০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪

ঈশ্বর ও দেবীদুর্গা – ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য



হিন্দু শাস্ত্র মতে, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। আর তাই তিনি ইচ্ছে করলেই যে কোনো সময়ে কোনো কাজ সম্পাদন করতে পারেন এবং ইচ্ছে করলেই যে কোনো সময় যে কোনো রূপও ধারণ করতে পারেন। তার নিরাকার রূপের নাম ব্রহ্ম; আর সাকার রূপের নাম দেবতা। ঈশ্বরের নিরাকার রূপটি নির্দিষ্ট হলেও সাকার রূপ অনির্দিষ্ট। মানুষের জ্ঞাত, অজ্ঞাত যে কোনো রূপ ধারণ করার ক্ষমতা তার আছে বলেই এই রূপটি নির্দিষ্ট নয়। অবশ্য সবসময় যে তার রূপ নিজের ইচ্ছের ওপরই নির্ভরশীল; এমন নয়। ভক্তের ইচ্ছের ওপরও অনেক সময় এই রূপ নির্ভর করে। অর্থাৎ কোনো মানুষ যদি ভক্তির সঙ্গে যে কোনো বাস্তব, অবাস্তব, কাল্পনিক কিংবা অন্য কোনো রূপে তাকে আরাধনা করে; তবে সেই রূপেরও তিনি তাকে কৃপা করতে পারেন। ঈশ্বরের রূপ তাই মুখ্য নয়; ভক্ত কোন আকৃতিতে তাকে আরাধনা করল এটা কোনো বিষয় নয়; তার ভক্তি, শ্রদ্ধা ও উদ্দেশ্যই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।
ঈশ্বরের সঙ্গে হিন্দুদের মূলত প্রেমের সম্পর্ক বিদ্যমান। এই প্রেমের একটি দাস্য প্রেম; অন্যটি বাৎস প্রেম। অর্থাৎ হিন্দুদের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্কের এটি প্রভু-দাস রূপ; অন্যটি মাতৃ-সন্তানরূপ। নিজেদের দাস ভাবে ভাবিত করে ঈশ্বরের (শ্রীকৃষ্ণ) প্রেমে বিভোর হওয়া এক ধরনের সাধনা। আবার নিজেদের সন্তান রূপে সজ্জিত করে ঈশ্বরকে মায়ের আসনে স্থান দেয়া (দুর্গা); অন্য আর এক ধরনের উপাসনা। দুই স্থলেই গভীর প্রেম ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে। কোন প্রেমের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি; তা অবশ্য বলা দুষ্কর। তবে যে প্রেমই বড় হোক না কেন; বাঙালি এখন দুই ভাবেই তাকে ভজনা করে। অবশ্য নিজেকে প্রেমিকা হিসেবে (রাধা) কল্পনা করে; ঈশ্বরকে (কৃষ্ণ) প্রেমিক হিসেবে আরাধনা করার চিত্রও বাংলায় দুর্লক্ষ নয়। মধ্যযুগে এ ধরনের আরাধনা চিত্রই বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে।
ঈশ্বরের মাতৃ রূপের নাম দুর্গা। তিনি দুর্গতি নাশ করেন বলে দুর্গা; আবার দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছেন বলেও দুর্গা। অবশ্য তিনি মহিষাসুরকে সংহার করেছেন বলে মহিষাসুর মর্দিনী এবং জগতের সব শক্তি ও মায়ার আধার বলে মহামায়া-মহাশক্তি। বিভিন্ন গুণ ও রূপের ওপর ভিত্তি করে অবশ্য তাকে চণ্ডী, কালী, তারা, কাত্যায়নী, উমা প্রভৃতি নামেও করা হয় সম্বোধন। তবে রূপ তার যতই বৈচিত্র্যময় হোক না কেন; দুর্গার মূল পরিচয় শক্তি দেবী হিসেবে। তিনি ঈশ্বরের শক্তির প্রতীক। বিশ্বের সব শক্তির উৎস হিসেবে তাকে কল্পনা করা হয়। আর তাই ক্রেতা যুগে অবতার রামচন্দ্র রাবণ বধের আগে এই দেবীর পূজা সম্পাদন করেছিলেন। শুধু তাই নয়; দ্বাপর যুগে অবতার কৃষ্ণও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অব্যবহতি পূর্বে অর্জুনকে দুর্গার আরাধনা করার জন্য দিয়েছিলেন পরামর্শ (দ্রঃ মহাভারত-ভীষ্মপর্ব)।
পুরাকালে দশদিক থেকে শক্তি সংগ্রহ করে মহিষাসুর নামক এক মহাপরাক্রমশালী দৈত্যকে দেবী দুর্গা পরাস্ত করেন। উল্লেখ্য, মহিষাসুর ঈশ্বরের একসময়কার পরম ভক্ত। কঠোর তপস্যা দ্বারা তিনি কোনো একসময় স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করেছিলেন। তবে আনন্দিত স্রষ্টা যখন তাকে প্রসন্ন চিত্তে কিছু বর নিতে আগ্রহী হলেন; তখন মহিষাসুর কেবল অমরত্বের চর চাইলেন। অন্য বর কামনার জন্য বার বার অনুরোধ করার পরও মহিষাসুর যখন তার সিদ্ধান্তে রইলেন অটল; তখন সৃষ্টিকর্তা তাকে সেই বর দিয়ে দিলেন। কিন্তু এই বর প্রাপ্তির পরই মহিষাসুরের চেহারা গেল পাল্টে। তিনি ত্রিভুবনের অধীশ্বর হয়ে সর্বপ্রকার সুখ ও ভোগের মালিক হওয়ার জন্য শুরু করে দিলেন ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা। তার এই নিষ্ঠুরতা এমন একটা পর্যায়ে গেল যে, দেবতারাও হলেন স্বর্গচ্যুত।
স্বর্গচ্যুত দেবতারা এতে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন এবং তাদের ক্রোধরাশি থেকে তৈরি হতে থাকল তেজদীপ্ত মহাশক্তি। এ মহাশক্তি আর কিছুই নয়; এই শক্তিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত শক্তি; সব দেবতার সম্মিলিত শক্তি; নারী রূপধারিণী মাতৃস্বরূপা দেবীদুর্গা। জগতের সব শক্তি একত্রভাবে সঞ্চিত হয়েই দেবীদুর্গা রূপে আসে মহিষাসুর দমনে।
কিন্তু মহিষাসুর তো অমর; অজেয়। তাকে কীভাবে সংহার করা যায়? দেবতারা স্রষ্টা (ব্রহ্মা) প্রদত্ত খানিক নিরীক্ষা করলেন এবং এরই ফাঁক নির্ণয় করে দুর্গার হাতে তুলে দিলেন অস্ত্র। দেবীদুর্গা অস্ত্র হাতে পেয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন; ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুর ওপর। কিন্তু অশুভ শক্তি বহুরূপী। বার বার সে রূপ পাল্টায়। তাকে চিহ্নিত করাই এক সময় দুর্গার জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও তিনি মহাশক্তি; বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হলেও একসময় ঠিকই তিনি শত্রুকে চিহ্নিত করতে পারেন এবং পদানত করে তার বক্ষে বসিয়ে দেন শূল।
তবে দেবতার (ব্রহ্ম) বর একেবারে বিফলেও গেল না। আসুরিক শক্তি সবসময়ই রয়ে গেল জগতে। ভালোর সঙ্গে মন্দ কাজও চলতে থাকল তার নির্দিষ্ট গতিতেই। অবশ্য শূল বিদ্ধ অসুরের পক্ষে যেমন যুদ্ধ জয় করা অসম্ভব; তেমনি শুভশক্তির পদানত অবস্থায় অশুভ শক্তির চূড়ান্ত বিজয় লাভ করাও দুষ্কর। আসুরিক তাই শূল বিদ্ধ অবস্থাতেই দুর্গার পদতলে রয়ে গেল চিরকাল।
পৌরাণিক কাহিনী বরাবরই প্রতীক ও রূপকধর্মী। এসব কাহিনীর সত্যতা-অসত্যতায় তাই কিছু আসে যায় না। কাহিনীর সভ্যতার চেয়ে এর অভ্যন্তরীণ তাৎপর্য বা ব্যঞ্জনাই মানুষের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ থেকেই মানুষ নিজেকে তৈরি করতে শেখে এবং তার কর্তব্য করতে পারে নির্ধারণ। এতদ্ব্যতীত ঈশ্বর যেহেতু উপনিষদে ভক্তকে যে কোনো রূপে তার উপাসনা করার দিয়েছেন অনুমতি এবং বেদে যেহেতু বলা হয়েছে দেবতার কোনো ইতর-বিশেষ নেই, অর্থাৎ আকৃতি কিংবা বয়সের ভিন্নতা সত্ত্বেও সব দেবতাই যেহেতু সমান, তাই দশ হাত ও ত্রিনয়নারূপী এই দেবীকে ঈশ্বর হিসেবেই ভক্তগণ করে থাকে উপাসনা ভক্তি।
বস্তুত মায়ের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক অচ্ছেদ্য; সব প্রিয় বস্তুকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করা তার চিরন্তন স্বভাব। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির মতো ঈশ্বরকেও বহু আগে থেকেই একদল মানুষ তাই মায়ের চোখে প্রত্যক্ষ করে আসছেন। এ যুগেও ঘটেনি এর ব্যত্যয়। জগন্মাতা দেবীদুর্গা আজও বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বড় আশ্রয়। মহাশক্তি দেবী দুর্গার পূজা আজ অবধি তাই বাঙালি হিন্দুর সর্বাপেক্ষা বড় উৎসব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাকিপ্রবি, সিলেট
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।