তুঙ্গ নদীর ধার ঘেঁষে ছোট্ট গ্রামে পা দিতেই মনটা আনন্দে ভরে উঠেছিল তরুণ সাংবাদিকের। নিতান্তই ছাপোষা গ্রাম, কিন্তু তার আকাশ-বাতাসে কী যেন একটা মিশে আছে, গড়পড়তা নয়, একটু অন্যরকম। হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসছে মিঠে কর্পূরের গন্ধ। একটা বাঁক ঘুরতেই সুব্রহ্মণ্যর মুদির দোকান। খদ্দেরদের ভিড়। ভিনরাজ্যের আগন্তুককে দেখে সাদরে দোকানে ডেকে নিলেন। হাসিমুখে প্রশ্ন, ‘‘কফি বা চায়াম, কিম ইচ্ছাতি ভব?’’ চমক লাগলেও মুখে হাসি ফুটল সাংবাদিকের। যা জেনে এসেছিলেন ঠিক তাই। একবিংশ শতকের ডিজিটাল সভ্যতার জগতে এ এক অন্য ভারত। আধুনিকতার কমতি নেই, আবার ধ্রুপদী ভাষা-সাহিত্যকেও ধারণ করে আছে অলঙ্কারের মতোই। নতুন-পুরনোর মিশেলে নিঃশব্দে বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে কর্নাটকের এই গ্রাম।
বেঙ্গালুরু থেকে যেতে হবে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। শিমোগা জেলায় পাশাপাশি গা ঘেঁষা দু’টি গ্রাম। মাট্টুর ও হোসাহাল্লি। লোকে বলে যমজ গ্রাম। মিলিয়ে ঝুলিয়ে হাজার পাঁচেক মানুষের বাস। প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে যমজ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে তুঙ্গ নদী। তুঙ্গ আর ভদ্রার মিলিত স্রোতই কর্নাটকের তুঙ্গভদ্রা। যা মিশেছে কৃষ্ণা নদীতে। নামে, প্রচারে মাট্টুরই সেরা। তবে বৈচিত্র্যে পিছিয়ে নেই হোসাহাল্লিও। এই বৈচিত্র্যটা কী, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সেটাই।
বৈচিত্র্য ঠিক বলা যায় না কিনা জানা নেই, কারণ নতুনের মোড়কে ঐতিহ্যকে হেলায় না হারিয়ে যখন আদর করে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলা হয়, তখন সেটা আত্মসত্তার মধ্যেই কোথাও মিলেমিশে এক হয়ে যায়। যেমনটা হয়েছে মাট্টুরে, হোসাহাল্লিতে। মানুষজন এখানে সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতে সচ্ছন্দ্য। গ্রামের নিজস্ব ভাষা অবশ্য কন্নড়। তামিল এবং খানিক তেলুগুরও চল রয়েছে। কিন্তু দোকানবাজারে, রাস্তাঘাটে, স্কুল-কলেজে, ঘরের ভিতরে ও বাইরে মাতৃভাষার মতো মুখে লেগে রয়েছে সংস্কৃত।
‘Language Of Gods’ টোলের শিক্ষকরা বলেন দেবভাষা, ছাপোষা মানুষের প্রাণের ভাষা। মুখের বুলিতেই মনের আরাম। কথায় বলে, দশচক্রে ভগবান ভূত হয় আর অব্যবহারে ভাষার ধার কমে। সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে নানা কাজে লাগানোর জন্য নিত্য মুখের ভাষাকে লেখার ভাষাতেও গড়েপিটে নিতে হয়। তবেই ভাষার প্রতি মানুষের আদর-সোহাগ জন্মায়। ঠিক এমনটাই করেছেন মাট্টুরের বাসিন্দারা। মুখের কথায়, হাতে-কলমে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে এমনকি অফিসের কাজকর্মেও সংস্কৃতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তাই সরকারি স্কুলকে গুরুর টোল বা পাঠশালা বলতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই এখানকার পড়ুয়াদের। নদীর ধারটিতে বসে চট বা মাদুর পেতে ঝরঝরে বেদের মন্ত্র আওড়াতে পারে দশ বছরের শিশুও।
গলির মোড়ে চায়ের দোকান সাজিয়ে অতিথিদের সঙ্গে নিত্য সংস্কৃতে বোলচাল চালান আরগুমাম। বলেছেন, ‘‘মারিয়াম্মা মন্দিরে ফি দিন সংস্কৃতের ক্লাস বসে। দোকানের কাজ সেরে আমি সেখানেই পড়াশোনা করতে যাই।’’
ভোরের আলো ফুটতেই কচি কচি কণ্ঠে বেদের মন্ত্রোচ্চারণে মুখরিত হয়ে ওঠে তুঙ্গ নদীর পাড়। সেখানেই জনা কয়েক ছাত্র নিয়ে গায়ত্রী বেদ পাঠাশালা চালান বর্ষীয়াণ গুরুমশাই। বেলা বাড়তে পাঠশালায় ভিড় জমান স্থানীয়রাও। নিত্যদিন গায়ত্রী বেদ পাঠশালায় আনাগোনা রুথুকুমার নায়েকের। সংস্কৃতে এখন বেশ সড়গড় রুথুকুমারের কথায়, ‘‘ভোর সাড়ে ৪টে থেকে পাঠশালা খোলে। চলে ৮টা অবধি। চট, মাদুর নিয়ে আমরা হাজির হয়ে যাই। ঠিক ঘরির কাঁটা মিলিয়ে ক্লাস নেন গুরুমশাই। সবাই এখানে মন দিয়ে ভাষাটা শেখে।’’
ভাষা শেখার জায়গা হরেক। গোটা গ্রামেই ছড়িয়ে। সরকারি স্কুল তো রয়েছেই, পাশাপাশি প্রাইভেট টিউশন করেন অনেকে। নয় নয় করেও ৩০ জন সংস্কৃত ভাষার গবেষক ও অধ্যাপক রয়েছেন। তেমনই একজন সংস্কৃতের অধ্যাপক ভানু প্রকাশ। ভাষার প্রতি গ্রামবাসীদের আগ্রহ বাড়াতে নিজের বাড়ির দরজায় বড় বড় করে লিখে রেখেছেন, ‘‘এই বাড়িতে সকলে মন খুলে সংস্কৃত চর্চা করতে পারেন। কেউ বাধা দেবে না।’’
প্রাইমারি স্কুলের প্রিন্সিপাল লক্ষ্মী দেবী সংস্কৃত ব্যাকরণে পণ্ডিত। সরকারি অনুদানে চলে তাঁর স্কুল। জানিয়েছেন, শিক্ষায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের গোড়া মজবুত করতে সংস্কৃতের বিকল্প নেই। তাঁর কথায়, ‘‘স্কুলে সব বিষয়ই পড়ানো হয়। অন্যান্য ভাষাতেও ক্লাস হয়। তবে সংস্কৃতের চর্চা কিছু বেশি। আমরা শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়ুয়াদের ছোট থেকেই এই ভাষায় স্বাবলম্বী করে তুলি। তাদের ফ্রিতে টিউশনও দেওয়া হয়।’’
মাট্টুর মানেই হল সংস্কৃত ভাষা চর্চার কেন্দ্র, ধ্রুপদী সঙ্গীতের আখড়া, বৈদিক সংস্কৃতের পীঠস্থান। নিজেদের গ্রামকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করেন গ্রামবাসীরা। এবং সরকারও। সালটা ১৯৮৩। সরকারি ভাবে মাট্টুরকে ‘সংস্কৃত গ্রাম’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ভাষার বিপ্লব আনতে যিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁর নাম টিএন গিরিশ। সারদা ভিলসা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রায় ৩৫ বছর ধরে গ্রামের আনাচ কানাচে সংস্কৃতের বীজ বুনেছেন তিনি। যে ভাষা একসময় ছিল নিছক পৌরোহিত্যের ভাষা, উচ্চকোটির ব্রাহ্মণের একচ্ছত্র অধিকারের নিশানি, তাকেই ঘরে ঘরে সাবলীল কথ্য ভাষায় পরিণত করতে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি তাঁকে। ছাতার মতো পাশে পেয়েছিলেন সংস্কৃত ভারতীকে। এই প্রতিষ্ঠান দেশজুড়ে মৃতপ্রায় দেবভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস চালাচ্ছে। সংস্কৃত ভারতীর চেয়ারম্যান চামু কৃষ্ণা শাস্ত্রীর উদ্যোগে মাট্টুরে চালু হয় সংস্কৃত ভাষার ক্লাস।
‘‘শুরুতেই সাফল্য পাইনি। অনেকেই মনে করেন সংস্কৃত ভাষা মৃতপ্রায়। মজার বিষয় হলো ভারতে এখনও সংস্কৃত ভাষাভাষীর সংখ্যা এক লক্ষের কাছাকাছি। বিশ্বব্যাপী প্রচার পাচ্ছে এই ভাষা। আমাদের গ্রামেও ধীরে ধীরে সংস্কৃত ভাষা সোনার খনিতে পরিণত হয়েছে,’’ জানিয়েছেন টিএন গিরিশ। তাঁর মতে, অনেকের কাছেই সংস্কৃত মানে আতঙ্ক। তাঁরা মনে করেন এটা শুধুমাত্রই পুজাপাঠের ভাষা। আড়ে বহরে ভারী, উচ্চারণে কঠিন। তবে মন দিয়ে এর স্বাদ নিতে থাকলে দেখা যাবে এই ভাষা যেমন তার ভাবে সুমধুর, তেমনি গাম্ভীর্যে অনন্য। বেদ, উপনিষদ, প্রাচীন পুঁথিপত্র থেকে মুখের বুলিতে সংস্কৃতকে স্বীকৃতি দিতে সময়টা তাই অনেক বেশিই লেগেছে বলে জানিয়েছেন গিরিশ।
২০১৮ সালের জুলাইতে মাট্টুরে গ্রাম পরিদর্শনে আসেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। এখানকার সংস্কৃত চর্চা দেখে অভিভূত হয়ে তিনি টুইটারে লিখেছিলেন, ‘‘গ্রামের মানুষেরা নির্দ্বিধায় সংস্কৃতে কথা বলেন, জাতপাত, ধর্মের তোয়াক্কা না করেই।’’
মাট্টুরে যেমন কথায় ও লেখনীতে সংস্কৃতের চর্চা হয়, হোসাহাল্লিতে তেমনি হয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের রেওয়াজ। কর্নাটকের প্রাচীন ইতিহাসকে গানের কথায় বিশেষত ধ্রুপদী সঙ্গীতের মোড়কে তুলে ধরার এই প্রথাকে বলে ‘গামাকা।’ এটি হোসাহাল্লির একটি প্রাচীন প্রথা। অনেকে বলেন ‘কাব্য বচন’, গীতিকারকে বলা হয় ‘গামাকি।’ গানের সুরে রাগের প্রাচুর্য। ‘গামাকি’ কিছুটা করে গানের সুর তোলেন, পাশে বসেই সেই কথাকে সরলভাবে বুঝিয়ে (‘ব্যাখ্যানা’) দেন অন্য একজন। সাধারণত ‘হরিশচন্দ্র কাব্য,’ ‘দেবী ভাগবত’-র মতো প্রাচীন কাব্য জায়গা করে নিয়েছে সঙ্গীতের এই ঘরানায়।
সংস্কৃত ভারতীর এক অধ্যাপকের কথায়, শুধু প্রাচীনত্বের জন্য নয়, জনপ্রিয়তার নিরিখেও সংস্কৃত ভাষা এখন আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশেষ করে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর কয়েক লক্ষ শব্দের ভাণ্ডার এসেছে এই প্রাচীন সংস্কৃত ভাষা থেকে। এর শিকড়ের সন্ধানে গবেষণা চলছে দেশে-বিদেশে। দৃষ্টান্তস্বরূপ জার্মানি। বর্তমানে জার্মানির ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রায় ১২০০টি স্কুলে সংস্কৃত পড়ানো হয়। আর সেটা পড়ানো হয় ঠিক বৈদিক যুগের একটা আবহে।
ভারতেও মোট ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে সংস্কৃত চর্চা করা হয়। যার মধ্যে—
১) রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত বিদ্যাপীঠ, তিরুপতি (অন্ধ্রপ্রদেশ), ২) রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত সংস্থান (প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়), নয়াদিল্লি, ৩) শ্রীভেঙ্কটেশ্বর বৈদিক ইউনিভার্সিটি, তিরুমালা, তিরুপতি (অন্ধ্রপ্রদেশ) ৪) কামেশ্বর সিং দারভাঙা সংস্কৃত ইউনিভার্সিটি, কামেশ্বর নগর, দারভাঙা (বিহার)৫) শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত বিদ্যাপীঠ, নয়াদিল্লি ৬) শ্রী শংকরাচার্য ইউনিভার্সিটি অব সংস্কৃত, কালাডি, এরনাকুলম ৭) শ্রী জগন্নাথ সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়, শ্রীবিহার, পুরী ৮) জগদগুরু রামানন্দাচার্য রাজস্থান সংস্কৃত ইউনিভার্সিটি ৯) সম্পূর্ণানন্দ সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়, বারাণসী ১০) সোমনাথ সংস্কৃত ইউনিভার্সিটি, সোমনাথ, জুনাগড় (গুজরাট) ১১) উত্তরাখণ্ড সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়, হরিদ্বার ১২) কবিকুলগুরু কালীদাস সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়, রামটেক, নাগপুর ১৩) মহর্ষি পাণিনি সংস্কৃত ইবম বেদিক ইউনিভার্সিটি, উজ্জয়িনী (মধ্যপ্রদেশ, ১৪) কর্নাটক সংস্কৃত ইউনিভার্সিটি, চমরেন্দ্র সংস্কৃত মহাপাঠশালা, বেঙ্গালুরু ১৫) কুমার ভাস্কর বর্মা সংস্কৃত অ্যান্ড অ্যান্সিয়েন্ট স্টাডিজ ইউনিভার্সিটি, নলবাড়ি (অসম)।
সংস্কৃতের মতো সুপ্রাচীন ভাষাকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে নরেন্দ্র মোদী সরকারও। সিবিএসই পাঠ্যক্রমে জার্মানের পাশাপাশি তৃতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সংস্কৃতকেও।
সংস্কৃত গ্রাম হিসেবে মাট্টুর সরকারি শিলমোহর পেলেও, ভারতে আরও কয়েকটি গ্রাম রয়েছে যেখানে রীতিমতো সংস্কৃত চর্চা হয়।
দেখে নেওয়া যাক কী কী সেই গ্রাম—
প্রথমেই বলা যায় মধ্যপ্রদেশের ঝিরি গ্রাম। রাজগড় জেলার সারাঙ্গপুর তেহসিলের এই গ্রামের একটা বড় অংশ সংস্কৃতে কথা বলে। ১৬ বছর ধরে ঝিরিতে স্থানীয় ভাষার জায়গা দখল করেছে সংস্কৃত। ২০০২ সালে সংস্কার ভারতী এখানে ক্যাম্প, ওয়ার্কশপ করে।
ওড়িশার উপকূলবর্তী গজপতি জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম সাসানা। গ্রামের অধিকাংশই ব্রাহ্মণ। ৫০টি পরিবারের প্রায় ৩০০ জন সদস্য নিয়মিত সংস্কৃতে কথাবার্তা চালান। সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার জন্য সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলও রয়েছে গ্রামে।
মধ্যপ্রদেশের কারেলি তেহসিলের বাঘুয়ার গ্রাম। সংস্কৃত এখানকার প্রথম ও প্রধান কথ্য ভাষা।
রাজস্থানের গানোরা গ্রাম। বাঁশওয়ারা জেলার ঘাটোল তেহসিলের এই গ্রামে এক সময় কথ্য ভাষা ছিল ওয়াগাড়ি। গ্রামে সংস্কৃত স্কুল তৈরির পর থেকে এখন আট থেকে আশির দেবভাষায় কথা বলতেই বেশি ভালোবাসেন।
মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুর জেলার মোহাড় গ্রাম। প্রত্যন্ত এই গ্রামেও সংস্কৃত ভাষার চল রয়েছে। অধিকাংশ গ্রামবাসী তাঁদের কথ্য ভাষা ছাড়াও সংস্কৃতে পারদর্শী।
আসলে ভাষা বাঁচে ব্যবহারে। ভাষা তো বাহারি ঠুনকো গয়না নয় যে তাকে আতু-পুতু করে তুলোর আরামে বন্দি করে রাখতে হবে! ভাষা হচ্ছে শ্রমিক মানুষের মতো। তার পায়ে লাগবে ধুলো, তার গায়ে বইবে ঘাম, সে ইচ্ছে হলে একলহমায় ভারা বেয়ে উঠবে সাতমহলায়, আবার নামবে টালির ঘরে। যেখানে খুশি যেতে পারে যে-ভাষা, যেখানে খুশি কাজে লাগতে পারে যে-ভাষা সেই ভাষাই সজীব, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা। আদি ভাষা সংস্কৃতকে তাই সিন্দুকে বন্দি করে রাখা নয়, বরং মুখের ভাষাতেই বন্দি করে রেখেছে মাট্টুর-সহ দেশের এই প্রত্যন্ত কিছু গ্রাম। বোঝাতে চেয়েছে, প্রগতির সঙ্গে ধ্রুপদীয়ানার কোনও বিরোধ নেই, বরং ধ্রুপদী জ্ঞান আসলে প্রগতিরই অনুঘটক। আর সেখানেই তাদের মুন্সিয়ানা।
তথ্যসুত্রঃ চৈতালী চক্রবর্তী, দ্য ওয়াল
গলির মোড়ে চায়ের দোকান সাজিয়ে অতিথিদের সঙ্গে নিত্য সংস্কৃতে বোলচাল চালান আরগুমাম। বলেছেন, ‘‘মারিয়াম্মা মন্দিরে ফি দিন সংস্কৃতের ক্লাস বসে। দোকানের কাজ সেরে আমি সেখানেই পড়াশোনা করতে যাই।’’
ভোরের আলো ফুটতেই কচি কচি কণ্ঠে বেদের মন্ত্রোচ্চারণে মুখরিত হয়ে ওঠে তুঙ্গ নদীর পাড়। সেখানেই জনা কয়েক ছাত্র নিয়ে গায়ত্রী বেদ পাঠাশালা চালান বর্ষীয়াণ গুরুমশাই। বেলা বাড়তে পাঠশালায় ভিড় জমান স্থানীয়রাও। নিত্যদিন গায়ত্রী বেদ পাঠশালায় আনাগোনা রুথুকুমার নায়েকের। সংস্কৃতে এখন বেশ সড়গড় রুথুকুমারের কথায়, ‘‘ভোর সাড়ে ৪টে থেকে পাঠশালা খোলে। চলে ৮টা অবধি। চট, মাদুর নিয়ে আমরা হাজির হয়ে যাই। ঠিক ঘরির কাঁটা মিলিয়ে ক্লাস নেন গুরুমশাই। সবাই এখানে মন দিয়ে ভাষাটা শেখে।’’
ভাষা শেখার জায়গা হরেক। গোটা গ্রামেই ছড়িয়ে। সরকারি স্কুল তো রয়েছেই, পাশাপাশি প্রাইভেট টিউশন করেন অনেকে। নয় নয় করেও ৩০ জন সংস্কৃত ভাষার গবেষক ও অধ্যাপক রয়েছেন। তেমনই একজন সংস্কৃতের অধ্যাপক ভানু প্রকাশ। ভাষার প্রতি গ্রামবাসীদের আগ্রহ বাড়াতে নিজের বাড়ির দরজায় বড় বড় করে লিখে রেখেছেন, ‘‘এই বাড়িতে সকলে মন খুলে সংস্কৃত চর্চা করতে পারেন। কেউ বাধা দেবে না।’’
প্রাইমারি স্কুলের প্রিন্সিপাল লক্ষ্মী দেবী সংস্কৃত ব্যাকরণে পণ্ডিত। সরকারি অনুদানে চলে তাঁর স্কুল। জানিয়েছেন, শিক্ষায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের গোড়া মজবুত করতে সংস্কৃতের বিকল্প নেই। তাঁর কথায়, ‘‘স্কুলে সব বিষয়ই পড়ানো হয়। অন্যান্য ভাষাতেও ক্লাস হয়। তবে সংস্কৃতের চর্চা কিছু বেশি। আমরা শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়ুয়াদের ছোট থেকেই এই ভাষায় স্বাবলম্বী করে তুলি। তাদের ফ্রিতে টিউশনও দেওয়া হয়।’’
মাট্টুর মানেই হল সংস্কৃত ভাষা চর্চার কেন্দ্র, ধ্রুপদী সঙ্গীতের আখড়া, বৈদিক সংস্কৃতের পীঠস্থান। নিজেদের গ্রামকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করেন গ্রামবাসীরা। এবং সরকারও। সালটা ১৯৮৩। সরকারি ভাবে মাট্টুরকে ‘সংস্কৃত গ্রাম’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ভাষার বিপ্লব আনতে যিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁর নাম টিএন গিরিশ। সারদা ভিলসা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রায় ৩৫ বছর ধরে গ্রামের আনাচ কানাচে সংস্কৃতের বীজ বুনেছেন তিনি। যে ভাষা একসময় ছিল নিছক পৌরোহিত্যের ভাষা, উচ্চকোটির ব্রাহ্মণের একচ্ছত্র অধিকারের নিশানি, তাকেই ঘরে ঘরে সাবলীল কথ্য ভাষায় পরিণত করতে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি তাঁকে। ছাতার মতো পাশে পেয়েছিলেন সংস্কৃত ভারতীকে। এই প্রতিষ্ঠান দেশজুড়ে মৃতপ্রায় দেবভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস চালাচ্ছে। সংস্কৃত ভারতীর চেয়ারম্যান চামু কৃষ্ণা শাস্ত্রীর উদ্যোগে মাট্টুরে চালু হয় সংস্কৃত ভাষার ক্লাস।
‘‘শুরুতেই সাফল্য পাইনি। অনেকেই মনে করেন সংস্কৃত ভাষা মৃতপ্রায়। মজার বিষয় হলো ভারতে এখনও সংস্কৃত ভাষাভাষীর সংখ্যা এক লক্ষের কাছাকাছি। বিশ্বব্যাপী প্রচার পাচ্ছে এই ভাষা। আমাদের গ্রামেও ধীরে ধীরে সংস্কৃত ভাষা সোনার খনিতে পরিণত হয়েছে,’’ জানিয়েছেন টিএন গিরিশ। তাঁর মতে, অনেকের কাছেই সংস্কৃত মানে আতঙ্ক। তাঁরা মনে করেন এটা শুধুমাত্রই পুজাপাঠের ভাষা। আড়ে বহরে ভারী, উচ্চারণে কঠিন। তবে মন দিয়ে এর স্বাদ নিতে থাকলে দেখা যাবে এই ভাষা যেমন তার ভাবে সুমধুর, তেমনি গাম্ভীর্যে অনন্য। বেদ, উপনিষদ, প্রাচীন পুঁথিপত্র থেকে মুখের বুলিতে সংস্কৃতকে স্বীকৃতি দিতে সময়টা তাই অনেক বেশিই লেগেছে বলে জানিয়েছেন গিরিশ।
২০১৮ সালের জুলাইতে মাট্টুরে গ্রাম পরিদর্শনে আসেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। এখানকার সংস্কৃত চর্চা দেখে অভিভূত হয়ে তিনি টুইটারে লিখেছিলেন, ‘‘গ্রামের মানুষেরা নির্দ্বিধায় সংস্কৃতে কথা বলেন, জাতপাত, ধর্মের তোয়াক্কা না করেই।’’
মাট্টুরে যেমন কথায় ও লেখনীতে সংস্কৃতের চর্চা হয়, হোসাহাল্লিতে তেমনি হয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের রেওয়াজ। কর্নাটকের প্রাচীন ইতিহাসকে গানের কথায় বিশেষত ধ্রুপদী সঙ্গীতের মোড়কে তুলে ধরার এই প্রথাকে বলে ‘গামাকা।’ এটি হোসাহাল্লির একটি প্রাচীন প্রথা। অনেকে বলেন ‘কাব্য বচন’, গীতিকারকে বলা হয় ‘গামাকি।’ গানের সুরে রাগের প্রাচুর্য। ‘গামাকি’ কিছুটা করে গানের সুর তোলেন, পাশে বসেই সেই কথাকে সরলভাবে বুঝিয়ে (‘ব্যাখ্যানা’) দেন অন্য একজন। সাধারণত ‘হরিশচন্দ্র কাব্য,’ ‘দেবী ভাগবত’-র মতো প্রাচীন কাব্য জায়গা করে নিয়েছে সঙ্গীতের এই ঘরানায়।
সংস্কৃত ভারতীর এক অধ্যাপকের কথায়, শুধু প্রাচীনত্বের জন্য নয়, জনপ্রিয়তার নিরিখেও সংস্কৃত ভাষা এখন আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশেষ করে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর কয়েক লক্ষ শব্দের ভাণ্ডার এসেছে এই প্রাচীন সংস্কৃত ভাষা থেকে। এর শিকড়ের সন্ধানে গবেষণা চলছে দেশে-বিদেশে। দৃষ্টান্তস্বরূপ জার্মানি। বর্তমানে জার্মানির ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রায় ১২০০টি স্কুলে সংস্কৃত পড়ানো হয়। আর সেটা পড়ানো হয় ঠিক বৈদিক যুগের একটা আবহে।
ভারতেও মোট ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে সংস্কৃত চর্চা করা হয়। যার মধ্যে—
১) রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত বিদ্যাপীঠ, তিরুপতি (অন্ধ্রপ্রদেশ), ২) রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত সংস্থান (প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়), নয়াদিল্লি, ৩) শ্রীভেঙ্কটেশ্বর বৈদিক ইউনিভার্সিটি, তিরুমালা, তিরুপতি (অন্ধ্রপ্রদেশ) ৪) কামেশ্বর সিং দারভাঙা সংস্কৃত ইউনিভার্সিটি, কামেশ্বর নগর, দারভাঙা (বিহার)৫) শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত বিদ্যাপীঠ, নয়াদিল্লি ৬) শ্রী শংকরাচার্য ইউনিভার্সিটি অব সংস্কৃত, কালাডি, এরনাকুলম ৭) শ্রী জগন্নাথ সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়, শ্রীবিহার, পুরী ৮) জগদগুরু রামানন্দাচার্য রাজস্থান সংস্কৃত ইউনিভার্সিটি ৯) সম্পূর্ণানন্দ সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়, বারাণসী ১০) সোমনাথ সংস্কৃত ইউনিভার্সিটি, সোমনাথ, জুনাগড় (গুজরাট) ১১) উত্তরাখণ্ড সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়, হরিদ্বার ১২) কবিকুলগুরু কালীদাস সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়, রামটেক, নাগপুর ১৩) মহর্ষি পাণিনি সংস্কৃত ইবম বেদিক ইউনিভার্সিটি, উজ্জয়িনী (মধ্যপ্রদেশ, ১৪) কর্নাটক সংস্কৃত ইউনিভার্সিটি, চমরেন্দ্র সংস্কৃত মহাপাঠশালা, বেঙ্গালুরু ১৫) কুমার ভাস্কর বর্মা সংস্কৃত অ্যান্ড অ্যান্সিয়েন্ট স্টাডিজ ইউনিভার্সিটি, নলবাড়ি (অসম)।
সংস্কৃতের মতো সুপ্রাচীন ভাষাকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে নরেন্দ্র মোদী সরকারও। সিবিএসই পাঠ্যক্রমে জার্মানের পাশাপাশি তৃতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সংস্কৃতকেও।
সংস্কৃত গ্রাম হিসেবে মাট্টুর সরকারি শিলমোহর পেলেও, ভারতে আরও কয়েকটি গ্রাম রয়েছে যেখানে রীতিমতো সংস্কৃত চর্চা হয়।
দেখে নেওয়া যাক কী কী সেই গ্রাম—
প্রথমেই বলা যায় মধ্যপ্রদেশের ঝিরি গ্রাম। রাজগড় জেলার সারাঙ্গপুর তেহসিলের এই গ্রামের একটা বড় অংশ সংস্কৃতে কথা বলে। ১৬ বছর ধরে ঝিরিতে স্থানীয় ভাষার জায়গা দখল করেছে সংস্কৃত। ২০০২ সালে সংস্কার ভারতী এখানে ক্যাম্প, ওয়ার্কশপ করে।
ওড়িশার উপকূলবর্তী গজপতি জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম সাসানা। গ্রামের অধিকাংশই ব্রাহ্মণ। ৫০টি পরিবারের প্রায় ৩০০ জন সদস্য নিয়মিত সংস্কৃতে কথাবার্তা চালান। সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার জন্য সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলও রয়েছে গ্রামে।
মধ্যপ্রদেশের কারেলি তেহসিলের বাঘুয়ার গ্রাম। সংস্কৃত এখানকার প্রথম ও প্রধান কথ্য ভাষা।
রাজস্থানের গানোরা গ্রাম। বাঁশওয়ারা জেলার ঘাটোল তেহসিলের এই গ্রামে এক সময় কথ্য ভাষা ছিল ওয়াগাড়ি। গ্রামে সংস্কৃত স্কুল তৈরির পর থেকে এখন আট থেকে আশির দেবভাষায় কথা বলতেই বেশি ভালোবাসেন।
মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুর জেলার মোহাড় গ্রাম। প্রত্যন্ত এই গ্রামেও সংস্কৃত ভাষার চল রয়েছে। অধিকাংশ গ্রামবাসী তাঁদের কথ্য ভাষা ছাড়াও সংস্কৃতে পারদর্শী।
আসলে ভাষা বাঁচে ব্যবহারে। ভাষা তো বাহারি ঠুনকো গয়না নয় যে তাকে আতু-পুতু করে তুলোর আরামে বন্দি করে রাখতে হবে! ভাষা হচ্ছে শ্রমিক মানুষের মতো। তার পায়ে লাগবে ধুলো, তার গায়ে বইবে ঘাম, সে ইচ্ছে হলে একলহমায় ভারা বেয়ে উঠবে সাতমহলায়, আবার নামবে টালির ঘরে। যেখানে খুশি যেতে পারে যে-ভাষা, যেখানে খুশি কাজে লাগতে পারে যে-ভাষা সেই ভাষাই সজীব, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা। আদি ভাষা সংস্কৃতকে তাই সিন্দুকে বন্দি করে রাখা নয়, বরং মুখের ভাষাতেই বন্দি করে রেখেছে মাট্টুর-সহ দেশের এই প্রত্যন্ত কিছু গ্রাম। বোঝাতে চেয়েছে, প্রগতির সঙ্গে ধ্রুপদীয়ানার কোনও বিরোধ নেই, বরং ধ্রুপদী জ্ঞান আসলে প্রগতিরই অনুঘটক। আর সেখানেই তাদের মুন্সিয়ানা।
তথ্যসুত্রঃ চৈতালী চক্রবর্তী, দ্য ওয়াল
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন