বাঙলার হিন্দুসমাজের ক্ষয়ের একটা প্ৰধান কারণ যে, নিম্নজাতিদের সংখ্যা হ্রাস এবং বংশলোপ—তাহা চক্ষুষ্মান্ ব্যক্তিমাত্রেই বুঝিতে পারেন, অন্ততপক্ষে পারা উচিত। বাঙলার হিন্দুসমাজে তথাকথিত উচ্চজাতিরা, অর্থাৎ—ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্ৰভৃতি কয়েকটি জাতি মোট শতকরা কুড়ি ভাগ হইতে পঁচিশ ভাগের বেশী নহে। অবশিষ্ট শতকরা ৭৫ হইতে ৮০ ভাগই তথাকথিত নিম্নজাতীয় হিন্দু। সুতরাং এই নিম্নজাতীয় হিন্দুদের আর্থিক অবস্থা ও জনবলের উপরেই যে হিন্দুসমাজের উন্নতি-অবনতি, শক্তিসমৃদ্ধি প্ৰধানত নির্ভর করে, একথা বলা বাহুল্য মাত্ৰ ।
বাঙলার হিন্দুসমাজের নিম্ন জাতীয় হিন্দুদের বংশলোপ হইতেছে, প্ৰধানত তিনটি কারণে :—বাল্যবিবাহ, কন্যাপণ এবং বিধবাবিবাহের অপ্রচলন । উচ্চজাতীয় হিন্দুদের অর্থাৎ যাহাদের আমরা সাধারণত “ভদ্রলোক সম্প্রদায়” বলি—তাহদের সঙ্গে এ বিষয়ে নিম্নজাতীয়দের সমস্যার কিছু প্ৰভেদ আছে। এই ভদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘বরপণ’ প্ৰচলিত ( বংশজ ব্ৰাহ্মণ প্ৰভৃতি কয়েকটি বিশেষ শ্রেণী ছাড়া ) এবং বাল্যবিবাহ প্ৰথা গত ৩০|৪০ বৎসরের মধ্যে একরূপ উঠিয়া গিয়াছে বলিলেই হয়। তাহাদের মধ্যে যথাসময়ে মেয়ের বিবাহ দেওয়াই একটা কঠিন সমস্যা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ২০|২৫ বৎসর বয়সের মেয়েদেরও বয়স গোপন করিয়া বিবাহ দিতে হয়, ইহা আমরা সকলেই জানি ।
“বরপণ” প্ৰথা এই সমস্যাকে আরও কঠিন করিয়া তুলিয়াছে। গত ৩০|৪০ বৎসর ধরিয়া ভদ্রলোক হিন্দুরা ‘বরপণের’ বিরুদ্ধে বহু বক্তৃতা করিয়াছেন, প্ৰবন্ধ লিখিয়াছেন, পণপ্ৰথা নিবারণী সমিতি করিয়া বহু ভাবী বরের এবং তাহাদের পিতাদের “প্ৰতিজ্ঞাপত্রে” স্বাক্ষর লইয়াছেন, নামজাদা নাট্যকারেরা নাটক লিখিয়া রঙ্গমঞ্চ হইতে এই ‘কু-প্রথার’ বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করিয়াছেন ; প্ৰসিদ্ধ ঔপন্যাসিকেরা এই বরপণ সমস্যাকে কেন্দ্ৰ করিয়া হৃদয়বিদারক উপন্যাস লিখিয়াছেন, এমন কি, স্নেহলতা হইতে আরম্ভ করিয়া আরও কয়েকজন হতভাগিনী কুমারী পিতামাতাকে বরপণের অত্যাচার হইতে রক্ষা করিবার জন্য আত্মহত্যা পৰ্য্যন্ত করিয়াছেন ; কিন্তু তথাপি এই জঘন্য প্রথা দূর হয় নাই, বরং উহা উত্তরোত্তর যেন বাড়িয়াই চলিয়াছে। ইহার কারণ কি ? আমাদের মনে হয়, অর্থনীতিশাস্ত্রে যে Law of Demand and Supply, অৰ্থাৎ ‘চাহিদা ও যোগানের’ নিয়ম আছে, এখানেও সেই নিয়মই কাৰ্য্য করিতেছে।
মধ্যবিত্ত ভদ্র সম্প্রদায়ের প্রায় সকল পিতামাতাই চাহেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত বি-এ, এম-এ, পাশ করা সরকারী চাকুরিয়া অথবা হবু-চাকুরিয়া জামাই। অন্ততপক্ষে উকীল, ডাক্তার, অধ্যাপক অথবা হবু-উকীল প্রভৃতি হইলেও চলে। কিন্তু এই শ্রেণীর ছেলের সংখ্যা খুব বেশী নহে, তার উপর জাতিভেদ এবং অসবৰ্ণ বিবাহের অপ্রচলন সেই সংখ্যা সমস্যাকে আরও কঠিন করিয়া তুলিয়াছে। ফলে বিবাহের বাজারে এই শ্রেণীর “শিক্ষিত” বরের দাম ক্ৰমাগত বাড়িয়াই চলিয়াছে। বৰ্তমানে বিয়ের বাজারে “আই-সি-এস” বরের মূল্য তিরিশ হাজার হইতে পঞ্চাশ হাজার টাকা,—ডেপুটী, মুন্সেফ প্রভৃতির দর দশ হাজার হইতে পনের হাজার টাকা পৰ্য্যন্ত উঠিয়াছে। এটর্ণী, উকীল, ডাক্তার, ব্যারিস্টার এবং বিলাতফেরত অন্যান্য শ্রেণীর বরের মূল্যও আট দশ হাজার টাকার কম নহে। সুতরাং মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের পক্ষে মেয়ের বিবাহ দেওয়া যে দুঃসাধ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা আর বিচিত্ৰ কি ! সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থেরা যতদিন ধনীদের অনুকরণে এবং তাহাদের সঙ্গেপাল্লা দিয়া এই বিশেষ শ্রেণীর “বর” খুঁজিবে, ততদিন বরপণ সমস্যার সমাধান হইবে না বলিয়াই আমাদের বিশ্বাস ।
তবে ভবিষ্যতে কয়েকটি কারণে এই বরপণ সমস্যার জটিলতা হ্রাস হইতে পারে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের বি-এ, এম-এ পাশ করা ছেলেদের এবং উকীল, ডাক্তার প্রভৃতির অথোপাৰ্জ্জনের অক্ষমতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহাদের দুৰ্দ্দশা চোখের উপর দেখিয়া মেয়ের বাপদের এই শ্রেণীর ছেলেদের উপর ঝোঁক কমিতে পারে । দ্বিতীয়ত, মেয়েদের বেশী বয়সে বিবাহ হইতেছে, তাহারা ছেলেদের মতই লেখাপড়াও শিখিতেছে। সুতরাং “বর মনোনয়ন” ব্যাপারে মেয়েদের মতামত অনেকক্ষেত্ৰে লইতে হইতেছে। আর অর্থ উপার্জনে অক্ষম “শিক্ষিত ছেলেদের” এই সব মেয়েরা ভবিষ্যতে পছন্দ করিবে কি না সন্দেহ। তৃতীয়ত, পূর্বোক্ত দ্বিতীয় কারণেই কোন কোন ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা “পরস্পরকে ভালবাসিয়া” বিবাহ করিতেছে এবং এরূপ বিবাহ প্ৰায়ই ‘অসবর্ণ’ হইতেছে। ভবিষ্যতে এরূপ বিবাহের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইবার সম্ভাবনাই দেখা যাইতেছে। বলা বাহুল্য, এ সব ক্ষেত্রে বরপণ সমস্যার প্রশ্ন উঠিবে না।
সে যাহাই হউক, বৰ্ত্তমানে এই “বরপণ সমস্যার” জন্য মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের মধ্যে অনেক বয়স পৰ্য্যন্ত মেয়েদের অনুঢ়া থাকিতে হইতেছে। ছেলেরাও এই আর্থিক সমস্যার দিনে অনেক সময় ৩৫|৪০ বৎসর বয়স পৰ্য্যন্ত অবিবাহিত থাকিতেছে । ইহার ফল মধ্যবিত্ত ভদ্র সম্প্রদায়ের পক্ষে কোনদিক দিয়াই কল্যাণকর হইতেছে না। নানা কারণে বাল্যবিবাহ বাঞ্ছনীয় নহে স্বীকার করি ; কিন্তু ছেলেমেয়েরা যদি ৩০|৩৫ বৎসর বয়স পৰ্যন্ত অবিবাহিত থাকে, তবে তাহার পরিণামও ভাল হইতে পারে না। উহার ফলে স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই উৎপাদিকা শক্তি হ্রাস হয়, এমন কি, বংশলোপের সম্ভাবনাও দেখা দেয়। উচ্চ জাতীয় হিন্দুদের মধ্যে জনসংখ্যা হ্রাসের ইহা একটি প্রধান কারণ, সন্দেহ নাই।
পূৰ্বেই বলিয়াছি, নিম্নজাতীয় হিন্দুদের মধ্যে সমস্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকার। ইহাদের মধ্যে “কন্যাপণ” প্ৰথাই প্রচলিত, অর্থাৎ মূল্য দিয়া কন্যা ক্ৰয় করিয়া বিবাহ করিতে হয় । বাল্যবিবাহও ইহাদের মধ্যে সমধিক প্ৰচলিত । তিন চার বৎসরের মেয়েরও বিবাহ হয় । সারদা আইন ইহার কোন পরিবর্ত্তন ঘটাইতে পারে নাই এবং যে-আকারে ঐ আইন প্ৰবৰ্ত্তিত হইয়াছে, তাহাতে কোনদিন নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্য হইতে যে বাল্যবিবাহ দূর হইবে, তাহারও কোন সম্ভাবনা দেখিতেছি না। এই সব নিম্নজাতিদের মধ্যে কোন এক অজ্ঞাত ”জৈবনিক” ( Biological ) কারণে কন্যার সংখ্যা সাধারণত খুব কম হওয়াতে সমস্যা আরও ঘোরালো হইয়াছে। মোটের উপর ফল দাঁড়াইতেছে এই যে, নিম্নজাতীয় হিন্দুদের মধ্যে অনেকেই অর্থের অভাবে “কন্যাপণ” দিয়া বেশী বয়স পৰ্য্যন্ত বিবাহ করিতেই পারে না । বহু বৎসর ধরিয়া সেজন্য তাহাদিগকে অর্থসঞ্চয় করিতে হয়। অবশেষে প্রৌঢ় বয়সে কিছু অর্থসঞ্চয় করিয়া তাহারা বিবাহ করে। কিন্তু কন্যার বয়স যত বেশী হয়, তত বেশী পণ দিতে হয়। সুতরাং যাহারা বেশী কিছু অর্থ সঞ্চয় করিতে পারে না, তাহাদের বাধ্য হইয়া অল্পবয়সের মেয়েকেই বিবাহ করিতে হয়। ৪৫|৫০ বৎসরের প্রৌঢ় ব্যক্তি চার-পাঁচ বৎসরের একটি মেয়েকে বিবাহ করিতেছে—এদৃশ্য গ্রাম অঞ্চলের নিম্নজাতীয় হিন্দুদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায়। ইহার পরিণাম বড়ই শোচনীয়। সেই বালিকা পত্নী যুবতী হইবার পূর্ব্বেই হয়ত বৃদ্ধ স্বামী ভবলীলা সম্বরণ করে। রাখিয়া যায় একটি নিঃসন্তানা বলবিধবা । একদিকে বৃদ্ধের বংশলোপ হয়, অন্যদিকে অরক্ষিতা যুবতীবিধবা সমাজের পক্ষে একটা জটিল সমস্যা হইয়া দাঁড়ায়। যদি বিধবা বিবাহের সুপ্রচলন থাকিত, তবে এই সমস্যার একটা সমাধান হইত। কিন্তু তাহা না থাকাতে ইহারা সমাজে দুর্নীতি ও ব্যভিচারের বিস্তারেই সহায়তা করে।
আমরা যে সব কথা বলিতেছি, তাহা অনেকের নিকট অপ্রিয় বোধ হইবে জানি। কিন্তু যতই অপ্রিয় হৌক, হিন্দুসমাজের কল্যাণের জন্য ইহা প্ৰকাশ্যভাবে স্বীকার করা ছাড়া গত্যন্তর নাই। হিন্দুসমাজের নিম্নজাতিরা যে ক্রমে লুপ্ত হইয়া যাইতেছে, তাহার জন্য বাল্যবিবাহ, কন্যাপণ এবং পুরুষদের বিবাহের অক্ষমতাই প্ৰধানত দায়ী। আমাদের জীবনের মধ্যেই পল্লী অঞ্চলে চোখের উপরে বহু জাতিকে ধীরে ধীরে লুপ্ত হইতে দেখিয়াছি। বহু গ্রামে ধোপা, ভূইমালী, বেহারা, ধীবর, নাপিত, কুমার, তেলী, সূত্রধর, পাটনী প্রভৃতি জাতির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। যে সব গ্রামে এই সব জাতীয় লোক এখনও আছে—সেখানেও তাহদের বংশে বালকবালিকার সংখ্যা কম । বয়স্ক লোকদের সংখ্যাই বেণী । অর্থাৎ ৪০|৪৫ বৎসর পরে উহাদের সংখ্যা আরও কমিয়া যাইবে এবং শেষ পৰ্য্যন্ত বংশে বাতি দিতে হয়ত কেহই থাকিবে না ।
ডা. রাধাকমল মুখোপাধ্যায় তাহার “বাঙ্গলা ও বাঙ্গালী” গ্রন্থে এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, হিন্দুসমাজে নিম্নজাতিদের সংখ্যা বাড়িতেছে, আর উচ্চজাতিদের সংখ্যা হ্রাস হইতেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি মাহিষ্য, রাজবংশী ও নমঃশূদ্ৰদের সংখ্যাবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করিয়াছেন। ডা. মুখোপাধ্যায়ের এই সিদ্ধান্ত আমরা গ্ৰহণ করিতে পারিলাম না । মাহিষ্য, রাজবংশী ও নমঃশূদ্র এই তিনটী জাতির সংখ্যা কিছু বাড়িতেছে বটে, বোধ হয় এখনও ইহাদের হাতে কৃষিকাৰ্য্য আছে বলিয়া ; কিন্তু এই তিনটি জাতি ছাড়া হিন্দু সমাজের অন্য সমস্ত নিম্নজাতির সংখ্যা কমিতেছে। এমন কি কোন কোন নিম্নজাতির অস্তিত্ব লুপ্ত হইবার উপক্রম হইয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, বেহারা, ধোপা, নাপিত, কুমার, মালী, ঝল্লমল্ল, ক্ষত্ৰিয়, কোচ, তিয়ার, হদি, হাজ্ব, লুপ্ত মাহিষ্য ( পাটনী), হাড়ি, ডোম, ভুঁইমালী, মুচি, রহিদাস ( চৰ্ম্মকার), জালিয়া, কাওরা, লোহার প্রভৃতি জাতিগুলির জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে হ্রাস হইতেছে। ১৯২১ সাল ও ১৯৩১ সালে এই দুইটি আদমসুমারীর লোকসংখ্যার তুলনা করিলে দেখা যাইবে, ইহাদের বংশ লোপ আসন্ন ।
উচ্চজাতীয় ভদ্র সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজেদের সমস্যার কথাই চিন্তা করেন। তাঁহাদের যত কিছু সংস্কারবুদ্ধি সবই নিজেদের কেন্দ্ৰ করিয়া । তাহাই অবশ্য স্বাভাবিক ; কিন্তু ইহাও ঠিক যে, এই সব নিম্নজাতীয়দের সমস্যা লইয়া যদি “শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা” চিন্তা না করেন এবং প্ৰতিকারের উপায় নিৰ্দেশ করিতে না পারেন, তবে সমগ্রভাবে হিন্দুসমাজের ক্ষয় নিবারণ করা যাইবে না ।
আমি বাঙলা দেশের যশোর, নদীয়া, ফরিদপুর ও পাবনা জেলার কতকগুলি গ্রামের কথা জানি। সেখানে অ-বাঙালী হিন্দু বেহারা, ধোবা, নাপিত প্রভৃতি আসিয়া বাঙালী হিন্দুর স্থান পূরণ করিতেছে। কিছুদিন পূর্ব্বে ময়মনসিংহ জেলা হিন্দু সম্মেলনে সভাপতি এবং পাবনা জেলা হিন্দু সম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি দেখাইয়াছেন যে, ঐ দুই জেলার গ্রামসমূহে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ক্রমশ লুপ্ত হইতেছে। বাঙলার মফঃস্বলের অনেক খেয়াঘাট হিন্দুস্থানীরা দখল করিয়া ফেলিয়াছে। সেজন্য কেবল ব্যবসাদার হিন্দুস্থানীদের দোষ দিয়া লাভ নাই। বাঙালী পাটনী যদি না পাওয়া যায়, তবে ভিন্ন প্ৰদেশাগত লোকেরাই সেই কাজের ভার গ্রহণ করিবে। বাঙলার উচ্চ জাতীয় ভদ্রসম্প্রদায়ের সঙ্গে যদি নিম্নজাতীয় হিন্দুদের যোগসূত্ৰ থাকিত, তবে তাহারা নিশ্চয়ই হিন্দুসমাজের নিম্নস্তরের অস্তিত্ব লোপের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিত। কিন্তু বৰ্তমানে তাহার কোন লক্ষণ দেখিতে পাইতেছি না ।
চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।
বাঙলার হিন্দুসমাজের নিম্ন জাতীয় হিন্দুদের বংশলোপ হইতেছে, প্ৰধানত তিনটি কারণে :—বাল্যবিবাহ, কন্যাপণ এবং বিধবাবিবাহের অপ্রচলন । উচ্চজাতীয় হিন্দুদের অর্থাৎ যাহাদের আমরা সাধারণত “ভদ্রলোক সম্প্রদায়” বলি—তাহদের সঙ্গে এ বিষয়ে নিম্নজাতীয়দের সমস্যার কিছু প্ৰভেদ আছে। এই ভদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘বরপণ’ প্ৰচলিত ( বংশজ ব্ৰাহ্মণ প্ৰভৃতি কয়েকটি বিশেষ শ্রেণী ছাড়া ) এবং বাল্যবিবাহ প্ৰথা গত ৩০|৪০ বৎসরের মধ্যে একরূপ উঠিয়া গিয়াছে বলিলেই হয়। তাহাদের মধ্যে যথাসময়ে মেয়ের বিবাহ দেওয়াই একটা কঠিন সমস্যা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ২০|২৫ বৎসর বয়সের মেয়েদেরও বয়স গোপন করিয়া বিবাহ দিতে হয়, ইহা আমরা সকলেই জানি ।
“বরপণ” প্ৰথা এই সমস্যাকে আরও কঠিন করিয়া তুলিয়াছে। গত ৩০|৪০ বৎসর ধরিয়া ভদ্রলোক হিন্দুরা ‘বরপণের’ বিরুদ্ধে বহু বক্তৃতা করিয়াছেন, প্ৰবন্ধ লিখিয়াছেন, পণপ্ৰথা নিবারণী সমিতি করিয়া বহু ভাবী বরের এবং তাহাদের পিতাদের “প্ৰতিজ্ঞাপত্রে” স্বাক্ষর লইয়াছেন, নামজাদা নাট্যকারেরা নাটক লিখিয়া রঙ্গমঞ্চ হইতে এই ‘কু-প্রথার’ বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করিয়াছেন ; প্ৰসিদ্ধ ঔপন্যাসিকেরা এই বরপণ সমস্যাকে কেন্দ্ৰ করিয়া হৃদয়বিদারক উপন্যাস লিখিয়াছেন, এমন কি, স্নেহলতা হইতে আরম্ভ করিয়া আরও কয়েকজন হতভাগিনী কুমারী পিতামাতাকে বরপণের অত্যাচার হইতে রক্ষা করিবার জন্য আত্মহত্যা পৰ্য্যন্ত করিয়াছেন ; কিন্তু তথাপি এই জঘন্য প্রথা দূর হয় নাই, বরং উহা উত্তরোত্তর যেন বাড়িয়াই চলিয়াছে। ইহার কারণ কি ? আমাদের মনে হয়, অর্থনীতিশাস্ত্রে যে Law of Demand and Supply, অৰ্থাৎ ‘চাহিদা ও যোগানের’ নিয়ম আছে, এখানেও সেই নিয়মই কাৰ্য্য করিতেছে।
মধ্যবিত্ত ভদ্র সম্প্রদায়ের প্রায় সকল পিতামাতাই চাহেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত বি-এ, এম-এ, পাশ করা সরকারী চাকুরিয়া অথবা হবু-চাকুরিয়া জামাই। অন্ততপক্ষে উকীল, ডাক্তার, অধ্যাপক অথবা হবু-উকীল প্রভৃতি হইলেও চলে। কিন্তু এই শ্রেণীর ছেলের সংখ্যা খুব বেশী নহে, তার উপর জাতিভেদ এবং অসবৰ্ণ বিবাহের অপ্রচলন সেই সংখ্যা সমস্যাকে আরও কঠিন করিয়া তুলিয়াছে। ফলে বিবাহের বাজারে এই শ্রেণীর “শিক্ষিত” বরের দাম ক্ৰমাগত বাড়িয়াই চলিয়াছে। বৰ্তমানে বিয়ের বাজারে “আই-সি-এস” বরের মূল্য তিরিশ হাজার হইতে পঞ্চাশ হাজার টাকা,—ডেপুটী, মুন্সেফ প্রভৃতির দর দশ হাজার হইতে পনের হাজার টাকা পৰ্য্যন্ত উঠিয়াছে। এটর্ণী, উকীল, ডাক্তার, ব্যারিস্টার এবং বিলাতফেরত অন্যান্য শ্রেণীর বরের মূল্যও আট দশ হাজার টাকার কম নহে। সুতরাং মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের পক্ষে মেয়ের বিবাহ দেওয়া যে দুঃসাধ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা আর বিচিত্ৰ কি ! সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থেরা যতদিন ধনীদের অনুকরণে এবং তাহাদের সঙ্গেপাল্লা দিয়া এই বিশেষ শ্রেণীর “বর” খুঁজিবে, ততদিন বরপণ সমস্যার সমাধান হইবে না বলিয়াই আমাদের বিশ্বাস ।
তবে ভবিষ্যতে কয়েকটি কারণে এই বরপণ সমস্যার জটিলতা হ্রাস হইতে পারে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের বি-এ, এম-এ পাশ করা ছেলেদের এবং উকীল, ডাক্তার প্রভৃতির অথোপাৰ্জ্জনের অক্ষমতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহাদের দুৰ্দ্দশা চোখের উপর দেখিয়া মেয়ের বাপদের এই শ্রেণীর ছেলেদের উপর ঝোঁক কমিতে পারে । দ্বিতীয়ত, মেয়েদের বেশী বয়সে বিবাহ হইতেছে, তাহারা ছেলেদের মতই লেখাপড়াও শিখিতেছে। সুতরাং “বর মনোনয়ন” ব্যাপারে মেয়েদের মতামত অনেকক্ষেত্ৰে লইতে হইতেছে। আর অর্থ উপার্জনে অক্ষম “শিক্ষিত ছেলেদের” এই সব মেয়েরা ভবিষ্যতে পছন্দ করিবে কি না সন্দেহ। তৃতীয়ত, পূর্বোক্ত দ্বিতীয় কারণেই কোন কোন ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা “পরস্পরকে ভালবাসিয়া” বিবাহ করিতেছে এবং এরূপ বিবাহ প্ৰায়ই ‘অসবর্ণ’ হইতেছে। ভবিষ্যতে এরূপ বিবাহের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইবার সম্ভাবনাই দেখা যাইতেছে। বলা বাহুল্য, এ সব ক্ষেত্রে বরপণ সমস্যার প্রশ্ন উঠিবে না।
সে যাহাই হউক, বৰ্ত্তমানে এই “বরপণ সমস্যার” জন্য মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের মধ্যে অনেক বয়স পৰ্য্যন্ত মেয়েদের অনুঢ়া থাকিতে হইতেছে। ছেলেরাও এই আর্থিক সমস্যার দিনে অনেক সময় ৩৫|৪০ বৎসর বয়স পৰ্য্যন্ত অবিবাহিত থাকিতেছে । ইহার ফল মধ্যবিত্ত ভদ্র সম্প্রদায়ের পক্ষে কোনদিক দিয়াই কল্যাণকর হইতেছে না। নানা কারণে বাল্যবিবাহ বাঞ্ছনীয় নহে স্বীকার করি ; কিন্তু ছেলেমেয়েরা যদি ৩০|৩৫ বৎসর বয়স পৰ্যন্ত অবিবাহিত থাকে, তবে তাহার পরিণামও ভাল হইতে পারে না। উহার ফলে স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই উৎপাদিকা শক্তি হ্রাস হয়, এমন কি, বংশলোপের সম্ভাবনাও দেখা দেয়। উচ্চ জাতীয় হিন্দুদের মধ্যে জনসংখ্যা হ্রাসের ইহা একটি প্রধান কারণ, সন্দেহ নাই।
পূৰ্বেই বলিয়াছি, নিম্নজাতীয় হিন্দুদের মধ্যে সমস্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকার। ইহাদের মধ্যে “কন্যাপণ” প্ৰথাই প্রচলিত, অর্থাৎ মূল্য দিয়া কন্যা ক্ৰয় করিয়া বিবাহ করিতে হয় । বাল্যবিবাহও ইহাদের মধ্যে সমধিক প্ৰচলিত । তিন চার বৎসরের মেয়েরও বিবাহ হয় । সারদা আইন ইহার কোন পরিবর্ত্তন ঘটাইতে পারে নাই এবং যে-আকারে ঐ আইন প্ৰবৰ্ত্তিত হইয়াছে, তাহাতে কোনদিন নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্য হইতে যে বাল্যবিবাহ দূর হইবে, তাহারও কোন সম্ভাবনা দেখিতেছি না। এই সব নিম্নজাতিদের মধ্যে কোন এক অজ্ঞাত ”জৈবনিক” ( Biological ) কারণে কন্যার সংখ্যা সাধারণত খুব কম হওয়াতে সমস্যা আরও ঘোরালো হইয়াছে। মোটের উপর ফল দাঁড়াইতেছে এই যে, নিম্নজাতীয় হিন্দুদের মধ্যে অনেকেই অর্থের অভাবে “কন্যাপণ” দিয়া বেশী বয়স পৰ্য্যন্ত বিবাহ করিতেই পারে না । বহু বৎসর ধরিয়া সেজন্য তাহাদিগকে অর্থসঞ্চয় করিতে হয়। অবশেষে প্রৌঢ় বয়সে কিছু অর্থসঞ্চয় করিয়া তাহারা বিবাহ করে। কিন্তু কন্যার বয়স যত বেশী হয়, তত বেশী পণ দিতে হয়। সুতরাং যাহারা বেশী কিছু অর্থ সঞ্চয় করিতে পারে না, তাহাদের বাধ্য হইয়া অল্পবয়সের মেয়েকেই বিবাহ করিতে হয়। ৪৫|৫০ বৎসরের প্রৌঢ় ব্যক্তি চার-পাঁচ বৎসরের একটি মেয়েকে বিবাহ করিতেছে—এদৃশ্য গ্রাম অঞ্চলের নিম্নজাতীয় হিন্দুদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায়। ইহার পরিণাম বড়ই শোচনীয়। সেই বালিকা পত্নী যুবতী হইবার পূর্ব্বেই হয়ত বৃদ্ধ স্বামী ভবলীলা সম্বরণ করে। রাখিয়া যায় একটি নিঃসন্তানা বলবিধবা । একদিকে বৃদ্ধের বংশলোপ হয়, অন্যদিকে অরক্ষিতা যুবতীবিধবা সমাজের পক্ষে একটা জটিল সমস্যা হইয়া দাঁড়ায়। যদি বিধবা বিবাহের সুপ্রচলন থাকিত, তবে এই সমস্যার একটা সমাধান হইত। কিন্তু তাহা না থাকাতে ইহারা সমাজে দুর্নীতি ও ব্যভিচারের বিস্তারেই সহায়তা করে।
আমরা যে সব কথা বলিতেছি, তাহা অনেকের নিকট অপ্রিয় বোধ হইবে জানি। কিন্তু যতই অপ্রিয় হৌক, হিন্দুসমাজের কল্যাণের জন্য ইহা প্ৰকাশ্যভাবে স্বীকার করা ছাড়া গত্যন্তর নাই। হিন্দুসমাজের নিম্নজাতিরা যে ক্রমে লুপ্ত হইয়া যাইতেছে, তাহার জন্য বাল্যবিবাহ, কন্যাপণ এবং পুরুষদের বিবাহের অক্ষমতাই প্ৰধানত দায়ী। আমাদের জীবনের মধ্যেই পল্লী অঞ্চলে চোখের উপরে বহু জাতিকে ধীরে ধীরে লুপ্ত হইতে দেখিয়াছি। বহু গ্রামে ধোপা, ভূইমালী, বেহারা, ধীবর, নাপিত, কুমার, তেলী, সূত্রধর, পাটনী প্রভৃতি জাতির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। যে সব গ্রামে এই সব জাতীয় লোক এখনও আছে—সেখানেও তাহদের বংশে বালকবালিকার সংখ্যা কম । বয়স্ক লোকদের সংখ্যাই বেণী । অর্থাৎ ৪০|৪৫ বৎসর পরে উহাদের সংখ্যা আরও কমিয়া যাইবে এবং শেষ পৰ্য্যন্ত বংশে বাতি দিতে হয়ত কেহই থাকিবে না ।
ডা. রাধাকমল মুখোপাধ্যায় তাহার “বাঙ্গলা ও বাঙ্গালী” গ্রন্থে এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, হিন্দুসমাজে নিম্নজাতিদের সংখ্যা বাড়িতেছে, আর উচ্চজাতিদের সংখ্যা হ্রাস হইতেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি মাহিষ্য, রাজবংশী ও নমঃশূদ্ৰদের সংখ্যাবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করিয়াছেন। ডা. মুখোপাধ্যায়ের এই সিদ্ধান্ত আমরা গ্ৰহণ করিতে পারিলাম না । মাহিষ্য, রাজবংশী ও নমঃশূদ্র এই তিনটী জাতির সংখ্যা কিছু বাড়িতেছে বটে, বোধ হয় এখনও ইহাদের হাতে কৃষিকাৰ্য্য আছে বলিয়া ; কিন্তু এই তিনটি জাতি ছাড়া হিন্দু সমাজের অন্য সমস্ত নিম্নজাতির সংখ্যা কমিতেছে। এমন কি কোন কোন নিম্নজাতির অস্তিত্ব লুপ্ত হইবার উপক্রম হইয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, বেহারা, ধোপা, নাপিত, কুমার, মালী, ঝল্লমল্ল, ক্ষত্ৰিয়, কোচ, তিয়ার, হদি, হাজ্ব, লুপ্ত মাহিষ্য ( পাটনী), হাড়ি, ডোম, ভুঁইমালী, মুচি, রহিদাস ( চৰ্ম্মকার), জালিয়া, কাওরা, লোহার প্রভৃতি জাতিগুলির জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে হ্রাস হইতেছে। ১৯২১ সাল ও ১৯৩১ সালে এই দুইটি আদমসুমারীর লোকসংখ্যার তুলনা করিলে দেখা যাইবে, ইহাদের বংশ লোপ আসন্ন ।
উচ্চজাতীয় ভদ্র সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজেদের সমস্যার কথাই চিন্তা করেন। তাঁহাদের যত কিছু সংস্কারবুদ্ধি সবই নিজেদের কেন্দ্ৰ করিয়া । তাহাই অবশ্য স্বাভাবিক ; কিন্তু ইহাও ঠিক যে, এই সব নিম্নজাতীয়দের সমস্যা লইয়া যদি “শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা” চিন্তা না করেন এবং প্ৰতিকারের উপায় নিৰ্দেশ করিতে না পারেন, তবে সমগ্রভাবে হিন্দুসমাজের ক্ষয় নিবারণ করা যাইবে না ।
আমি বাঙলা দেশের যশোর, নদীয়া, ফরিদপুর ও পাবনা জেলার কতকগুলি গ্রামের কথা জানি। সেখানে অ-বাঙালী হিন্দু বেহারা, ধোবা, নাপিত প্রভৃতি আসিয়া বাঙালী হিন্দুর স্থান পূরণ করিতেছে। কিছুদিন পূর্ব্বে ময়মনসিংহ জেলা হিন্দু সম্মেলনে সভাপতি এবং পাবনা জেলা হিন্দু সম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি দেখাইয়াছেন যে, ঐ দুই জেলার গ্রামসমূহে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ক্রমশ লুপ্ত হইতেছে। বাঙলার মফঃস্বলের অনেক খেয়াঘাট হিন্দুস্থানীরা দখল করিয়া ফেলিয়াছে। সেজন্য কেবল ব্যবসাদার হিন্দুস্থানীদের দোষ দিয়া লাভ নাই। বাঙালী পাটনী যদি না পাওয়া যায়, তবে ভিন্ন প্ৰদেশাগত লোকেরাই সেই কাজের ভার গ্রহণ করিবে। বাঙলার উচ্চ জাতীয় ভদ্রসম্প্রদায়ের সঙ্গে যদি নিম্নজাতীয় হিন্দুদের যোগসূত্ৰ থাকিত, তবে তাহারা নিশ্চয়ই হিন্দুসমাজের নিম্নস্তরের অস্তিত্ব লোপের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিত। কিন্তু বৰ্তমানে তাহার কোন লক্ষণ দেখিতে পাইতেছি না ।
চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন