদের পুরোহিত
ছিলেন। এদের মধ্যে রমেশ শাস্ত্রী নামে একজন বাংলা- বিহারের বিখ্যাত পণ্ডিত
ছিলেন। তিনি শাস্ত্রমতে বললেন, বিশ্বজিৎ, রাজসুয়, অশ্বমেদ ও গোমেধ- এই
চারটি মহাযজ্ঞ রয়েছে। বিশ্বজিৎ ও রাজসুয় নামক মহাযজ্ঞ শুধু সম্রাটরা করতে
পারবেন। অশ্বমেধ ও গোমেধ যজ্ঞ দুটিও নিষিদ্ধ। একমাত্র দুর্গোৎসব ছাড়া অন্য
কোনো মহাযজ্ঞ করা সঠিক নয়। রাজা রামচন্দ্রের বিধানে ভক্তিসহ দুর্গোৎসব করলে
সর্বযজ্ঞের ফল লাভ করা সম্ভব বলে মত প্রকাশ করেন রমেশ শাস্ত্রী। উপস্থিত
অন্য পণ্ডিতরাও ওই মতামতের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন। আর রাজা কংসনারায়ণ সে
মতেই পূজার বিশাল আয়োজন করেন। ওই সময় সাড়ে ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজকীয় পরিবেশে
দুর্গোৎসব শুরু করেন। আর এই বিশাল পূজার পূরোহিত ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত
পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী। আর এখান থেকেই শুরু হয় মহা ধুমধামে দুর্গোৎসব।
তৎকালীন সময়ে এই মহাযজ্ঞে আনন্দ, ধুমধাম ও উৎসাহে সবাই মোহিত হয়েছিলেন।
পরের বছর থেকে এ অঞ্চলের অনেক সামন্ত রাজা ও ধনী ব্যক্তি বিখ্যাত পণ্ডিত
রমেশ শাস্ত্রীর পদ্ধতি অনুসারে দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু করেন। মার্কন্ডেয়
পুরাণে যদিও দুর্গোৎসবের কিছু বৃত্তান্ত রয়েছে, কিন্তু সমগ্র যজ্ঞটির বিধান
প্রাচীন কোনো গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে নেই। এ কারণে পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর
প্রণীত আচারই ব্যাপক জনপ্রিয় হিসেবে সনাতন হিন্দু সমাজ সানন্দে দুর্গোৎসব
পালন শুরু করে।
সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় এই উৎসবের
আমেজ ছড়িয়ে আছে সারাবিশ্বে। বাংলাদেশ এবং কলকাতার নামকরা প্রাচীন পূজার
রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। দুই বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে পূজার শুরু ও
প্রাচীন ইতিহাস কলকাতাকে ঘিরেই। বাংলার দুর্গাপূজার সূচনা করেন কলকাতার
রাজশাহী তাহেরপুরের জমিদার কৃষ্ণনারায়ণ। তখন সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল।
মতান্তরে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাতেই দুর্গাপূজা শুরু। কলকাতার
নামকরা পুরনো পূজাগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে আছে শোভাবাজার রাজবাড়ি,
হাটখোলার দত্ত, পাথুরিয়াঘাটা, লাহাবাড়ির পূজা, ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ির
পূজা, মালিক বাড়ির পূজা ইত্যাদি।
প্রাণকৃষ্ণ হালদারের পুজো :
কলকাতার ইতিহাস ঘাঁটলে সবচেয়ে পুরনো পূজা বলতে পাওয়া যায় বাগবাজারের
প্রাণকৃষ্ণ হালদারের পূজা। কষ্ঠিপাথরের খোদাই করা সেই মূর্তির সঙ্গে
ছেলেমেয়ে নন, ছিলেন জয়া আর বিজয়া নামে দুই সঙ্গিনী। সে প্রায় ৪০০ বছর আগের
কথা।
বেহালার সাবর্ণ রায় চৌধুরীর পূজা:
কলকাতার প্রথাগত দুর্গা
পূজার পথিকৃৎ কিন্তু প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো বেহালা সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের
এই পূজা। ১৬১০ সালে এই পূজার সূত্রপাত করেন বড়িশার জমিদার লক্ষ্মীনারায়ণ
রায় মজুমদার। এই পূজা আজো চলছে শুরুর সময়কার আচার পদ্ধতি অনুসারেই। পূজার
বোধন হয় কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে, অর্থাৎ মহানবমীর ১৫ দিন আগের তিথিতে।
দেবী মূর্তির রূপ ও রংয়ের কোনো পরিবর্তন নেই। মণ্ডপে মূর্তিও তৈরি হয় সেই
পুরনো আমলের কাঠামোর ওপর। আটচালা মণ্ডপেই হয় কুমারী পূজা।
শোভাবাজারের রাজবাড়ির পূজা : ১৭৫৭ সালে লর্ড ক্লাইভের পলাশী জয়ের পরে
ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসারদের আপ্যায়নের জন্যই রাজা নবকৃষ্ণদেব এই
পূজার আয়োজন করেন। রথের দিনে কাঠামো পূজা করে মূর্তি বানানো শুরু হয়। বোধন
হয় নবমীর ১৫ দিন আগে। পূজায় বসত বাছাই করা বাইজিদের নাচের আসর। সন্ধিপূজায়
কামান ছোঁড়া হতো। গোরাদের ব্যান্ড বাজিয়ে মহাসমারোহে জোড়া নৌকায় ভাসান হতো
দশমীতে। তারপর উড়িয়ে দেওয়া হতো কৈলাশের উদ্দেশ্যে নীলকণ্ঠ পাখি।
হাটখোলার দত্তবাড়ির পূজা :
পূজায় শোভাবাজার বাড়ির সঙ্গে বরাবরের টক্কর দিত
হাটখোলার দত্তরা। নিমতলা স্ট্রিটে জগৎরাম দত্ত এই পূজার প্রচলন করেন। পরে
পূজার দায়িত্ব নেন ঈশ্বর দেব প্রসাদ। সিংহের মুখ হতো ঘোড়ার মতো। চালচিত্রের
উপরে রাধাকৃষ্ণ আর নিচে নিশুম্ভ যুদ্ধের বর্ণনা আঁকা। মাথায় থাকত দুটি
টিয়া। রিপু বলির নামে ফল, সবজি বলি হতো। বাইজি থেকে সপুত্র মহিলা সব
কিছুতেই ছিল টেক্কা দেওয়ার লড়াই। লড়াই চলত ভাসানের মিছিল বা ঘাটের লড়াই
নিয়ে। ভাসানে উড়ত দুইটি নীলকণ্ঠ।
লাহাবাড়ির পূজা :
ঈশ্বর প্রাণকৃষ্ণ
লাহা প্রায় ২০০ বছর আগে এই পূজা শুরু করেন। কথিত আছে স্বপ্নে পারিবারিক
দেবী জয়া জয়া মায়ের নির্দেশেই পূজা আরম্ভ হয়। এই পূজা লাহা বাড়ির পূজা নামে
বিখ্যাত। এদের দুর্গা শিবনেত্র। শিবের কোলে তার অধীষ্ঠান। রিপু বলি এদেরও
হয়। পূজা শুরু হয় সপ্তমীতে নাটমন্দিরে জয়া জয়া মা-এর অধীষ্ঠানের পরে।
দশমীতে যখন মা বেরিয়ে যান তারপর থেকে মূল ফটক বন্ধ থাকে। বিসর্জনের পরে
একজন বাইরে থেকে চেঁচিয়ে ৩ বার মা কে ডাকেন, মা ভিতরে থেকে গেছেন কী না
জানতে। নিশ্চিত হলে তবে দরজা খোলে।
ছাতুবাবু-লাটুবাবুর পূজা :
১৭৮০
সালে থেকেই রামদুলাল দে সরকার তার বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে যে পূজার প্রচলন
করেন তাই পরে ছাতুবাবু-লাটুবাবুর পূজা নামে খ্যাত। এদের ঠাকুরদালান
গঙ্গামাটির তৈরি, এদেরও রথের দিনে কাঠামো পূজা হয়। এখানে অসুরসহ মা-দুর্গা
এবং তার সন্তানদের সাজানো হয় মঠচুবড়ি আর্টে। সিংহ ঘোটকাকৃতি। লক্ষ্মী-
সরস্বতী পূজিত হন জয়া-বিজয়া রূপে। আর থাকেন শিব, রাম, হনুমান। প্রতিপদ থেকে
ষষ্ঠি পর্যন্ত ঘট পূজা করা হয়। সপ্তমীতে কলা বোউ স্নান করিয়ে মূর্তিপূজা
শুরু। শুরুর দুই বছর পরে এক অষ্টমীতে বলির জন্য আনা ছাগশিশু রামদুলালের
পায়ের ফাঁকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নেয়। এই ঘটনার পরে প্রাণি বলি বন্ধ হয়ে যায়।
আখ ও চালকুমড়ো বলি হয়।
পাথুরিয়াঘাটার পূজা :
পাথুরিয়াঘাটায় প্রায়
১৬৫ বছরের পুরনো দুর্গা পূজার সূত্রপাত রামলোচন ঘোষের হাতে। ৩ চালার ঠাকুর
আর ঘোড়া মুখের সিংহ এই পূজায়। ষষ্ঠী ও নবমীতে কুমারী পূজা ছাড়া সধবা পূজাও
হয়। এদের শিল্পী ও ঢাকিরাও আসত পরিবারের মধ্যে থেকেই। ৭০-৮০ বছর হলো এখানে
বলি বন্ধ।
হাওড়া পণ্ডিত মহাশয়ের বাড়ির পূজা:
হাওড়া পণ্ডিত সমাজের
সভাপতি মুরারী মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে পূজা শুরু হয় ৩৫০ বছর আগে। মা
এখানে কন্যারূপে পূজিত হন। বাড়ির মেয়েরা পূজার বৈদ্যের জন্য মুড়কি, নাড়ু
তৈরি করেন। সারা বছর বাড়িতে যা রান্না হয় সপ্তমী থেকে নবমী সেই সমস্ত পদ
রান্না করে মায়ের ভোগ নিবেদন করা হয়। অষ্টমীর দিন সন্ধি পূজার পর একটি
থালায় সমান করে সিঁদুর দিয়ে চৌকির ওপর মূল বেদীর তলায় একটি কাঠির সাহায্যে
রাখা হয়। দশমীর দিন ওই থালায় মায়ের হাত, পা কিংবা পদ্মের চিহ্ন পাওয়া যায়।