উত্তর আমেরিকা মহাদেশের পেরু এবং মেক্সিকোর উপকূলে অবস্থিত আছে এক আশ্চর্যকর প্রাচীন সভ্যতা । কয়েক শতক ধরে বিজ্ঞানীদের নানা গবেষণাকর্ম সম্পাদন করা সত্ত্বেও এই পৌরণিক সভ্যতার রহস্যের জাল ভেদে করা সম্ভব হয়নি । বর্তমান এটি একটি পৃথিবীর বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে । এখনো পর্যন্ত এই স্থানে অবস্থিত পিরামিডগুলো পর্যটকদের বিনোদন দান করলেও বিজ্ঞানীদের মাথার চুল হরণ হচ্ছে এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে । মেক্সিকোর উপকূলে এই বিখ্যাত সভ্যতার নাম “মায়ান সভ্যতা ।” মায়ান সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল তখনই, যে সময়ে বিজ্ঞানী সমাজের ধারণা মতে একের পর এক বানর সমাজ থেকে মানুষের উদ্ভব হচ্ছিল । এটি বিজ্ঞানীদের কাছে ধাঁধার মত বিষয় ।
মিসরীয় পিরামিড ও মায়ান পিরামিডের মধ্যে স্থাপত্যগত মিল পাওয়া যায় । যেমনঃ- উভয়ের চারকোণা, সকীর্ণ শিখর এবং বিস্তৃত ভূমি রয়েছে । কিন্তু তাঁদের মধ্যে একটি পার্থক্য হল মায়ান পিরামিডগুলো আসলে মন্দির বা উপসনালয় ছিল । অন্যদিকে মিসরীয় পিরামিডগুলো হল সমাধি স্তম্ভ ।
মিসরীয় পিরামিড ও মায়ান পিরামিডের মধ্যে স্থাপত্যগত মিল পাওয়া যায় । যেমনঃ- উভয়ের চারকোণা, সকীর্ণ শিখর এবং বিস্তৃত ভূমি রয়েছে । কিন্তু তাঁদের মধ্যে একটি পার্থক্য হল মায়ান পিরামিডগুলো আসলে মন্দির বা উপসনালয় ছিল । অন্যদিকে মিসরীয় পিরামিডগুলো হল সমাধি স্তম্ভ ।
“চিচেন ইটা” নামক স্থানটি ছিল মায়ান বা ময়রাজ্যের রাজধানী । এখানে নির্মিত স্থাপত্যগুলো কমপক্ষে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩৫ বা ৪৫৫ সালের । এই স্থানটি নতুন সপ্ত আশ্চর্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে । এখানে সবচেয়ে অপূর্ব দর্শনীয় পিরামিড হচ্ছে “কুলকোন পিরামিড” । এই কুলকোন পিরামিডের আশ্চর্যকর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ঠিক দুপুর ৩টায় যখন এই পিরামিডের শিখরে রোদ পড়ে তখন আলো ছায়ার সংমিশ্রনে এক অপূর্ব পাখি আকৃতির দেহ তৈরির দৃশ্যের অবতারণা ঘটে । মায়ানরা এই পাখিকে ভগবানের সেবক রূপে দর্শন করে (বৈদিক সভ্যতায় ভগবান বিষ্ণুর সেবক গড়ুর পাখি) ।
রেইন ফরেস্ট এর অভ্যন্তরে মায়ান সভ্যতার নিদর্শন আরেকটি স্থান হচ্ছে “কোবা” । এই স্থানের আশ্চর্যকর নিদর্শন হচ্ছে “মুল” মন্দির এছাড়া এখানে ‘ক্যানোট’ নামক প্রাকৃতিক কুয়া দর্শনীয় । এখন প্রশ্ন হল উত্তর আমেরিকা এই সকল পিরামিড কি বৈদিক সভ্যতার আলোকে তৈরি ? এ প্রশ্নের সমাধানের উদ্দেশ্য বিশ্ব পরিভ্রমনে বের হন ভারতীয় বিখ্যাত আর্কিটেক্ট ডঃ ভি. গণপতি স্থপতি । ১৯৯৫ সালে বসন্তে তিনি উত্তর আমেরিকার মেক্সিকো এবং পেরু পরিদর্শন করেন । এর পূর্বে তিনি প্রাচীন বৈদিক এবং তামিল স্থাপত্য বিষয়ক শাস্ত্র গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন । তিনি শাস্ত্র গবেষণা করে জানতে পারেন যে, প্রাচীন ভারতবর্ষ এবং প্রাচীন আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে । ঠিক যেমন বর্তমানে হয়তো অনেকেই জানেন যে, বিখ্যাত নাবিক কলম্বাস প্রথম আমেরিকা আবিষ্কার করেন নি । তা যদি হত তবে ভারতীয়
বৈদিক সভ্যতা আমেরিকাতে প্রবেশ লাভ করে কিভাবে ?
বৈদিক সভ্যতা আমেরিকাতে প্রবেশ লাভ করে কিভাবে ?
ডঃ গণপতি প্রথমে পেরুতে হাজার বছরের প্রাচীন শিব মন্দিরের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন । তিনি মায়ান পিরামিড পরিদর্শন করেন । তিনি দেখেন যে, এই পিরামিড কিংবা অন্যান্য স্থাপত্যগুলোর সাথে উত্তর ভারতের বৈদিক স্থাপত্যের শুধুমাত্র কাঠামোগত মিলই নয় বরং জ্যামিতিক ভাস্তু পুরুষমন্ডলেরও আশ্চর্যকর মিল রয়েছে । এছাড়া তিনি ইন্ডিয়ান মন্দিরের শিখর এবং মায়ান পিরামিড শিখরের মধ্যে তাত্ত্বিক মিল পেয়েছেন । যেমন উভয়ের শিখরের দৈর্ঘ্য ৮×৮ বর্গফুট । এছাড়া গবেষণায় আরও একটি আশ্চর্যকর তথ্য পাওয়া গেছে । মূলত পেরুর, মেক্সিকোর কুলকু নামক এলাকার সকল স্থাপত্য এবং পিরামিড মূলত, ‘বসতি’ নামক বৈদিক স্থাপত্য শাস্ত্রের আলোকে নির্মিত হয়েছে । জমির মাপ, দরজা ও জানালার দিকে, ছাদের অবস্থান সহ সম্পূর্ণ স্থাপত্যের প্রতিটি কলাম ও ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা ব্যবহৃত হয়েছে সম্পূর্ণ ময়দদানব লিখিত ‘বসতি’ নামক শাস্ত্রানুসারে, যে সকল সূত্র বর্তমান ভারতের ৬০ শতাংশ ঘরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ।
অমল পুরাণ শ্রীমদভাগবতমে এই ময়দানবের বর্ণনা দেওয়া আছে । তিনি ছিলেন স্থাপত্যবিদ্যা, যন্ত্রবিদ্যাসহ আরো নানা বিদ্যায় পারদর্শী । এছাড়া শ্রীমদ্ভাগবত হতে আরো জানা যায় যে, ময়দানবের নিবাসস্থল হচ্ছে সুতল নামক গ্রহ, কিন্তু তিনি একসময় পৃথিবীতে আসেন । ময়দানবের বহু বৈদিক স্থাপত্য পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা জুড়ে রয়েছে । এখন প্রশ্ন হল ময়দানব কি উত্তর আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন ? পৌরাণিক শাস্ত্র মতে কমপক্ষে ৮০০০ বছর পূর্বে পৃথিবী গ্রহের উপর ময়দানবের প্রভাব ছিল অসীম ।
ময়দানবের আশ্চর্য শক্তিমত্তা ও জ্ঞান । তিনি স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে কয়েকটি শাস্ত্র লিখেন এবং স্থাপত্য নির্মানে মগ্ন হন । ধারণা করা হয় যে, তিনি পরবর্তীতে বর্তমান আমেরিকার পূর্ব উপকূলে বৈদিক স্থাপত্য নির্মান করে মায়ান সভ্যতার বিকাশ শুরু করেন । মূলত, ময়দানব থেকে ‘ময়া’ বা মায়ান সভ্যতার উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয় । তবে এই তথ্যের পেছনে শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে । যেমন – বহু মায়ান ও বৈদিক শব্দের মধ্যে মিল পাওয়া গেছে । ময়া শব্দ ‘কুলটালিনী’ বলতে স্বর্গীয় শক্তিকে বোঝায় ঠিক সংস্কৃত শব্দ ‘কুন্ডলিনী’ বলতে জীবনের শক্তি বা চেতনার শক্তিকে বোঝায় । এছাড়া সংস্কৃত শব্দ ‘যোগ’; ময়া সভ্যতায় ‘যোগহ’ । ভাস্তু মতে, বর্গাকার গ্রীড কে বলা হয় মনডুকা মন্ডল । যে কোন বৈদিক স্থাপত্যের কেন্দ্রে অবস্থিত চতুবর্গাকার স্থানকে ‘ব্রহ্মস্থান’ বলা হয় । এই অংশে এমন আশ্চর্যকর শক্তি থাকে যে, এই স্থানে কোন মানুষের পক্ষে থাকা সম্ভব হয় না । এই স্থানে মূলত ভগবানের বিগ্রহ অধিষ্ঠিত থাকে । মায়ানরা এই স্থানকে ‘চিলামবুরাম’ বলে যার অর্থ পবিত্র কক্ষ । মায়ান রুমগুলো বর্গাকৃতির এবং সম্পূর্ণ ‘বসতি’ মতে নির্মিত ।
পিরামিড সত্যিই এক আশ্চর্যকর স্থাপত্য যা হাজার হাজার বছর পূর্বে নির্মিত হয়েছিল । কিন্তু বর্তমানেও পিরামিডের প্রয়োগ বিভিন্ন ক্ষেত্রে হচ্ছে যেহেতু এটির মহাজাগতিক শক্তি রয়েছে । প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্রকারগণ পিরামিডের আশ্চর্যময় শক্তি সম্পর্কে ধারণা ছিল এবং তারা বিভিন্ন যন্ত্র তৈরিতে পিরামিডের ধারণা ব্যবহার করত । যেমন – বর্তানেও ভারতের প্রায় ঘরে পিরামিড আকৃতির ‘শ্রীযন্ত্র’ ব্যবহার করা হয় । এছাড়া পিরামিডের শক্তি ভাস্তু, জ্যোতিষতত্ত্ব, রং থেরাপি, মেডিটেশন সহ আরো অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে । এছাড়া মিশর বা মেক্সিকো ছাড়াও হিমালয় সহ পৃথিবীর আরো ৪০ টি স্থানে পিরামিড রয়েছে । পিরামিডের আশ্চর্যকর গুণাবলী সম্বন্ধে বহু গবেষণা হয়েছে । যেমন ফ্রান্সের গবেষক ড. বোবসি গবেষণায় আবিষ্কার করেছেন যে, যে কোন স্থাপত্যের চেয়ে পিরামিড ও ভাস্তুশাস্ত্র সম্বলিত স্থাপত্যে; খাবার, ফুল-ফল অধিক সতেজ থাকে । এছাড়া পিরামিড আকৃতির গৃহে খাবার জল ও খাবার তাড়াতাড়ি হজম হয় এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হয় । এছাড়া আধ্যাত্মিক উন্নতির ক্ষেত্রেও পিরামিড কিংবা ভাস্তু স্থাপত্য অধিক ফলপ্রসু ।
উপরোক্ত আলোচনায় জানা গেল যে, পিরামিড মূলত বৈদিক ভাস্তু স্থাপত্য এবং এটির মূল কেন্দ্র হচ্ছে বৈদিক সভ্যতা । সুতরাং এ আলোচনা থেকে আমরা আরো বুঝতে পারি যে, বৈদিক সভ্যতা এবং বৈদিক শাস্ত্র কতটা উন্নত ও ব্যবহারিক ।
Written by:
সংকীর্তন মাধব
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন