রুদ্রাক্ষ
=====
শিবপুরাণ হতে রুদ্রাক্ষের উৎপত্তি সন্মন্ধে যা জানা যায় ---
নারদ উবাচ-
" এবং ভূতানুভাবোঽয়ং রুদ্রাক্ষ ভবতাঽনঘ ।
বর্ণিতো মহতাং পূজ্যঃ কারণং তত্র কিং বদ্ ।। "
অর্থাৎ, নারদ নারায়ণকে প্রশ্ন করলেন - হে ভগবন্ অনঘ ! রুদ্রাক্ষের এই প্রকার প্রভাব এবং মহাপুরুষদের দ্বারা এই রুদ্রাক্ষ পূজিত হওয়ার কারন কি?
নারায়ণ উবাচ-
" এবমেব পুরা পৃষ্টো ভগবান গিরীশঃ প্রভুঃ ।
ষন্মুখেন চ রুদ্রস্তং যদুবাচ শৃণুস্ব তৎ ।। "
অর্থাৎ, নারায়ণ বললেন- হে নারদ ! এই কথা পূর্বে ভগবান গিরীশ শঙ্কর -কে তার পুত্র ষণ্মুখ অর্থাৎ কার্তিকেয় জিজ্ঞাসা করেছিলেন ।
শ্রী ঈশ্বর উবাচ-
"শৃণু ষ্ণমুখ তত্ত্বেন কথয়ামি সমাসতঃ ।
ত্রিপুরো নাম দৈত্ত্যস্তু পুরাঽসীৎ সর্বদূর্জয়ঃ ।।
হতাস্তেন সুরাঃ সর্বে ব্রহ্মাবিষ্ণাদি দেবতাঃ ।
সর্বৈস্তু কথিতে তস্মিংস্তদাহং ত্রিপুরং প্রতি ।
অচিন্ত্যং মহাশস্ত্রমঘোরাখ্যাং মনোহরম্ ।।
সর্বদেবময়ং দিব্যং জ্বলন্তং ঘোররূপী যৎ ।
ত্রিপুরস্য বধার্থায় দেবানাং তারণায় চ,
সর্ববিঘ্নপশমন মঘোরাস্ত্র মচিন্তয়ম্ ।।
দিব্যবর্ষ সহস্রং তু চক্ষুরুন্মীলিতং ময়া ।
পশ্চান্মাকুলাক্ষিভ্যঃ পতিতা জলবিন্দবঃ ।।
তত্রাশ্রুবিন্দুতো জাতা মহারুদ্রাক্ষ বৃক্ষকঃ ।
মমাজ্ঞয়া মহাসেন সর্বেষাং হিতকাম্যয়া ।।
--------- অর্থাৎ, ভগবান শঙ্কর বললেন- হে ষন্মুখ বা কার্ত্তিক ! মনোযোগ সহকারে এই তত্ত্ব শ্রবণ কর, আমি সংক্ষেপে তোমাকে বলছি । ত্রিপুর নামক দৈত্য অতীব দূর্জয় হয়ে উঠেছিল ।সেই অসুর ব্রহ্মা বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতাকে পর্যন্ত স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেছিল। দেবতাগন স্বর্গ বিচ্যুত হয়ে তাদের দুঃখের কাহীনি আমার কাছে এসে সবিস্তারে বলে। এই কথা শ্রবণ করে আমি ঐ অসুর কে বধ করার উদ্দেশ্যে ও দেবতাগনের রক্ষার্থে সর্বপ্রকার বিঘ্ন নাশ কারী এক সর্বদেবময় দিব্য মহাঅঘোরাস্ত্রের চিন্তা করেছিলাম । এক দিব্য সহস্র বৎসর চিন্তা করার পর আমি যখন আমার চোখ উন্মীলিত করি তখন আমার চোখ থেকে জলবিন্দু ভূমিতে পতিত হয়। সেই তৃ্তীয় নেত্র হতে পরা অশ্রুবিন্দু থেকে এক দিব্য বৃক্ষের উৎপত্তি হয়। হে মহাসেন ( কার্তিকের অপর নাম) আমার আদেশেই ঐ বৃক্ষ জগতের হিতার্থে উৎপন্ন হয়েছিল।"
সাধারণত কার্তিক মাসের শেষে বা অগ্রহায়ণ (বর্তমান বাংলা মাস) মাসের শুরুতে গাছটিতে ফল ধরা শুরু হয় । ফল এর উপরে গাঢ় নীল রঙের আবরণ থাকে যা ছিললে ঐ রুদ্রাক্ষ দেখা যায় । এর মধ্যে কিছু দাগ এর মত দেখা যায় যাকে আধ্যাত্মিক ভাষায় মুখ বলা হয়।
প্রাপ্তি স্থানঃ ভারতের উত্তর প্রদেশ, উত্তর কাশীর গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। তিব্বতেও এটি পাওয়া যায়। ইন্দোনেশিয়া, জাভা, সুমাত্রা ও চীন দেশের কিছু অংশে রুদ্রাক্ষ উৎপন্ন হয়ে থাকে। এর মধ্যে নেপালের ভোজপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি রুদ্রাক্ষ উৎপন্ন হয়। মূলত ২১ রকমের রুদ্রাক্ষ দেখা যায় এখন। তবে ১৪ থেকে ২১ মুখী রুদ্রাক্ষ দুষ্প্রাপ্য। বাজারে ১ থেকে ১৪ মুখী অবধি রুদ্রাক্ষ পাওয়া যায়। এর মধ্যে তিন, চার, পাঁচ ও ছয়মুখি রুদ্রাক্ষ বেশি পাওয়া যায়। একই সঙ্গে দুর্লভও বটে। এর বাইরে ত্রিজুতি, গৌরী শঙ্কর ও গণেশ নামেও রুদ্রাক্ষ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে কিংবা বাজারের হিসাবে, একমুখী গোলাকার রুদ্রাক্ষ সর্বোত্কৃষ্ট। প্রতিটি রুদ্রাক্ষের আলাদা ফল। নিজের দেহতত্বের সাথে মিলিয়ে যথার্থ রুদ্রাক্ষ পড়তে পারলে নবগ্রহ মানুষকে কৃপা করে। আসলে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছে রুদ্রাক্ষ একটি পবিত্র ফল। মানসিক শান্তি ও পবিত্রতা এবং ধ্যানে এটি শতকের পর শতক ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে।
আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রমতে, এটি সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি শুষে নেয়। ফলে মস্তিষ্ক, হূদযন্ত্রসহ শরীর সুস্থ ও সবল থাকে। এটি রক্তের স্বাভাবিক গতি সচল রাখে। উচ্চ রক্তচাপ, হিস্টিরিয়া, ক্ষয়রোধ, স্মৃতিশক্তিহীনতা, বদহজম প্রভৃতি রোগে উপশম এনে দেয়। স্নায়ুর ওপর থেকে চাপ কমিয়ে মানসিক শান্তি আনে রুদ্রাক্ষ। জ্যোতিষ শাস্ত্রে একে বাত, কৃমি, অশুভ গ্রহ প্রভাবের বিনাশক হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।
রুদ্রাক্ষের ব্যবহার কখনই শুধু সাধুসন্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সেই প্রাচীনকাল থেকেই গোটাবিশ্বে এর প্রতি কৌতূহল রয়েছে। বিভিন্ন দেশের নামিদামি মানুষ শুভকামনা, সুস্বাস্থ্য, সফলতা, আর্থিক উন্নতি এবং অশুভ শক্তি দূরে রাখতে রুদ্রাক্ষ দিয়ে তৈরি পণ্য শরীরে ধারণ করে আসছেন। আমজনতাও পিছিয়ে নেই, তারাও চেষ্টা করেন এর সুফল ভোগ করতে।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
রুদ্রাক্ষের গুণাগুণ
=============
বিভিন্ন শাস্ত্রে এক থেকে চৌদ্দমুখী পর্যন্ত রুদ্রাক্ষ ব্যবহারের যে নিয়ম, আচার ও অনুষ্ঠানের উল্লেখ আছে তা এখানে বলা হচ্ছে -----
একমুখী রুদ্রাক্ষ --- রুদ্রাক্ষের মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই শ্রেণীকে ‘শিব’ নামে অভিহিত করা হয়। রুদ্রাক্ষের সব গুণাগুণ সমস্তই এ শ্রেণির রুদ্রাক্ষের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। খুবই দুর্লভ শ্রেণির রুদ্রাক্ষ এবং অত্যন্ত মূল্যবানও বটে। বলা হয়, এই রুদ্রাক্ষ ধারণে মানুষ অপরাজেয় হয়। বিশেষ আধ্যাত্মিক উন্নতিও ঘটে। রুদ্রাক্ষের উজ্জীবন করতে হয়, মন্ত্র উচ্চারণ করে ডান বাহুতে বা কণ্ঠে এ রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে লোকপ্রভাবিনী শক্তির স্ফুরণ ঘটে। রাশিচক্রে রবিগ্রহ, পাপপীড়িত,পাপগ্রহদৃষ্ট, নীচস্থ পাপযুক্ত বা যে কোনোভাবে পীড়িত হলে এ গ্রহের শান্তির জন্য উপরোক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধ সংস্কারপূর্বক জপ করে ধারণ করলে রবিগ্রহের সমস্ত কুফল নষ্ট হয়।
-
দ্বিমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এ জাতীয় রুদ্রাক্ষকে ‘হরগৌরী’ নামে অভিহিত করা হয়। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে মনের একাগ্রতা জীবনে শান্তি এনে দেয়। অজ্ঞাতসারে গোহত্যাজনিত পাপের স্খলন হয়। কুলকুলিনী শক্তি সম্পর্কে চেতনার সঞ্চার করে। মন্ত্র উচ্চারণসহযোগে এই রুদ্রাক্ষের উজ্জীবন হয়। মন্ত্র পাঠ করে ডান হাতে বা কণ্ঠে এ রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে ত্রিজন্ম সঞ্চিত পাপরাশি দূরীভূত হয়।
রাশিচক্রে কেতুগ্রহ নীচস্থ, পাপপীড়িত বা যে কোনোভাবে অশুভ হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি সংস্কারপূর্বক ১০৮ বার জপ করে ধারণ করলে কেতুগ্রহের সমস্ত কুফল নষ্ট হয়।
-
ত্রিমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এ জাতীয় রুদ্রাক্ষের নাম ‘অগ্নি’। অতীত পাপ বিনষ্ট করে, মানুষের সৃজনীশক্তির বিকাশ সাধন করে, চিরকর্মচঞ্চল জীবনীশক্তিকে উন্নীত করে, ম্যালেরিয়া রোগ নিবারণ করে। মন্ত্র পাঠ করে দু’বাহুতে ধারণ করলে অসাধারণ শক্তির সঞ্চার হয়। রাশিচক্রে মঙ্গল বা যে কোনোভাবে পীড়িত হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধ সংস্কারপূর্বক জপ করে ধারণ করলে মঙ্গল গ্রহের সমস্ত কুফল নষ্ট হয়।
-
চতুর্মুখী রুদ্রাক্ষ --- জ্যোতিষী নাম ‘ব্রহ্মা’। মনের ক্রিয়াকলাপের উপরে এ শ্রেণির রুদ্রাক্ষের প্রভাব চমত্কার। সে কারণে উন্মত্ততা, অনিদ্রা, বিষাদময়তা ইত্যাদি মানসিক রোগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করা হয়। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি হয়। তুচ্ছ বিষয়ে মানসিক অস্থিরতার উপশম হয়, মানসিক অবসাদ দূর হয়, উদ্বেগ, ভয়, খিটখিটে স্বভাব ও আত্মহনন-চিন্তা ইত্যাদির প্রকোপ হ্রাস করে। বক্তৃতা-ক্ষমতা, কর্মতত্পরতা ও বুদ্ধি বৃদ্ধির উন্মেষকারক এ রুদ্রাক্ষ। মন্ত্র পাঠ করে কণ্ঠে ধারণ করতে হয়। রাশিচক্রে চন্দ্রগ্রহ নীচস্থ, পাপযুক্ত ও পাপপীড়িত হয়ে দ্বিতীয়ে, ষষ্ঠে, অষ্টমে দ্বাদশে অবস্থান করলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধ সংস্কার করে ১০৮ বার জপের পর ডান হাতে ধারণ করলে চন্দ্রগ্রহের সমস্ত কুফল নষ্ট করে বিভিন্ন শান্তি ও সুখ বহন করে।
-
পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ -- সর্বাধিক পরিচিত এবং সর্বত্রই এ রুদ্রাক্ষ পাওয়া যায়। এ রুদ্রাক্ষ দুই শ্রেণীর হয়ে থাকে। এর নাম ‘কালাগি রুদ্র’। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে নিষিদ্ধ খাদ্যগ্রহণ ও নিষিদ্ধ কর্ম সম্পাদনের পাপ অপনোদন হয়, মানসিক প্রশান্তি আসে। সন্ধ্যাকালে দেহের যে কোনো অংশে ধারণ করলে অখাদ্য ভোজনজনিত পাপ নষ্ট হয়। রাশিচক্রে শনিগ্রহ, রবিযুক্ত হলে লগ্নে, দ্বিতীয়ে, ষষ্ঠে, সপ্তমে, অষ্টমে, দ্বাদশে অবস্থান করলে বা যে কোনোভাবে শনিগ্রহ পাপপীড়িত, নীচস্থ ও অশুভ গ্রহযুক্ত হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি সংস্কারপূর্বক মন্ত্র জপ করলে ও পরে বীজমন্ত্র জপ করে ধারণ করলে শনিগ্রহের সমস্ত অশুভ ফল নষ্ট হয়।
-
ষড়মুখী রুদ্রাক্ষ ---- এ জাতীয় রুদ্রাক্ষের নাম ‘কার্তিকেয়’। ছাত্রদের পক্ষে ও যারা দুরারোগ্য রোগে ভুগছেন তাদের পক্ষে এ রুদ্রাক্ষ বিশেষ উপকারী। জ্ঞানবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ রুদ্রাক্ষর চমত্কার কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায়। মন্ত্রযোগে রুদ্রাক্ষ উজ্জীবন করা হয়। ভূত-প্রেতাদি দ্বারা অনিষ্ট সাধনের ক্ষেত্রে প্রতিকাররূপে ধারণীয়। মানসিক অবসাদ, স্বভাবের উগ্রতা ও নানা রোগের উপকারকারী এ রুদ্রাক্ষ। রাশিচক্রে শুক্র কন্যায় নীচস্থ, অশুভ গ্রহযুক্ত দ্বিতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ, অষ্টম, দ্বাদশে অবস্থান করলে বা অশুভ হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি সংস্কারপূর্বক মন্ত্র জপের পর ধারণ করলে শুক্রগ্রহের সমস্ত অশুভ ভাব নষ্ট হয়।
-
সপ্তমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এ শ্রেণির রুদ্রাক্ষের নাম অনন্ত মাতৃকা। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে সামাজিক প্রতিষ্ঠা, অর্থ মান, যশ ও প্রতিপত্তিলাভের পথ সুগম হয়ে থাকে। রাশিচক্রে রাহুগ্রহ রবি ও চন্দ্র যুক্ত হয়ে লগ্নে দ্বিতীয়ে, চতুর্থে, পঞ্চমে, ষষ্ঠে, সপ্তমে, অষ্টমে, নবমে, দশমে এবং দ্বাদশে অবস্থান করলে বা কোনোভাবে অশুভ হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ উজ্জীবন করতে হয়। ১০৮ বার মন্ত্র জপ করে উক্ত রুদ্রাক্ষ কণ্ঠে ধারণ করলে রাহু গ্রহের সমস্ত কুফল বিনষ্ট হয়।
-
অষ্টমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এই রুদ্রাক্ষের দুটি নাম বিনায়ক ও বটুকভৈরব। শনিগ্রহ ও রাহুর অশুভ প্রভাব খর্ব করে। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে হঠাত্ আঘাত পাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। দুষ্কৃতকারীদের হাতে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
রাশিচক্রে শনি ও রাহু অশুভ থাকলে উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি সংস্কারপূর্বক পুরুষের ডান বাহুতে এবং স্ত্রীলোকের বাম বাহুতে ধারণীয়। নির্দিষ্ট মন্ত্রে পূজা করে এবং পরে জপ করে, বীজমন্ত্র জপ করে উক্ত রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে সমস্ত অশুভ প্রভাব দূরীভূত হয়।
-
নবমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এ রুদ্রাক্ষের নাম মহাকাল ভৈরব। ধারণে জীবনে উন্নতির সূচনা যায়, সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জয়লাভ করা হয়। দুর্ঘটনা ও হঠাত্ মৃত্যুর হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। ধারণের পূর্বে মন্ত্র উচ্চারণ করে এ রুদ্রাক্ষের উজ্জীবন বা প্রাণসঞ্চার করে নিতে হয়। মন্ত্র পাঠের পর উচ্চারণ করতে হয়। বুদ্ধিবৃত্তিজনিত কাজকর্মের ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রচুর সুফল দান করে এ রুদ্রাক্ষ। রাশিচক্রে বৃহস্পতি গ্রহ মকরে নীচস্থ, মকরস্থানে অবস্থান করলে, বা মারকস্থ হলে এবং ষষ্ঠ, অষ্টম, দ্বাদশ স্থানে অবস্থান করলে কিংবা কোনোভাবে অশুভ হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উপরোক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধ সংস্কার পূর্বক ধারণের পর মন্ত্র জপ করে বৃহস্পতয়ে’ এ বীজমন্ত্র জপের পর পুরুষের দক্ষিণ বাহুতে এবং স্ত্রীলোকের বামবাহুতে ধারণ করলে সকল অশুভ বিনাশ হয়।
-
দশমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এ শ্রেণির রুদ্রাক্ষ দুর্লভ। এর নাম মহাবিষ্ণু। মর্যাদা, প্রতিষ্ঠা, সুনাম, খ্যাতি, সন্মান, পার্থিব সমৃদ্ধি, কর্মদক্ষতা এবং ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জনে সহায়ক এ রুদ্রাক্ষ। প্রেতাদি কর্তৃক অনিষ্টকর প্রভাব থেকেও মুক্ত হওয়া যায়।
রাশিচক্রে বুধ গ্রহ নীচস্থ শত্রুযুক্ত ও শত্রুক্ষেত্রগত, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ, অষ্টম ও দ্বাদশ স্থানে অবস্থান করলে বা কোনোভাবে পীড়িত হলে উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক সংস্কার করে ধারণ করতে হয়। মন্ত্র পাঠ ও জপ করে জপের পর উক্ত রুদ্রাক্ষ কণ্ঠে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ দূরীভূত হয়।
-
একাদশমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এটি একটি বিশেষ জাতের রুদ্রাক্ষ। এর নাম মহামৃত্যুঞ্জয়। মেয়েদের নানা অসুখের ক্ষেত্রে একান্তভাবেই সুফল প্রদানকারী, আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটলে, আত্মহনন চিন্তা এসে মনকে ও মেজাজ খিটখিটে স্বভাবের হয়ে উঠলে এ রুদ্রাক্ষ ধারণে তার উপশম হয়। মন্ত্র উচ্চারণযোগে রুদ্রাক্ষ উজ্জীবিত করে ধারণ করা প্রয়োজন। রাশিচক্রে শুক্র ও মঙ্গল অশুভ থাকলে মন্ত্রে যথাবিধি সংস্কার করে মন্ত্র জপ করে ডান হাতে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ প্রভাব নাশ হয়।
-
দ্বাদশমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এর নাম অর্ক বা আদিত্য। এ রুদ্রাক্ষ রবি ও রাহুর অশুভ প্রভাবকে প্রশমিত করে। রবি যখন মকরে বা কুম্ভরাশিতে অবস্থিত হয়ে অশুভদশা প্রাপ্ত হয় তখন এ রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে সকল কুফল নষ্ট হয়। ব্যবসায়িক মন্দা বা অসাফল্য নিবারণ করতে মন্ত্র সহযোগে এ রুদ্রাক্ষকে উজ্জীবন করে ধারণ করতে হয়। মন্ত্র উচ্চারণ করে ১০৮ বার জপের পর রুদ্রাক্ষটি কণ্ঠে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ বিনষ্ট হয়।
-
ত্রয়োদশমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এর নাম কাম। এর ধারণে সর্বভাবেই কামনীয় বিষয়ের প্রাপ্তিযোগ ঘটে। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিপূরণ হয়। চিন্তামণি মন্ত্র সহযোগে এ রুদ্রাক্ষ উজ্জীবন করতে হবে। অতঃপর মন্ত্র ১০৮ বার বীজমন্ত্র জপ করে ডান হাতে ধারণ করলে সমস্ত পাপ দূর হয় ও সকল মনোরথ সিদ্ধি হয়। এর ধারণে চন্দ্র ও শুক্রের অশুভ প্রভাব নাশ হয়ে থাকে।
-
চতুর্দশমুখী রুদ্রাক্ষ: এই রুদ্রাক্ষ শ্রীকণ্ঠ নামে পরিচিত। এই রুদ্রাক্ষ ইন্দ্রিয় সংযমে সাহায্য করে। পঞ্চমুখ হনুমানমন্ত্র সহযোগে একে উজ্জীবিত করতে হয়। মন্ত্র পাঠ করে বীজমন্ত্র জপ করে ধারণ করলে শুক্রগ্রহের সমস্ত অশুভ বিনষ্ট হয়। মন্ত্র ১০৮ বার জপ করে ধারণ করলে বৃহস্পতি ও রবির সমস্ত অশুভ প্রভাব নষ্ট হয়ে থাকে।
.
জ্যোতিষমতে রুদ্রাক্ষ ধারণের বিধি ও ফলাফল বর্ণনা করা হলো। শুদ্ধচিত্তে সঠিক মন্ত্রোচ্চারণাদিপূর্বক রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে অবশ্যই ফল লাভ হবে। যেহেতু নকল রুদ্রাক্ষ দ্বারা প্রতারিত হবার আশঙ্কা আছে, তাই বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষা করিয়ে অনুষ্ঠানাদির জন্য যোগ্য পুরোহিতের সাহায্য নেয়া বাঞ্ছনীয়। সংক্রান্তি, অষ্টমী তিথি, চতুর্দশী তিথি, গ্রহণ, পূর্ণিমা বা অমাবস্যা ইত্যাদি পুণ্য তিথিতেই রুদ্রাক্ষ ধারণ বিধেয়। তিথির সঙ্গে শুভ নক্ষত্র যোগ দেখে নিতে হবে। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের উপদেশ মেনে চলা উচিত। বাহুতে বা কণ্ঠে স্বর্ণসূত্রে, রৌপ্যসূত্রে বা কার্পাসসূত্রে গ্রথিত করে পঞ্চগব্য, পঞ্চামৃত দ্বারা মহাস্নান করিয়ে উল্লিখিত মন্ত্রসহযোগে রুদ্রাক্ষকে উজ্জীবিত করে ভক্তিসহকারে ধারণের কথা শাস্ত্রে বলা হয়েছে।
লিখেছেনঃ প্রীথিশ ঘোষ
=====
শিবপুরাণ হতে রুদ্রাক্ষের উৎপত্তি সন্মন্ধে যা জানা যায় ---
নারদ উবাচ-
" এবং ভূতানুভাবোঽয়ং রুদ্রাক্ষ ভবতাঽনঘ ।
বর্ণিতো মহতাং পূজ্যঃ কারণং তত্র কিং বদ্ ।। "
অর্থাৎ, নারদ নারায়ণকে প্রশ্ন করলেন - হে ভগবন্ অনঘ ! রুদ্রাক্ষের এই প্রকার প্রভাব এবং মহাপুরুষদের দ্বারা এই রুদ্রাক্ষ পূজিত হওয়ার কারন কি?
নারায়ণ উবাচ-
" এবমেব পুরা পৃষ্টো ভগবান গিরীশঃ প্রভুঃ ।
ষন্মুখেন চ রুদ্রস্তং যদুবাচ শৃণুস্ব তৎ ।। "
অর্থাৎ, নারায়ণ বললেন- হে নারদ ! এই কথা পূর্বে ভগবান গিরীশ শঙ্কর -কে তার পুত্র ষণ্মুখ অর্থাৎ কার্তিকেয় জিজ্ঞাসা করেছিলেন ।
শ্রী ঈশ্বর উবাচ-
"শৃণু ষ্ণমুখ তত্ত্বেন কথয়ামি সমাসতঃ ।
ত্রিপুরো নাম দৈত্ত্যস্তু পুরাঽসীৎ সর্বদূর্জয়ঃ ।।
হতাস্তেন সুরাঃ সর্বে ব্রহ্মাবিষ্ণাদি দেবতাঃ ।
সর্বৈস্তু কথিতে তস্মিংস্তদাহং ত্রিপুরং প্রতি ।
অচিন্ত্যং মহাশস্ত্রমঘোরাখ্যাং মনোহরম্ ।।
সর্বদেবময়ং দিব্যং জ্বলন্তং ঘোররূপী যৎ ।
ত্রিপুরস্য বধার্থায় দেবানাং তারণায় চ,
সর্ববিঘ্নপশমন মঘোরাস্ত্র মচিন্তয়ম্ ।।
দিব্যবর্ষ সহস্রং তু চক্ষুরুন্মীলিতং ময়া ।
পশ্চান্মাকুলাক্ষিভ্যঃ পতিতা জলবিন্দবঃ ।।
তত্রাশ্রুবিন্দুতো জাতা মহারুদ্রাক্ষ বৃক্ষকঃ ।
মমাজ্ঞয়া মহাসেন সর্বেষাং হিতকাম্যয়া ।।
--------- অর্থাৎ, ভগবান শঙ্কর বললেন- হে ষন্মুখ বা কার্ত্তিক ! মনোযোগ সহকারে এই তত্ত্ব শ্রবণ কর, আমি সংক্ষেপে তোমাকে বলছি । ত্রিপুর নামক দৈত্য অতীব দূর্জয় হয়ে উঠেছিল ।সেই অসুর ব্রহ্মা বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতাকে পর্যন্ত স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেছিল। দেবতাগন স্বর্গ বিচ্যুত হয়ে তাদের দুঃখের কাহীনি আমার কাছে এসে সবিস্তারে বলে। এই কথা শ্রবণ করে আমি ঐ অসুর কে বধ করার উদ্দেশ্যে ও দেবতাগনের রক্ষার্থে সর্বপ্রকার বিঘ্ন নাশ কারী এক সর্বদেবময় দিব্য মহাঅঘোরাস্ত্রের চিন্তা করেছিলাম । এক দিব্য সহস্র বৎসর চিন্তা করার পর আমি যখন আমার চোখ উন্মীলিত করি তখন আমার চোখ থেকে জলবিন্দু ভূমিতে পতিত হয়। সেই তৃ্তীয় নেত্র হতে পরা অশ্রুবিন্দু থেকে এক দিব্য বৃক্ষের উৎপত্তি হয়। হে মহাসেন ( কার্তিকের অপর নাম) আমার আদেশেই ঐ বৃক্ষ জগতের হিতার্থে উৎপন্ন হয়েছিল।"
সাধারণত কার্তিক মাসের শেষে বা অগ্রহায়ণ (বর্তমান বাংলা মাস) মাসের শুরুতে গাছটিতে ফল ধরা শুরু হয় । ফল এর উপরে গাঢ় নীল রঙের আবরণ থাকে যা ছিললে ঐ রুদ্রাক্ষ দেখা যায় । এর মধ্যে কিছু দাগ এর মত দেখা যায় যাকে আধ্যাত্মিক ভাষায় মুখ বলা হয়।
প্রাপ্তি স্থানঃ ভারতের উত্তর প্রদেশ, উত্তর কাশীর গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। তিব্বতেও এটি পাওয়া যায়। ইন্দোনেশিয়া, জাভা, সুমাত্রা ও চীন দেশের কিছু অংশে রুদ্রাক্ষ উৎপন্ন হয়ে থাকে। এর মধ্যে নেপালের ভোজপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি রুদ্রাক্ষ উৎপন্ন হয়। মূলত ২১ রকমের রুদ্রাক্ষ দেখা যায় এখন। তবে ১৪ থেকে ২১ মুখী রুদ্রাক্ষ দুষ্প্রাপ্য। বাজারে ১ থেকে ১৪ মুখী অবধি রুদ্রাক্ষ পাওয়া যায়। এর মধ্যে তিন, চার, পাঁচ ও ছয়মুখি রুদ্রাক্ষ বেশি পাওয়া যায়। একই সঙ্গে দুর্লভও বটে। এর বাইরে ত্রিজুতি, গৌরী শঙ্কর ও গণেশ নামেও রুদ্রাক্ষ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে কিংবা বাজারের হিসাবে, একমুখী গোলাকার রুদ্রাক্ষ সর্বোত্কৃষ্ট। প্রতিটি রুদ্রাক্ষের আলাদা ফল। নিজের দেহতত্বের সাথে মিলিয়ে যথার্থ রুদ্রাক্ষ পড়তে পারলে নবগ্রহ মানুষকে কৃপা করে। আসলে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছে রুদ্রাক্ষ একটি পবিত্র ফল। মানসিক শান্তি ও পবিত্রতা এবং ধ্যানে এটি শতকের পর শতক ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে।
আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রমতে, এটি সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি শুষে নেয়। ফলে মস্তিষ্ক, হূদযন্ত্রসহ শরীর সুস্থ ও সবল থাকে। এটি রক্তের স্বাভাবিক গতি সচল রাখে। উচ্চ রক্তচাপ, হিস্টিরিয়া, ক্ষয়রোধ, স্মৃতিশক্তিহীনতা, বদহজম প্রভৃতি রোগে উপশম এনে দেয়। স্নায়ুর ওপর থেকে চাপ কমিয়ে মানসিক শান্তি আনে রুদ্রাক্ষ। জ্যোতিষ শাস্ত্রে একে বাত, কৃমি, অশুভ গ্রহ প্রভাবের বিনাশক হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।
রুদ্রাক্ষের ব্যবহার কখনই শুধু সাধুসন্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সেই প্রাচীনকাল থেকেই গোটাবিশ্বে এর প্রতি কৌতূহল রয়েছে। বিভিন্ন দেশের নামিদামি মানুষ শুভকামনা, সুস্বাস্থ্য, সফলতা, আর্থিক উন্নতি এবং অশুভ শক্তি দূরে রাখতে রুদ্রাক্ষ দিয়ে তৈরি পণ্য শরীরে ধারণ করে আসছেন। আমজনতাও পিছিয়ে নেই, তারাও চেষ্টা করেন এর সুফল ভোগ করতে।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
রুদ্রাক্ষের গুণাগুণ
=============
বিভিন্ন শাস্ত্রে এক থেকে চৌদ্দমুখী পর্যন্ত রুদ্রাক্ষ ব্যবহারের যে নিয়ম, আচার ও অনুষ্ঠানের উল্লেখ আছে তা এখানে বলা হচ্ছে -----
একমুখী রুদ্রাক্ষ --- রুদ্রাক্ষের মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই শ্রেণীকে ‘শিব’ নামে অভিহিত করা হয়। রুদ্রাক্ষের সব গুণাগুণ সমস্তই এ শ্রেণির রুদ্রাক্ষের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। খুবই দুর্লভ শ্রেণির রুদ্রাক্ষ এবং অত্যন্ত মূল্যবানও বটে। বলা হয়, এই রুদ্রাক্ষ ধারণে মানুষ অপরাজেয় হয়। বিশেষ আধ্যাত্মিক উন্নতিও ঘটে। রুদ্রাক্ষের উজ্জীবন করতে হয়, মন্ত্র উচ্চারণ করে ডান বাহুতে বা কণ্ঠে এ রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে লোকপ্রভাবিনী শক্তির স্ফুরণ ঘটে। রাশিচক্রে রবিগ্রহ, পাপপীড়িত,পাপগ্রহদৃষ্ট, নীচস্থ পাপযুক্ত বা যে কোনোভাবে পীড়িত হলে এ গ্রহের শান্তির জন্য উপরোক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধ সংস্কারপূর্বক জপ করে ধারণ করলে রবিগ্রহের সমস্ত কুফল নষ্ট হয়।
-
দ্বিমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এ জাতীয় রুদ্রাক্ষকে ‘হরগৌরী’ নামে অভিহিত করা হয়। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে মনের একাগ্রতা জীবনে শান্তি এনে দেয়। অজ্ঞাতসারে গোহত্যাজনিত পাপের স্খলন হয়। কুলকুলিনী শক্তি সম্পর্কে চেতনার সঞ্চার করে। মন্ত্র উচ্চারণসহযোগে এই রুদ্রাক্ষের উজ্জীবন হয়। মন্ত্র পাঠ করে ডান হাতে বা কণ্ঠে এ রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে ত্রিজন্ম সঞ্চিত পাপরাশি দূরীভূত হয়।
রাশিচক্রে কেতুগ্রহ নীচস্থ, পাপপীড়িত বা যে কোনোভাবে অশুভ হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি সংস্কারপূর্বক ১০৮ বার জপ করে ধারণ করলে কেতুগ্রহের সমস্ত কুফল নষ্ট হয়।
-
ত্রিমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এ জাতীয় রুদ্রাক্ষের নাম ‘অগ্নি’। অতীত পাপ বিনষ্ট করে, মানুষের সৃজনীশক্তির বিকাশ সাধন করে, চিরকর্মচঞ্চল জীবনীশক্তিকে উন্নীত করে, ম্যালেরিয়া রোগ নিবারণ করে। মন্ত্র পাঠ করে দু’বাহুতে ধারণ করলে অসাধারণ শক্তির সঞ্চার হয়। রাশিচক্রে মঙ্গল বা যে কোনোভাবে পীড়িত হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধ সংস্কারপূর্বক জপ করে ধারণ করলে মঙ্গল গ্রহের সমস্ত কুফল নষ্ট হয়।
-
চতুর্মুখী রুদ্রাক্ষ --- জ্যোতিষী নাম ‘ব্রহ্মা’। মনের ক্রিয়াকলাপের উপরে এ শ্রেণির রুদ্রাক্ষের প্রভাব চমত্কার। সে কারণে উন্মত্ততা, অনিদ্রা, বিষাদময়তা ইত্যাদি মানসিক রোগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করা হয়। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি হয়। তুচ্ছ বিষয়ে মানসিক অস্থিরতার উপশম হয়, মানসিক অবসাদ দূর হয়, উদ্বেগ, ভয়, খিটখিটে স্বভাব ও আত্মহনন-চিন্তা ইত্যাদির প্রকোপ হ্রাস করে। বক্তৃতা-ক্ষমতা, কর্মতত্পরতা ও বুদ্ধি বৃদ্ধির উন্মেষকারক এ রুদ্রাক্ষ। মন্ত্র পাঠ করে কণ্ঠে ধারণ করতে হয়। রাশিচক্রে চন্দ্রগ্রহ নীচস্থ, পাপযুক্ত ও পাপপীড়িত হয়ে দ্বিতীয়ে, ষষ্ঠে, অষ্টমে দ্বাদশে অবস্থান করলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধ সংস্কার করে ১০৮ বার জপের পর ডান হাতে ধারণ করলে চন্দ্রগ্রহের সমস্ত কুফল নষ্ট করে বিভিন্ন শান্তি ও সুখ বহন করে।
-
পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ -- সর্বাধিক পরিচিত এবং সর্বত্রই এ রুদ্রাক্ষ পাওয়া যায়। এ রুদ্রাক্ষ দুই শ্রেণীর হয়ে থাকে। এর নাম ‘কালাগি রুদ্র’। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে নিষিদ্ধ খাদ্যগ্রহণ ও নিষিদ্ধ কর্ম সম্পাদনের পাপ অপনোদন হয়, মানসিক প্রশান্তি আসে। সন্ধ্যাকালে দেহের যে কোনো অংশে ধারণ করলে অখাদ্য ভোজনজনিত পাপ নষ্ট হয়। রাশিচক্রে শনিগ্রহ, রবিযুক্ত হলে লগ্নে, দ্বিতীয়ে, ষষ্ঠে, সপ্তমে, অষ্টমে, দ্বাদশে অবস্থান করলে বা যে কোনোভাবে শনিগ্রহ পাপপীড়িত, নীচস্থ ও অশুভ গ্রহযুক্ত হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি সংস্কারপূর্বক মন্ত্র জপ করলে ও পরে বীজমন্ত্র জপ করে ধারণ করলে শনিগ্রহের সমস্ত অশুভ ফল নষ্ট হয়।
-
ষড়মুখী রুদ্রাক্ষ ---- এ জাতীয় রুদ্রাক্ষের নাম ‘কার্তিকেয়’। ছাত্রদের পক্ষে ও যারা দুরারোগ্য রোগে ভুগছেন তাদের পক্ষে এ রুদ্রাক্ষ বিশেষ উপকারী। জ্ঞানবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ রুদ্রাক্ষর চমত্কার কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায়। মন্ত্রযোগে রুদ্রাক্ষ উজ্জীবন করা হয়। ভূত-প্রেতাদি দ্বারা অনিষ্ট সাধনের ক্ষেত্রে প্রতিকাররূপে ধারণীয়। মানসিক অবসাদ, স্বভাবের উগ্রতা ও নানা রোগের উপকারকারী এ রুদ্রাক্ষ। রাশিচক্রে শুক্র কন্যায় নীচস্থ, অশুভ গ্রহযুক্ত দ্বিতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ, অষ্টম, দ্বাদশে অবস্থান করলে বা অশুভ হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি সংস্কারপূর্বক মন্ত্র জপের পর ধারণ করলে শুক্রগ্রহের সমস্ত অশুভ ভাব নষ্ট হয়।
-
সপ্তমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এ শ্রেণির রুদ্রাক্ষের নাম অনন্ত মাতৃকা। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে সামাজিক প্রতিষ্ঠা, অর্থ মান, যশ ও প্রতিপত্তিলাভের পথ সুগম হয়ে থাকে। রাশিচক্রে রাহুগ্রহ রবি ও চন্দ্র যুক্ত হয়ে লগ্নে দ্বিতীয়ে, চতুর্থে, পঞ্চমে, ষষ্ঠে, সপ্তমে, অষ্টমে, নবমে, দশমে এবং দ্বাদশে অবস্থান করলে বা কোনোভাবে অশুভ হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ উজ্জীবন করতে হয়। ১০৮ বার মন্ত্র জপ করে উক্ত রুদ্রাক্ষ কণ্ঠে ধারণ করলে রাহু গ্রহের সমস্ত কুফল বিনষ্ট হয়।
-
অষ্টমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এই রুদ্রাক্ষের দুটি নাম বিনায়ক ও বটুকভৈরব। শনিগ্রহ ও রাহুর অশুভ প্রভাব খর্ব করে। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে হঠাত্ আঘাত পাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। দুষ্কৃতকারীদের হাতে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
রাশিচক্রে শনি ও রাহু অশুভ থাকলে উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি সংস্কারপূর্বক পুরুষের ডান বাহুতে এবং স্ত্রীলোকের বাম বাহুতে ধারণীয়। নির্দিষ্ট মন্ত্রে পূজা করে এবং পরে জপ করে, বীজমন্ত্র জপ করে উক্ত রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে সমস্ত অশুভ প্রভাব দূরীভূত হয়।
-
নবমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এ রুদ্রাক্ষের নাম মহাকাল ভৈরব। ধারণে জীবনে উন্নতির সূচনা যায়, সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জয়লাভ করা হয়। দুর্ঘটনা ও হঠাত্ মৃত্যুর হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। ধারণের পূর্বে মন্ত্র উচ্চারণ করে এ রুদ্রাক্ষের উজ্জীবন বা প্রাণসঞ্চার করে নিতে হয়। মন্ত্র পাঠের পর উচ্চারণ করতে হয়। বুদ্ধিবৃত্তিজনিত কাজকর্মের ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রচুর সুফল দান করে এ রুদ্রাক্ষ। রাশিচক্রে বৃহস্পতি গ্রহ মকরে নীচস্থ, মকরস্থানে অবস্থান করলে, বা মারকস্থ হলে এবং ষষ্ঠ, অষ্টম, দ্বাদশ স্থানে অবস্থান করলে কিংবা কোনোভাবে অশুভ হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উপরোক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধ সংস্কার পূর্বক ধারণের পর মন্ত্র জপ করে বৃহস্পতয়ে’ এ বীজমন্ত্র জপের পর পুরুষের দক্ষিণ বাহুতে এবং স্ত্রীলোকের বামবাহুতে ধারণ করলে সকল অশুভ বিনাশ হয়।
-
দশমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এ শ্রেণির রুদ্রাক্ষ দুর্লভ। এর নাম মহাবিষ্ণু। মর্যাদা, প্রতিষ্ঠা, সুনাম, খ্যাতি, সন্মান, পার্থিব সমৃদ্ধি, কর্মদক্ষতা এবং ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জনে সহায়ক এ রুদ্রাক্ষ। প্রেতাদি কর্তৃক অনিষ্টকর প্রভাব থেকেও মুক্ত হওয়া যায়।
রাশিচক্রে বুধ গ্রহ নীচস্থ শত্রুযুক্ত ও শত্রুক্ষেত্রগত, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ, অষ্টম ও দ্বাদশ স্থানে অবস্থান করলে বা কোনোভাবে পীড়িত হলে উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক সংস্কার করে ধারণ করতে হয়। মন্ত্র পাঠ ও জপ করে জপের পর উক্ত রুদ্রাক্ষ কণ্ঠে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ দূরীভূত হয়।
-
একাদশমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এটি একটি বিশেষ জাতের রুদ্রাক্ষ। এর নাম মহামৃত্যুঞ্জয়। মেয়েদের নানা অসুখের ক্ষেত্রে একান্তভাবেই সুফল প্রদানকারী, আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটলে, আত্মহনন চিন্তা এসে মনকে ও মেজাজ খিটখিটে স্বভাবের হয়ে উঠলে এ রুদ্রাক্ষ ধারণে তার উপশম হয়। মন্ত্র উচ্চারণযোগে রুদ্রাক্ষ উজ্জীবিত করে ধারণ করা প্রয়োজন। রাশিচক্রে শুক্র ও মঙ্গল অশুভ থাকলে মন্ত্রে যথাবিধি সংস্কার করে মন্ত্র জপ করে ডান হাতে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ প্রভাব নাশ হয়।
-
দ্বাদশমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এর নাম অর্ক বা আদিত্য। এ রুদ্রাক্ষ রবি ও রাহুর অশুভ প্রভাবকে প্রশমিত করে। রবি যখন মকরে বা কুম্ভরাশিতে অবস্থিত হয়ে অশুভদশা প্রাপ্ত হয় তখন এ রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে সকল কুফল নষ্ট হয়। ব্যবসায়িক মন্দা বা অসাফল্য নিবারণ করতে মন্ত্র সহযোগে এ রুদ্রাক্ষকে উজ্জীবন করে ধারণ করতে হয়। মন্ত্র উচ্চারণ করে ১০৮ বার জপের পর রুদ্রাক্ষটি কণ্ঠে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ বিনষ্ট হয়।
-
ত্রয়োদশমুখী রুদ্রাক্ষ ---- এর নাম কাম। এর ধারণে সর্বভাবেই কামনীয় বিষয়ের প্রাপ্তিযোগ ঘটে। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিপূরণ হয়। চিন্তামণি মন্ত্র সহযোগে এ রুদ্রাক্ষ উজ্জীবন করতে হবে। অতঃপর মন্ত্র ১০৮ বার বীজমন্ত্র জপ করে ডান হাতে ধারণ করলে সমস্ত পাপ দূর হয় ও সকল মনোরথ সিদ্ধি হয়। এর ধারণে চন্দ্র ও শুক্রের অশুভ প্রভাব নাশ হয়ে থাকে।
-
চতুর্দশমুখী রুদ্রাক্ষ: এই রুদ্রাক্ষ শ্রীকণ্ঠ নামে পরিচিত। এই রুদ্রাক্ষ ইন্দ্রিয় সংযমে সাহায্য করে। পঞ্চমুখ হনুমানমন্ত্র সহযোগে একে উজ্জীবিত করতে হয়। মন্ত্র পাঠ করে বীজমন্ত্র জপ করে ধারণ করলে শুক্রগ্রহের সমস্ত অশুভ বিনষ্ট হয়। মন্ত্র ১০৮ বার জপ করে ধারণ করলে বৃহস্পতি ও রবির সমস্ত অশুভ প্রভাব নষ্ট হয়ে থাকে।
.
জ্যোতিষমতে রুদ্রাক্ষ ধারণের বিধি ও ফলাফল বর্ণনা করা হলো। শুদ্ধচিত্তে সঠিক মন্ত্রোচ্চারণাদিপূর্বক রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে অবশ্যই ফল লাভ হবে। যেহেতু নকল রুদ্রাক্ষ দ্বারা প্রতারিত হবার আশঙ্কা আছে, তাই বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষা করিয়ে অনুষ্ঠানাদির জন্য যোগ্য পুরোহিতের সাহায্য নেয়া বাঞ্ছনীয়। সংক্রান্তি, অষ্টমী তিথি, চতুর্দশী তিথি, গ্রহণ, পূর্ণিমা বা অমাবস্যা ইত্যাদি পুণ্য তিথিতেই রুদ্রাক্ষ ধারণ বিধেয়। তিথির সঙ্গে শুভ নক্ষত্র যোগ দেখে নিতে হবে। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের উপদেশ মেনে চলা উচিত। বাহুতে বা কণ্ঠে স্বর্ণসূত্রে, রৌপ্যসূত্রে বা কার্পাসসূত্রে গ্রথিত করে পঞ্চগব্য, পঞ্চামৃত দ্বারা মহাস্নান করিয়ে উল্লিখিত মন্ত্রসহযোগে রুদ্রাক্ষকে উজ্জীবিত করে ভক্তিসহকারে ধারণের কথা শাস্ত্রে বলা হয়েছে।
লিখেছেনঃ প্রীথিশ ঘোষ
1 Comments:
ওম নমঃ ভগবতে রুদ্রায় নমোঃ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন