০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪

আধুনিক বিজ্ঞান ও সনাতন হিন্দু ধর্ম – তাপস ঘোষ, কলকাতা।


সনাতনধর্মের ( প্রকৃত হিন্দু ধর্মের ) প্রাচীন মুনি ঋষি গণ এবং তাঁদের উত্তরসূরি হিন্দু সাধক গণ তাঁদের সাধনার মধ্যে দিয়ে বহুত্বময় এই জগতের কারণ স্বরূপ এক , অখণ্ড , অনন্ত চৈতন্যকে ( consciousness ) উপলব্ধি করেছেন । এই চিৎ সত্তা বা চৈতন্যকেই তাঁরা জগতের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ রূপে চিহ্নিত করেছেন । জগতের ভিত্তি স্বরূপ এই অখণ্ড অনন্ত চৈতন্যকেই ঈশ্বর বলা হয় ।


বেদের উপমা অনুযায়ী বলা যায় , মাকড়সা নিজদেহ থেকে জাল উৎপন্ন করে স্বয়ং সেই জালে অবস্থান করে । এখানে জালের উপাদান হল মাকড়সার দেহ , কাজেই মাকড়সাই জালের উপাদান কারণ । আবার মাকড়সা নিজেই জাল তৈরী করেছে তাই জালের নিমিত্ত-কারণও ( কর্মের কর্তা ) মাকড়সা । ঠিক তেমনই চৈতন্য স্বরূপ ঈশ্বর এই জগতের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ দুইই ।
হিন্দু দর্শন ঈশ্বরের বিশেষণ হিসাবে ‘ সচ্চিদানন্দ ‘ শব্দটি প্রয়োগ করে । সচ্চিদানন্দ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে আমরা সৎ ( শাশ্বত বা সনাতন ) , চিৎ ( চেতনা বা জ্ঞানময়তা ) এবং আনন্দ ( প্রেমময়তা ) এই শব্দ গুলি পাই । এই শাশ্বত চৈতন্যময় সত্তাই জগৎ কারণ ঈশ্বর ।জগতের সবকিছুর মুল উপাদান হওয়ায় তিনি আমাদের সকলের আত্মস্বরূপ বা ‘ আত্মা ‘ ( self ) । হিন্দু শাস্ত্রে এই চৈতন্যময় সত্তাকে ‘ আত্মা ‘ নামেও অভিহিত করা হয় । এই আত্মাই জগত রূপে প্রতিভাত হচ্ছেন ।
শ্রী ভগবান গীতায় শিক্ষা দিচ্ছেন , ” সমং সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্তং পরমেশ্বরম্ ।/ বিনশ্বৎস্ববিনশ্যন্তং যঃ পশ্যতি স পশ্যতি।। / সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্ । / ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্ ।। / ” ( গীতা – ১৩ /২৮-২৯ )
অর্থাৎ, বিনাশশীল সর্বভূতে অবিনাশী ঈশ্বরকে যিনি সমভাবে দেখেন তিনিই যথার্থ দর্শন করেন ; কারণ সর্বত্র সমভাবে সেই ঈশ্বর অবস্থিত দেখে সেই সমদর্শী আর কাউকে হিংসা করতে পারেননা । সেইজন্য তিনি পরম গতি প্রাপ্ত হন ।
আমাদের উপনিষদে এই জাগতিক সবকিছুর স্বরূপ হিসাবে সেই অনন্ত চৈতন্যময় ঈশ্বরকেই চিহ্নিত করা হয়েছে । ” ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত বা কুমারী । / ত্বং জীর্ণো দন্ডেন বঞ্চসি ত্বং জাতো ভবসি – বিশ্বতোমুখঃ ।। / ( শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪/৩) অর্থাৎ তুমি স্ত্রী , তুমি পুরুষ , তুমি কুমার , তুমি কুমারী , তুমি বৃদ্ধ – দণ্ডহস্তে ভ্রমণ করছ , তুমি জাত হয়ে নানা রূপ ধারণ করেছ ।
সুতরাং দেখাযাচ্ছে হিন্দুধর্ম তত্ত্ব অনুযায়ী এই বহুত্ব পূর্ণ জগতের পিছনে একত্ব রয়েছে । এবং জগতের ভিত্তি স্বরূপ সেই একত্ব হল অখণ্ড চৈতন্য বা ঈশ্বর ।
আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান quantum potential ভিত্তিক holistic approach দ্বারা জগতের এই একত্বের দিকে , এই স্বরূপতঃ অখণ্ডতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে । বিজ্ঞানী ডেভিড বোহম্ , বিজ্ঞানী বেসিল হিলি প্রমুখ বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানীর গবেষণা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য । বিজ্ঞানী বোহম্ পরীক্ষা করে প্রমাণ করেছেন Bell’s Theorem কে , যা জগতের এক ও অখণ্ড সত্তার কথা বলে । এই তত্ত্ব অনুসারে বিশ্বের সবকিছু যুক্ত আছে unbroken wholeness এর সঙ্গে ।
আমাদের বেদান্ত দর্শনে জগতের কারণ স্বরূপ নিত্যমুক্ত অখণ্ড চৈতন্যের কথা বলা হয় । আধুনিক বিজ্ঞানীগণ নিত্যমুক্ত অখণ্ড চৈতন্য ( consciousness )কে মূল হিসাবে ধরে জীবের individual চৈতন্যের ব্যাখ্যা করতে চাইছেন । বিজ্ঞানের এই নতুন পদক্ষেপকে বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী অমিত গোস্বামী চিহ্নিত করেছেন ‘ monistic ontological approach ‘ নামে । এই monistic ontological approach আসলে চৈতন্যের বিজ্ঞান ( science within consciousness ) যা অধ্যাত্ম সাধকের তুরীয় অনুভূতির সমর্থক ।
হাজার হাজার বছর আগে ভারতীয় ঋষি গণ তাঁদের অধ্যাত্ম গবেষণার ফলাফল রেখে গেছেন বেদ নামক পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থে । বেদান্ত বা উপনিষদ হল এই বেদেরই সারভাগ বা নির্যাস । এই যুক্তি ও প্রত্যক্ষ অনুভূতি নির্ভর অধ্যাত্মতত্ত্বের উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সনাতন হিন্দু ধর্ম । বর্তমান জড় বিজ্ঞানও ভিন্ন পথে এগিয়ে চলেছে একই সত্যের দিকে । বিজ্ঞানের এই অগ্রগতি এখনও শেষ হয়নি । হয়তো এমন দিন আসতে চলেছে যেদিন জড় বিজ্ঞানীরা তাঁদের ভাষায় তাঁদের মতো করে ঘোষণা করবেন , ” শৃন্বতু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ । / আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূঃ ।। / বেদাহমেতাং পুরুষং মহান্তম্/ আদিত্য বর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ । / তমেব বিদিত্বাহতিমৃত্যুমেতি / নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহনায় ।। / ” {শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (২/৫ ও ৩/৮ ) }
— ” হে দিব্যধামবাসী অমৃতের সন্তানগণ তোমরা শ্রবণ কর , আমি পথ খুঁজে পেয়েছি । যিনি সকল অন্ধকারের পারে , তাকে জানলেই মৃত্যুকে অতিক্রম করা যায় । 
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।