১২ এপ্রিল ২০১৫

তীর্থস্থান ও মন্দির পরিচিতি পর্ব- ০২

কাশী বিশ্বনাথ :
---------------
কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ভারতের একটি বিখ্যাত মন্দির। এটি উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বারাণসীতে অবস্থিত। মন্দিরটি গঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। কাশী বিশ্বনাথ মন্দির " জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির" নামে পরিচিত শিবের বারোটি পবিত্রতম মন্দিরের অন্যতম। মন্দিরের প্রধান দেবতা শিব "বিশ্বনাথ" বা "বিশ্বেশ্বর" নামে পূজিত হন। বারাণসী শহরের অপর নাম "কাশী" এই কারণে মন্দিরটি "কাশী বিশ্বনাথ মন্দির" নামে পরিচিত। মন্দিরের ১৫.৫ মিটার উঁচু চূড়াটি সোনায় মোড়া। তাই মন্দিরটিকে স্বর্ণমন্দিরও বলা হয়ে থাকে। পুরাণে এই মন্দিরটির উল্লেখ পাওয়া যায়। মন্দিরটি শৈবধর্মের প্রধান কেন্দ্রগুলির অন্যতম। অতীতে বহুবার এই মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পুনর্নির্মিত হয়েছে। মন্দিরের পাশে জ্ঞানবাপী মসজিদ নামে একটি মসজিদ রয়েছে। আদি মন্দিরটি এই মসজিদের জায়গাটিতেই অবস্থিত ছিল। বর্তমান মন্দিরটি ১৭৮০ সালে ইন্দোরের মহারানি অহিল্যা বাই হোলকর তৈরি করে দেন।১৯৮৩ সাল থেকে উত্তরপ্রদেশ সরকার এই মন্দিরটি পরিচালনা করে আসছেন।

স্কন্দ পুরাণের কাশীখণ্ডে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়।একাদশ শতাব্দীতে হরিচন্দ্র মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। ১১৯৪ সালে মহম্মদ ঘোরি বারাণসীর অন্যান্য মন্দিরগুলির সঙ্গে এই মন্দিরটিও ধ্বংস করে দেন। এরপরেই আবার মন্দিরটি পুনর্নির্মিত হয়। এরপর কুতুবুদ্দিন আইবক মন্দিরটি ধ্বংস করেন। আইবকের মৃত্যুর পর মন্দিরটি আবার নির্মিত হয়। ১৩৫১ সালে ফিরোজ শাহ তুঘলক মন্দিরটি আবার ধ্বংস করেন। ১৫৮৫ সালে আকবরের রাজস্ব মন্ত্রী টোডরমল আবার মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন।এরপর ১৬৬৯ সালে আওরঙ্গজেব পুনরায় মন্দিরটি ধ্বংস করে জ্ঞানবাপী মসজিদ তৈরি করান। এই মসজিদটি আজও মন্দিরের পাশে অবস্থিত। মসজিদের পিছনে পুরনো মন্দিরের কিছু ধ্বংসাবশেষ আজও দেখা যায়। বর্তমান মন্দিরটি ১৭৮০ সালে ইন্দোরের মহারানি অহিল্যা বাই হোলকর তৈরি করে দিয়েছিলেন। ১৮৩৫ সালে পাঞ্জাবের শিখ সম্রাট রঞ্জিত সিংহ মন্দিরের চূড়াটি ১০০০ কিলোগ্রাম সোনা দিয়ে মুড়ে দেন।

মন্দির চত্বরটি অনেকগুলি ছোটো ছোটো মন্দির নিয়ে গঠিত। এই মন্দিরগুলি গঙ্গার তীরে "বিশ্বনাথ গলি" নামে একটি গলিতে অবস্থিত। প্রধান মন্দিরের মধ্যে একটি ৬০ সেন্টিমিটার উঁচু ও ৯০ সেন্টিমিটার পরিধির শিবলিঙ্গ রূপার বেদির উপর স্থাপিত।ছোটো মন্দিরগুলির নাম কালভৈরব, দণ্ডপাণি, অবিমুক্তেশ্বর, বিষ্ণু, বিনায়ক, শনীশ্বর, বিরূপাক্ষ ও বিরূপাক্ষ গৌরী মন্দির। মন্দিরের মধ্যে জ্ঞানবাপী নামে একটি ছোটো কুয়ো আছে। মুসলমান আক্রমণের সময় প্রধান পুরোহিত স্বয়ং জ্যোতির্লিঙ্গটি রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সেটি নিয়ে এই কুয়োয় ঝাঁপ দিয়েছিলেন।

কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরটি পবিত্রতম মন্দিরগুলির অন্যতম। আদি শঙ্করাচার্য, রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, গোস্বামী তুলসীদাস, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, গুরু নানক প্রমুখ ধর্মনেতারা এই মন্দির দর্শনে এসেছিলেন। ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, গঙ্গায় একটি ডুব দিয়ে এই মন্দির দর্শন করলে মোক্ষ লাভ করা সম্ভব।


তথ্যসূত্র -উইকিপিডিয়া




বৈদিক প্লানেটরিয়াম মন্দির:
-----------------------------
শ্রী চৈতন্যের জন্মস্থান করেন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় মায়াপুর গ্রামে। এখানে ইসকন প্রতিষ্ঠিত চন্দ্রোদয় মন্দির আছে। এই মন্দিরের অনেক সেবক শ্বেতাঙ্গ, যারা ইউরোপ ও আমেরিকার নানা দেশ থেকে এসে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছেন । তবে যেকোনো ধর্মের মানুষ এখানে স্বাগত ।

এই মায়াপুরে নির্মিত হচ্ছে বৈদিক প্লানেটরিয়াম মন্দির (ছবি) যা ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিট্যাল বিল্ডিং এর অনুরূপ প্রায় ৩০০ফুট উঁচু ,গম্বুজ আকৃতির মন্দির - শ্রীশ্রী গৌর নিতাই মন্দির । শ্রীশ্রী রাধামাধব এবং বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীর নিত্য সেবা পূজা সম্পন্ন করার মানসে শ্রীমদ্ভাগবতে ৫ম স্কন্ধে বর্ণিত নির্দেশনা মতো অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে।

৬০মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এই বৈদিক প্লানেটরিয়াম মন্দিরের কাজ আগামী ২০১৬ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ইসকন কর্তৃপক্ষ।





সোমনাথ মন্দির:
-----------------
সোমনাথ মন্দির ভারতের একটি প্রসিদ্ধ শিব মন্দির। গুজরাট রাজ্যের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের বেরাবলের নিকটস্থ প্রভাস ক্ষেত্রে এই মন্দির অবস্থিত। শিবের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে পবিত্রতম। সোমনাথ শব্দটির অর্থ “চন্দ্র দেবতার রক্ষাকর্তা”। সোমনাথ মন্দিরটি ‘চিরন্তন পীঠ’ নামে পরিচিত। কারণ অতীতে ছয় বার ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও মন্দিরটি সত্বর পুনর্নিমিত হয়।১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে জুনাগড়ের ভারতভুক্তির সময় এই অঞ্চল পরিদর্শন করে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মন্দিরের কাজ এগিয়ে নিয়ে যান ভারত সরকারের অপর এক মন্ত্রী কে. এম. মুন্সি।হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দক্ষ প্রজাপতি কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে চন্দ্র প্রভাস তীর্থে শিবের আরাধনা করলে, শিব তাঁর অভিশাপ অংশত নির্মূল করেন। এই কারণে চন্দ্র সোমনাথে শিবের একটি স্বর্ণমন্দির নির্মাণ করেন। পরে রাবণ রৌপ্য ও কৃষ্ণ চন্দনকাষ্ঠ দ্বারা মন্দিরটি পুনর্নিমাণ করেছিলেন। গুজরাটের সোলাঙ্কি শাসক ভীমদেব মন্দিরটি নির্মাণ করেন প্রস্তরে। প্রসঙ্গত, সোলাঙ্কি ছিল ভারতের পাঁচ রাজপুত রাজ্যের অন্যতম।

সোমনাথ মন্দিরের আরাধ্য দেবতা শিব সোমেশ্বর মহাদেব নামে পরিচিত। পুরাণ অনুসারে, সত্যযুগে সোমেশ্বর মহাদেব ভৈরবেশ্বর, ত্রেতাযুগে শ্রাবণিকেশ্বর ও দ্বাপর যুগে শ্রীগলেশ্বর নামে পরিচিত ছিলেন। চন্দ্র তাঁর স্ত্রী রোহিণীর প্রতি অত্যধিক আসক্তি বশত তাঁর অন্য ছাব্বিশ স্ত্রীকে উপেক্ষা করতে থাকেন। এই ছাব্বিশ জন ছিলেন দক্ষ প্রজাপতির কন্যা। এই কারণে দক্ষ তাঁকে ক্ষয়িত হওয়ার অভিশাপ দেন। প্রভাস তীর্থে চন্দ্র শিবের আরাধনা করলে শিব তাঁর অভিশাপ অংশত নির্মূল করেন। এরপর ব্রহ্মার উপদেশে কৃতজ্ঞতাবশত চন্দ্র সোমনাথে একটি স্বর্ণ শিবমন্দির নির্মাণ করেন। পরে রাবণ রৌপ্যে, কৃষ্ণ চন্দনকাষ্ঠে এবং রাজা ভীমদেব প্রস্তরে মন্দিরটি পুনর্নিমাণ করেছিলেন।

সোমনাথের প্রথম মন্দিরটি খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকে বিদ্যমান ছিল।গুজরাটের বল্লভীর যাদব রাজারা ৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন।৭২৫ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধের আরব শাসনকর্তা জুনায়েদ তাঁর সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে এই মন্দিরটি ধ্বংস করে দেন।
তারপর ৮১৫ খ্রিস্টাব্দে গুজ্জর প্রতিহার রাজা দ্বিতীয় নাগভট্ট সোমনাথের তৃতীয় মন্দিরটি নির্মাণ করান। এই মন্দিরটি ছিল লাল বেলেপাথরে নির্মিত সুবিশাল একটি মন্দির। ১০২৪ খ্রিস্টাব্দে মামুদ গজনি আরেকবার মন্দিরটি ধ্বংস করেন।
১০২৬ থেকে ১০৪২ খ্রিস্টাব্দের মাঝে কোনো এক সময়ে গুজ্জর পরমার রাজা মালোয়ার ভোজ ও সোলাঙ্কি রাজা আনহিলওয়ারার প্রথম ভীমদেব আবার মন্দিরটি নির্মাণ করান। এই মন্দিরটি ছিল কাঠের তৈরি। কুমারপাল (রাজত্বকাল ১১৪৩-৭২) কাঠের বদলে একটি পাথরের মন্দির তৈরি করে দেন।১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সৈন্যবাহিনী পুনরায় মন্দিরটি ধ্বংস করে।
হাসান নিজামির তাজ-উল-মাসির লিখেছেন, গুজরাটের রাজা করণ পরাজিত হন, তাঁর সেনাবাহিনী পলায়ন করে, "পঞ্চাশ হাজার কাফেরকে তরবারির আঘাতে নরকে নিক্ষেপ করা হয়" এবং "বিজয়ীদের হাতে আসে কুড়ি হাজারেরও বেশি ক্রীতদাস ও অগণিত গবাদি পশু"।

১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে সৌরাষ্ট্রের চূড়াসম রাজা মহীপাল দেব আবার মন্দিরটি নির্মাণ করান। তাঁর পুত্র খেঙ্গর ১৩২৬ থেকে ১৩৫১ সালের মাঝে কোনো এক সময়ে মন্দিরে শিবলিঙ্গটি প্রতিষ্ঠা করেন।১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুলতান প্রথম মুজফফর শাহ আবার মন্দিরটি ধ্বংস করেন।মন্দিরটি পুনর্নির্মিত হলে ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুলতান মাহমুদ বেগদা আবার এটি ধ্বংস করে দেন।কিন্তু এবারও মন্দিরটি পুনর্নির্মিত হয়। ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মন্দিরটি ধ্বংস করেন।আওরঙ্গজেব সোমনাথ মন্দিরের জায়গায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদে হিন্দু শাস্ত্র-ভিত্তিক মোটিফগুলি সম্পূর্ণ ঢাকা পড়েনি।পরে ১৭৮৩ সালে পুণের পেশোয়া, নাগপুরের রাজা ভোঁসলে, কোলহাপুরের ছত্রপতি ভোঁসলে, ইন্দোরের রানি অহল্যাবাই হোলকর ও গোয়ালিয়রের শ্রীমন্ত পাতিলবুয়া সিন্ধের যৌথ প্রচেষ্টায় মন্দিরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তবে মূল মন্দিরটি মসজিদে পরিণত হওয়ায় সেই জায়গায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ধ্বংসাবশেষের পাশে।

তেরো শতকের আরব ভূগোলবিদ আসারু-ল-বিলাদ ওয়ান্ডারস অফ থিংস ক্রিয়েটেড, অ্যান্ড মার্ভেলস অফ থিংস এক্সিস্টিং বইতে লিখেছেন যে “সোমনাথ: ভারতের বিখ্যাত শহর, সমুদ্রের উপকূলে অবস্থিত এবং সমুদ্রের তরঙ্গবিধৌত। এই স্থানের বিস্ময়কর স্থানগুলির মধ্যে একটি হল এক মন্দির যেখানে সোমনাথ নামে একটি বিগ্রহ রয়েছে। বিগ্রহটি মন্দিরের মাঝখানে নিচের কোনোরকম ঠেকনা ছাড়াই উপর থেকে ঝুলে রয়েছে। হিন্দুরা এটিকে খুব শ্রদ্ধা করে। বিগ্রহটিকে ওভাবে ঝুলতে দেখে মুসলমানই হোক, আর কাফেরই হোক, সবাই আশ্চর্য হয়ে যায়। চন্দ্রগ্রহণের দিন হিন্দুরা এই মন্দিরে তীর্থ করতে আসে। সেই সময় লক্ষ লক্ষ লোক এই মন্দিরে ভিড় জমান।" “সুলতান ইয়ামিনু-দ দৌলা মাহমুদ বিন সুবুক্তিগিন ভারতের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করলেন। তিনি ভেবেছিলেন সোমনাথ ধ্বংস করে দিলেই হিন্দুদের মুসলমান করা যাবে। তাই তিনি সোমনাথ ধ্বংস করার ব্যাপারে বিশেষভাবে যত্নবান হন। এর ফলে হাজার হাজার হিন্দুকে জোর করে মুসলমান করা হয়। তিনি ৪১৬ হিজরির জিল্কাদা মাসের মাঝামাঝি সময় (১০২৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে) এসেছিলেন।
"বিহগ্রের দিকে সুলতান আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলেন। তারপর লুটের মাল নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিলেন। ধনসম্পদ তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। সেখানে সোনা ও রুপো দিয়ে তৈরি অনেক মূর্তি ছিল। রত্নখচিত অনেক পাত্র ছিল। ভারতের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সেসব জিনিস সেই মন্দিরে পাঠিয়েছিলেন। মন্দির থেকে লুণ্ঠিত দ্রব্যের মোট অর্থমূল্য ছিল কুড়ি হাজার দিনারেরও বেশি।


পশুপতিনাথ মন্দির:
--------------------
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও বিখ্যাত এই শিবমন্দির ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্যতম।এটি নেপালের প্রাচীনতম মন্দির।নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর পূর্বদিকে বাগমতি নদীর তীরে পশুপতিনাথ মন্দির অবস্থিত।শিবের আরেক নাম পশুপতি।মন্দির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে পৌরাণিক কাহিনীতে বলা হয়েছে একবার শিব ও পার্বতী কাঠমান্ডু উপত্যকায় বাগমতী নদীর তীরে বেড়াতে আসেন ।নদী ও বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে শিব পার্বতী মুগ্ধ হয়ে নিজেদের হরিণে পরিণত করে এই এলাকায় ঘুরে বেড়ানো শুরু করলেন।কিছুদিন পরেই দেবতা ও মানুষরা শিবকে খুঁজতে শুরু করলেন।বিভিন্ন ঘটনার পর দেবতারা শিবকে খুঁজে পেলেও তিনি এই স্থান ত্যাগ করতে অস্বীকার করেন।শেষ পর্যন্ত শিব ঘোষণা করলেন যেহেতু তিনি বাগমতীর তীরে হরিণ বেশে ঘুরেছেন সেহেতু তিনি এখানে পশুপতিনাথ বা পশুদের অধিকর্তা বলে পরিচিত হবেন।এই মন্দির কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা সঠিক ভাবে জানা না গেলেও চতুর্থ শতাব্দী থেকে এখানে মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল।৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে লিচ্ছবি রাজা সুপুস পদেভ এখানে একটি পাঁচ তলা মন্দির নির্মাণ করেন।একাদশ শতকে রাজা শিবদেব এই মন্দিরের সংস্কার করেন।১৭শ শতকে রাজা ভূপেন্দ্র মল্ল মন্দিরটি পুনর্নিমাণ করেন ।

প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢোকার পর একটি বিশাল প্রাঙ্গনের মাঝখানে পশুপতিনাথের মূল মন্দিরটি নেপালের প্যাগোডা রীতিতে তৈরি।কৌণিক গঠন,কাঠের কারুকার্য এ সবই নেপালের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যরীতির অংশ। মন্দিরটি চারকোণা ।একস্তর বিশিষ্ট ভিত্তিভূমির ওপর স্থাপিত মন্দিরটি ভূমি থেকে ২৩.৬ মিটার উঁচু ।মন্দিরটির সারা গায়ে সোনা ও রূপার কারুকাজ করা ।দেবদেবীর মূর্তি খোদাই করা হয়েছে মন্দিরের দেয়ালে । দু'স্তর বিশিষ্ট ছাদ তামার তৈরি তাতে সোনার প্রলেপ দেওয়া ।মন্দিরটির চারটি প্রধান দরজা । চারটি দরজাই রূপা দিয়ে মোড়া ।প্রতিটি দরজার দু'পাশে সোনা দিয়ে প্রধান দেবদেবীদের মূর্তি তৈরি করা হয়েছে ।মন্দিরের ভিতরে রয়েছে একটি পবিত্র কক্ষ ।এই চারটি মুখ পশুপতিনাথ বা শিবের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কিত চার দেব বিষ্ণু,সূর্য,পার্বতী ও গণেষের । মন্দিরের চূড়া সোনার তৈরি । পশ্চিম দরজার সামনে রয়েছে একটি বিশাল ষাঁড়ের মূর্তি যার নাম নন্দী ।নন্দী মূর্তিটি ব্রোঞ্জের তৈরি সোনার প্রলেপ দেওয়া ।মন্দিরের ছাদের নিচের দেয়ালে সপ্তদশ শতাব্দীতে কাঠের অপূর্ব কারুকার্যের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে শিব,পার্বতী,গণেষ,কুমার কার্তিক এবং যোগিনীদের মূর্তি ।

এছাড়া রয়েছে হনুমান,রাম,সীতা,লক্ষ্মণসহ রামায়ণের বিভিন্ন চরিত্র ও পুরাণের বিভিন্ন কাহিনী ও দেবদেবীর ছবি । পশুপতিনাথের প্রাঙ্গনেই রয়েছে আরো বেশ কয়েকটি প্রাচীন মন্দির ।মন্দিরের দক্ষিণে আছে ৭ম শতকে তৈরি লিচ্ছবি মন্দির চাদেশ্বর,উত্তরে রয়েছে নবম শতকে নির্মিত ব্রহ্মা মন্দির ।এছাড়া রয়েছে একাদশ শতকে নির্মিত গুহেশ্বরী মন্দির,চতুর্দশ শতকে নির্মিত রাম মন্দির ও বৈষ্ণব মন্দির। পশুপতিনাথের উত্তর-পূর্বদিকে আছে প্রাচীন বাসুকিনাথের মন্দির ।নাগ দেবতা বাসুকি পশুপতিনাথ শিবের সঙ্গী ।মূল মন্দিরে প্রবেশের আগে অনেকেই বাসুকিনাথের মন্দিরে পূজা দেন।পশুপতিনাথের মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলছে বাগমতী নদী ।পুণ্যার্থীরা এই নদীতে স্নান করেন। এজন্য নদীর দু'তীরে রয়েছে অনেক ঘাট।এর মধ্যে উনিশ শতকে প্রতিষ্ঠিত আর্য ঘাট বিশেষ গুরুত্ব বহন করে ।এ ঘাটে শুধু মাত্র নেপালের রাজপরিবারের সদস্যদের মরদেহ দাহ করা হতো । তবে ভষ্মেশ্বর ঘাটে মূল শ্মশান অবস্থিত ।এই ঘাট হলো কাঠমান্ডু উপত্যকার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শ্মশান ঘাট । নদীর তীরে গেলেই দেখা যায় সারি সারি চিতা জ্বলছে। গৌরি ঘাট হলো নারীদের স্নানের জন্য বহুল ব্যবহৃত ঘাট ।

নেপালের পশুপতিনাথ মন্দির তার অপূর্ব শৈল্পিক কারুকার্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিশ্ব বিখ্যাত । পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক পশুপতিনাথের মন্দির দেখতে যান । 




সূর্য মন্দির কোনার্ক:
---------------------

ভারতের বিখ্যাত সূর্য মন্দির কোনার্ক ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের এই সূর্য মন্দিরকে অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী ও সমৃদ্ধ ইতিহাসের জন্য ইউনেস্কো বিশ্ব সভ্যতার একটি উত্তরাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে।উড়িষ্যায় পুরী ও ভুবনেশ্বরের কাছে বঙ্গোপসাগরের বেলাভূমিতে ১৩ শ শতকে পূর্ব-গঙ্গা রাজ্যের অধিপতি মহারাজ নরসিংহ দেব সূর্য দেবতার আরাধনার জন্য এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন।এই মন্দির তার অভিনব আকার,বিশালত্ব আর কারুকার্যের জন্য ভারতের সপ্তমাশ্চর্যের অন্যতম।তামিল শব্দ কোণ আর সংস্কৃত শব্দ অর্ক মিলে কোনার্ক শব্দটির সৃষ্টি।উড়িষ্যা ও দ্রাবিড় স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে নির্মিত মন্দিরটি ধূসর বেলে পাথরে বিশাল একটি রথের আকারে গড়া হয়েছে।সমুদ্র থেকে উঠে আসা সূর্যদেবের বিশাল রথ,তার সামনে রয়েছে সাত জোড়া ঘোড়া।বারো জোড়া বিশাল চাকার ওপর পুরো মন্দিরটি নির্মিত।চাকার কারুকার্য দর্শকদের জন্য একটি প্রধান আকর্ষণ।প্রতিটি চাকা একেকটি সূর্যঘড়ি।চাকার ভেতরের দাঁড়গুলো সূর্যঘড়ির সময়ের কাঁটা।এখনো নিখুঁতভাবে সময় জানা যায় এই সূর্যঘড়ির সাহায্যে।মন্দিরের প্রবেশ পথেই রয়েছে বিশাল দুটি সিংহের মূর্তি যারা লড়াই করছে দুটি রণহস্তীর সঙ্গে।মন্দিরের বেদী থেকে শুরু করে চূড়া পর্যন্ত
প্রতি ইঞ্চি জায়গায় পাথরের ভাস্কর্য ও
কারুকার্য রয়েছে ।
দেবতা,অপ্সরা,কিন্নর,যক্ষ,গন্ধর্ব,নাগ,মানুষ,বিভি
ন্ন প্রাণী,পৌরাণিক বিভিন্ন ঘটনার
প্রতিরূপ,নৃত্যরত নরনারী,প্রেমিক
যুগল,রাজদরবারের বিভিন্ন দৃশ্য,শিকারের দৃশ্য
ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পাথরের বুকে ।মূর্তিগুলোর
মানবিক আবেদন,নিখুঁত গড়ন,লীলায়িত
ভঙ্গী শিল্পকলার চরম উত্‍কর্ষের নিদর্শন ।
কলিঙ্গ রীতিতে নির্মিত মন্দিরের
চূড়াগুলো পিরামিড আকৃতির।মন্দিরের
সামনে রয়েছে নাটমন্ডপ ।এখানে একসময়
দেবদাসীরা দেবতার উদ্দেশ্যে পূজানৃত্য পরিবেশন
করতেন ।মন্দিরের
ভিতরে রয়েছে নাটমন্দির,ভোগমন্দির ও গর্ভগৃহ।
মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৮৫৭ ফুট ।
তবে মন্দিরের অনেক অংশ এখন
বালিতে দেবে গেছে । মন্দিরের দেয়াল এখনো ২০০
ফুট উঁচু।
মন্দিরে সূর্যদেবতার যে বিশাল বিগ্রহ ছিল
তা এখন নেই ।কালের করাল গ্রাসে স্থাপনার অনেকটাই আজ
ধ্বংসপ্রাপ্ত ।কথিত আছে যে বাংলার সুলতান
সুলেমান খান কারানির সেনাপতি কালাপাহাড়ের
আক্রমণে কোনার্ক মন্দির প্রথম ধ্বংসপ্রাপ্ত
হয় ।উড়িষ্যার ইতিহাস অনুযায়ী কালাপাহাড়
১৫০৮ সালে কোনার্ক আক্রমণ করে ।
১৬২৬ সালে খুরদার তত্কালীন রাজা পুরুষোত্তম
দেবের পুত্র নরশিমা দেব সূর্যদেবের
বিগ্রহটি পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে নিয়ে যান ।
সেখানে একটি পৃথক মন্দিরে সূর্য ও চন্দ্র দেবতার বিগ্রহ স্থাপন করা হয় । শুধু বিগ্রহই নয় তিনি কোনার্ক মন্দির থেকে কারুকার্য করা অনেক পাথর পুরীর মন্দিরে নিয়ে যান। এমনকি নবগ্রহ পথ নামে একটি বিশাল প্রস্তর খন্ডও তিনি পুরীতে নিয়ে যান ।মারাঠা শাসনামলে কোনার্ক মন্দির থেকে অনেক ভাস্কর্য ও প্রস্তরখন্ড পুরীতে নিয়ে যাওয়া হয় । ১৭৭৯ সালে কোনার্ক থেকে অরুণ কুম্ভ নামে বিশাল একটি স্তম্ভ নিয়ে পুরীর সিংহদ্বারের সামনে স্থাপন করা হয় । এই সময় মারাঠা প্রশাসন কোনার্কের নাট মন্ডপটি অপ্রয়োজনীয় মনে করে ভেঙ্গে ফেলে ।সূর্যদেবের বিগ্রহ অপসারণের পর
কোনার্কে পূজা ও আরতি বন্ধ হয়ে যায় । পর্তুগীজ জলদস্যুদের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে কোনার্ক বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয় ।

আঠারশ' শতক নাগাদ কোনার্ক মন্দির তার সকল গৌরব হারিয়ে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে ।মন্দিরের অনেক অংশ বালির নিচে চাপা পড়ে যায় ।মন্দির চত্বর ও এর আশেপাশের এলাকা ধীরে ধীরে ঘন অরণ্যে ছেয়ে যায় ।বুনো জন্তুরা বাসা বাঁধে মন্দিরের ভিতর ।জলদস্যু ও ডাকাতের আস্তানায় পরিণত হয় কোনার্ক মন্দির । সেসময় দিনের আলোতেও সাধারণ মানুষ ভয়ে এর ত্রিসীমানায় যেত না। বিংশ শতাব্দীতে প্রত্নতত্ববিদরা কোনার্ক মন্দির পুনরাবিষ্কার করেন। খননের ফলে লোকচক্ষুর সামনে উন্মোচিত হয়।

কোনার্ক মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্য শৈলী,বিষ্ময়কর ভাস্কর্যকীর্তি ও অনন্য শিল্প সম্ভার।কোনার্ক মন্দিরের অনেক শিল্প কীর্তি এখন সূর্য মন্দির জাদুঘর ও উড়িষ্যার জাতীয় জাদুঘরে রয়েছে।প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী কোনার্কের সূর্য মন্দির দেখতে আসেন। প্রাচীন ভারতীয় স্থপতি ও ভাস্করদের শিল্পনৈপুণ্য ও সৃষ্টিশীলতা আজও মানুষকে বিস্ময় বিমুগ্ধ করে।


সৌজন্যেঃ রথযাত্রা
 
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।