১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ডা. মুঞ্জে ও বর্ত্তমান হিন্দুসমাজের দুৰ্গতি

১৯২৩ সালে অসহযোগ আন্দোলনের শেষ পর্বে মালাবারে যে নৃশংস কাণ্ড ঘটে, তাহা সাধারণত “মোপলা বিদ্রোহ” নামে পরিচিত। মালাবারের মুসলমানদিগকে ‘মোপলা’ বলে। মালাবারের এই মোপলারা ১৯২১ সালে স্থানীয় হিন্দুদের সঙ্গে একত্রে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়াছিল—মহাত্মা গান্ধীর ‘অহিংসার’ বাণীও তাহাদের মধ্যে প্রচারিত হইয়াছিল। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনের অবসানে সহসা মোপলাদের মধ্যে একটা ভীষণ প্ৰতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফলে মালাবারে হিন্দুদের সঙ্গে মোপলাদের প্রবল সঙ্ঘর্ষ হয়। মোপলারা জোর করিয়া ৩৪ হাজার হিন্দুকে ‘মুসলমান’ করিয়া ফেলে, বহু হিন্দু নারী মোপলাদের দ্বারা ধৰ্ষিত হয়, বহু হিন্দুমন্দির কলুষিত হয়। মালাবারে হিন্দুরাই সংখ্যাধিক, তৎসত্ত্বেও তাহারা এইরূপে মোপলাদের হাতে সর্বপ্রকারে বিপৰ্য্যস্ত হয়।


‘মোপলা বিদ্রোহের’1 এই শোচনীয় কাহিনী ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়াইয়া পড়ে এবং হিন্দুদের মধ্যে স্বভাবতঃই প্রবল চাঞ্চল্য ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই সময়ে শৃঙ্গেরী মঠের জগৎগুরু শঙ্করাচাৰ্য্য মধ্যপ্রদেশের প্রসিদ্ধ হিন্দু নেতা ডা. বি এস মুঞ্জেকে প্রকৃত অবস্থা স্বচক্ষে প্ৰত্যক্ষ করিবার জন্য মালাবারে যাইতে অনুরোধ করেন । ডা. মুঞ্জে মালাবারে গিয়া সমস্ত অবস্থা অনুসন্ধান করিয়া জগৎগুরু শঙ্করাচাৰ্য্যের নিকট একটি রিপোর্ট দেন। ডা. মুঞ্জের এই রিপোর্ট বৰ্ত্তমানে দুষ্পাপ্য। আমরা বহু চেষ্টা করিয়া পুণার “মারাঠা” পত্রের সম্পাদক শ্ৰীযুত কেটকারের সৌজন্যে উহার একখণ্ড সংগ্ৰহ করিয়াছি। ঐ রিপোর্টে ডা. মুঞ্জে মালাবারের হিন্দুদের অবস্থা আলোচনা প্রসঙ্গে সাধারণভাবে সমগ্ৰ ভারতের হিন্দুসমাজের দুৰ্গতির যে সব কারণ বিশ্লেষণ করিয়াছেন এবং প্রতিকারের পন্থা নিৰ্দেশ করিয়াছেন, এই ১৭ বৎসর পরেও তাহার সত্যতা আমরা মৰ্ম্মে মৰ্ম্মে উপলব্ধি করিতেছি। ভারতের সমস্ত প্রদেশের হিন্দুদেরই ডা. মুঞ্জের এই মূল্যবান রিপোর্টের মৰ্ম্ম অবগত হওয়া এবং উহা লইয়া আলোচনা করা উচিত। কেননা উহার ফলে হিন্দুসমাজের ব্যাধির মূল কোথায়, তাহা উপলব্ধি করা সহজ হইবে এবং প্ৰতিকারের পন্থা অবলম্বন করাও সম্ভবপর হইবে।
মালাবারের হিন্দুদের শোচনীয় এবং অসহায় অবস্থার জন্য ডা. মুঞ্জে ব্ৰাহ্মণদিগকেই দায়ী করিয়াছেন, কেননা প্ৰাচীনকাল হইতেই ব্ৰাহ্মণেরাই হিন্দু সমাজ শাসন করিতেছেন এবং এ যুগেও তাহাদের প্রভাব অসীম। তাঁহাদেরই প্ৰবৰ্ত্তিত নানা সামাজিক অনুশাসন, বিধিনিষেধ, আচারব্যবহারের কুফল ভারতের অন্যত্র যেমন, মালাবারেও তেমনি হিন্দুরা ভোগ করিতেছে। এস্থলে উল্লেখযোগ্য যে, ডা. মুঞ্জে নিজে উচ্চশ্রেণীর মারাঠা ব্ৰাহ্মণ। ডা. মুঞ্জে তাঁহার রিপোর্টে বলিয়াছেন:-

“মালাবারের ব্ৰাহ্মণদের নিজেদের পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠতাসম্বন্ধে এমনই অদ্ভুত ধারণা যে, কোন অ-বৰ্ণ বা নিম্নজাতীয় হিন্দু তাঁহাদের নিকটে অন্ততপক্ষে ৫০|৬০ ফিটের মধ্যে আসিতে পারে না। এই কুপ্রথার মধ্যে শোচনীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, ঐ সব অ-বর্ণ হিন্দুরা যতক্ষণ হিন্দু থাকে, ততক্ষণই তাহাদের ঐ নিয়ম পালন করিতে হয়,—কিন্তু যেই তাহারা মুসলমান হইয়া ‘খাঁ’, ‘সৈয়দ’ প্ৰভৃতি পদবী গ্ৰহণ করে, অমনি তাহারা স্পশ্য ও আচরণীয় হইয়া উঠে, ব্ৰাহ্মণেরা আর তাহদের সান্নিধ্য অপবিত্র মনে করেন না। আর ঐ সব নবদীক্ষিত মোপলা—যাহারা কয়েক ঘণ্টা পূর্ব্বেই হিন্দুরূপে অস্পৃশ্য ও ঘৃণ্য ছিল—তাহারাই উচ্চ জাতীয় হিন্দুদের উপর প্রভুত্ব করিতে কুণ্ঠিত হয় না। হিন্দুসমাজের এই অস্পৃশ্যতা ও অনাচরণীয়তা সম্বন্ধীয় বিধিবিধান ‘থিয়া’, ‘পঞ্চমা’ প্ৰভৃতি অ-বর্ণ হিন্দুদের চিন্তা ও চরিত্রের উপর ঘোর অনিষ্টকর প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। মালাবারের হিন্দুসমাজে ইহারাই সংখ্যাধিক এবং ইহারা পরিশ্রমী, কষ্টসহ, দৈহিক শক্তিশালী। বিপদের সময়ে মোপলাদের আক্রমণ হইতে অন্যান্য হিন্দুদিগকে ইহারাই রক্ষা করিবার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু পূর্বোক্ত সামাজিক পাপের ফলে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা ইহাদের সহানুভূতি হারাইয়াছে। যদি ইহাদিগকে হিন্দুসমাজের মধ্যে সম্মানের স্থান দিয়া সঙ্ঘবদ্ধ করা যায়, তবেই কেবল হিন্দু সমাজ আত্মরক্ষা করিতে পরিবে।”


ডা. মুঞ্জে মালাবারের হিন্দুসমাজের সম্বন্ধে যে মন্তব্য করিয়াছেন, বাঙলার হিন্দু সমাজের সম্বন্ধেও ঠিক সেই মন্তব্য করা যাইতে পারে। এখানেও ‘অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয়’ হিন্দুদিগকে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখিয়া থাকে। কিন্তু যে মুহূর্তে ঐ সব ‘অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয়’ হিন্দু হিন্দুধৰ্ম্ম ত্যাগ করিয়া মুসলমান বা খ্রীস্টান হয়, সেই মুহূৰ্ত্ত হইতে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা তাহাদিগকে ভয় ও সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দেখিতে থাকে। “অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয়” অর্থাৎ নিম্নজাতীয় হিন্দুদের প্রতি উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের এই ব্যবহারের ফলে হিন্দু সমাজ বহুধাখণ্ডিত হইয়া পড়িয়াছে,—নিম্নজাতীয় হিন্দুরা নিজেদের আর ‘হিন্দু’ বলিয়া গৰ্ব্ববোধ করিতে পারে না।


মালাবারের অধিকাংশ মোপলাই হিন্দুদের বংশধর। কিরূপে মালাবারের মোপলাদের সংখ্যা এরূপ বাড়িয়া গেল, তাহাদের এতটা প্রাধান্যই বা কিরূপে সম্ভব হইল, তাহার কারণ বর্ণনা করিতে গিয়া ডা. মুঞ্জে বলিতেছেন:-
“প্রচলিত কাহিনী এই যে, ৮ শত বৎসর পূর্ব্বে মালাবারের হিন্দু রাজা ব্ৰাহ্মণদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় নিজের রাজ্যমধ্যে বসতি স্থাপন করিবার জন্য আরব মুসলমানদিগকে সর্ব্বপ্রকার সুবিধা প্রদান করেন। রাজা এই সব আরবকে মুসলমান ধৰ্ম্মপ্রচার করিবার জন্য অনুমতি তো দিলেন-ই, তাহাদিগকে উৎসাহ ও সাহায্যদানকল্পে এমন আদেশ ও জারী করিলেন যে, প্ৰত্যেক হিন্দু ধীবর পরিবারের অন্তত একজন পুরুষকে মুসলমান হইতে হইবে। এইরূপে একদিকে রাজার প্রশ্রয় ও সাহায্য, অন্যদিকে মুসলমানদের উৎসাহ, জবরদস্তি এবং প্রলোভনের ফলে দলে দলে হিন্দুরা মুসলমান হইতে লাগিল, হিন্দুরা জীবনসংগ্রামে পিছাইয়া পড়িতে লাগিল। আর জামোরিন রাজাদের তথা হিন্দুসমাজের গুরু ও পরামর্শদাতা ব্ৰাহ্মণেরা প্রসন্ন ঔদাসিন্যের সঠিত সেই দৃশ্য দেখিতে লাগিলেন। তাঁহারা ভাবিলেন, ‘অস্পৃশ্য’ হিন্দু তথা মুসলমান সম্প্রদায় উভয়ের আক্রমণ হইতেই তাঁহাদের পবিত্ৰ সনাতন ধৰ্ম্ম নিরাপদ রহিল। ব্ৰাহ্মণেরা সমুদ্রযাত্রার যে নিষেধবিধি প্ৰবৰ্ত্তন করিয়াছিলেন, এ সমস্ত তাহারই প্ৰত্যক্ষ পরিণাম। মালাবার সমুদ্রকুলবর্ত্তী রাজ্য—উহা রক্ষা করিবার জন্য নৌবহর ও নৌসৈন্য চাই। কিন্তু সমুদ্রযাত্ৰা নিষিদ্ধ বলিয়া হিন্দুরা ঐ সব কাজ করিতে পারে না। কাজেই রাজাকে উহার জন্য আরব মুসলমান ও উহাদের দ্বারা মুসলমান ধৰ্ম্মে দীক্ষিত হিন্দু বংশধরদের উপরই নির্ভর করিতে হইল।”


অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের মস্তিষ্ক হইতে উদ্ভূত একটা অস্বাভাবিক সামাজিক নিষেধবিধির জন্য মালাবারের হিন্দু রাজার নির্দেশে হিন্দুসমাজ আত্মহত্যা করিতে প্ৰবৃত্ত হইল। পৃথিবীর কোন সভ্য সমাজে এরূপ নির্ব্বুদ্ধিতাপ্রসূত আত্মহত্যার দৃষ্টান্ত বিরল। বাঙলার হিন্দুসমাজেও সমুদ্রযাত্রা নিষেধবিধি কয়েক শতাব্দী ধরিয়া কি ঘোর অনিষ্ট করিয়াছে, তাহা আমরা সকলেই জানি। চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্যের কারণই ইহাই। এরূপ আত্মহত্যাকর সামাজিক বিধান হিন্দুসমাজে আরও বহু আছে।


সাধারণভাবে বৰ্ত্তমান হিন্দুসমাজের দুৰ্গতির মূল নির্ণয় করিতে গিয়া ডা. মুঞ্জে বলিয়াছেন যে, হিন্দু সমাজের গঠন ব্যবস্থাই তাহার দৌৰ্ব্বল্যের প্ৰধান কারণ। হিন্দু সমাজ নানা জাতি ও নানাস্তরে বিভক্ত। ইহারা প্ৰত্যেকে স্বতন্ত্র, প্ৰত্যেকের সংস্কৃতি, শিক্ষা, আচারব্যবহার স্বতন্ত্র, এক অংশের সঙ্গে অপর অংশের প্রাণের যোগ নাই । পরস্পরের প্রতি সমবেদনা নাই। সুতরাং এই সমাজে সংহতিশক্তি আসিবে কোথা হইতে ? ইহার এক অংশ আক্রান্ত হইলে, অন্য অংশ যে সাহায্যাৰ্থ অগ্রসর হইবে না, তাহা আর আশ্চৰ্য্য কি ? যতদিন হিন্দুরা স্বাধীন ছিল, ততদিন এই জাতিভেদের উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ বিশেষ কোন বাধা পায় নাই। উচ্চজাতিরা নিম্নজাতিদের অবজ্ঞা করিত, তাহাদের পায়ের তলায় রাখিত, আর নিম্নজাতিরাও সেই দাসত্বকে অদৃষ্ট ও কৰ্ম্মফলের দোহাই দিয়া নিরুপায়ভাবে মানিয়া লইত। কিন্তু যখন ভিন্ন ধৰ্ম্মাবলম্বী বিদেশীরা বিজয়ীবেশে এদেশে আসিল এবং প্ৰভু হইয়া বসিল, তখন হইতে অবস্থার পরিবর্ত্তন ঘটিল। প্ৰথমে মুসলমান ধৰ্ম্মাবলম্বী পাঠান ও মোগলেরা, তারপর খ্রীস্টান ইউরোপীয়েরা। ইহাদের কাহারও মধ্যে জাতিভেদ নাই,—ইহাদের সামাজিক ব্যবস্থায় সকলেই সমান, স্পশ্য অস্পৃশ্যের বিচার তো নাই-ই।


 নিম্নজাতিরা সহজেই এই তথ্য আবিষ্কার করিল এবং বিদেশী প্ৰভুদের আশ্রয় ও অনুগ্রহ প্রার্থনা করিতে বিলম্ব করিল না। বিদেশী প্রভুরাও তাহাদিগকে মানুষের মৰ্যাদা দিতে লাগিল। যাহারা এতকাল স্বীয় সমাজের উচ্চশ্রেণীর নিকট অবজ্ঞা ও অপমান পাইয়া আসিয়াছে, তাহারা বিদেশী প্ৰভুদের নিকট ভিন্নরূপ ব্যবহার পাইয়া, স্বভাবতঃই তাহাদের অনুগত হইয়া পড়িল। ইহার ফলে হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণীয় ও নিম্নবর্ণীয়দের মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়িয়া গেল,—উচ্চবর্ণীয়দের প্রতি নিম্নবর্ণীয়দের ঘেটুকু সহানুভূতি ও মমত্বের ভাব ছিল, তাহাও হ্রাস পাইতে লাগিল। তারপর নিম্নবণীয়রা যখন দেখিল যে, ঐসব বিদেশী প্ৰভুদের নিকট উচ্চবর্ণীয়েরাও মাথা নত করিতে লাগিল, তাহাদের চাকুরী গ্ৰহণ করল, তখন স্বভাবতঃই উচ্চবর্ণীয়দের প্ৰতি নিম্নবর্ণীয়দের শ্রদ্ধাও ক্রমে ক্ষীণ হইতে লাগিল৷ আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তীক্ষ্ণধী ব্ৰাহ্মণেরা এই পরিবৰ্ত্তন দেখিয়া ও দেখিলেন না, ইহার সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া আত্মরক্ষার তথা সমাজরক্ষার কোন ব্যবস্থা করিলেন না। ফলে আজ নিম্ন জাতীয়েরা হিন্দুসমাজ হইতে পৃথক হইয়া পড়িবে, এরূপ আশঙ্কার কারণ দেখা দিয়াছে। বিদেশী শাসকেরা একটা কৃত্ৰিম ‘তপসীলী’ সম্প্রদায় সৃষ্টি করিয়া সেই বিচ্ছেদ ও স্বাতন্ত্র্যকে পাকা করিবার ব্যবস্থা করিয়াছে।


ডা. মুঞ্জে মালাবারে লক্ষ্য করিয়াছিলেন যে, হিন্দুরা স্বভাবতই শান্ত, নিরীহ এবং “বশম্বদ’ প্ৰকৃতির; তাহারা দুৰ্দ্দান্ত এবং বেপরোয়া প্ৰকৃতির মুসলমান প্ৰতিবাসীদের সঙ্গে আঁটিয়া উঠিতে পারে না, সহজেই নীতি স্বীকার করে। হিন্দুদের এই প্রকৃতিগত দৌৰ্ব্বল্যের কারণ কি, ডা. মুঞ্জে তাহার বিশ্লেষণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। এস্থলে বলা যাইতে পারে, ডা. মুঞ্জে মালাবারের হিন্দুদের চরিত্রে যে সব ক্ৰটী লক্ষ্য করিয়াছেন, তাহা ভারতের সকল প্রদেশের হিন্দুদের চরিত্রেই লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং ডা. মুঞ্জের এই বিশ্লেষণ সকল প্রদেশের হিন্দুদের সম্বন্ধেই প্ৰযোজ্য। ডা. মুঞ্জেও সেই দিক হইতেই ইহার বিচার করিয়াছেন। ডা. মুঞ্জের মতে হিন্দু সমাজের এই প্ৰকৃতিগত দৌৰ্ব্বল্যের কারণ—(১) হিন্দুরা সাধারণত নিরামিষাশী, নিরামিষ খাদ্য মানুষকে শান্ত, শিষ্ট, নিরীহ করিয়া তোলে। (২) বৈদিক আদর্শ ছিল জীবনকে বীৰ্য্যবানের মত ভোগ করা। কিন্তু পরবর্ত্তী কালের বৌদ্ধধৰ্ম্ম, বৈষ্ণব ধৰ্ম্ম প্ৰভৃতির আদর্শ হইয়া দাঁড়াইল বৈরাগ্য ও ত্যাগ। এই আদর্শ হিন্দুদের ঘোর অনিষ্ট করিয়াছে। (৩) ‘অহিংসা পরম ধৰ্ম্ম’—এই অ-বৈদিক আদর্শ হিন্দু সমাজের সবল মনোবৃত্তিকে নষ্ট করিয়া দিয়াছে। (৪) বাল্যবিবাহও হিন্দুদের শারীরিক ও মানসিক দৌৰ্ব্বলের অন্যতম প্ৰধান কারণ। এমন কি, ডা. মুঞ্জের মতে বাল্যবিবাহ ও নিরামিষ আহার-এই দুইয়ে মিলিয়া হিন্দুসমাজের সর্ব্বনাশ করিয়াছে।
হিন্দুসমাজের সংহতিশক্তির অভাবের জন্য জাতিভেদই যে প্রধানত দায়ী, একথা ডা. মুঞ্জে পুনঃ পুনঃ দৃঢ়তার সঙ্গে বলিয়াছেন। কিন্তু তিনি সরাসরি জাতিভেদ প্রথা তুলিয়া দিবার প্রস্তাব করেন নাই। জাতিভেদের কুফলকে কিরূপে প্ৰতিহত করিয়া হিন্দুসমাজকে সঙ্ঘবদ্ধ ও সংহতিসম্পন্ন করা যায়, তাহারই উপায় চিন্তা করিয়াছেন। এ সম্বন্ধে ডা. মুঞ্জের সিদ্ধান্ত এই:-


(১) হিন্দুদের এমন একটা স্থান থাকা চাই যেখানে সমস্ত জাতি ও বর্ণের হিন্দু একত্ৰ মিলিত হইতে পারে। মুসলমানদের মসজিদ এইরূপ স্থান। এখানে উচ্চনীচ ধনী দরিদ্র ভেদ নাই, সকলে মিলিত হইয়া সামাজিক কল্যাণ ও সুখদুঃখের কথা আলোচনা করে। জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা-কণ্টকিত হিন্দুদের মধ্যে ঐ রূপ সাধারণ মিলনভূমি গড়িয়া উঠিতে পারে নাই। এখন হিন্দুসমাজের কল্যাণের জন্য দেবমন্দিরকে ঐরূপ মিলনক্ষেত্রে পরিণত করিতে হইবে। এখানে উচ্চনীচভেদ থাকিবে না, অস্পৃশ্যতা বর্জন করিতে হইবে। ডা. মুঞ্জে বলেন, ইহা একটা অসম্ভব প্ৰস্তাব নয়, পুরীর জগন্নাথ মন্দির এখনও সর্বজাতীয় হিন্দুর মিলনক্ষেত্র। জগন্নাথ মন্দিরের দৃষ্টান্ত সমস্ত গ্রামে নগরে অনুসরণ করিতে হইবে। ইহার ফলে হিন্দুসমাজের সংহতি শক্তি বাড়িবে।

 (২) অসবর্ণ বিবাহ প্রথার বহুল প্ৰচলন করিতে হইবে। এই প্ৰথা বৰ্ত্তমানে অপ্রচলিত হইলেও মোটেই অ-শাস্ত্রীয় নহে। অনুলোম ও প্ৰতিলোম বিবাহের ব্যবস্থা মনু ও অন্যান্য স্মৃতিকার সমর্থন করিয়াছেন। পূর্ব্বে হিন্দু সমাজে যে ইহা প্রচলিত ছিল, তাহার দৃষ্টান্তেরও অভাব নাই। ডা. মুঞ্জে মনে করেন যে, অসবৰ্ণ বিবাহ বহুল পরিমাণে প্রচলিত হইলে, জাতিভেদের তীব্ৰতা হ্রাস হইবে, হিন্দুসমাজের সংহতি শক্তিও বাড়িবে। অসবর্ণ বিবাহের সুফলের উপর ডা. মুঞ্জের এমন দৃঢ় বিশ্বাস যে, তাঁহার মতে এই ব্যবস্থা অবলম্বন করিলে হিন্দুসমাজের সমস্ত ব্যাধি দূর হইবে। তিনি অকুণ্ঠিত চিত্তে বলিয়াছেন—
I believe that it is the reversion to this “IDharinasastric’ sociology which will prove a panacea for all the social evils that beset the prescnt Hindu Society.


(৩) অস্পৃশ্যতা ও অনাচারণীয়তা বর্জ্জন। ডা. মুঞ্জে বলেন,—“হিন্দুসমাজের পক্ষে ইহাই বৰ্ত্তমান সময়ে সৰ্ব্বাপেক্ষা বেশী প্রয়োজন, কেননা ইহা ব্যতীত হিন্দুরা তাহাদের মাতৃভূমি ভারতবর্ষে নিজেদের প্রাধান্য রক্ষা করিতে পরিবে না এবং জীবনসংগ্রামে বিদেশী ও বিধর্ম্মীদের দ্বারা পদে পদে প্ৰতিহত হইবে।” সৰ্ব্বাগ্রে তথাকথিত অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয়দের মন্দির প্রবেশের অধিকার এবং অন্য সকলের সঙ্গে মিশিয়া দেবতার পূজা করিবার অধিকার স্বীকার করিয়া লইতে হইবে। তারপর তাহাদিগকে অন্য সমস্ত সামাজিক অধিকার দিতে হইবে। অস্পৃশ্য, অনাচরণীয় ও অবনতরূপে যাহাদিগকে আমরা পৃথক করিয়া রাখিয়াছি, তাহাদিগকে যদি আপনার করিয়া লইতে না পারি, তবে হিন্দুসমাজের ও হিন্দুজাতির ধবংস অনিবাৰ্য্য। উপসংহারে ডা. মুঞ্জে বর্তমান হিন্দু সমাজের সমস্যাকে দুইটি প্ৰধান ভাগে বিভক্ত করিয়াছেন—(১) জাতিভেদ প্ৰপীড়িত হিন্দুসমাজকে কিরূপে সঙ্ঘবদ্ধ ও সংহতিশক্তিম্পন্ন করিতে হইবে; (২) “নিরীহ ও শান্ত” হিন্দুকে কিরূপে সবল মনোবৃত্তিসম্পন্ন ও আত্মরক্ষায় সক্ষম করিয়া তুলিতে হইবে। ১৭ বৎসর পূর্বে ডা. মুঞ্জে হিন্দুসমাজের সম্মুখে যে সমস্যা তুলিয়া ধরিয়াছিলেন, এখনও আমরা তাহার সমাধান করিতে পারি নাই। অদূর ভবিষ্যতে যদি না করিতে পারি, তবে হিন্দুসমাজের পক্ষে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব।

• মালাবারের কট্টর সাম্প্রদায়িক মুসলমান । আরব থেকে এসে ভারতীয় নারী বিবাহ করে বংশবৃদ্ধি করেছে । প্রায়ই স্থানীয় হিন্দুদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাত । সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ ঘটেছিল ১৮৫২ খ্রীস্টাব্দে ।↩

চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।