০৩ জানুয়ারী ২০১৮

প্রসঙ্গঃ দেবতা ও ভগবানের পার্থক্য

ভগবানের সাকার স্বরূপের উপাসনা করা সর্বোত্তম বা শ্রেষ্ঠ। কিন্তু সাকার স্বরূপের যারা উপাসনা করেন তাদের মধ্যে ভগবান সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার বিভ্রান্তি-

সাধারণত হিন্দু সমাজে কিছু মানুষ দেবতা ও ভগবানের পার্থক্য জানে না। ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ, শিব, দুর্গা, কালী প্রভৃতি দেবতাদের সঙ্গে বিষ্ণু, নারায়ণ, রাম, নৃ্সিংহ, বামন প্রভৃতি ভগবানের সম পর্যায়ভুক্ত বলে মনে করে থাকেন। এটি আমাদের জানা উচিত যে ভগবান ও দেবতাদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে। যেমন- দেবতারা হচ্ছেন ভগবানের দ্বারা নিযুক্ত এ জড়জগতের বিভিন্ন কার্য সম্পাদনের নিয়ন্ত্রণ কর্তা। যে ভাবে অগ্নি দেবতা অগ্নি নিয়ন্ত্রণ করেন; বরুণদেব জলের নিয়ন্ত্রণ করেন; বায়ু দেবতা বায়ু নিয়ন্ত্রণ করেন ইত্যাদি। শাস্ত্র অনুসারে দেবতারা জীবতত্ত্ব। যে কোন জীব ভগবান থেকে বিশেষ শক্তি প্রাপ্ত হয়ে দেবতাদের আসন গ্রহণ করতে পারেন।

 কিন্তু ভগবান জীবতত্ত্ব নন, তিনি হচ্ছেন বিষ্ণু তত্ত্ব। দেবতাদের আধিপত্য এই জড়জগতে সীমাবদ্ধ, কিন্তু ভগবানের আধিপত্য বা ঐশ্বরত্বের প্রভাব জড় ও চিন্ময় জগত সর্বত্র ব্যাপ্ত। দেবতারা মানুষকে একমাত্র ভৌতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করতে পারেন, কিন্তু মুক্তি দিতে পারেন না। ভগবান জীবকে মুক্তি প্রদান করতে পারেন। দেবতারা মায়াধীন, কিন্তু ভগবান হচ্ছেন মায়াধীশ। সৃষ্টি ও প্রলয়কালে দেবতাদেরও প্রভাবিত হতে হয়, কিন্তু ভগবান নিত্য বর্তমান এবং তার ধামও নিত্য বর্তমান। এইভাবে ইন্দ্রলোক, চন্দ্রলোক প্রলয়ের সময়ে সব ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। কিন্তু ভগবানের ধাম- বৈকুণ্ঠ, অযোধ্যা, গোলক বৃন্দাবন ইত্যাদি ধ্বংস প্রাপ্ত হবে না। ইন্দ্র, চন্দ্র প্রভৃতি দেবতাগণ প্রকৃতির তিনটি গুণ দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকেন। 

কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, রাম, নারায়ণ প্রভৃতি গুণাতীত। তাদের কার্যকলাপ প্রকৃতির তিনটি গুণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। সাধারণ মানুষ এই সমস্ত পার্থক্য বুঝতে পারে না। দেবতা ও ভগবানকে এক বা সমপর্যায় বলে মনে করে থাকে। এটি অবশ্য জেনে রাখা উচিত আমাদের বৈদিক সাহিত্যে তেত্রিশ কোটি দেবতাদের বর্ণনা করা হয়েছে। শাস্ত্রানুসারে যারা বিভিন্ন জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা বিভিন্ন ফল অতি সত্ত্বর লাভ করতে চান, তারা ভিন্ন ভিন্ন দেবতাদের উপাসনা করতে পারেন। কিন্তু সেটি বুদ্ধিমান মানুষের কাজ নয়, কেননা জাগতিক ফল অনিত্য। 

যারা বুদ্ধিমান ব্যক্তি তারা ভগবানের শরণাগত হন। এভাবে সমস্ত দেবতাদেরকে ভগবান বলে উপাসনা করা ঠিক নয়। তার সঙ্গে সঙ্গে এটুকুও জানতে হবে যে দেবতাদের ভগবানের সমান না হলেও তাঁরা ভগবানের অতি নিজজন, তাঁরা পূজ্য, তাই দেবতাদের শ্রদ্ধা করা মানুষের কর্তব্য। দেবতাদের পূজা করা যেতে পারে, শ্রদ্ধা করা যেতে পারে, কিন্তু ভগবানকে ভক্তি করতে হয়। এভাবে মানুষের ভগবান ও দেবতাদের মধ্যে পার্থক্য জেনে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে ভগবানের ভক্ত হওয়া কর্তব্য। তা না হলে দুর্লভ মনুষ্য জীবনের আসল লক্ষ্যে পৌছাতে পারবে না। ভগবদ্গীতায় বর্ণনা করা হয়েছে-

যান্তি দেবব্রতা দেবান্ পিতৃন্ যান্তি পিতৃব্রতাঃ।
ভূতানি যান্তি ভূতেজ্যা যান্তি মদ্যাজিনোহপি মাম্।।
(ভঃগী ৯/২৫)

দেবতাদের উপাসনা করলে দেবলোক যাবে, পিতৃপুরুষদের উপাসনা করলে পিতৃলোক যাবে, ভূত-প্রেতের পূজা করলে ভূতলোক যাবে। কৃষ্ণের উপাসনা করলে কৃষ্ণের ধামে যাবে। দেবতাদের পূজা করে দেবলোক যাবে এবং কৃষ্ণের পূজা করে কৃষ্ণ লোক যাবে- এটার মধ্যে পার্থক্য হল- দেবলোক যাওয়ার পর পুণ্য শেষ বা ক্ষয় হলে আবার মর্ত্যলোকে ফিরে আসতে হবে। ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে-“আব্রহ্মভ

বনাল্লোকাঃ

পুনরাবর্তিনোহর্জুন” কিন্তু ভগবদ্ধামে গিয়ে ভগবানকে প্রাপ্ত হলে আর এ জড়জগতে ফিরে আসতে হবে না। “ মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে”।“যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম”। এভাবে দেখানো হয়েছে জীবনের আবর্ত থেকে অর্থাৎ বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে হলে জীবনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

জয় শ্রীকৃষ্ণ

সনাতন ধর্মের জয় হোক
(C) DN Sridip
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।