১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বিবাহ সমস্যার জটিলতা

বহু জাতি উপজাতি ও শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হিন্দুসমাজ যে কেবল দুর্ব্বল ও সংহতিশক্তিহীন হইয়া পড়িয়াছে, তাহা নহে, উহার ফলে বিবাহসমস্যা এই সমাজে অত্যন্ত জটিল হইয়া উঠিয়াছে। বৰ্ত্তমান সমাজব্যবস্থার মূল ভিত্তি বিবাহ, সুতরাং এই প্রথার উপরে সমাজের উন্নতি বা অবনতি যে বহুল পরিমাণে নির্ভর করে, তাহা বলা বাহুল্য মাত্র। হিন্দুসমাজে বহু জাতি উপজাতি শ্রেণী শাখা প্ৰশাখার সৃষ্টি হওয়ার ফলে বিবাহের ক্ষেত্র ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হইতে সঙ্কীর্ণতর হইয়া আসিয়াছে। এই সঙ্কীর্ণ পরিধির মধ্যে বিবাহযোগ্য পাত্র ও পাত্রী পাওয়াই অনেক সময় দুর্ঘট। অনেক স্থলে পাত্র ও পাত্রীর মধ্যে রক্তের সম্বন্ধ এমন ঘনিষ্ঠ হয় যে, বিবাহের ফল কখন ভাল হইতে পারে না,- বংশানুক্রমের নিয়ম (Law of heredity) অনুসারে জাতির উৎকর্ষ সাধিত হইতে পারে না। সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে পৃথক দুইটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জাতির (Race) মধ্যে বিবাহ যেমন বাঞ্জনীয় নহে, তেমনি যাহাদের মধ্যে রক্তের সম্বন্ধ নিকটতম তাহাদের মধ্যে বিবাহও প্ৰশস্ত নহে।

জাতিভেদের আদর্শ অনুসরণ করিয়া বিবাহ ব্যাপারে হিন্দুসমাজ কোথায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহার মোটামুটি একটা হিসাব করা যাক। ডা. ভগবান দাস বলেন যে, সমগ্ৰ ভারতের হিন্দুসমাজের জাতি উপজাতি শ্রেণী শাখা প্ৰশাখা প্ৰভৃতি বিচার করিলে প্ৰায় তিন হাজার বিভাগ হইয়া দাঁড়ায়। কেবলমাত্র বাঙলাদেশের হিন্দুসমাজের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেও ডা. ভগবান দাসের মন্তব্য অত্যুক্তি বা অতিরঞ্জিত বলিয়া মনে হইবে না। বাঙলার হিন্দু সমাজ “ছত্ৰিশ জাতিতে বিভক্ত” এইরূপ একটা চলতি কথা আছে। প্রকৃতপক্ষে জাতির সংখ্যা তাহা অপেক্ষা অনেক বেশী, বোধ হয়। কয়েক শতের কম হইবে না। কেন না সম্ভব অসম্ভব সমস্ত রকম বিভিন্ন বৃত্তিকে অবলম্বন করিয়া এক একটা স্বতন্ত্র জাতি গড়িয়া উঠিয়াছে। যে সমস্ত আদিম জাতি ও পাহাড়িয়া জাতিরা হিন্দু সমাজের মধ্যে আসিয়া প্ৰবেশ করিয়াছে, তাহারাও এক একটা স্বতন্ত্র জাতি হইয়াছে। এই “কয়েক শত জাতির” মধ্যে আবার উপজাতি, শ্রেণী, শাখা, প্ৰশাখা আছে। তাহাদের পরস্পরের মধ্যেও বিবাহ হয় না। ব্ৰাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্ৰভৃতি উচ্চজাতিদের কথা দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যাইতে পারে। বাঙ্গলার ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে রাঢ়ী, বারেন্দ্ৰ, বৈদিক, সপ্তশতী বা সারস্বত, শাকদ্বীপী-এই কয়েকটি প্রধান বিভাগ আছে।

বাগাড়ী ব্ৰাহ্মণ নামেও এক শ্রেণীর ব্ৰাহ্মণ আছে, কিন্তু ইহারা বৰ্ত্তমানে রাঢ়ীয় ব্ৰাহ্মণদের অন্যতম শাখা বলিয়া গণ্য। প্ৰাচীন বাঙলায় রাঢ়, বরেন্দ্ৰ, বাগড়ী, বঙ্গ, মিথিলা-এই কয়েকটি বিভাগ ছিল। রাঢ়ী, বারেন্দ্র, বাগড়ী প্রভৃতি ব্ৰাহ্মণদের নাম এই সমস্ত বিভাগ হইতেই হইয়াছে। এইসব প্ৰধান বিভাগ ছাড়া বর্ণ ব্ৰাহ্মণ, ভাট ব্ৰাহ্মণ, অগ্ৰদানী ব্ৰাহ্মণ প্ৰভৃতিও আছে। ইহাদের প্ৰত্যেকের মধ্যে আবার শ্রেণীভেদ ও শাখা প্ৰশাখা ভেদ আছে। যথা- রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে কুলীন, বংশজ, শ্রোত্ৰিয় প্রভৃতি ভেদ আছে। বারেন্দ্ৰ ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে কৌলীন্য প্ৰথা তো আছেই, তাহা ছাড়া নয়টি পটী আছে।1 বৈদিক ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে পাশ্চাত্য বৈদিক ও দাক্ষিণাত্য বৈদিক এই দুই শাখা আছে। শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ বা গ্রহবিপ্ৰদের মধ্যেও দুইটি শাখা-রাঢ়ীয় ও নদীয়া বঙ্গসমাজ আছে। এই নদীয়া বঙ্গসমাজেরই একটি শাখা বারেন্দ্ৰ সমাজ। শাকদ্বীপী ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে কৌলীন্য প্ৰথাও আছে।


কায়স্থদের মধ্যে উত্তর রাঢ়ী, দক্ষিণ রাঢ়ী, বারেন্দ্র ও বঙ্গজ এই ৪টি প্ৰধান শ্রেণী আছে। বলা বাহুল্য, ব্ৰাহ্মণদের ন্যায় কায়স্থদের প্রত্যেক শ্রেণীর মধ্যে আবার কুলীন, মৌলিক প্রভৃতি ভেদ আছে। বৈদ্য জাতির মধ্যেও রাঢ়ী ও বারেন্দ্ৰ শ্রেণীবিভাগ আছে।


ব্ৰাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যদের এই সমস্ত বিভিন্ন শ্রেণী ও শাখা প্ৰশাখার ভিতর পরস্পর বিবাহ হয় না। যথা— রাঢ়ী ও বারেন্দ্ৰ ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে বিবাহ হয় না, সপ্তসতী বা শাকদ্বীপী ব্ৰাহ্মণদের সঙ্গেও রাঢ়ী বা বারেন্দ্ৰ ব্ৰাহ্মণদের বিবাহ হয় না। কায়স্থ ও বৈদ্যের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যেও বিবাহ চলে না। আজকাল বিভিন্ন শ্রেণীর কায়স্থদের পরস্পরের মধ্যে ২৪টা বিবাহ হইতেছে বটে, কিন্তু উহার সংখ্যা নগণ্য, কায়স্থ সমাজে তাহা ‘শিষ্ট বিবাহ’ বলিয়া এখনও প্ৰসন্ন মনে গৃহীত হয় না। রাঢ়ী ও বারেন্দ্ৰ ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে বিবাহ হয় না বলিলেই ঠিক হয়। ইদানীং যে ২/১টি বিবাহ হইয়াছে, তাহা ঐ দুই সমাজে শ্রদ্ধার সঙ্গে গৃহীত হয় নাই। আমি জানি, কোন রাঢ়ী ব্রাহ্মণের পুত্ৰ বারেন্দ্ৰ কন্যাকে বিবাহ করাতে পিতা মনের ক্ষোভে গৃহত্যাগ করেন।



ব্ৰাহ্মণ ও কায়স্থ এই উভয় জাতির মধ্যেই কৌলীন্য প্রথা বিবাহের জটিলতা আরও বৃদ্ধি, এবং নানাদিক দিয়া সমাজের ঘোর অনিষ্ট করিয়াছে। কৌলীন্যের অনিষ্টকর প্রভাব সৰ্ব্বাপেক্ষা বেশী দেখা যায় রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদের মধ্যে। কৌলীন্য প্রথা রাঢ়ীয় ব্ৰাহ্মণ সমাজে কিরূপ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভেদ সৃষ্টি করিয়াছে এবং উহার ফলে বিবাহ সমস্যা অসম্ভব রকম জটিল হইয়া উঠিয়াছে, তাহা প্ৰসিদ্ধ ঐতিহাসিক ডা. রমেশচন্দ্র মজুমদার তাহার একটি প্ৰবন্ধে সংক্ষেপে বর্ণনা করিয়াছেন:

“বল্লাল সেনের কৌলীন্য প্ৰথা ব্যক্তিগত গুণের উৎকর্ষের উপর প্ৰতিষ্ঠিত, বংশানুক্রমিক ছিল না। . . . বল্লাল সেনের পরে দুইটা বিষয়ে নিয়ম প্ৰণালী বিধিবদ্ধ হইয়া কৌলীন্য প্রথাটিকে জটিল করিয়া তুলিল। লক্ষ্মণ সেন নিয়ম করিলেন যে, কুলীন কন্যা যে ঘরে প্রদত্ত হইবে, আবার সেই ঘর হইতে কন্যা গ্ৰহণ করিতে হইবে। ইহার নাম বংশ পরিবর্ত্তন। দ্বিতীয়তঃ, কুলীনদের মধ্যে কে কিরূপ উচ্চনীচ কুলে আদানপ্ৰদান করিয়াছে তাহা নির্ণয় করিয়া কুলীনদের পদমৰ্য্যাদার সমতা স্থির করা হইবে। ইহার নাম সমীকরণ। রাঢ়ীয় ব্ৰাহ্মণ সমাজে ইহার প্রচলন হয়, বারেন্দ্ৰ সমাজে এই ব্যবস্থা গৃহীত হয় নাই। প্রথম সমীকরণে সাতজন কুলীন সমান বলিয়া গণ্য হইলেন। দ্বিতীয় সমীকরণে চৌদ্দজন সমান বলিয়া গণ্য হইলেন। ইহারাই কুলীনদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলিয়া গণ্য হইলেন। এতদ্ব্যতীত লক্ষ্মণ সেনের সময়েই জটিল দার্শনিক তত্ত্বের দ্বারা কৌলীন্যের ব্যাখ্যা হয় এবং সূক্ষ্ম ন্যায়ের তর্ক ‘দ্বারা কৌলীন্যের উৎকর্ষ স্থির করার ব্যবস্থা প্ৰবৰ্ত্তিত হয়।” 2


লক্ষণ সেনের কয়েক শত বৎসর পরে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে দেবীবর ঘটক “মেলবন্ধন” করিয়া কৌলীন্য প্রথাকে জটিলতম করিয়া তুলিলেন। ডা. রমেশচন্দ্র মজুমদারের প্রবন্ধ হইতে পুনরায় আমরা উদ্ধত করিতেছিঃ—
“দেবীবর দেখিলেন সকল কুলীনই অল্পবিস্তর দোষাশ্রিত। যাহাঁদের বেশী দোষ ছিল অথবা যাঁহারা তাঁহার বিরুদ্ধ পক্ষ ছিলেন, দেবীবর তাহাদিগকে নিষ্কুলীন করিলেন। তাঁহারা দেবীবরের ছাঁটা ‘বংশজ’ বলিয়া গণ্য হইলেন। অল্প দোষাশ্ৰিত অন্য কুলীনগণকে দেবীবর ছত্রিশভাগে অথবা মেলে বিভক্ত করিলেন। মহারাজ বল্লাল সেন গুণ অনুসারে কৌলীন্য মৰ্য্যাদা দিয়াছিলেন, আর দেবীদ্বরের বিধানে যে দোষী, তিনি প্ৰধান কুলীন বলিয়া গণ্য হইলেন। এক এক প্রকার দোষে দুষ্ট কুলীনদিগকে লইয়া এক এক ‘মেল’ সৃষ্ট হইল। দেবীবর প্রতি মেলে দুই দুইজনকে প্ৰধান বলিয়া স্বীকার করিলেন। যাঁহার হইতে মেলের উৎপত্তি তিনি “প্ৰকৃতি’ এবং তাঁহার সহিত কুল করিয়া যিনি সমমৰ্য্যাদাসম্পন্ন হইলেন, তিনি ‘পালটি’। দেবীবর নিয়ম করেন, প্ৰত্যেক মেলের মধ্যে যে যাহার প্রকৃতি, যে যাহার ‘পালটি’—তাঁহাদেরই মধ্যে পরস্পর আদান-প্ৰদান বা কুলকাৰ্য্য চলিতে পরিবে। তাহার বাহিরে কেহ কুলকাৰ্য্য করিতে পরিবে না, করিলে কুল নষ্ট হইবে।”3


বলা বাহুল্য, এই অদ্ভুত, অস্বাভাবিক, মূঢ় ব্যবস্থার ফলে কুলীন ব্রাহ্মণ সমাজে বহুবিবাহ প্ৰবেশ করিল। অনেক সময়ে বহুবিবাহেও কুলাইত না, কন্যারা অবিবাহিত জীবন যাপন করিতে বাধ্য হইত। ইচ্ছার ফলে যে ঘোর দুনীতি ও অনাচার ব্ৰাহ্মণ সমাজে প্রবেশ করিল, কয়েক শতাব্দী ধরিয়া বাঙালী জাতি তাহার ফল ভোগ করিয়াছে এবং এখনও করিতেছে। এক একজন কুলীন ব্রাহ্মণ ৫০/৬০ হইতে ১০০। ১৫০টি পৰ্যন্ত বিবাহ করিতেন। তাহাও আবার বহু অর্থ দিয়া এই সব কুলীন জামাইকে সংগ্ৰহ করিতে হইত। বিবাহের পরও কন্যারা অনূঢ়ার মত পিতৃগৃহেই থাকিয়া যাইত। কৌলীন্যের ফলে অনাচার ও ব্যভিচার সমাজে কি ভাবে প্ৰবেশ করিয়াছিল, পণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্ন তৎকৃত ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকে তাহার জ্বলন্ত চিত্র অঙ্কিত করিয়া সমাজকে কষাঘাত করিয়াছেন। ইদানীং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “বামুনের মেয়ে” উপন্যাসেও কৌলীন্য প্রথার শোচনীয় পরিণতি আর একদিক দিয়া দেখানো হইয়াছে। প্রধানত পুণ্যশ্লোক ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চেষ্টায়। এই ‘বহুবিবাহ প্রথার’ প্ৰাবল্য হ্রাস পায়। 4
কুলীনদের মধ্যে কন্যার বিবাহ দেওয়া যেমন দুঃসাধ্য, “বংশজ”দের মধ্যে তেমনি আবার ছেলের বিবাহ দেওয়া দুঃসাধ্য। ইহাদিগকে কন্যা সংগ্রহের জন্যই ‘পণ’ দিতে হয়। ফলে অনেক বংশজ ব্ৰাহ্মণ বিবাহ করিতে পারে না, হয়ত বৃদ্ধ বয়সে শেষ পৰ্য্যন্ত একটি বালিকার পাণিগ্রহণ করিতে বাধ্য হয়। আবার কন্যা বিক্রয় করিয়া মূল্য পাইবার লোভে প্ৰতারকেরা বহু অ-ব্রাহ্মণের কন্যাকেও ব্রাহ্মণকন্যা পরিচয় দিয়া বিবাহ দেয়। পূর্ব্বে এরূপ ঘটনা বহু ঘটিত, বৰ্ত্তমানকালে উহার সংখ্যা হ্রাস হইয়াছে।


এক শতাব্দী পূর্ব্বে এ বিষয়ে হিন্দুসমাজের অবস্থা কিরূপ ছিল, তাহা ১৮৩৭ সালের ১৭ই জুন তারিখের “সমাচার দর্পণ” সংবাদপত্রে উদ্ধৃত নিম্নলিখিত পত্ৰ হইতে পাওয়া যায়ঃ-
“সম্পাদক মহাশয়, এ দেশের কুলীন বংশজ ব্রাহ্মণেরাই জাতি লোপ করিয়াছেন। তাহার কারণ আমি বিশেষ করিয়া বলি আপনি বিবেচনা করিবেন। বংশজ ব্ৰাহ্মণেরা কন্যা ক্ৰয় করিয়া বিবাহ করেন, কিন্তু তাহাতে অনেক জাতির কন্যা চলিয়া যায়। অধিক কি কহিব, কন্যা ক্রয় করিয়া বিবাহকরণ ব্যবহার থাকাতে বংশজ ব্ৰাহ্মণ মোসলমানের কন্যা পৰ্যন্তও বিবাহ করিয়াছেন, আমি ইহার একক প্ৰমাণ লিখিতেছি। (ইহার পর বর্দ্ধামানের একটি ঘটনার উল্লেখ আছে।) ভাটপাড়াতেও এক ব্ৰাহ্মণ ক্রীতকন্যা বিবাহ করেন এবং বস্তু কাল সহবাস করিয়া শেষে জানিলেন, পোদ জাতীয় বৈষ্ণবের কন্যা গ্ৰহণ করিয়াছেন। এতদ্ভিন্ন কলিকাতা সহরের মধ্যে এরূপ স্ত্রী অনেক আছে আমি সাহসপূর্বক বলিতে পারি, ভারিভারি পণ্ডিত ন্যায়রত্বের ও প্রধান প্রধান বাঁড়ুয্যের ঘরে যে, তাঁহাদিগের পুত্ৰ-পৌত্ৰাদির গৃহিণী সকল আছেন, তাহাদিগের অনেকেই ধোপা, নাপিত, বৈষ্ণব, মালি, কামার, কাপালিক কন্যা, কিন্তু সম্পত্তিশালী ব্ৰাহ্মণের ঘরে পড়িয়া পবিত্ৰ ব্ৰাহ্মণী হইয়া গিয়াছেন, এখন তাঁহাদিগের পাকান্ন সকলেই পবিত্ৰ জ্ঞান করেন। 5


“ভরার মেয়ে” কথাটি কেহ কেহ হয়ত শুনিয়া থাকিবেন। কিন্তু ইহার মধ্যে হিন্দুসমাজের কৌলীন্য প্রথার কি শোচনীয় ক্ষত লুক্কায়িত আছে, তাহা হয়ত অনেকে জানেন না। পশ্চিম বঙ্গে যেমন, পূর্ব্ববঙ্গেও তেমনই এই কৌলীন্যের ফলে বংশজ ব্ৰাহ্মণের কন্যার অভাবে বিবাহ করিতে পারিতেন না ইহা পূৰ্বেই বলিয়াছি। ইহার ফলে ‘কন্যা ব্যবসায়ী’ এক দল লোকের সৃষ্টি হইয়াছিল। তাহারা অন্যান্য স্থান হইতে কন্যা সংগ্ৰহ করিয়া আনিয়া ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল প্ৰভৃতি অঞ্চলে বিবাহার্থী বংশজ ব্ৰাহ্মণদের নিকট বিক্রয় করিত। এইসব মেয়ে প্রায়ই নিম্নজাতীয়া হইত, কিন্তু বিবাহাৰ্থ ব্ৰাহ্মণেরা নির্ব্বিচারে তাহাদিগকে ক্রয় করিয়া বিবাহ করিতেন। “ভরা” বা নৌকাতে করিয়া কন্যা ব্যবসায়িগণ এইসব মেয়েকে বিক্রয়ার্থ আনিত বলিয়া লোকে চলতি কথায় ইহাদিগকে “ভরার মেয়ে’ বলিত। যে”রক্তের বিশুদ্ধতা” রক্ষার জন্য কৌলীন্য প্রথার সৃষ্টি-সেই ‘রক্তের বিশুদ্ধতা’ রক্ষা এইভাবেই হইত! কৌলীন্য প্রথার কৃপায় ব্রাহ্মণ সমাজে কত যে নিম্ন বর্ণের রক্ত মিশিয়া গিয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। “কুলীনের ছেলে।” সেকালে একটা গালি বলিয়া গণ্য হইত।
বারেন্দ্ৰ ব্ৰাহ্মণ, রাঢ়ীয় কায়স্থ সমাজ প্রভৃতিতেও কৌলীন্য প্রথা ঘোর অনিষ্ট করিয়াছে। বারেন্দ্ৰ ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে ‘করণ’ প্রথার নাম কেহ কেহ হয়ত শুনিয়াছেন। প্রথাটি বড়ই অদ্ভুত।

উপযুক্ত কুলীন পাত্র না পাওয়া গেলেও মেয়েকে যোগ্য অকুলীন পাত্রে যদি কেহ দান করেন, তবে তাহাকে এই ‘করণ’ প্রথার আশ্রয় লইতে হয়। প্ৰথমে একটি ‘কুশপুত্তলিকা’রূপী কুলীন বরের সঙ্গে কন্যাকে বিবাহ দিতে হয়, তারপর ঐ ‘কুশপুত্তলিকা’ দাই করিয়া আসল ‘অকুলীন’ বরের সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দেওয়া হয়। কৌলীন্য প্রথার ইহা যে কত বড় হাস্যকর পরিণতি, তাহা সহজেই বুঝা যায়। “মনকে চোখ ঠারিতে” গিয়া লোকে যে প্রকৃতপক্ষে ‘বিধবা কন্যার বিবাহ দিত ইহা ভাবিত না। বারেন্দ্ৰ ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে যেমন “করণ’ প্ৰথা, দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ সমাজে তেমনই “আদ্যিরস” । ইহা “করণ’ প্রথার তুলনায় অত্যন্ত নিষ্ঠুর। মৌলিক গোষ্ঠীপতি কায়স্থ তাঁহার কন্যাকে কোন মুখ্য কুলীনের ছেলের সঙ্গে বিবাহ দিবার পূর্ব্বে, প্রথমে ঐ কুলীন ছেলেকে একটি কুলীনের মেয়ের সঙ্গে বিবাহ দেওয়াইতেন । ইহাতে ছেলের “কুলরক্ষা” হইত। তারপর ঐ ছেলেকে গোষ্ঠীপতি মৌলিক নিজের মেয়ের সঙ্গে বিবাহ দিতেন। ইহাকেই বলে “আদিরস”। বলা বাহুল্য, এরূপ বিবাহে প্রথমোক্ত কুলীনের মেয়েটি প্রায়ই পরিত্যক্তা থাকিত এবং দ্বিতীয় স্ত্ৰী গোষ্ঠীপতি মৌলিকের কন্যাকে লইয়াই স্বামী বাস করিত। দীনবন্ধু মিত্রের “জামাইবারিক” ব্যঙ্গনাট্যে রাঢ়ী কায়স্থ সমাজে কৌলীন্যের এই সব অনাচার সম্বন্ধে শ্লেষাত্মক চিত্ৰ আছে।
কৌলীন্য প্রথা এবং তাহার আনুষঙ্গিক রীতিনীতি হিন্দুসমাজের উচ্চ জাতিদের মধ্যে যে কিভাবে বিবাহসঙ্কটের সৃষ্টি করিয়াছে, তাহার সামান্য কিছু পরিচয়ই আমরা দিলাম।

• [^06] দ্রষ্টব্য↩

• কৌলীন্য প্রথা—‘ভারতবর্ষ’।↩

• দেবীবর ঘটকের এই প্ৰচেষ্টার মধ্যে একটা হয়ত উদার উদ্দেশ্য ছিল। যে ব্ৰাহ্মণদের বংশে “পাঠান দোষ” ও “মোগল দোষ” (ব্যাখ্যা অনাবশ্যক) ঘটিয়াছিল, সম্ভবতঃ তাহাদিগকে সমাজের মধ্যে স্থান দিবার জন্য তিনি “দোষের” উপর ভিক্তি করিয়া মেলবন্ধন করিয়াছিলেন।—লেখক↩

• পূর্ব্ববঙ্গে রাসবিহারী মুখোপাধ্যায় বহু বিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেন। তিনি গ্রামে গ্রামে গান গাহিয়া বেড়াইয়া বহু বিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রচারকাৰ্য্য করিতেন। তিনি নিজে কুলীন ব্ৰাহ্মণ ছিলেন এবং বহুবিবাহ করিয়া উহার কুফল ভোগ করিয়াছিলেন।—লেখক↩

• শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় । “ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বাঙালী সমাজের সমস্যা”-সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ৩য় সংখ্যা, ১৩৪৬↩

চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।
বিঃদ্রঃ আরো পোষ্ট পেতে লাইক ও শেয়ার করুন

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।