স্বামী বিবেকানন্দ (১২ জানুয়ারি, ১৮৬৩ – ৪ জুলাই, ১৯০২) (পূর্বাশ্রমের নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত[২]) ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ হিন্দু ধর্মগুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য এবং রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা।[৩] স্বামী বিবেকানন্দ ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেদান্ত ও যোগশাস্ত্রের প্রচার ও প্রসারে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।[৩] ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে হিন্দুধর্মকে বিশ্বজনীন ধর্মের স্তরে উন্নীত করা তথা সর্বধর্মসমন্বয় চেতনার বিস্তারে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।[৪] আধুনিক ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণের প্রধান চালিকাশক্তি ছিলেন বিবেকানন্দ।[৫] তাঁর সর্বাধিক খ্যাতি ১৮৯৩ সালে বিশ্বধর্ম মহাসভায়[২] “আমেরিকান ভ্রাতা ও ভগিনী”দের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত[৬][৭] তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতাটির মাধ্যমে পাশ্চাত্য সমাজে হিন্দুধর্মের পরিচিতি প্রদানে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
১৮৬৩ সালে কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম। তাঁর চিন্তা-চেতনার অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর যুক্তিবাদী পিতা ও ধর্মপ্রাণা জননী। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মপিপাসা ও গভীর ঈশ্বরানুরাগ লক্ষিত হত। ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছেন এমন এক ব্যক্তির সন্ধানে বেরিয়ে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসের সান্নিধ্যে আসেন এবং পরে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে অদ্বৈত বেদান্তের শিক্ষা দেন। তাঁর কাছ থেকেই বিবেকানন্দ শেখেন যে সব ধর্মই সত্য এবং মানুষের সেবাই সর্বোৎকৃষ্ট ঈশ্বরোপাসনা। গুরুর মৃত্যুর পর সন্ন্যাস অবলম্বন করে তিনি সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ পদব্রজে পর্যটন করেন। পরবর্তীকালে শিকাগো যাত্রা করে ১৮৯৩ সালের বিশ্বধর্ম মহাসভায় হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ফোরাম, বিশ্ববিদ্যালয় ও সংঘ তাঁর বাগ্মীতায় মুগ্ধ হয়ে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণ জানান। একাধিক সাধারণ ও ব্যক্তিগত সভায় ভাষণ দিয়ে তিনি আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও আরও কয়েকটি দেশে বেদান্ত, যোগশাস্ত্র ও হিন্দুধর্মকে সুপরিচিত করে তোলেন। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে তিনি স্থাপন করেন বেদান্ত সোসাইটি। ভারতে প্রত্যাবর্তন করে ১৮৯৩ সালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন নামে একটি মানবকল্যাণমূলক আধ্যাত্মিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। স্বামী বিবেকানন্দ ভারতে অন্যতম জাতি-স্রষ্টারূপে পরিগণিত হন। তাঁর শিক্ষা মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু, অরবিন্দ ঘোষ, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন প্রমুখ একাধিক জাতীয় নেতা ও দার্শনিককে প্রভাবিত করেছিল।[২][৫][৮
বংশ-পরিচয়
স্বামী বিবেকানন্দের মা ভুবনেশ্বরী দেবী (১৮৪১-১৯১১)
বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “আমার জ্ঞানের বিকাশের জন্য আমি আমার মায়ের কাছে ঋণী।”[৯]
স্বামী বিবেকানন্দ এক কায়স্থ দত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই দত্ত-পরিবারের আদি নিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার অন্তর্গত দত্ত-ডেরিয়াটোনা বা দত্ত-ডেরেটোনা গ্রামে। দত্ত-পরিবার মুঘল আমল থেকে ওই গ্রামে বাস করছিলেন। তাঁরাই ওই গ্রামের জমিদার ছিলেন বলে অনুমিত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে দত্ত-পরিবারের রামনিধি দত্ত তাঁর ছেলে রামজীবন দত্ত ও নাতি রামসুন্দর দত্তকে নিয়ে গড়-গোবিন্দপুর (অধুনা কলকাতা ময়দান-ফোর্ট উইলিয়াম অঞ্চল) গ্রামে চলে আসেন। এখানে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু হলে এলাকার অন্যান্য বাসিন্দাদের সঙ্গে দত্তরাও চলে আসেন সুতানুটিতে (অধুনা উত্তর কলকাতা)। সেখানে তাঁরা প্রথমে মধু রায়ের গলিতে একটি বাড়ি তৈরি করেন। রামসুন্দরের বড়ো ছেলে রামমোহন দত্ত ৩ নং গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িটি নির্মাণ করেন। এই বাড়িতেই পরে স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম হয়। রামসুন্দরের বড়ো ছেলে দুর্গাপ্রসাদ ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের ঠাকুরদা। তিনি তাঁর একমাত্র ছেলে বিশ্বনাথ দত্তের জন্মের পরই সন্ন্যাস অবলম্বন করে গৃহত্যাগ করেছিলেন। বিশ্বনাথ দত্ত দুর্গাপ্রসাদের ছোট ভাই কালীপ্রসাদ কর্তৃক প্রতিপালিত হন। কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাটর্নি হিসেবে তিনি সারা ভারতে সুনাম অর্জন করেছিলেন। বিশ্বনাথ দত্ত ইংরেজি, বাংলা, ফারসি, আরবি, উর্দু, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষা শিখেছিলেন। ইতিহাস পাঠে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি সুলোচনা (১৮৮০) ও শিষ্ঠাচার-পদ্ধতি (বাংলা ও হিন্দি ভাষায়, ১৮৮২) নামে দুটি বইও রচনা করেছিলেন। ধর্মবিষয়ে বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন উদার। বাইবেল ও দেওয়ান-ই-হাফিজ তাঁর প্রিয় বই ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবাবিবাহ আন্দোলনকেও তিনি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন। দুর্গাপ্রসাদের সংসারত্যাগের পর কালীপ্রসাদের অমিতব্যয়িতায় দত্ত-পরিবারের আর্থিক সাচ্ছল্য নষ্ট হয়েছিল। কিন্তু অ্যাটর্নিরূপে বিশ্বনাথ দত্তের সুদূর-প্রসারিত খ্যাতি সেই সাচ্ছল্য কিয়দংশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।[১০] তাঁর স্ত্রী ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন সিমলার নন্দলাল বসু মেয়ে। তিনি বিশেষ ভক্তিমতী নারী ছিলেন। তাঁর প্রথম কয়েকটি সন্তানের মৃত্যু ও কন্যাসন্তানের জন্মের পর পুত্রসন্তান কামনায় তিনি তাঁর এক কাশীবাসিনী আত্মীয়াকে দিয়ে কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরে নিত্য পূজা দেওয়ার ব্যবস্থা করান। এরপরই স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম হওয়ায় তাঁর বিশ্বাস হয় যে, তিনি শিবের কৃপায় পুত্রলাভ করেছেন।[১১]
জন্ম ও বাল্যজীবন
৩ নং গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট, কলকাতা। এই বাড়িতেই নরেন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে বাড়িটি রামকৃষ্ণ মিশনের অন্যতম কেন্দ্র।
১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি (বাংলা ১২৬৯ সালের ২৯ পৌষ), সোমবার, মকর সংক্রান্তির দিন সকাল ৬টা ৪৯ মিনিটে[১২] কলকাতার সিমলা অঞ্চলের ৩ নং গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে[১৩] স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম।[১১] তাঁর নামকরণ করা হয় নরেন্দ্রনাথ দত্ত।[১৪] পিতার যুক্তিবাদী মন ও জননীর ধর্মীয় চেতনা স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তা ও ব্যক্তিত্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।[৮] প্রথম জীবনেই পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানের সহিত তাঁর পরিচিতি ঘটেছিল। এই কারণে অকাট্য প্রমাণ ও ব্যবহারিক পরীক্ষা ছাড়া কোনো বক্তব্যই তিনি গ্রহণ করতেন না। অন্যদিকে অতি অল্পবয়সেই ধ্যান ও বৈরাগ্যের আধ্যাত্মিক আদর্শের প্রতি তাঁর মন আকৃষ্ট হয়।[৮] নরেন্দ্রনাথের বাল্যশিক্ষার সূচনা ঘটে স্বগৃহেই। ১৮৭১ সালে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন এবং ১৮৭৯ সালে প্রবেশিকা (এন্ট্রান্স) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।[১৫] দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ ও পাণ্ডিত্য।[১৬] বেদ, উপনিষদ, ভাগবত গীতা, রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের প্রতিও তাঁর আগ্রহের কথা সুবিদিত। কণ্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীত – শাস্ত্রীয় সংগীতের উভয় শাখাতেই তাঁর বিশেষ পারদর্শীতা ছিল। বাল্যকাল থেকেই খেলাধুলা, শারীরিক ব্যায়াম ও অন্যান্য সংগঠনমূলক কাজকর্মেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন।[১৬] অতি অল্পবয়সেই বিভিন্ন কুসংস্কার এবং ধর্ম ও বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্য বিচারের যুক্তিগ্রাহ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।[১৭]
নরেন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক বিকাশে তাঁর মায়ের ভূমিকাটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী জীবনে তিনি তাঁর মায়ের একটি কথা বারংবার উদ্ধৃত করতেন, সারা জীবন পবিত্র থাকো, নিজের সম্মান রক্ষা কোরো, অন্যের সম্মানে আঘাত কোরো না। কোমল হও, কিন্তু প্রয়োজনবোধে নিজের হৃদয়কে শক্ত রেখো[১৪] কথিত আছে, নরেন্দ্রনাথ ছিলেন ধ্যানসিদ্ধ; ঘুমের মধ্যে তিনি এক জ্যোতি দর্শন করতেন ও ধ্যানের সময় বুদ্ধের দর্শন পেতেন।[১৮
কলেজে ও ব্রাহ্মসমাজে
১৮৮০ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রথম বর্ষের কলা বিভাগে ভর্তি হন নরেন্দ্রনাথ। পরের বছর তিনি চলে যান স্কটিশ চার্চ কলেজে। এই সময়েই তিনি অধ্যয়ন করেন পাশ্চাত্য যুক্তিবিজ্ঞান, পাশ্চাত্য দর্শন ও ইউরোপীয় জাতিসমূহের ইতিহাস।[১৭] ১৮৮১ সালে এফ.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৮৮৪ সালে ব্যাচেলর অফ আর্টস ডিগ্রি লাভ করেন।[১৯][২০] তাঁর অধ্যাপকদের মতে, নরেন্দ্রনাথ ছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভাসম্পন্ন ছাত্র। স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যক্ষ উইলিয়াম হেস্টি তাঁর সম্পর্কে লেখেন, “নরেন্দ্র ছিল সত্যকারের প্রতিভাবান। আমি বহু দেশ ভ্রমণ করেছি; এই ছেলেটির মধ্যে মেধা ও সম্ভাবনার যে সাক্ষর দেখি তা আমি কারোর মধ্যে পাইনি, এমনকি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দর্শন বিভাগীয় ছাত্রদের মধ্যেও না।” (“Narendra is really a genius. I have travelled far and wide but I have never come across a lad of his talents and possibilities, even in German universities, among philosophical students.”)[২১] তিনি ছিলেন একজন শ্রুতিধর, অর্থাৎ অসামান্য স্মৃতিশক্তির অধিকারী ব্যক্তি।[২২][২৩] কথিত আছে, তাঁর সঙ্গে এক আলোচনার পর ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার বলেছিলেন, “আমি ভাবতেও পারিনি, এই রকম একটি বাচ্চা ছেলে এত কিছু পড়েছে।”[২৪]
ছেলেবেলা থেকে আধ্যাত্মিকতা, ঈশ্বরোপলব্ধি ও সর্বোচ্চ অধ্যাত্ম সত্যের উপলব্ধির জন্য তাঁর ব্যাকুলতা দৃষ্ট হয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ধর্মীয় ও দার্শনিক ধ্যান-ধারণা নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সেযুগের এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন ব্রাহ্মসমাজের সংস্পর্শে আসেন এবং ব্রাহ্মসমাজের একেশ্বরবাদ, অপৌত্তলিকতা ও সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার চেতনার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন।[২৫] এই সময়ে ব্রাহ্মসমাজের দুই সর্বোচ্চ নেতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে সাক্ষাত করে তাঁদের কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন। কিন্তু কোনো সদুত্তর পান না।[২৬][২৭]
কথিত আছে, নরেন্দ্রনাথ ডেভিড হিউম, ইমানুয়েল কান্ট, জোহান গটলিব ফিচ, বারুখ স্পিনোজা, গেয়র্গ ভিলহেল্ম হেগল, আর্থার সোফেনহয়্যার, ওগুস্ত কোঁত, হারবার্ট স্পেনসার, জন স্টুয়ার্ট মিল ও চার্লস ডারউইন প্রমুখের রচনাবলি অধ্যয়ন করেছিলেন।[২১][২৮] হারবার্ট স্পেনসারের বিবর্তনবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি নিজের প্রকাশক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের জন্য স্পেনসারের এডুকেশন (Education) নামক গ্রন্থখানি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। কিছুকাল তাঁর সঙ্গে হারবার্ট স্পেনসারের পত্রালাপও হয়।[২৯][৩০] পাশ্চাত্য দার্শনিকদের রচনা অধ্যয়নের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভারতীয় সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ তথা বহু বাংলা গ্রন্থও অধ্যয়ন করেছিলেন।[২৮]
অধ্যক্ষ হেস্টি সাহিত্যের এক ক্লাসে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের দি এক্সকার্সন (The Excursion) কবিতাটির আলোচনাকালে কবির প্রাকৃতিক-ভাবতন্ময়তার (nature-mysticism) বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে রামকৃষ্ণ পরমহংসের উল্লেখ করলে নরেন্দ্রনাথ প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণের কথা জানতে পারেন।[৩১] কবিতায় ব্যবহৃত trance শব্দটির অর্থ বোঝাতে গিয়ে হেস্টি তাঁর ছাত্রদের বলেন যে এই শব্দটির প্রকৃত অর্থ জানতে হলে তাদের দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যেতে হবে। এতে তাঁর কয়েকজন ছাত্র উদ্বুদ্ধ হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনে যান। তাঁদের মধ্যে নরেন্দ্রনাথ ছিলেন অন্যতম।[৩২][৩৩]
শ্রীরামকৃষ্ণ সমীপে রামকৃষ্ণ পরমহংস
“ঠাকুরের ঐদিনকার অদ্ভুত স্পর্শে মুহূর্তমধ্যে ভাবান্তর উপস্থিত হইল। স্তম্ভিত হইয়া সত্য সত্যই দেখিতে লাগিলাম, ঈশ্বর ভিন্ন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অন্য কিছুই আর নাই!… যখন প্রকৃতিস্থ হইলাম, তখন ভাবিলাম উহাই অদ্বৈতবিজ্ঞানের আভাস! তবে তো শাস্ত্রে ঐ বিষয়ে যাহা লেখা আছে, তাহা মিথ্যা নহে! তদবধি অদ্বৈততত্ত্বের উপরে আর কখনও সন্দিহান হইতে পারি নাই।”[৩৪][৩৫] ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত নরেন্দ্রনাথের জীবনের ধারাটিকে পরিবর্তিত করে দেয়।[৩৬] এই সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গে নরেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “তাঁহাকে [রামকৃষ্ণ] একজন সাধারণ লোকের মতো বোধ হইল, কিছু অসাধারণত্ব দেখিলাম না। অতি সরল ভাষায় তিনি কথা কহিতেছিলেন, আমি ভাবিলাম, এ ব্যক্তি কি একজন বড় ধর্মাচার্য হইতে পারেন? আমি সারা জীবন অপরকে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছি, তাঁহার নিকটে গিয়া তাঁহাকেও সেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মহাশয়, আপনি কি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন?’ তিনি উত্তর দিলেন- ‘হাঁ।’ ‘মহাশয়, আপনি কি তাঁহার অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারেন?’ ‘হাঁ’। ‘কি প্রমাণ? ‘ ‘আমি তোমাকে যেমন আমার সম্মুখে দেখিতেছি, তাঁহাকেও ঠিক সেইরূপ দেখি, বরং আরও স্পষ্টতর, আরও উজ্জ্বলতররূপে দেখি।’ আমি একেবারে মুগ্ধ হইলাম। [...] আমি দিনের পর দিন এই ব্যক্তির নিকট যাইতে লাগিলাম। [...] ধর্ম যে দেওয়া যাইতে পারে, তাহা আমি বাস্তবিক প্রত্যক্ষ করিলাম। একবার স্পর্শে, একবার দৃষ্টিতে একটা সমগ্র জীবন পরিবর্তিত হইতে পারে। আমি এইরূপ ব্যাপার বারবার হইতে দেখিয়াছি।”[৩৬][৩৭]
যদিও প্রথমে নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণকে নিজের গুরু রূপে স্বীকার করতে সম্মত ছিলেন না। তিনি তাঁর ধ্যানধারণার বিরুদ্ধের প্রায়শই বিদ্রোহ প্রকাশ করতেন। তবু শ্রীরামকৃষ্ণের ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে বার বার তাঁর দর্শনে ছুটে যেতেন।[৩৮] প্রথম দিকে শ্রীরামকৃষ্ণের তুরীয় আনন্দের ভাব ও দর্শনকে কেবলমাত্র মনগড়া কল্পনা বলে মনে করতেন।[৮] [৩৯] ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হিসেবে তিনি মূর্তিপূজা ও বহুদেববাদের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন কালীর উপাসক।[৪০] অদ্বৈত বেদান্ততত্ত্বকেও নরেন্দ্রনাথ নাস্তিকতা ও পাগলামি বলে উড়িয়ে দিতেন; এবং মাঝে মাঝেই তা নিয়ে উপহাস করতেন।[৩৯]
শ্রীরামকৃষ্ণের ধ্যানধারণা গ্রহণ করতে না পারলেও নরেন্দ্রনাথ তা উড়িয়ে দিতে পারতেন না। কোনো মত গ্রহণ করার আগে তা যাচাই করে নেওয়াই ছিল নরেন্দ্রনাথের স্বভাব। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে পরীক্ষা করেন। শ্রীরামকৃষ্ণও কোনোদিন তাঁকে যুক্তিবর্জনের পরামর্শ দেননি। তিনি ধৈর্য সহকারে নরেন্দ্রনাথের তর্ক ও পরীক্ষার সম্মুখীন হন এবং তাঁকে সকল দৃষ্টিকোণ থেকেই সত্য পরীক্ষা করতে বলেন।[৩৮] পাঁচ বছর শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে থেকে নরেন্দ্রনাথ এক অশান্ত, বিভ্রান্ত, অধৈর্য যুবক থেকে এক পরিণত ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হন। ঈশ্বরোপলব্ধির জন্য তিনি সর্বস্ব ত্যাগে স্বীকৃত হন এবং শ্রীরামকৃষ্ণকে নিজের গুরু রূপে স্বীকার করে নিয়ে গুরুর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেন।[৩৮]
১৮৮৫ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ গলার ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এই সময় তাঁকে কলকাতার কাশীপুরে স্থানান্তরিত করা হয়। জীবনের অন্তিম পর্বে বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরুভ্রাতাগণ তাঁর সেবাসুশ্রুষা করেছিলেন। এখানেই শ্রীরামকৃষ্ণের তত্ত্বাবধানে তাঁদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা চলে। কথিত আছে, কাশীপুরেই বিবেকানন্দ নির্বিকল্প সমাধির অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন।[৪১] শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের শেষ পর্বে বিবেকানন্দ ও তাঁর কয়েকজন গুরুভ্রাতা গুরুর নিকট থেকে সন্ন্যাসীর গৈরিক বস্ত্র লাভ করেছিলেন। যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম রামকৃষ্ণ সংঘ।[৪২] গুরুর নিকট থেকে বিবেকানন্দ এই শিক্ষাই পান যে মানবসেবাই সর্বাপেক্ষা কার্যকরী ঈশ্বরোপাসনা।[৮][৪৩] কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণের অবতারত্ব নিয়ে বিবেকানন্দের মনে সন্দেহের উদ্রেক হলে শ্রীরামকৃষ্ণ ঘোষণা করেছিলেন, “যে রাম, যে কৃষ্ণ, সে-ই রামকৃষ্ণ… “[৪৪] শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অবর্তমানে নিজের শিষ্যদের দেখাশোনার দায়িত্ব দেন বিবেকানন্দের উপর, এবং তাঁর শিষ্যদেরও বিবেকানন্দকে নেতা বলে স্বীকার করতে বলেন।[৪৫] দীর্ঘ অসুস্থতার পর ১৮৮৬ সালের ১৬ অগস্ট অতিপ্রত্যুষে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে রামকৃষ্ণ পরমহংসের মহাপ্রয়াণ ঘটে। তাঁর শিষ্যদের মতে, এ ছিল তাঁর মহাসমাধি।[৪৫]
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন