শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬ – ১৫৩৪) ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী এবং ষোড়শ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক। তিনি অধুনাপশ্চিমবঙ্গের নদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণাবতার মনে করেন। শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য ছিলেন ভাগবত পুরাণ ওভগবদ্গীতা-য় উল্লিখিত দর্শনের ভিত্তিতে সৃষ্ট বৈষ্ণব ভক্তিযোগ মতবাদের একজন বিশিষ্ট প্রবক্তা। তিনি বিশেষত রাধা ও কৃষ্ণ রূপে ঈশ্বরের পূজা প্রচার করেন এবং হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রটি জনপ্রিয় করে তোলেন। সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষাষ্টক নামক প্রসিদ্ধ স্তোত্রটিও তাঁরই রচনা। গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতানুসারে, ভাগবত পুরাণের শেষের দিকের শ্লোকগুলিতে রাধারানির ভাবকান্তি সংবলিত শ্রীকৃষ্ণের চৈতন্য রূপে অবতার গ্রহণের কথা বর্ণিত হয়েছে।[
চৈতন্য মহাপ্রভুর পূর্বাশ্রমের নাম গৌরাঙ্গ বা নিমাই। তাঁর গাত্রবর্ণ স্বর্ণালি আভাযুক্ত ছিল বলে তাঁকে গৌরাঙ্গ বা গৌর নামে অভিহিত করা হত। অন্যদিকে নিম বৃক্ষের নিচে জন্ম বলে তাঁর নামকরণ হয়েছিল নিমাই। ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী সাহিত্য বাংলা সন্তজীবনী ধারায় এক নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়েছিল। সেযুগে একাধিক কবি চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করে গিয়েছেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর চৈতন্য চরিতামৃত, বৃন্দাবন দাস ঠাকুরের চৈতন্য ভাগবত এবং লোচন দাস ঠাকুরের চৈতন্যমঙ্গল।
চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি দোলপূর্ণিমার রাত্রে চন্দ্রগ্রহণের সময় নদিয়ার মায়াপুরে চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম। তাঁর পিতামাতা ছিলেন অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার অন্তর্গত নবদ্বীপের অধিবাসী জগন্নাথ মিশ্র ও শচী দেবী। চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ওড়িশার জাজপুরের আদি বাসিন্দা। তাঁর পিতামহ মধুকর মিশ্র ওড়িশা থেকে বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেন।
চৈতন্যদেবের পিতৃদত্ত নাম ছিল বিশ্বম্ভর মিশ্র। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন স্বনামধন্য পণ্ডিত। তর্কশাস্ত্রে নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিতের খ্যাতি ছিল অবিসংবাদিত। জপ ও কৃষ্ণের নাম কীর্তনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ যে ছেলেবেলা থেকেই বজায় ছিল, তা জানা যায় তাঁর জীবনের নানা কাহিনি থেকে। কিন্তু তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয় ছিল সংস্কৃত গ্রন্থাদি পাঠ ও জ্ঞানার্জন। পিতার মৃত্যুর পর গয়ায় পিণ্ডদানকরতে গিয়ে নিমাই তাঁর গুরু ঈশ্বর পুরীর সাক্ষাৎ পান। ঈশ্বর পুরীর নিকট তিনি গোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত হন। এই ঘটনা নিমাইয়ের পরবর্তী জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর পণ্ডিত থেকে ভক্ত রূপে তাঁর অপ্রত্যাশিত মন পরিবর্তন দেখে অদ্বৈত আচার্যের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় বৈষ্ণব সমাজ আশ্চর্য হয়ে যান। অনতিবিলম্বে নিমাই নদিয়ার বৈষ্ণব সমাজের এক অগ্রণী নেতায় পরিণত হন।
কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষিত হওয়ার পর নিমাই শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি জন্মভূমি বাংলা ত্যাগ করে কয়েক বছর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান পর্যটন করেন। এই সময় তিনি অবিরত কৃষ্ণনাম জপ করতেন। জীবনের শেষ চব্বিশ বছর তিনি অতিবাহিত করেন জগন্নাথধাম পুরীতে। ওড়িশার সূর্যবংশীয় হিন্দু সম্রাট গজপতি মহারাজা প্রতাপরুদ্র দেব শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে ভগবান কৃষ্ণের সাক্ষাৎ অবতার মনে করতেন। মহারাজা প্রতাপরুদ্র চৈতন্যদেব ও তাঁর সংকীর্তন দলের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিলেন। ভক্তদের মতে, জীবনের শেষপর্বে চৈতন্যদেব ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতেন এবং অধিকাংশ সময়েই ভাবসমাধিস্থ থাকতেন।
গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মতে, চৈতন্য মহাপ্রভু ঈশ্বরের তিনটি পৃথক পৃথক রূপের আধার: প্রথমত, তিনি কৃষ্ণের ভক্ত; দ্বিতীয়ত, তিনি কৃষ্ণভক্তির প্রবক্তা; এবং তৃতীয়ত, তিনি রাধিকার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ কৃষ্ণের স্বরূপ। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত চৈতন্য জীবনীগ্রন্থগুলির বর্ণনা অনুসারে, তিনি একাধিকবার অদ্বৈত আচার্য ও নিত্যানন্দ প্রভুকে কৃষ্ণের মতো বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন