১২ জুলাই ২০১৫

প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের সেই মর্মান্তিক কাহিনী

নালন্দা ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত একটি প্রাচীন উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র। প্রাচীন নালন্দা মহাবিহার বিহারের রাজধানী পাটনা শহর থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ছিল। খ্রিষ্টীয় ৪২৭ অব্দ থেকে ১১৯৭ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে নালন্দা ছিল একটি প্রসিদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র। এই মহাবিহারকে "ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম" বলে মনে করা হয়। এখানকার কয়েকটি সৌধ মৌর্য সম্রাট অশোক নির্মাণ করেছিলেন। গুপ্ত সম্রাটরাও এখানকার কয়েকটি মঠের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, গুপ্ত সম্রাট শক্রাদিত্যের (অপর নাম কুমারগুপ্ত, রাজত্বকাল ৪১৫-৫৫) রাজত্বকালে নালন্দা মহাবিহারের বিকাশলাভ ঘটে। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন ওপাল সম্রাটগণও এই মহাবিহারের পৃষ্ঠপোষক হয়েছিলেন।১৪ হেক্টর আয়তনের মহাবিহার চত্বরটি ছিল লাল ইঁটে নির্মিত। খ্যাতির মধ্যগগনে থাকাকালীন অবস্থায় চীন, গ্রিস ও পারস্য থেকেও শিক্ষার্থীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে আসতেন বলে জানা যায়।
১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কি মুসলমান আক্রমণকারী বখতিয়ার খিলজি নালন্দা মহাবিহার লুণ্ঠন ও ধ্বংস করেন। এই ঘটনা ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচিত হয়। ২০০৬ সালে ভারত, চীন,সিঙ্গাপুর, জাপান ও অন্যান্য কয়েকটি রাষ্ট্র যৌথভাবে এই সুপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টির পুনরুজ্জীবনের প্রকল্প গ্রহণ করে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম স্থির হয়েছে নালন্দা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটি প্রাচীন নালন্দা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষের নিকট নির্মিত হবে।
"নালন্দা" শব্দটির অর্থ "দানে অকৃপণ"।
চীনা তীর্থযাত্রী সন্ন্যাসী হিউয়েন সাঙ নালন্দা নামের বিবিধ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তাঁর একটি মত হল, এই নামটি স্থানীয় আম্রকুঞ্জের মধ্যবর্তী পুষ্করিণীতে বসবাসকারী একটি নাগের নাম থেকে উদ্ভুত। কিন্তু যে মতটি তিনি গ্রহণ করেছেন, সেটি হল,শাক্যমুনি বুদ্ধ একদা এখানে অবস্থান করে "অবিরত ভিক্ষাপ্রদান" করতেন; সেই থেকেই এই নামের উদ্ভব।
সারিপুত্তর মৃত্যু হয়েছিল "নালক" নামে এক গ্রামে। কোনো কোনো গবেষক এই গ্রামটিকেই "নালন্দা" নামে অভিহিত করেন।
নালন্দা পৃথিবীর প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি এবং এটি ইতিহাসের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেও একটি। এর স্বর্ণযুগে ১০,০০০ এর অধিক শিক্ষার্থী এবং ২,০০০ শিক্ষক এখানে জ্ঞান চর্চা করত। একটি প্রধান ফটক এবং সুউচ্চ দেয়ালঘেরা বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপত্যের একটি মাস্টারপিস হিসেবে সুপরিচিত ছিল।বিশ্ববিদ্যালয়ে আটটি ভিন্ন ভিন্ন চত্বর(compound) এবং দশটি মন্দির ছিল; ছিল ধ্যান করার কক্ষ এবং শ্রেনীকক্ষ। প্রাঙ্গনে ছিল কতগুলো দীঘি ও উদ্যান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারটি ছিল একটি নয়তলা ভবন যেখানে পাণ্ডুলিপি তৈরি করা হত অত্যন্ত সতর্কতার সাথেধর্মের পাশাপাশি বেদ _উপনিশদ, বিতর্ক, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতিষ বিদ্যা, শিল্প কলা, চিকিৎসাশাস্ত্র সহ তৎকালীন সর্বোচ্চ শিক্ষা ব্যাবস্থার উপযোগী আরো বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে নিয়মিত পাঠ দান চলত এখানে।। তৎকালীন জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই চর্চার সুযোগ থাকায় সুদূর কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত,ইন্দোনেশিয়া, পারস্য এবং তুরস্ক থেকে জ্ঞানী ও জ্ঞান পিপাসুরা এখানে ভীড় করতেন। চীনের ট্যাং রাজবংশের রাজত্বকালে চৈনিক পরিব্রাজক জুয়ানঝাং ৭তম শতাব্দিতে নালন্দার বিস্তারিত বর্ণনা লিখে রেখে গেছেন।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার ধর্ম গুঞ্জ বা ধর্মগঞ্জ সেই সময়ে বৌদ্ধজ্ঞানের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ভান্ডার হিসাবে সুপরিচিত ছিল। পাঠাগারে ছিল শত শত হাজার হাজার পুঁথি,। পাঠাগারের মূল ভবন ছিল তিনটি যার প্রত্যেকটি প্রায় নয়তলা ভবনের সমান উঁচু; ভবনগুলো রত্নসাগর, রত্নদধি ও রত্নরঞ্জক নামে পরিচিত ছিল।
নালন্দার লাইব্রেরী
শত শত বছর ধরে অবদান রেখে আসা একটি সভ্য, উন্নত জাতি তৈরী ও জ্ঞান উৎপাদনকারী নিরীহ এই প্রতিষ্ঠানটি ১১৯৩ খ্রষ্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী আক্রমন করে ধ্বংস করে ফেলেন। তার আক্রমনের বর্বরতা এত ভয়াবহ আকারে ছিল এ সম্পর্কে পারস্য ইতিহাসবিদ মিনহাজ তাঁর “তাবাকাতে নাসিরি” গ্রন্থে লিখেছেন “হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আগুনে পুড়িয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে সেখানে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করেন খিলজী” এরপর আগুন লাগিয়ে দেন লাইব্রেরীর ভবন গুলোতে। লাইব্রেরীতে বইয়ের পরিমান এত বেশী ছিল যে কয়েক মাস সময় লেগেছিল সেই মহা মূল্যবান বই গুলো পুড়ে ছাই ভষ্ম হতে(জনশ্রুতি আছে ছয় মাস) খিলজী শুধু নালন্দাকে পুড়িয়ে ছাই করেন নি, একই সাথে পুড়িয়ে ছাই করেছেন একটি জাতির সভ্যতা, ইতিহাস, প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞানের অমূল্য বই যা থেকে আমরা জানতে পারতাম সে যুগের ভারত বর্ষের শিক্ষার অবকাঠামো, তৎকালীন সামাজিক-সাংষ্কৃতিক অবস্থা ও প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে। জাতি হিসাবেও হয়তো আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে সহস্র বছর।
সেদিন তার ধারালো তরবারির নিষ্ঠুর আঘাতে ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্ত বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়া নিরস্ত্র মানুষের আর্ত চিৎকারে ও জীবন্ত মানুষ পোড়া গন্ধের সাথে বাতাসে ভেসে আসা বাচঁতে চাওয়া ঝলসানো সাধারণ মানুষ গুলোর করুণ আর্তনাদে স্তব্ধ হয়েছিল একটি সভ্য জাতির অগ্রযাত্রা।খিলজীর এই পাশবিক নিষ্ঠুর বর্বরতাও পরিচিতি পায় এক শ্রেণীর ধর্মান্ধদের চোখে ধর্মীয় বিজয় হিসাবে! আর আমাদের পাঠ্য পুস্তক গুলোতে এই নির্মম, নিষ্ঠুর বখতিয়ার খলজিকে নায়ক হিসেবে দেখান হয়। ভাবতেই অবাক লাগে কিভাবে ইতিহাস্কে বিকৃত করা হয়। চেষ্টা করা হয়্য নালন্দার ইট কাঠ পাথরের চাপা কান্না আর আহাকার যেন আমাদের কানে না পৌছাতে পারে।
কিছু কিছু স্থাপনা এখনো টিকে আছে, যেমন নিকটবর্তী সূর্য মন্দির যা একটি হিন্দু মন্দির। মোট ১৫,০০০ বর্গ মিটার এলাকায় খননকার্য চলানো হয়েছে, অবশ্য যদি জুয়ানঝাংয়েরহিসাব সঠিক হয় তাহলে মাত্র ১০% জায়গায় এখন পর্যন্ত খননকার্য চালানো হয়েছে।
নালন্দায় এখন কেউ বাস করে না, নিকটবর্তী জনবসতি বড়গাঁও নামক গ্রামে।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রায় সকল ধর্ম গ্রন্থের সংগ্রহ শালা। বিশেষ করে বেদ আর উপনিষদের উপর আলোচনা, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ গুলো অত্যন্ত সতর্কতা ও যত্নের সাথে সংরক্ষন করা হয়। এই পুস্তক গুলো ধ্বংসের ফলে পরবর্তীতে হিন্দু ধর্মে নানা কু প্রথা- আচার স্থান পায়। যার প্রভাব এখন রয়ে গেছে হিন্দু ধর্মে।
নালন্দায় ধর্মীয় বিজয় সফল হলেও লজ্জিত হয় মানবতা, পরাজিত হয় সভ্যতা, শৃঙ্খলিত হয় শিক্ষা।
এভাবে উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা, আক্রোশ, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে পৃথিবী থেকে বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল ধর্মান্ধরা কয়েকশ বছর ধরে মানব সভ্যতাকে আলোর পথ দেখানো মানুষ গড়া্র এই কারখানাটিকে।

লেখকঃ শ্রী ইশাইমুন & Ramkrishna Bhattacharya
http://en.wikipedia.org/wiki/Nalanda
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।