১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

হিন্দুর জীবনী শক্তি হ্রাসের আশঙ্কা

আমাদের মনে হয়, হিন্দুসমাজের শ্রমিক, কৃষক ও শিল্পী জাতিগুলির মধ্যে একটা কৰ্ম্মবিমুখতা, জীবনে ঔদাসীন্যের ভাব এবং Will to live বা বাঁচিবার ইচ্ছার অভাব প্রবেশ করিয়াছে ।1 আর ইহারই অবশ্যম্ভাবী পরিণামস্বরূপ তাহাদের মধ্যে spirit of adventure বা দুঃসাহসিকতার অভাব ঘটিয়াছে। যে Aggressiveness বা জিগীষু সবল মনোবৃত্তির জন্য মানুষ জীবনসংগ্রামে অন্যের সঙ্গে প্ৰতিযোগিতায় পাল্লা দিতে পারে, জীবনের যাত্রাপথে অবলীলাক্রমে নূতন নূতন পথ বাছিয়া লয়, বাঙলার হিন্দুদের মধ্যে তাহা লোপ পাইতেছে। পক্ষান্তরে মুসলমানদের মধ্যে তাহা তুলনায় বেশী পরিমাণে আছে। সেই জন্যই দেখি, নূতন চরের জমিতে সাপ ও কুমীরের সঙ্গে লড়াই করিয়া মুসলমানেরা নূতন বসতি স্থাপন করে। সুন্দরবন অঞ্চলে জঙ্গল কাটিয়া বাঘের সঙ্গে তাল ঠুকিয়া তাহারাই গ্রাম গড়িয়া তােলে। আসামের জঙ্গল ও পাহাড়ে তাহারাই যাইয়া উপনিবেশন স্থাপন করে। জাহাজের লস্কর হইয়া উত্তাল সমুদ্রবক্ষে তাহারাই পাড়ি দেয়। বাঙলার গ্রামের হিন্দুদের মধ্যে এই দুঃসাহসিকতা-অজানা দুৰ্গম পথে যাত্রার সাহস আজ আর নাই। চাঁদ সদাগর, শ্ৰীমন্ত সদাগরের বংশ লোপ পাইয়াছে। বাঙ্গলার প্রিয় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্বজাতির গৌরব কীৰ্ত্তন করিয়া লিখিয়াছেনー
বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি,
আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই, নাগের মাথায় নাচি ।2

কিন্তু আজ বাঙ্গলার হিন্দুরা এই গৌরবের দাবী করিতে পারে কি ? যে সব কৃষক, শ্রমিক ও শিল্পী হিন্দু গ্রামে বাস করে, তাহারা সাতপুরুষের ভিটা আঁকড়াইয়াই পড়িয়া থাকে। নূতন চর অঞ্চলে বা সুন্দরবনে যাইয়া নূতন গ্রাম পত্তন করিবার প্রবৃত্তি বা উদ্যম তাহাদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায় না বা সেজন্য ঝুঁকি লইতেও তাহারা প্ৰস্তুত নহে। বাঙলা ছাড়িয়া আসামের দুৰ্গম অরণ্যে গিয়া যাহারা উপনিবেশ করিয়াছে, তাহদের মধ্যেও হিন্দুদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। এমন কি, বাঙলার কোন প্ৰাচীন গ্রামে গেলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, হিন্দুরা ঝোপঝাড় আবৃত এঁদো পুকুর ও ডোবাপরিপূর্ণ গ্রামের পুরাতন অংশে বাস করিতেছে। অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হইলেও উহা ছাড়িয়া গ্রামের ফাঁকা মাঠে নূতন বসতি করিবার প্রবৃত্তি বা উদ্যম তাহদের নাই। কিন্তু মুসলমানেরা ঐ ভাবে ‘সাতপুরুষের ভিটার’ মায়ায় আবদ্ধ থাকে না । তাহারা প্রয়োজন হইলে পুরাতন বসতি ছাড়িয়া স্বাস্থ্যকর অঞ্চলে গিয়া নূতন বসতি গড়িতে দ্বিধা করে না।


বাঙলা দেশে হিন্দুর তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা যে দ্রুতবাড়িয়া যাইতেছে, মুসলমানদের অধিকতুর সাহসিকতা, aggressiveness বা জিগীষু সবল মনোবৃত্তি তাহার একটা প্ৰধান কারণ, ইহা অস্বীকার করিয়া লাভ নাই । ইহার সঙ্গে বিবেচনা করিতে হইবে, মুসলমানদের মধ্যে বহু বিবাহ প্ৰথা এবং বিধবাবিবাহের সুপ্ৰচলন। দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরা যাইতে পারে, কোন নূতন চরে বা সুন্দরবনের জঙ্গলকাটা জমিতে ৫|৬ ঘর মুসলমান গিয়া বসতি করিল। তাহদের প্রায় প্ৰত্যেকের একাধিক স্ত্রী আছে, যে সমস্ত নারী বিধবা হইতেছে, তাহদেরও শীঘ্রই পুনর্বিবাহ হইবার পক্ষে কোন বাধা নাই। ইহাদের যেসব ছেলেমেয়ে হইতেছে, তাহারাও বিবাহযোগ্য হইতেই অতি সহজেই পরস্পরের সহিত বিবাহিত হইতেছে। জাতিভেদের কোন বাধা নাই। ইহার সঙ্গে আরও বিবেচনা করিতে হইবে, মুসলমানদের মধ্যে কৰ্ম্মের প্রতি অবজ্ঞা নাই, কোন কাৰ্য্যকেই তাহারা হীন মনে করে না । এই সমস্ত অবস্থা একত্র বিবেচনা করিলে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হইবে যে, ৩০|৪০ বৎসরের মধ্যেই পূর্বোক্ত ঐ ৫|৬ ঘর মুসলমানের বংশ কিরূপ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি হইবে এবং নূতন গ্রামে ৪০|৫০ ঘর মুসলমানের বসতি সহজেই বিস্তৃত হইয়া পড়িবে। ইহা আমাদের কল্পনামাত্র নয়, বাস্তবক্ষেত্রে এইভাবেই বাঙলা দেশে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং এখনও পাইতেছে।


আর একটা কারণ যে হিন্দুকৃষকের সংখ্যা হ্রাস, তাহাতে সন্দেহ নাই। ভারতবর্ষ বিশেষভাবে বাঙলা দেশ কৃষিপ্রধান। এখনও অধিকাংশ লোক এদেশে গ্রামেই বাস করে এবং কৃষিকাৰ্য্য করিয়া জীবনধারণ করে। সেই কৃষিকাৰ্য্যই যে ক্রমে হিন্দুদের হস্তচ্যুত3 হইতেছে এবং তাহারা ভূমিহীন হইয়া পড়িতেছে, ইহা বাঙলার হিন্দুদের পক্ষে আশঙ্কা ও উদ্বেগের কারণ। আরও দুর্লক্ষণের কথা, কৃষিকাৰ্য্য কেবল হিন্দুদের হস্তচ্যুতই হইতেছে না, কৃষির প্রতি হিন্দুসাধারণের একটা অবজ্ঞার ভাব আসিয়াছে। ‘লাঙ্গল ছুঁইলে অশুচি হয়’ বাঙলার অনেকস্থলে এমন কুসংস্কারের অস্তিত্বও দেখা যায়। ‘ধরিত্রী মাতার’ সঙ্গে বাঙলার গ্রামবাসীদের জীবনমরণ সম্বন্ধ, উহার সঙ্গে তাহাদের নাড়ীর টান, প্ৰাণের যোগ। বাঙলার হিন্দু যদি সেই ‘ধরিত্রী মাতার” ক্রোড় হইতে বিচ্যুত হয়, তবে সে বাঁচিবে কেমন করিয়া ?


যে-পূৰ্ব্ববঙ্গে মুসলমানদের সংখ্যা অত্যধিক বাড়িতেছে, সেই পূৰ্ব্ববঙ্গেই পাশাপাশি একই গ্রামে বাস করিয়া হিন্দুদের সংখ্যা এত নিম্নহারে বাড়িতেছে কেন, এ প্রশ্ন স্বভাবতঃই উঠিতে পারে। ইহা হইতে কি মনে হয় না যে, মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুদের জীবনীশক্তি তথা প্ৰজননশক্তি অনেক কম ? হিন্দুদের প্রজননশক্তি মুসলমানদের তুলনায় কম হওয়ার নানা কারণ থাকিতে পারে,—যথা— ( ১ ) হিন্দুরা প্ৰধানতঃ নিরামিষাশী, আর মুসলমানেরা প্ৰধানতঃ মাংসাশী ; (২) হিন্দুরা শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে মুসলমানদের অপেক্ষা বেশী অগ্রসর, আর শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে কম অগ্রসর অথচ সুস্থ, সবল, জীবনশক্তি বিশিষ্ট জাতির মধ্যে প্রজননশক্তি বেশী হয় ; (৩) হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানদের মধ্যে কৃষক ও শ্রমিকের সংখ্যা বেশী, আর এই শ্রেণীর লোকের মধ্যেই যে প্ৰজনন শক্তি বেশী হয়, ইহাও সুপরিচিত তথ্য ।
হিন্দুসমাজকে আজ এই সব তথ্য সম্বন্ধে বিশেষভাবে চিন্তা করিয়া জীবনসংগ্রামে আত্মরক্ষার উপায় স্থির কফিতে হুইবে ।

• কলিকাতায় হিন্দুদের মধ্যে আত্মহত্যার হার মুসলমানদের অপেক্ষা ৪.২ গুণ বেশী । ーলেখক↩

• ‘আমরা’ কবিতা ‘কুহু ও কেকা’ কাব্যগ্রন্থে প্রাপ্তব্য↩

• ১৯২১ সালে বাংলায় হিন্দুদের মধ্যে শতকরা ৬২ জন কৃষিজীবী আর মুসলমানদের মধ্যে শতকরা ৮৯ জন কৃষিজীবী । ーলেখক↩

গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।