একদা সেই দক্ষিণেশ্বরের ছোট্ট ঘরটিতে বসে শ্রীরামকৃষ্ণ যুবক নরেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “হ্যাঁরে, তুই কি চাস?” যুবক বেশ উদ্ধত ভাবেই উত্তর দিলেন, “আমি সমাধিতে ডুবে থাকতে চাই”। কথা শুনে শ্রীরামকৃষ্ণের মন ভরল না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ভাবশিষ্যকে মৃদু তিরস্কার করে বললেন, “বলিস কি রে? এই তুই সবচেয়ে বড় মনে করলি? আমি ভেবেছিলাম তুই একটা বড় মহীরুহ হবি আর তার তলায় শ্রান্ত পথিকেরা এসে আশ্রয় পাবে, শান্তি ও বিশ্রাম লাভ করবে, তা না হয়ে তুই-ও নিজের মুক্তির কামনা করছিস?” নরেন্দ্রনাথ চমকে উঠলেন। কিন্তু বেদবাক্যগুলির গভীর তাৎপর্য তখন তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। পরে গুরুদেবের দেহত্যাগের পর পরিব্রাজক বেশে যখন তিনি তৎকালীন ভারতের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে অবহিত হলেন তখনই বুঝতে শুরু করলেন। তিনি অনুধাবন করলেন, অতীব গৌরবোজ্জ্বল ভারতবর্ষ কতগুলি বদ্ধমূল ধারণা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। দেশের লোকসকল ধর্ম ধর্ম করে পরস্পর হৃদয়বত্তাকে আরও সংকীর্ণতা ও নিগূঢ় অনুশাসনে বেঁধে ফেলেছে। সর্বত্র দারিদ্রের প্রতাপ। শিক্ষার অভাব। চিন্তাধারার মধ্যেও সামাজিক ন্যায় ও গণতন্ত্রের কোনও অস্তিত্ব নেই। এ কী ভারতবর্ষ তিনি দেখছেন? যেখানে মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে কেবল বিভেদের প্রাচীর। অস্পৃশ্যতার বাড়বাড়ন্ত। এ সব দেখেশুনে গভীর বেদনায় ব্যথিত হয়ে উঠলেন জ্যোতি-তনয় বিবেকানন্দ। ফলে সন্ন্যাসীর আত্মমগ্নতা থেকে নেমে এলেন তিনি কঠিন বাস্তবতায়। দেশ ও জাতিকে আরও গভীর ভাবে চেনার জন্য আতিথ্য গ্রহণ করলেন রাজার প্রাসাদ থেকে দরিদ্রের কুটিরে। আরও আরও প্রত্যক্ষ করলেন দুঃখ, দারিদ্র, বন্ধন ও অজ্ঞতার গভীর অন্ধকার। শুনলেন নৈরাশ্য নিপীড়িত লক্ষ লক্ষ ভারত সন্তানের করুণ আর্তনাদ। ভারতবর্ষের এই বর্তমান দৈন্যরূপ তাঁর চিত্তকে দলিত মথিত করে তুলল।
আর সেই অস্থিরতার প্রশমনে ভারতের শেষ শিলাখণ্ডে ধ্যানমগ্ন হলেন নবযুগের ঋষি বিবেকানন্দ। তাঁর অন্তরমন ধ্যানের গভীরে প্রবেশ করেই উপলব্ধি করল অখণ্ড গৌরবোজ্জ্বল ভারতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রূপ। এই সম্যক দর্শনে তিনি বুঝলেন, এই দেশের ঘোর অবনতির জন্য দায়ী প্রাণহীন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, জনসাধারণকে উপেক্ষা এবং নারীজাতিকে অবমাননা। তাই ভারতকে উঠতে হলে প্রয়োজন স্বচ্ছ বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা যা ভারতের ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সমন্বয়সাধন করেই গড়ে উঠতে পারে। আর সেই সঙ্গে প্রয়োজন স্বদেশবাসীর দারিদ্র দুঃখ লাঞ্ছনা মোচনের জন্য কিছু করা এবং নারীজাতিকে তাঁর স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করা। তিনি এক্ষণে আরও উপলব্ধি করলেন শ্রীরামকৃষ্ণের অবতরণের মুখ্য উদ্দেশ্য হল, মানুষের দুঃখ দূর করা, মূর্খ-দরিদ্র-বঞ্চিত-শোষিত-নিপীড়িত-লাঞ্ছিত মানুষের সর্বাত্মক চেতনার জাগরণ ঘটানো, নরের মধ্যে নারায়ণকে দেখা জীবকে শিবজ্ঞানে সেবা করা।
স্বামীজি গুরুর এই আদর্শকে কার্যত এর পর থেকে প্রচার করতে ও কর্মে রূপ দিতে যত্নবান হলেন। ফলে, তিনি প্রথমেই হিন্দুর হাজার হাজার বছরের যে ধর্ম আকাঙ্ক্ষায় মানুষ ও সমাজকে অস্বীকার করে বিদ্যমান ছিল তার মূলে কুঠারাঘাত করলেন। তিনি বললেন, “নিজের মুক্তি চাস যে জাহান্নমে যাবি। সকলের মুক্তি কামনাই হল যথার্থ সন্ন্যাসের লক্ষণ।” সেই সঙ্গে সন্ন্যাস ধর্মের সামাজিকীকরণের কথা ঘোষণা করে বললেন, “বৃহৎ সংখ্যক মানুষ যদি ক্ষুধা, পীড়া ও অজ্ঞানের দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে, সে ক্ষেত্রে কয়েক জন ব্যক্তি মানুষ যদি ঊর্ধ্বায়িত জীবনের আকাঙ্ক্ষা করে তা শুধু স্বার্থপরতার নয়, চরম পাপও। প্রয়োজন হল ব্যক্তির জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে শত শত লোকের কল্যাণ এবং এ ভাবে দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতি।” তাঁর দৃঢ় মত হল, যত দিন জগতে একজনও বদ্ধ থাকবে, অজ্ঞানে আচ্ছন্ন থাকবে, আমি নিজের মুক্তি চাই না। আমি বারবার জন্মগ্রহণ করে তাদের কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করব। পরবর্তী কালে আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর বেলুড়ে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ সংঘ’ গঠন করে তাঁর মূল আদর্শবাণী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করলেন এই একটিই মহামন্ত্র ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ আত্মার মুক্তি ও জগতের কল্যাণ যা হল এই সংঘের মূল মন্ত্র।
বস্তুত স্বামীজি ছিলেন বিশ্ব আচার্য বা লোকশিক্ষক। তাঁকে কোনও বিশ্বের ধর্ম বা গোষ্ঠী নিজের বলে দাবি করতে পারেন না। তিনি মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্যই জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আর অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই আত্মমুক্তিকামী সাধারণ মানুষ থেকে পরিণত হয়েছিলেন মহান দেশপ্রেমিকে, সমাজ সংস্কারক ও জগৎ কল্যাণের ভূমিকায়। তিনি নিজে যেমন ছিলেন সৎ ও অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর, তেমন ভাবেই প্রত্যেক ভারতবাসীকে গঠন করতে চাইতেন। তাঁর মধ্যে অদ্ভুত ধীশক্তি, বজ্রদৃঢ় মনোবল, ঐকান্তিক ঈশ্বরনির্ভরতা, অসাধারণ মানবপ্রেম, অসম্ভব সহৃদয়তার প্রকাশ ঘটেছিল। তাই তিনি ছিলেন শাশ্বত ভারতাত্মার নবীন ও প্রেরণাদায়ী উজ্জ্বল মূর্তি। বলতে কি গুরুর আদর্শ শিরোধার্য করে বিবেকানন্দ সারা জীবনই মানবচেতনার সমৃদ্ধির জন্য নানা কথা বলে গেছেন। বিশেষত তাঁর মধ্যে মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা সত্যিই ছিল অসাধারণ। স্বামীজির প্রত্যাশা ছিল মেয়েরা যেমন আত্মবোধে জাগ্রতা হবে, তেমনই কর্মক্ষেত্রেও স্বনির্ভরতার উজ্জ্বল আসনে প্রতিষ্ঠিত হবে। নারীদের পবিত্রতা ও সংযমের উপর জোর দিলেও স্বামীজি নারীর স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেননি। তিনি সে সময়ে বলেছিলেন, “আমরা স্ত্রীলোককে নীচ, অধম, মহা হেয়, অপবিত্র বলি। তার ফল আমরা পশু, উদ্যমহীন, দরিদ্র। তোমরা যদি মেয়েদের উন্নতি করিতে পার তবে আশা আছে। নচেৎ পশুজন্ম ঘুচবে না।” স্বামীজি মেয়েদের বলতেন এঁরা হলেন মূর্তিমতী শক্তি। যদি এই নারীশক্তিকে ঠিক মতো ব্যবহার করা যায়, তা হলে সহজেই দেশের উন্নতি হবে এবং সমাজও সার্বিক ভাবে সুন্দর হয়ে উঠবে। এ ব্যাপারে তাঁর যথাযোগ্য মন্তব্য হল “মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাধীনতা দাও। তা হলে তারা নিজেরাই নিজেদের গড়ে নেবে।”
এই নারীজাতির উন্নতির পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চা করা, ভাষার চর্চা, শিল্প স্থাপন করা এবং দরিদ্র জনগণ তথা কৃষক-শ্রমিকের জীবনের মানোন্নতির জন্যও তাঁর বড় অবদান রয়েছে। বস্তুত মানবসেবার সমস্ত উপকরণগুলির সম্বন্ধেই স্বামীজি সর্বদা সচেতন ছিলেন। স্বামীজি চেয়েছিলেন, সেবা ধর্মের আমূল পরিবর্তন যা সমস্ত মানুষকে এক দিব্যচেতনায় উদ্বুদ্ধ করবে। তাঁর মতে, ‘মানবসেবাই ঈশ্বরসেবা’ এটি স্বামীজি যে ভাবে প্রচার করে গেছেন তার তুলনা বিরল। বস্তুত স্বামীজির এই অসাধারণ সেবামার্গের অনুপ্রেরণাতে আকৃষ্ট হয়েই ভারতের বুকে নানা সেবাকাজ চলছে। এ আদর্শ অবশ্য যৌবনে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে শিখিয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মনে করতেন, “চোখ বুজলে ভগবান আছেন আর চোখ খুললে তিনি কি নেই? প্রতিমায় ঈশ্বরের পুজো হয়, আর জীবন্ত মানুষে হয় না? …যত্র জীব তত্র শিব”। স্বামীজি বুঝেছিলেন ঠাকুরের নবযুগের এই মহামন্ত্র মানুষকে দেবে বাঁচার মন্ত্র, হতাশা থেকে মুক্তি, জীবত্ব থেকে শিবত্বের উত্তরণের এক অভিনব সুসমাচার।
স্বামীজির প্রবর্তিত এই সুমহান সেবাধর্মের বিজয়রথ এগিয়ে চলেছে দেশ হতে দেশান্তরে। তাঁর মহান জীবন এবং ততোধিক প্রাণপদ বাণী ভারতের ইতিহাসে এক নবযুগের যে সূচনা করেছে তাতে সন্দেহ নেই। বস্তুত শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদে বিবেকানন্দের কণ্ঠে যে স্বর ধ্বনিত হয়েছে তা ভারতেরই কণ্ঠস্বর। যে ভারত মরেনি, যে ভারত মরবে না। যে ভারত পুরোনো হয় কিন্তু কখনও স্থবির হয় না, জরায় নষ্ট হয় না যে ভারত চিরনবীন যে ভারত স্বীয় ব্রতসাধনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শ্রীঅরবিন্দ তাই লিখে গিয়েছেন, “বিবেকানন্দের যাত্রা, যে বিবেকানন্দকে তাঁর গুরু চিহ্নিত করেছিলেন সেই বিরাট শক্তিধর পুরুষ হিসেবে যিনি গোটা জগৎটাকে দু’হাতে ধরে পাল্টে দিতে সমর্থ ছিলেন, পৃথিবীর সম্মুখে এটা প্রমাণ হয়েছে যে ভারতবর্ষ জাগ্রত হয়েছে, শুধু নিজে বাঁচার জন্য নয়, জগৎকে জয় করার জন্যও।”
স্বামীজির সার্ধশতবর্ষের প্রাক্কালে আজ আরও একবার সকলকে স্মরণ করতে হবে এই মহামানবের অপরূপ বাণীটিও যা সতত প্রেরণাদায়ক। যা পথ চলার হাতিয়ার এবং মানবমুক্তির অন্যতম সোপান।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন