প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে যে মৌলিক প্রভেদ দেখা যায় , তা হল - প্রাচ্যবাসীরা অন্তর্জগতের অনুসন্ধানে তাঁদের অধিকাংশ শক্তি ব্যয় করেছেন । প্রাচীন ভারতবর্ষ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রভুত উন্নতি সাধন করা সত্ত্বেও সেগুলোকে ' অপরা বিদ্যা ' বলে চিহ্নিত করে ' পরা বিদ্যা ' অর্থাৎ অন্তর্জগতের সন্ধানে আত্মনিয়োগ করেছিল । অন্তর্জগত-সন্ধানী ঋষিরা ক্রমশঃ এই দৃশ্যমান জগতের অবাস্তবতা অনুধাবন করলেন । এই দৃশ্যমান জগৎ পরিবর্তনশীল , আর যা পরিবর্তনশীল তা নিত্য বা পরম ( absolute ) হতে পারেনা । বিষয়টি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের relativity তত্ত্বের সাথে তুলনীয় । জগতের ঘটনাগুলি নির্দিষ্ট frame of reference এর সাপেক্ষেই সত্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে । frame of reference বদলে গেলেই তা অন্যভাবে প্রতিভাত হবে । আমাদের ঋষিগণ খুঁজতে চেয়েছেন এই পরিবর্তনশীল অনিত্যতার পিছনে কি সেই নিত্যবস্তু , যাকে পরম সত্য (absolute truth) বলে নির্দেশ করা যাবে ? এই সন্ধানই ভারতে অধ্যাত্মবিদ্যার জন্ম দিয়েছে । অপরপক্ষে পাশ্চাত্য দেশের মানুষ জড়জগতের রহস্যভেদ করতে গিয়ে জড়বিজ্ঞানে ক্রমশঃ পারদর্শী হয়ে উঠেছে । পাশ্চাত্য সভ্যতা তাই বহির্মুখী এবং প্রাচ্য তথা ভারতীয় সভ্যতা অন্তর্মুখী । ভারতের বেদান্তবাদী ঋষিরা এই ভ্রমাত্মক দৃশ্যমান জড়জগৎকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে দৃশ্যমান জড়জগতের কারণ স্বরূপ যে absolute সত্ত্বার সন্ধান পেয়েছেন, তাকে তাঁরা ' সদ্ - চিৎ - আনন্দ ' - এই নামে অভিহিত করলেন । ' সদ্ ' , অর্থাৎ সত্য স্বরূপ বা নিত্য , ' চিৎ', অর্থাৎ চৈতন্য বা জ্ঞানস্বরূপ এবং 'আনন্দ', অর্থাৎ প্রেমস্বরূপ । এই ' সদ্ - চিৎ - আনন্দ ' কে 'ব্রহ্ম' নামেও অভিহিত করা হয় । 'ব্রহ্ম'ই পরম ( absolute ) , 'ব্রহ্ম' ছাড়া প্রকৃতপক্ষে আর কোনকিছুরই অস্তিত্ব নেই । ব্রহ্মের যেটুকুতে 'সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়' নামক এই পরিবর্তনশীল জগতের ভ্রম সাধিত হচ্ছে , বেদান্ত তাকেই নির্দেশ করল - 'ঈশ্বর' বা 'ভগবান' নামে । ঈশ্বর হলেন এই পরিবর্তনশীল জগৎ চক্রের কেন্দ্র স্বরূপ , আবার তিনিই পরিবর্তনশীল জগৎ রূপে নিজেকে অভিব্যক্ত করছেন । সুতরাং দেখা গেল - ভ্রমাত্মক দৃষ্টিতে যা বহুত্বময় জগৎ , জ্ঞানদৃষ্টিতে তাই ঈশ্বর ।জগৎকে এই ভ্রমাত্মক দৃষ্টিতে দেখার ফলে আমরা নিজেদেরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলেছি । '' আমার থেকে অমুক আলাদা '' -এটা ভ্রমাত্মক দৃষ্টির উপলব্ধি । জ্ঞানদৃষ্টিতে আমরা সকলেই একই পরমসত্তা - ঈশ্বরের প্রকাশ । আমাদের এই প্রকৃত 'আমিত্বের' সন্ধান পেয়েছিলেন প্রাচীন ভারতবর্ষের আর্য ঋষিগণ তাঁদের সাধনার মধ্যে দিয়ে । জন্ম হয়েছিল বিশ্বের প্রাচীনতম আধ্যাত্মিক দর্শনের । পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যখন অজ্ঞানের মোহনিদ্রায় আচ্ছন্ন , সেই সুপ্রাচীন অতীতে হিমালয় শিখরে ধ্বনিত হয়েছিল - '' শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্যপুত্রাঃ । আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থু ।। বেদাহমেতাং পুরুষং মহান্তম্ । আদিত্য বর্ণং তমসো পরস্তাৎ ।। ত্বমেব বিদিত্বাহতি মৃত্যুমেতি । নান্যং পন্থা বিদ্যতেহনায় ।। '' এই আমাদের সনাতন চেতনা - সনাতন ধর্ম , যার বর্তমান প্রচলিত নাম ' হিন্দু ধর্ম ' । বিশ্বে এমন কোনও ধর্মমত নেই যার মূল ভাব সনাতন ধর্মে নেই । সুতরাং ঐতিহাসিক বিচারে সনাতন হিন্দুধর্ম সকল ধর্মের উৎস । যুগে যুগে এই ধর্মের রক্ষার্থে যুগপুরুষগণ আবির্ভূত হন , তাঁদের পুণ্য প্রভাবে সনাতন ধর্ম নতুন ভাবে নতুন শক্তিতে জেগে ওঠে । এই ধর্ম তাই চিরন্তন , আর যা চিরন্তন তাই তো শাশ্বত বা সনাতন ।হিন্দু ঋষিগণ ধর্মপথ নির্দেশের সময় মানুষের রুচি ও ক্ষমতার ভিন্নতার কথা চিন্তা করেছেন , তাই মূর্তি পূজা থেকে শুরু করে নিরাকার ব্রহ্ম উপাসনা পর্যন্ত সবই হিন্দু ধর্মে স্বীকৃত হয়েছে । বিভিন্ন মাপের মানুষের জন্য একই মাপের পোশাক এই ধর্ম দেয়না । হিন্দুরা নিজ নিজ রুচি ও ক্ষমতার স্তর অনুযায়ী নিজের উপযুক্ত সাধন পদ্ধতি বেছে নিতে পারেন । উদ্দেশ্য সবারই এক , এবং তা হল - আত্ম জ্ঞান , অর্থাৎ স্ব-স্বরূপ কে জানা ।হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন সাধন পথ গুলিকে মুখ্যতঃ চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে । এগুলি হল জ্ঞান যোগ , কর্ম যোগ , ভক্তি যোগ ও রাজ যোগ ।
জ্ঞান যোগে আত্ম বিশ্লেষণ এবং ' শ্রবণ , মনন ও নিদিধ্যাসনের ' দ্বারা ' নেতি নেতি ' বিচারের মাধ্যমে সাধক লক্ষ্যে উপনীত হন । আচার্য শঙ্কর এই সাধনা প্রচার করেছেন ।
কর্ম যোগে নিষ্কাম কর্ম দ্বারা সকাম কর্ম বন্ধন কেটে সাধক লক্ষ্যে উপনীত হন । ভগবান শ্রী কৃষ্ণ অর্জুন কে কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে কর্মযোগে উদ্দীপ্ত করেছেন ।
ভক্তিযোগে প্রেমের বন্ধনে ভক্ত সাধক ঈশ্বরকে ধরার চেষ্টা করেন । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্য ( মহাপ্রভু ) এই ভাবের প্রচার করেছেন ।
রাজযোগে ধ্যান , প্রাণায়াম প্রভৃতি শারীরিক ও মানসিক প্রক্রিয়ার দ্বারা সাধক স্ব-স্বরূপ লাভ করেন । মহর্ষি পতঞ্জলি এই সাধন পদ্ধতি প্রচার করেছেন ।
"পুতুল পূজা করে না হিন্দু কাঠ মাটি দিয়ে গড়া মৃন্ময়ি মাঝে চিন্ময়ি হেরী হয়ে যাই আত্মহারা" স্বামী বিবেকানন্দের এই কথার মানে বুঝতে পারলে মূর্তিপূজার মানে বোঝা যায়। হিন্দু ধর্মে অজস্র স্তর আছে । প্রতিমা পুজা একটি নিম্নস্তর । সাধারণ মানুষের ধারণা মন দ্বারা সীমায়িত , তাই অনন্তের কল্পনা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব । যার কোনও আকার নেই , তার কোনও সীমা নেই । কোনও ধর্মের মানুষই প্রাথমিক ভাবে সীমাহীন অনন্তের ধারণা করতে পারেনা ।মুসলিমরা পশ্চিম দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে কেন ? কারণ পশ্চিম দিকে মক্কা নামক এক সীমায়িত স্থানে তাদের ঈশ্বরের প্রতীক আছে । অনন্তের ভাব অবলম্বন করতে সক্ষম হলে তাদের আর বিশেষ দিকনির্দেশের দরকার পড়তোনা । কারণ অনন্ত যিনি তিনি তো সর্ব দিকে সমভাবে বিরাজমান । খৃস্টানরা ক্রস বুকে ঝুলিয়ে ঘোরে কেন ? ওটাও একটি প্রতীক যাকে তারা পবিত্র ঈশ্বরের সাথে যুক্ত করেছে । হিন্দুরা মানব মনের এই সীমাবদ্ধতার কথা জানে , কিন্তু অন্যদের মতো এটাকে এড়িয়ে যায়না । তাই '' নির্বিকল্প - নিরাকার - সচ্চিদানন্দঘন '' ঈশ্বরীয় সত্তার প্রথম আবিষ্কারক হয়েও হিন্দু ঋষিরা মূর্তি পূজার প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করেননি । কোথায় ছিল এইসব সমালোচকদের ধর্ম , যখন আমাদের ঋষিরা এই নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেছেন ? জগতের সমস্ত ঈশ্বরীয় মতবাদই হিন্দুদের কাছ থেকে ধার করা । সুদুর অতীতে সমগ্র জগত যখন অজ্ঞানের আদিম অন্ধকারে ঘুমাচ্ছে তখন ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মই আলোকবর্তিকা রূপে মানুষকে এই নিরাকার , অব্যক্ত , সচ্চিদানন্দের দিকে আকৃষ্ট করেছিল ।হিন্দুরা কখনোই প্রতিমাকেই ঈশ্বর মনে করে না। হাস্যকর হলেও সত্য, যারা প্রতিমা ভাংচুর করে তারা প্রতিমাকেই হিন্দুদের ভগবান মনে করে ভাংচুর চালায়। হিন্দুরা মূর্তিকে ঈশ্বরের প্রতীক হিসেবে উপাসনা করে এবং পূজা শেষে জলে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়, কারণ হিন্দুরা জানে প্রতিমা কাঠ-খড়-মাটি ছাড়া কিছু নয়। মূর্তির জীবন আছে -এরকম কখনোই ভাবে না; ভাবে তারাই, যারা মূর্তি ভাংচুর করে। ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর আর দুঃখজনকও বটে। (চুপি চুপি বলে রাখি, কোন কোন ধর্মের শাস্ত্রে বলা হয়েছে, মূর্তিপূজকদের আর তাদের মূর্তিগুলোকেও নরকের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। মূর্তিগুলোও নাকি যন্ত্রণায় চিত্কার করবে মূর্তিপূজকদের সাথে!!! হিঃ হিঃ হিঃ খিক্ খিক্।)
কৃতজ্ঞতাঃ
তাপস ঘোষ দাদা এবং মানিক রক্ষিত দাদা
- See more at: http://bangalihindupost.blogspot.in/2012/05/blog-post_17.html#sthash.ix7YWmS0.dpuf
জ্ঞান যোগে আত্ম বিশ্লেষণ এবং ' শ্রবণ , মনন ও নিদিধ্যাসনের ' দ্বারা ' নেতি নেতি ' বিচারের মাধ্যমে সাধক লক্ষ্যে উপনীত হন । আচার্য শঙ্কর এই সাধনা প্রচার করেছেন ।
কর্ম যোগে নিষ্কাম কর্ম দ্বারা সকাম কর্ম বন্ধন কেটে সাধক লক্ষ্যে উপনীত হন । ভগবান শ্রী কৃষ্ণ অর্জুন কে কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে কর্মযোগে উদ্দীপ্ত করেছেন ।
ভক্তিযোগে প্রেমের বন্ধনে ভক্ত সাধক ঈশ্বরকে ধরার চেষ্টা করেন । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্য ( মহাপ্রভু ) এই ভাবের প্রচার করেছেন ।
রাজযোগে ধ্যান , প্রাণায়াম প্রভৃতি শারীরিক ও মানসিক প্রক্রিয়ার দ্বারা সাধক স্ব-স্বরূপ লাভ করেন । মহর্ষি পতঞ্জলি এই সাধন পদ্ধতি প্রচার করেছেন ।
"পুতুল পূজা করে না হিন্দু কাঠ মাটি দিয়ে গড়া মৃন্ময়ি মাঝে চিন্ময়ি হেরী হয়ে যাই আত্মহারা" স্বামী বিবেকানন্দের এই কথার মানে বুঝতে পারলে মূর্তিপূজার মানে বোঝা যায়। হিন্দু ধর্মে অজস্র স্তর আছে । প্রতিমা পুজা একটি নিম্নস্তর । সাধারণ মানুষের ধারণা মন দ্বারা সীমায়িত , তাই অনন্তের কল্পনা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব । যার কোনও আকার নেই , তার কোনও সীমা নেই । কোনও ধর্মের মানুষই প্রাথমিক ভাবে সীমাহীন অনন্তের ধারণা করতে পারেনা ।মুসলিমরা পশ্চিম দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে কেন ? কারণ পশ্চিম দিকে মক্কা নামক এক সীমায়িত স্থানে তাদের ঈশ্বরের প্রতীক আছে । অনন্তের ভাব অবলম্বন করতে সক্ষম হলে তাদের আর বিশেষ দিকনির্দেশের দরকার পড়তোনা । কারণ অনন্ত যিনি তিনি তো সর্ব দিকে সমভাবে বিরাজমান । খৃস্টানরা ক্রস বুকে ঝুলিয়ে ঘোরে কেন ? ওটাও একটি প্রতীক যাকে তারা পবিত্র ঈশ্বরের সাথে যুক্ত করেছে । হিন্দুরা মানব মনের এই সীমাবদ্ধতার কথা জানে , কিন্তু অন্যদের মতো এটাকে এড়িয়ে যায়না । তাই '' নির্বিকল্প - নিরাকার - সচ্চিদানন্দঘন '' ঈশ্বরীয় সত্তার প্রথম আবিষ্কারক হয়েও হিন্দু ঋষিরা মূর্তি পূজার প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করেননি । কোথায় ছিল এইসব সমালোচকদের ধর্ম , যখন আমাদের ঋষিরা এই নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেছেন ? জগতের সমস্ত ঈশ্বরীয় মতবাদই হিন্দুদের কাছ থেকে ধার করা । সুদুর অতীতে সমগ্র জগত যখন অজ্ঞানের আদিম অন্ধকারে ঘুমাচ্ছে তখন ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মই আলোকবর্তিকা রূপে মানুষকে এই নিরাকার , অব্যক্ত , সচ্চিদানন্দের দিকে আকৃষ্ট করেছিল ।হিন্দুরা কখনোই প্রতিমাকেই ঈশ্বর মনে করে না। হাস্যকর হলেও সত্য, যারা প্রতিমা ভাংচুর করে তারা প্রতিমাকেই হিন্দুদের ভগবান মনে করে ভাংচুর চালায়। হিন্দুরা মূর্তিকে ঈশ্বরের প্রতীক হিসেবে উপাসনা করে এবং পূজা শেষে জলে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়, কারণ হিন্দুরা জানে প্রতিমা কাঠ-খড়-মাটি ছাড়া কিছু নয়। মূর্তির জীবন আছে -এরকম কখনোই ভাবে না; ভাবে তারাই, যারা মূর্তি ভাংচুর করে। ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর আর দুঃখজনকও বটে। (চুপি চুপি বলে রাখি, কোন কোন ধর্মের শাস্ত্রে বলা হয়েছে, মূর্তিপূজকদের আর তাদের মূর্তিগুলোকেও নরকের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। মূর্তিগুলোও নাকি যন্ত্রণায় চিত্কার করবে মূর্তিপূজকদের সাথে!!! হিঃ হিঃ হিঃ খিক্ খিক্।)
কৃতজ্ঞতাঃ
তাপস ঘোষ দাদা এবং মানিক রক্ষিত দাদা
- See more at: http://bangalihindupost.blogspot.in/2012/05/blog-post_17.html#sthash.ix7YWmS0.dpuf
1 Comments:
Hare Krishna,Nice Post
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন