ডা. ভগবান দাসের মতে জাতিভেদই
হিন্দুসমাজের বর্তমান দুৰ্গতির মূল কারণ। যাহা পূৰ্ব্বে সমাজের স্বাভাবিক
অবস্থায়।“বর্ণাশ্ৰমধৰ্ম্ম” ছিল, তাহাই কালক্রমে বিকৃত হইয়া এই ঘোর
অনিষ্টকর জাতিভেদ প্রথায় পরিণত হইয়াছে। মহাত্মা গান্ধী এবং আরও কোন কোন
মনীষীও এই রূপ কথা ইতিপূৰ্ব্বে বলিয়াছেন। কথাটা অনেকটা সত্য হইলেও, আমাদের
মনে হয়, ইহার সবখানি ঐতিহাসিক সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নহে। প্রাচীন
ভারতীয় আর্য্যদের মধ্যে বর্ণাশ্রম বা কৰ্ম্মবিভাগের উপর প্রতিষ্ঠিত
সমাজব্যবস্থা ছিল বটে, কিন্তু জাতিভেদ যে একেবারেই ছিল না এমন কথা বলা যায়
না। জাতিভেদের আরম্ভ হইয়াছিল সেই কালে, যে কালে দ্বিজাতি ও শূদ্র এই দুই
বৃহৎ শ্রেণীবিভাগ হইয়াছিল। দ্বিজাতি বলিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই
তিন বর্ণকে বুঝাইত। ইহারা সকলেই ছিলেন আর্য্য। এই তিন বর্ণের মধ্যে আহার
ব্যবহারে, বিবাহের আদান- প্রদানে বিশেষ কোন ভেদ ছিল না। ইহার পরেই একটা
দুর্ল্লঙ্ঘ্য গণ্ডী টানিয়া দেওয়া হইয়াছিল—আর সেই গণ্ডীর অপর পারে ছিল
শূদ্রেরা।
শূদ্র বলিতে ‘অনাৰ্য্যদের’ বুঝাইত। আর্য্যেরা ভারতে আসিয়া আদিম অধিবাসী অনাৰ্য্যদের যুদ্ধে পরাজিত করিয়া কতকাংশকে ধ্বংস করিয়া ফেলিলেন। যে সব অনার্য্য আর্য্যদের শরণাপন্ন হইল, তাহাদের দাস বা অনুগত হইয়া বাস করিতে সম্মত হইল, তাহারাই আখ্যা পাইল শূদ্র (মূল শব্দ ‘ক্ষুদ্র’)। তাহারা আর্য্যদের পরিচর্য্যা করিয়া তাহাদের সমাজের আওতায় কোনরূপে জীবন ধারণ করিতে লাগিল (‘পরিচর্য্যাত্মকং কৰ্ম্ম শূদ্ৰস্যাপি স্বভাবজং)। কিন্তু শুধু পরিচর্য্যার অধিকারটুকুই তাহারা পাইল,— আৰ্য্যেরা তাহাদের সঙ্গে আহার-ব্যবহার মেলা-মেশা করিতেন না, বৈবাহিক আদান-প্রদান তো দূরের কথা। ‘অস্পৃশ্যতা’ ও ‘অনাচরণীয়তার’ সূচনা হইল এইখানেই।
কিন্তু এইখানেই শেষ নয়। শূদ্রদের মধ্যেও আবার একটা গণ্ডী টানা হইল। তাহাদের মধ্যে যাহারা নিতান্ত হীন, অধম বা বৰ্ব্বর বলিয়া বিবেচিত হইল, তাহারা হইল ‘অন্ত্যজ’। ইহারা আর্য্যদের অধ্যূষিত গ্রামে বা নগরে থাকিতে পারিত না, উহার বাহিরে প্রান্তসীমায় থাকিতে বাধ্য হইত। শূদ্রেরা চতুর্থবৰ্ণ বলিয়া গণ্য হইয়াছিল। আর এই অন্ত্যজদের বলা হইত ‘পঞ্চমবৰ্ণ। 1 ভারতের সকল প্রদেশেই এই পঞ্চমবর্ণের অস্তিত্ব এককালে ছিল।
এখনও দক্ষিণ ভারতে বিশেষত মাদ্রাজে তাহার জীবন্ত নিদর্শন বিদ্যমান। এই পঞ্চমবর্ণয়েরা এমনই ‘হীন ও অধম’ যে, তাহারা গ্রাম বা সহরের এলাকার বাহিরে বাস করিতে বাধ্য হয়, রাজপথ দিয়া হাটিতে পারে না। সাধারণের ব্যবহার্য্য কূপ হইতে জল তুলিতে পারে না। ব্রাহ্মণ দেখিলে পলায়ন করে, পাছে তাহাদের গায়ের বাতাস লাগিয়া ব্রাহ্মণ অশুচি হয়। আমাদের বাঙ্গলা দেশেও অন্ত্যজদের বংশীয়েরা আছে, কিন্তু তাহাদের এতটা সামাজিক নিৰ্য্যাতন বা দুর্ভোগ সহ করিতে হয় না।
এই যে দ্বিজাতি, শূদ্র এবং অন্ত্যজ—ইহাই হিন্দুসমাজে প্রথম জাতিভেদ। আর্য্যেরা অবশ্য নিজেদের রক্তের বিশুদ্ধি তথা সভ্যতা সংস্কৃতি রক্ষার জন্যই এরূপ সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। কিন্তু উহার ফলে যে বিষবৃক্ষের বীজ উপ্ত হইয়াছিল, তাহাই কালক্রমে বৰ্দ্ধিত ও শাখা- প্রশাখা সমম্বিত হইয়া সহস্রশীর্ষ জাতিভেদরূপে প্রকট হইল।
হিন্দু সমাজে যে অস্পৃশ্যতারূপ ব্যাধি প্রবল হইয়া উঠিয়াছে, তাহারও ভিত্তি পূৰ্ব্বোক্ত আৰ্য-অনাৰ্য্য ভেদের উপর। দ্বিজাতির শূদ্র ও অন্ত্যজদের স্পর্শ করিতেন না, করিলে ‘ধৰ্ম্মহানি’ হইত, তাহাদের প্রস্তুত বা পৃষ্ট আহাৰ্য্য-পানীয় গ্রহণ করা তো দূরের কথা। কালক্রমে পরিচর্য্যার গুণে শূদ্রদের মধ্যে কেহ কেহ দ্বিজাতিদের স্পৃশ্য ও আচরণীয় হইল বটে, কিন্তু অনেকে পূৰ্ব্ববং অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয়ই রহিয়া গেল। অন্ত্যজদের তো কাহারও ভাগ্যের উন্নতি হইলই না। বাঙ্গলা দেশের হিন্দুসমাজে অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয় উভয়ই আছে। কতকগুলি জাতি অনাচরণীয়? (যাহাদের জল ‘চল’ নহে) কিন্তু অস্পৃশ্য নহে, – অপর কতকগুলি উভয়ই।
সুতরাং ডাক্তার ভগবান দাস যে বলিয়াছেন, প্রাচীনকালে হিন্দু- সমাজে বর্ণাশ্রম ছিল, জাতিভেদ ছিল না, তাহার মধ্যে এইটুকু সত্য যে, আৰ্য্য ‘দ্বিজাতিদের’ মধ্যে (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য) জাতিভেদ ছিল না,—আহার-ব্যবহার, বৈবাহিক আদান-প্রদান তাহাদের পরস্পরের মধ্যে চলিত। একের বংশধরেরা অন্যের বৃত্তি অবলম্বন করিতে পারিত। কিন্তু এরূপ “বিশুদ্ধ” বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা খুব বেশীদিন অব্যাহত ছিল বলিয়া মনে হয় না। মহাভারতের যুগেও দেখি,—দ্বিজাতিদের মধ্যে বৃত্তি অনেকটা বংশানুক্রমিক হইয়া উঠিয়াছে অর্থাৎ বর্ণাশ্রম জাতি- ভেদের আকার ধারণ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। ব্রাহ্মণের বংশধরেরা ব্রাহ্মণের বৃত্তিই অবলম্বন করিত, কেহ কদাচিৎ ক্ষত্রিয় বৃত্তি অবলম্বন করিত।
আবার ক্ষত্রিয়দের মধ্যেও কেহ কদাচিৎ ব্রাহ্মণ্য-বৃত্তি অবলম্বন করিত। কিন্তু লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, ক্ষত্ৰিয়বৃত্তি অবলম্বনকারী ব্রাহ্মণের “ক্ষত্ৰিয়” বলিয়া গণ্য হইতেন না, ব্রাহ্মণই থাকিয়া যাইতেন। যথা দ্রোণাচাৰ্য্য, কৃপাচাৰ্য্য, অশ্বথামা প্রভৃতি। পরশুরামের কথাও এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। বৈশ্য অধিরথ-পুত্র কর্ণ ক্ষত্ৰিয়বৃত্তি গ্রহণ করিলেও ক্ষত্রিয় বলিয়া গণ্য হন নাই। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য-এই তিন বর্ণের মধ্যে বিবাহের আদান-প্রদান চলিত বটে, কিন্তু তাহার দৃষ্টান্ত অল্প। এই সমস্ত হইতে বুঝা যায়, মহাভারতের যুগেই দ্বিজাতিদের মধ্যে জাতিভেদ বেশ দানা বাঁধিয়া উঠিয়াছিল এবং অনেকটা পাকাপাকি- ভাবেই ‘বৃত্তি’ বংশানুক্রমিক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।
সঙ্গে সঙ্গে আর একটা ব্যাপার ঘটিল—যাহাতে জাতিভেদের কাঠামো আরও বেশী দৃঢ়তর হইল। আর্য্যসমাজের প্রথমাবস্থায় দ্বিজাতিদের মধ্যে উচ্চনীচ-ভেদ বিশেষ ছিল না, সকলেরই মর্য্যাদা সমান ছিল। কিন্তু কালক্রমে নানা কারণে ব্রাহ্মণদের মর্যাদা খুব বাড়িয়া গেল, তাঁহারাই সমাজের শীর্ষস্থান অধিকার করিলেন। ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা ব্রাহ্মণের পরে এবং বৈশ্যের মর্য্যাদা ক্ষত্রিয়ের পরে নির্দিষ্ট হইল। ফলে, পরস্পরের মধ্যে আহারব্যবহার, বৈবাহিক আদানপ্রদান ক্রমশ লুপ্ত হইল। ব্রাহ্মণ যদি ক্ষত্রিয়ের চেয়ে বেশী মানী হন, তাহার বাড়ীতে অন্নগ্রহণ না করেন, তবে তিনি ক্ষত্রিয়ের কন্যাকে বিবাহ করিবেন কিরূপে? ক্ষত্ৰিয়ই বা ব্রাহ্মণকন্যার পাণি-পীড়নের সাহস সঞ্চয় করিবেন কিরূপে? মহাভারতে যে সমাজের দৃশ্য অঙ্কিত হইয়াছে, তাহাতে এই সব প্রথা তখনই যে অনেকটা বদ্ধমূল হইয়াছিল, তাহা বেশ বুঝিতে পারা যায়।
এইভাবে দ্বিজাতিদের মধ্যে জাতিভেদ যখন বেশ পাকারকম হইয়া দাঁড়াইল, তখন আর একটা জটিল সমস্যার সৃষ্টি হইল। বর্ণবিভাগকে গণ্ডী টানিয়া জাতিভেদে পরিণত করা যায়, কিন্তু সহস্ৰ চেষ্টা করিয়াও বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ বন্ধ করা যায় না। সেক্ষেত্রে জীবপ্রকৃতি মানুষের সকল বিধিনিষেধকে অগ্রাহ করিয়া সমাজশাসনের অনভিপ্রেত কাণ্ড করিয়া বসে। সুতরাং বিধিনিষেধ সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয়, ক্ষত্রিয়-বৈশ্য, বৈশ্য-ব্রাহ্মণ প্রভৃতির বৈবাহিক মিলন ঘটিতে লাগিল। ফলে, বিভিন্ন মিশ্র জাতি বা সঙ্করজাতির সৃষ্টি হইতে লাগিল। বলা বাহুল্য, এই প্ৰাকৃতিক নিয়ম হইতে অনাৰ্য্য শূদ্রেরাও বাদ গেল না-তাহাঁদের যুবকযুবতীদের সঙ্গেও ব্রাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়, বৈশ্যের বৈবাহিক মিলন ঘটিতে লাগিল। কালক্রমে এই যে সব সঙ্করজাতির সৃষ্টি হইল, তাহাদিগকে সমাজের কোথায় স্থান দেওয়া হইবে, ইহা এক মহাসমস্যা হইয়া দাড়াইল।
এই সমস্যার বিপুলতা ও জটিলতার প্রমাণ “মনুসংহিতা’ হইতে পাওয়া যায়। সঙ্করজাতির সৃষ্টি অবশ্য মোটেই বাঞ্ছনীয় ছিল না, বরং অত্যন্ত নিন্দনীয়ই ছিল। “গীতায়’ অৰ্জ্জুন বলিয়াছেন, ‘সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্যচ’ 2। কিন্তু তৎসত্ত্বেও “বৰ্ণসঙ্কর”দের কিছুতেই অগ্ৰাহ্য বা উপেক্ষা করা গেল না, সমাজে তাহাদিগকে স্থান দিতেই হইল; চারিবর্ণ বা চারিজাতি ভাঙ্গিয়া বহুবর্ণ বহুজাতিতে পরিণত হইল। এইরূপে জাতিভেদ বেশ জাঁকালো রকমে বহু বিচিত্ৰ মূৰ্ত্তিতে হিন্দুসমাজে তাহার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করিল।
চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।
শূদ্র বলিতে ‘অনাৰ্য্যদের’ বুঝাইত। আর্য্যেরা ভারতে আসিয়া আদিম অধিবাসী অনাৰ্য্যদের যুদ্ধে পরাজিত করিয়া কতকাংশকে ধ্বংস করিয়া ফেলিলেন। যে সব অনার্য্য আর্য্যদের শরণাপন্ন হইল, তাহাদের দাস বা অনুগত হইয়া বাস করিতে সম্মত হইল, তাহারাই আখ্যা পাইল শূদ্র (মূল শব্দ ‘ক্ষুদ্র’)। তাহারা আর্য্যদের পরিচর্য্যা করিয়া তাহাদের সমাজের আওতায় কোনরূপে জীবন ধারণ করিতে লাগিল (‘পরিচর্য্যাত্মকং কৰ্ম্ম শূদ্ৰস্যাপি স্বভাবজং)। কিন্তু শুধু পরিচর্য্যার অধিকারটুকুই তাহারা পাইল,— আৰ্য্যেরা তাহাদের সঙ্গে আহার-ব্যবহার মেলা-মেশা করিতেন না, বৈবাহিক আদান-প্রদান তো দূরের কথা। ‘অস্পৃশ্যতা’ ও ‘অনাচরণীয়তার’ সূচনা হইল এইখানেই।
কিন্তু এইখানেই শেষ নয়। শূদ্রদের মধ্যেও আবার একটা গণ্ডী টানা হইল। তাহাদের মধ্যে যাহারা নিতান্ত হীন, অধম বা বৰ্ব্বর বলিয়া বিবেচিত হইল, তাহারা হইল ‘অন্ত্যজ’। ইহারা আর্য্যদের অধ্যূষিত গ্রামে বা নগরে থাকিতে পারিত না, উহার বাহিরে প্রান্তসীমায় থাকিতে বাধ্য হইত। শূদ্রেরা চতুর্থবৰ্ণ বলিয়া গণ্য হইয়াছিল। আর এই অন্ত্যজদের বলা হইত ‘পঞ্চমবৰ্ণ। 1 ভারতের সকল প্রদেশেই এই পঞ্চমবর্ণের অস্তিত্ব এককালে ছিল।
এখনও দক্ষিণ ভারতে বিশেষত মাদ্রাজে তাহার জীবন্ত নিদর্শন বিদ্যমান। এই পঞ্চমবর্ণয়েরা এমনই ‘হীন ও অধম’ যে, তাহারা গ্রাম বা সহরের এলাকার বাহিরে বাস করিতে বাধ্য হয়, রাজপথ দিয়া হাটিতে পারে না। সাধারণের ব্যবহার্য্য কূপ হইতে জল তুলিতে পারে না। ব্রাহ্মণ দেখিলে পলায়ন করে, পাছে তাহাদের গায়ের বাতাস লাগিয়া ব্রাহ্মণ অশুচি হয়। আমাদের বাঙ্গলা দেশেও অন্ত্যজদের বংশীয়েরা আছে, কিন্তু তাহাদের এতটা সামাজিক নিৰ্য্যাতন বা দুর্ভোগ সহ করিতে হয় না।
এই যে দ্বিজাতি, শূদ্র এবং অন্ত্যজ—ইহাই হিন্দুসমাজে প্রথম জাতিভেদ। আর্য্যেরা অবশ্য নিজেদের রক্তের বিশুদ্ধি তথা সভ্যতা সংস্কৃতি রক্ষার জন্যই এরূপ সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। কিন্তু উহার ফলে যে বিষবৃক্ষের বীজ উপ্ত হইয়াছিল, তাহাই কালক্রমে বৰ্দ্ধিত ও শাখা- প্রশাখা সমম্বিত হইয়া সহস্রশীর্ষ জাতিভেদরূপে প্রকট হইল।
হিন্দু সমাজে যে অস্পৃশ্যতারূপ ব্যাধি প্রবল হইয়া উঠিয়াছে, তাহারও ভিত্তি পূৰ্ব্বোক্ত আৰ্য-অনাৰ্য্য ভেদের উপর। দ্বিজাতির শূদ্র ও অন্ত্যজদের স্পর্শ করিতেন না, করিলে ‘ধৰ্ম্মহানি’ হইত, তাহাদের প্রস্তুত বা পৃষ্ট আহাৰ্য্য-পানীয় গ্রহণ করা তো দূরের কথা। কালক্রমে পরিচর্য্যার গুণে শূদ্রদের মধ্যে কেহ কেহ দ্বিজাতিদের স্পৃশ্য ও আচরণীয় হইল বটে, কিন্তু অনেকে পূৰ্ব্ববং অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয়ই রহিয়া গেল। অন্ত্যজদের তো কাহারও ভাগ্যের উন্নতি হইলই না। বাঙ্গলা দেশের হিন্দুসমাজে অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয় উভয়ই আছে। কতকগুলি জাতি অনাচরণীয়? (যাহাদের জল ‘চল’ নহে) কিন্তু অস্পৃশ্য নহে, – অপর কতকগুলি উভয়ই।
সুতরাং ডাক্তার ভগবান দাস যে বলিয়াছেন, প্রাচীনকালে হিন্দু- সমাজে বর্ণাশ্রম ছিল, জাতিভেদ ছিল না, তাহার মধ্যে এইটুকু সত্য যে, আৰ্য্য ‘দ্বিজাতিদের’ মধ্যে (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য) জাতিভেদ ছিল না,—আহার-ব্যবহার, বৈবাহিক আদান-প্রদান তাহাদের পরস্পরের মধ্যে চলিত। একের বংশধরেরা অন্যের বৃত্তি অবলম্বন করিতে পারিত। কিন্তু এরূপ “বিশুদ্ধ” বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা খুব বেশীদিন অব্যাহত ছিল বলিয়া মনে হয় না। মহাভারতের যুগেও দেখি,—দ্বিজাতিদের মধ্যে বৃত্তি অনেকটা বংশানুক্রমিক হইয়া উঠিয়াছে অর্থাৎ বর্ণাশ্রম জাতি- ভেদের আকার ধারণ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। ব্রাহ্মণের বংশধরেরা ব্রাহ্মণের বৃত্তিই অবলম্বন করিত, কেহ কদাচিৎ ক্ষত্রিয় বৃত্তি অবলম্বন করিত।
আবার ক্ষত্রিয়দের মধ্যেও কেহ কদাচিৎ ব্রাহ্মণ্য-বৃত্তি অবলম্বন করিত। কিন্তু লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, ক্ষত্ৰিয়বৃত্তি অবলম্বনকারী ব্রাহ্মণের “ক্ষত্ৰিয়” বলিয়া গণ্য হইতেন না, ব্রাহ্মণই থাকিয়া যাইতেন। যথা দ্রোণাচাৰ্য্য, কৃপাচাৰ্য্য, অশ্বথামা প্রভৃতি। পরশুরামের কথাও এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। বৈশ্য অধিরথ-পুত্র কর্ণ ক্ষত্ৰিয়বৃত্তি গ্রহণ করিলেও ক্ষত্রিয় বলিয়া গণ্য হন নাই। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য-এই তিন বর্ণের মধ্যে বিবাহের আদান-প্রদান চলিত বটে, কিন্তু তাহার দৃষ্টান্ত অল্প। এই সমস্ত হইতে বুঝা যায়, মহাভারতের যুগেই দ্বিজাতিদের মধ্যে জাতিভেদ বেশ দানা বাঁধিয়া উঠিয়াছিল এবং অনেকটা পাকাপাকি- ভাবেই ‘বৃত্তি’ বংশানুক্রমিক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।
সঙ্গে সঙ্গে আর একটা ব্যাপার ঘটিল—যাহাতে জাতিভেদের কাঠামো আরও বেশী দৃঢ়তর হইল। আর্য্যসমাজের প্রথমাবস্থায় দ্বিজাতিদের মধ্যে উচ্চনীচ-ভেদ বিশেষ ছিল না, সকলেরই মর্য্যাদা সমান ছিল। কিন্তু কালক্রমে নানা কারণে ব্রাহ্মণদের মর্যাদা খুব বাড়িয়া গেল, তাঁহারাই সমাজের শীর্ষস্থান অধিকার করিলেন। ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা ব্রাহ্মণের পরে এবং বৈশ্যের মর্য্যাদা ক্ষত্রিয়ের পরে নির্দিষ্ট হইল। ফলে, পরস্পরের মধ্যে আহারব্যবহার, বৈবাহিক আদানপ্রদান ক্রমশ লুপ্ত হইল। ব্রাহ্মণ যদি ক্ষত্রিয়ের চেয়ে বেশী মানী হন, তাহার বাড়ীতে অন্নগ্রহণ না করেন, তবে তিনি ক্ষত্রিয়ের কন্যাকে বিবাহ করিবেন কিরূপে? ক্ষত্ৰিয়ই বা ব্রাহ্মণকন্যার পাণি-পীড়নের সাহস সঞ্চয় করিবেন কিরূপে? মহাভারতে যে সমাজের দৃশ্য অঙ্কিত হইয়াছে, তাহাতে এই সব প্রথা তখনই যে অনেকটা বদ্ধমূল হইয়াছিল, তাহা বেশ বুঝিতে পারা যায়।
এইভাবে দ্বিজাতিদের মধ্যে জাতিভেদ যখন বেশ পাকারকম হইয়া দাঁড়াইল, তখন আর একটা জটিল সমস্যার সৃষ্টি হইল। বর্ণবিভাগকে গণ্ডী টানিয়া জাতিভেদে পরিণত করা যায়, কিন্তু সহস্ৰ চেষ্টা করিয়াও বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ বন্ধ করা যায় না। সেক্ষেত্রে জীবপ্রকৃতি মানুষের সকল বিধিনিষেধকে অগ্রাহ করিয়া সমাজশাসনের অনভিপ্রেত কাণ্ড করিয়া বসে। সুতরাং বিধিনিষেধ সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয়, ক্ষত্রিয়-বৈশ্য, বৈশ্য-ব্রাহ্মণ প্রভৃতির বৈবাহিক মিলন ঘটিতে লাগিল। ফলে, বিভিন্ন মিশ্র জাতি বা সঙ্করজাতির সৃষ্টি হইতে লাগিল। বলা বাহুল্য, এই প্ৰাকৃতিক নিয়ম হইতে অনাৰ্য্য শূদ্রেরাও বাদ গেল না-তাহাঁদের যুবকযুবতীদের সঙ্গেও ব্রাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়, বৈশ্যের বৈবাহিক মিলন ঘটিতে লাগিল। কালক্রমে এই যে সব সঙ্করজাতির সৃষ্টি হইল, তাহাদিগকে সমাজের কোথায় স্থান দেওয়া হইবে, ইহা এক মহাসমস্যা হইয়া দাড়াইল।
এই সমস্যার বিপুলতা ও জটিলতার প্রমাণ “মনুসংহিতা’ হইতে পাওয়া যায়। সঙ্করজাতির সৃষ্টি অবশ্য মোটেই বাঞ্ছনীয় ছিল না, বরং অত্যন্ত নিন্দনীয়ই ছিল। “গীতায়’ অৰ্জ্জুন বলিয়াছেন, ‘সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্যচ’ 2। কিন্তু তৎসত্ত্বেও “বৰ্ণসঙ্কর”দের কিছুতেই অগ্ৰাহ্য বা উপেক্ষা করা গেল না, সমাজে তাহাদিগকে স্থান দিতেই হইল; চারিবর্ণ বা চারিজাতি ভাঙ্গিয়া বহুবর্ণ বহুজাতিতে পরিণত হইল। এইরূপে জাতিভেদ বেশ জাঁকালো রকমে বহু বিচিত্ৰ মূৰ্ত্তিতে হিন্দুসমাজে তাহার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করিল।
চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন