সমাজের সর্বপ্রধান শক্তি-সংহতিশক্তি বা সঙ্ঘশক্তি । এই শক্তিবলেই সমাজ বিধৃত হইয়া থাকে এবং বাহিরের আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিতে পারে । সংহতিসক্তিশক্তির প্রধান লক্ষণ বিছিন্নকে একত্র করা, বৈষম্যের মধ্য হইতে সাম্যের ভিত্তিতে সকলকে কেন্দ্রীভূত করা । যে সমাজে এই শক্তি যত বেশী বিকাশপ্রাপ্ত হয়, সে-সমাজ তত বেশী জীবন্ত । দুৰ্ভাগ্যক্রমে হিন্দুসমাজে ইহার বিপরীত লক্ষণই দেখিতে পাইতেছি। এ সমাজে বিকর্ষণী শক্তিই প্রবল, ইহা সকলকে এক সাম্যের সূত্রে গ্রথিত করিবার চেষ্টা করা দূরে থাকুক, পৃথক্ করিয়া দিবার জন্যই যেন ব্যস্ত। পুরুভূজের দেহের মত হিন্দুসমাজ নিজেকে কেবলই ভাগ করিতেছে এবং সেই সব পৃথক পৃথক ভাগ হইতে এক একটা স্বতন্ত্র উপসমাজের সৃষ্টি হইতেছে। ইহাদের কাহারও সঙ্গে কাহারও যেন যোগ নাই। অন্য একটা উপমা দিয়া বলিতে পারা যায়, হিন্দুসমাজ যেন একটা ভাসমান দ্বীপপুঞ্জ;-অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ ইহার মধ্যে আছে, কিন্তু তাহাদের কাহারও সঙ্গে কাহারও ঘনিষ্ঠ বন্ধন নাই। অনেক সময় ভাবিলে বিস্ময় বোধ হয়, এতকাল ধরিয়া বিকর্ষণীশক্তিপ্রধান এই সমাজ কিরূপে টিকিয়া আছে। কিন্তু এই জরাজীর্ণ প্ৰাচীন সমাজের চারিদিকে যেমন ফাটল ধরিয়াছে, বৈষম্যনীতি যেমন প্ৰবল হইতে প্ৰবলতর হইতেছে, তাহাতে ইহার ভবিষ্যৎ মোটেই আশাপ্ৰদ মনে হয় না।
অবস্থা এমন শোচনীয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, তথাকথিত “নিম্ন জাতিরাও” পরস্পরকে হীন ও ক্ষুদ্ৰ মনে করে এবং একে অন্যকে “অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয়” বলিয়া ঘুণা করে। “শুদ্ধি ও সংগঠন” আন্দোলন যাঁহারা পরিচালনা করিয়াছেন, তাঁহাদের এ সম্বন্ধে সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা আছে। একজন সংস্কারপন্থী ব্ৰাহ্মণ কি কায়স্থ হয়ত মুচি, মেথর বা ডোমের হাতে জল খাইবে, কিন্তু মুচি, মেথর বা ডোম কেহই পরস্পরের হাতের জল খাইবে না, এক পংক্তিতে বসিয়া ভোজন করা তো দূরের কথা। এজন্য দায়ী তাহারা নহে-দায়ী উচ্চ জাতীয়েরাই। উচ্চ জাতীয়েরা যে বৈষম্যের মন্ত্র নিম্ন জাতিদের কানে দিয়াছে, এ তাহারই পরিণাম। চেলারা এখন গুরুদের ছাড়াইয়া গিয়াছে। আজ যে বৃটিশ শাসকেরা নিম্ন জাতিদের লইয়া একটা কৃত্ৰিম তপশীলী সম্প্রদায় সৃষ্টি করিতে পারিয়াছেন এবং এই ‘তপশীলীরা’ নিজেদের সমগ্ৰ হিন্দুসমাজ হইতে পৃথক বলিয়া ভাবিতে শিখিতেছে এবং তদনুসারে কার্য্যও করিতেছে,-এ-ও উচ্চ জাতীয়দের বৈষম্যনীতিরূপ পাপের ফল।
বিকর্ষণী শক্তির প্রভাবে কেবল যে অসংখ্য জাতি, উপজাতি, শাখাজাতি প্ৰভৃতিরই সৃষ্টি হইয়াছে, তাহা নহে; হিন্দুসমাজে বহুলোক নানাভাবে হীন, পতিত ও ভ্ৰষ্ট হইয়া আছে। বৌদ্ধধৰ্ম্মের অধঃপতন ও সনাতন হিন্দু ধৰ্ম্মের পুনরভ্যুদয়ের ফলে বহু বৌদ্ধ সনাতন হিন্দুসমাজের মধ্যে ফিরিয়া আসিল বটে, কিন্তু যাহারা ফিরিয়া আসিল না, তাহারা হীন ও পতিত বলিয়া গণ্য হইল। এমন কি ২/৩ পুরুষ পরে উহাদের মধ্যে যাহারা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ফিরিয়া আসিল, তাহাদেরও পাতিত্যদোষ সম্পূর্ণ ঘুচিল না; সমাজের নিম্নস্তরে অস্পৃশ্য বা অনাচরণীয় হইয়াই তাহারা রহিল। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, বাঙলাদেশে হিন্দু ধৰ্ম্মের নব অভ্যুদয় একটু বিলম্বে হইয়াছিল। রাজা বল্লাল সেনের পরেও ২৩ শতাব্দী পৰ্য্যন্ত বহুলোক বৌদ্ধাচার সম্পূর্ণ ত্যাগ করে নাই। শেষ পৰ্য্যন্ত ইহাদের মধ্যে অনেকেই হিন্দুসমাজের মধ্যে আসিতে বাধ্য হইয়াছিল বটে, কিন্তু সমাজে তাহারা উচ্চস্থান পায় নাই। এই জাতিভেদপ্ৰপীড়িত দেশে ঐতিহাসিক তথ্যের আলোচনা করাও সব সময়ে নিরাপদ নয়, লোকের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কা আছে। তৎসত্ত্বেও দুই একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিতে চেষ্টা করিব। যে ‘ডোম’ জাতি এখন অস্পৃশ্য বলিয়া গণ্য, তাহারা এককালে বৌদ্ধ ছিল—তাহাদের মধ্যে অনেকে বৌদ্ধাচাৰ্য্য ও পুরোহিতের কার্য্যও করিত। সেদিন পৰ্য্যন্ত প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধদেবতা ধৰ্ম্মঠাকুরের পূজা প্ৰধানত এই ‘ডোম’ পুরোহিতেরাই করিয়াছে। ‘যোগী’ সম্প্রদায়েরা পূর্বপুরুষেরা যে বৌদ্ধ ছিল, তাহাতে সন্দেহের অরসর নাই। ইতিহাস পাঠকেরা জানেন, সুবর্ণবণিকদের মধ্যে একটা বৃহৎ অংশ বল্লাল সেনের পরেও বহুকাল পৰ্য্যন্ত বৌদ্ধ ছিল। সেইজন্যই পরবর্ত্তী কালে হিন্দুসমাজে তাহারা তাহাদের প্রাপ্য উচ্চস্থান পায় নাই। অথচ সুবর্ণবণিকেরা হিন্দুসমাজের কোন তথাকথিত উচ্চজাতির চেয়েই কোন দিক দিয়া নিকৃষ্ট নহে।
নবজাগ্ৰত হিন্দুসমাজ বৌদ্ধ ও বৌদ্ধাচারসম্পন্নদিগকে কেবল যে হীন ও পতিত করিয়া রাখিয়াছিল তাহা নহে, তাহাদের উপর বহু নিৰ্য্যাতন ও অত্যাচারও করিয়াছিল। ফলে অনেকে দেশ ছাড়িয়া নেপাল, তিব্বত প্ৰভৃতি স্থানে পলাইয়াছিল, যাহারা ছিল তাহারা হিন্দু সমাজে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছিল অথবা আত্মগোপন করিয়াছিল। সুতরাং ইসলাম ধৰ্ম্ম তাহার সাম্যের বাণী লইয়া যখন এদেশে দেখা দিল, তখন এই সব নিৰ্য্যাতিত বৌদ্ধ এবং বৌদ্ধাচারীরা দলে দলে ইসলাম ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিতে লাগিল। ইসলাম বিজেতা শাসকদের ধৰ্ম্ম হওয়াতে এই ধৰ্ম্মান্তর গ্রহণের কাৰ্য্য আরও সহজ হইল। প্রলোভনের অভাব ছিল না। বাঙলা দেশে নিম্ন জাতীয়দের মধ্যেই বৌদ্ধের সংখ্যা বেশী ছিল এবং ইহারাই বেশীর ভাগ মুসলমান হইল।
ব্ৰাহ্মণশাসিত হিন্দুসমাজ ইসলাম ধৰ্ম্মের এই প্ৰবল আক্রমণ রোধ করিবার জন্য ভ্ৰান্তপথে অগ্রসর হইল। অধিকতর সাম্যভাব বা উদারতর নীতি অবলম্বন করা দূরে থাকুক, হিন্দুসমাজ নিজের চারিদিকে দুর্ভেদ্য দুর্গ রচনা করিল; জাতিভেদের কঠোরতা আরও বর্দ্ধিত হইল, অস্পৃশ্যতা ও অনাচরণীয়তা আরও বেশী প্ৰবল হইল। ইহার ফলে কোনরূপ “যবন সংস্পৰ্শ” ঘটিলেই তাহা পাতিত্যের কারণ বলিয়া গণ্য হইতে লাগিল। “শ্ৰীচৈতন্য চরিতামৃতে” রূপসনাতন ও সুবুদ্ধি রায়ের যে কাহিনী আছে, তাহা হইতে এই “যবন সংস্পৰ্শজনিত” পাতিত্য দোষের স্বরূপ বেশ বুঝা যায়। রূপ সনাতন দুই ভ্ৰাতা গৌড়ের বাদশাহের 1 প্রধান অমাত্য ছিলেন। অনেক সময়েই তাঁহাদিগকে রাজকাৰ্য্য ব্যপদেশে বাদশাহের ভবনেই থাকিতে হইত, ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশাও করিতে হইত। সম্ভবত “আহার্য্য দোষও” কিছু ঘটিয়া থাকিবে। তাঁহারা ছিলেন মূলত কানাড়ী ব্ৰাহ্মণ—তাঁহাদের পূর্বপুরুষেরা বাঙলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করাতে তাঁহারা বাঙালী ব্ৰাহ্মণসমাজেই মিশিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু গৌড়ের বাদশাহের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসাতে ব্ৰাহ্মণসমাজ তাঁহাদিগকে “পতিত” বলিয়া গণ্য করিলেন। শ্ৰীগৌরাঙ্গের কৃপায় ইহারা উভয়েই সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী হন এবং বৃন্দাবনে থাকিয়া ভক্তিধৰ্ম্ম প্রচার করিতে থাকেন। তাহারা বাদশাহের মন্ত্রীরূপে কেবল যে রাজকাৰ্য্যে বিচক্ষণ ছিলেন তাহা নহে, সৰ্বশাস্ত্ৰে প্ৰগাঢ় পণ্ডিতও ছিলেন। তাঁহারা যে সব বৈষ্ণব দর্শনের গ্ৰন্থ লিখিয়া গিয়াছেন, তাহাতেই তাহাদের পাণ্ডিত্য ও অগাধ শাস্ত্ৰজ্ঞানের পরিচয় সুপ্ৰকাশ। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধৰ্ম্ম ও দর্শন প্রচারে তাঁহারাই যে অগ্রণী, এমন কি সর্বশ্রেষ্ঠ, একথা বলিলে অত্যুক্তি হয় না। অথচ সমাজের অলঙ্কারস্বরূপ এই দুই ভ্ৰাতাকেই তদানীন্তন ব্ৰাহ্মণসমাজ ‘পতিত’ বলিয়া গণ্য করিয়াছিলেন ।
সুবুদ্ধি রায়ের কাহিনীও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তিনি পূর্ব্বে গৌড়ের রাজা ছিলেন, পরে স্বীয় মুসলমান মন্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতায় রাজ্যচু্যত হন। এই মুসলমান মন্ত্রীই পরে বাদশাহ হন এবং তঁহারই ছলনাতে একবার সুবুদ্ধি রায় কোন “অখাদ্য” দ্রব্যের ভ্রাণ গ্ৰহণ করিয়াছিলেন। সেই অনিচ্ছাকৃত মহা অপরাধের জন্য ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতেরা ব্যবস্থা দিলেন, তাহাকে “তুষানল প্ৰায়শ্চিত্ত” করিতে হইবে। অর্থাৎ তুষের আগুনে ধীরে ধীরে পুড়িয়া আত্মহত্যা করিতে হইবে। মহাপ্ৰভু শ্ৰীগৌরাঙ্গের রূপায় অবশেষে তিনি এই আত্মহত্যার দায় হইতে মুক্তিলাভ করেন এবং একজন ঈশ্বরভক্ত পরম বৈষ্ণব হইয়া উঠেন। 2
বাঙলাদেশে “পীরালি” 3 ব্ৰাহ্মণদের ইতিহাসও ঠিক এই শ্রেণীর ঘটনার সহিত সংসৃষ্ট। এই “পীরালি” ব্ৰাহ্মণদের সম্বন্ধে নানারূপ কাহিনী প্ৰচলিত আছে। তবে কোনরূপ “যবন সংস্পৰ্শ” দোষেই যে তাঁহারা “পীরালিত্ব” প্ৰাপ্ত হইয়াছিলেন, সমস্ত কাহিনীতেই এইরূপ কথা আছে। সম্ভবত এই “পীরালিদের” পূৰ্বপুরুষ রূপ-সনাতনের মতই কোন মুসলমান নবাব বা বাদশাহের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন অথবা সুবুদ্ধি রায়ের মত “অখাদ্যের” ভ্ৰাণ গ্ৰহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। কেহ কেহ মনে করেন, ইহাদের কোন পূৰ্বপুরুষ কোন একজন মুসলমান পীরের ভক্ত হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। যে কারণই সত্য হউক, কোনরূপ “যবন সংস্পৰ্শ’ই যে ইহাদের পাতিত্যের কারণ, তাহাতে সন্দেহ নাই। এই “অপরাধে”র জন্য পুরুষপরম্পরাক্রমে ইহাঁরা হিন্দুসমাজে কোণঠাসা হইয়া আছেন। আধুনিককালে যদিও “পীরালি” ঠাকুর বংশের বংশধরগণ নিজেদের বিদ্যা-বুদ্ধি-প্ৰতিভায় বাঙালী হিন্দুসমাজে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছেন, তবুও তাঁহাদের সেই “মালিন্য” তিরোহিত হয় নাই। হিন্দুসমাজের এই আত্মহত্যাকর নীতির দ্বারা তাহার যে কি গুরুতর ক্ষতি হইয়াছে, তাহা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
• হুসেন শাহ↩
• প্রায়শ্চিত্ত পুঁছিল তিঁহো পণ্ডিতের স্থানে
তাঁরা কহে তপ্তঘৃত খাঞা ছাড় প্রাণে ॥
প্রভু কহে ইঁহা হইতে যাহ বৃন্দাবন ।
নিরন্তর কৃষ্ণনাম কর সঙ্কীর্তন ॥
এক নামাভাষে তোমার পাপ দোষ যাবে ।
আর নাম লইতে কৃষ্ণ চরণ পাইবে ॥
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত—মধ্যলীলা, ২৫শ পরিচ্ছেদ
↩
• মুসলমানের অন্নগ্রহণ দোষপৃষ্ট ব্রাহ্মণ । ঘ্রাণের দ্বারাও অর্ধভোজন হয়, সুতরাং নিষিদ্ধ খাদ্যের ঘ্রাণ-গ্রহণ করলেও পতিত হবার রীতি ছিল । জোড়াসাঁকোর ঠাকুররা ছিলেন পীরালি ব্রাহ্মণ ।
চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।
অবস্থা এমন শোচনীয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, তথাকথিত “নিম্ন জাতিরাও” পরস্পরকে হীন ও ক্ষুদ্ৰ মনে করে এবং একে অন্যকে “অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয়” বলিয়া ঘুণা করে। “শুদ্ধি ও সংগঠন” আন্দোলন যাঁহারা পরিচালনা করিয়াছেন, তাঁহাদের এ সম্বন্ধে সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা আছে। একজন সংস্কারপন্থী ব্ৰাহ্মণ কি কায়স্থ হয়ত মুচি, মেথর বা ডোমের হাতে জল খাইবে, কিন্তু মুচি, মেথর বা ডোম কেহই পরস্পরের হাতের জল খাইবে না, এক পংক্তিতে বসিয়া ভোজন করা তো দূরের কথা। এজন্য দায়ী তাহারা নহে-দায়ী উচ্চ জাতীয়েরাই। উচ্চ জাতীয়েরা যে বৈষম্যের মন্ত্র নিম্ন জাতিদের কানে দিয়াছে, এ তাহারই পরিণাম। চেলারা এখন গুরুদের ছাড়াইয়া গিয়াছে। আজ যে বৃটিশ শাসকেরা নিম্ন জাতিদের লইয়া একটা কৃত্ৰিম তপশীলী সম্প্রদায় সৃষ্টি করিতে পারিয়াছেন এবং এই ‘তপশীলীরা’ নিজেদের সমগ্ৰ হিন্দুসমাজ হইতে পৃথক বলিয়া ভাবিতে শিখিতেছে এবং তদনুসারে কার্য্যও করিতেছে,-এ-ও উচ্চ জাতীয়দের বৈষম্যনীতিরূপ পাপের ফল।
বিকর্ষণী শক্তির প্রভাবে কেবল যে অসংখ্য জাতি, উপজাতি, শাখাজাতি প্ৰভৃতিরই সৃষ্টি হইয়াছে, তাহা নহে; হিন্দুসমাজে বহুলোক নানাভাবে হীন, পতিত ও ভ্ৰষ্ট হইয়া আছে। বৌদ্ধধৰ্ম্মের অধঃপতন ও সনাতন হিন্দু ধৰ্ম্মের পুনরভ্যুদয়ের ফলে বহু বৌদ্ধ সনাতন হিন্দুসমাজের মধ্যে ফিরিয়া আসিল বটে, কিন্তু যাহারা ফিরিয়া আসিল না, তাহারা হীন ও পতিত বলিয়া গণ্য হইল। এমন কি ২/৩ পুরুষ পরে উহাদের মধ্যে যাহারা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ফিরিয়া আসিল, তাহাদেরও পাতিত্যদোষ সম্পূর্ণ ঘুচিল না; সমাজের নিম্নস্তরে অস্পৃশ্য বা অনাচরণীয় হইয়াই তাহারা রহিল। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, বাঙলাদেশে হিন্দু ধৰ্ম্মের নব অভ্যুদয় একটু বিলম্বে হইয়াছিল। রাজা বল্লাল সেনের পরেও ২৩ শতাব্দী পৰ্য্যন্ত বহুলোক বৌদ্ধাচার সম্পূর্ণ ত্যাগ করে নাই। শেষ পৰ্য্যন্ত ইহাদের মধ্যে অনেকেই হিন্দুসমাজের মধ্যে আসিতে বাধ্য হইয়াছিল বটে, কিন্তু সমাজে তাহারা উচ্চস্থান পায় নাই। এই জাতিভেদপ্ৰপীড়িত দেশে ঐতিহাসিক তথ্যের আলোচনা করাও সব সময়ে নিরাপদ নয়, লোকের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কা আছে। তৎসত্ত্বেও দুই একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিতে চেষ্টা করিব। যে ‘ডোম’ জাতি এখন অস্পৃশ্য বলিয়া গণ্য, তাহারা এককালে বৌদ্ধ ছিল—তাহাদের মধ্যে অনেকে বৌদ্ধাচাৰ্য্য ও পুরোহিতের কার্য্যও করিত। সেদিন পৰ্য্যন্ত প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধদেবতা ধৰ্ম্মঠাকুরের পূজা প্ৰধানত এই ‘ডোম’ পুরোহিতেরাই করিয়াছে। ‘যোগী’ সম্প্রদায়েরা পূর্বপুরুষেরা যে বৌদ্ধ ছিল, তাহাতে সন্দেহের অরসর নাই। ইতিহাস পাঠকেরা জানেন, সুবর্ণবণিকদের মধ্যে একটা বৃহৎ অংশ বল্লাল সেনের পরেও বহুকাল পৰ্য্যন্ত বৌদ্ধ ছিল। সেইজন্যই পরবর্ত্তী কালে হিন্দুসমাজে তাহারা তাহাদের প্রাপ্য উচ্চস্থান পায় নাই। অথচ সুবর্ণবণিকেরা হিন্দুসমাজের কোন তথাকথিত উচ্চজাতির চেয়েই কোন দিক দিয়া নিকৃষ্ট নহে।
নবজাগ্ৰত হিন্দুসমাজ বৌদ্ধ ও বৌদ্ধাচারসম্পন্নদিগকে কেবল যে হীন ও পতিত করিয়া রাখিয়াছিল তাহা নহে, তাহাদের উপর বহু নিৰ্য্যাতন ও অত্যাচারও করিয়াছিল। ফলে অনেকে দেশ ছাড়িয়া নেপাল, তিব্বত প্ৰভৃতি স্থানে পলাইয়াছিল, যাহারা ছিল তাহারা হিন্দু সমাজে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছিল অথবা আত্মগোপন করিয়াছিল। সুতরাং ইসলাম ধৰ্ম্ম তাহার সাম্যের বাণী লইয়া যখন এদেশে দেখা দিল, তখন এই সব নিৰ্য্যাতিত বৌদ্ধ এবং বৌদ্ধাচারীরা দলে দলে ইসলাম ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিতে লাগিল। ইসলাম বিজেতা শাসকদের ধৰ্ম্ম হওয়াতে এই ধৰ্ম্মান্তর গ্রহণের কাৰ্য্য আরও সহজ হইল। প্রলোভনের অভাব ছিল না। বাঙলা দেশে নিম্ন জাতীয়দের মধ্যেই বৌদ্ধের সংখ্যা বেশী ছিল এবং ইহারাই বেশীর ভাগ মুসলমান হইল।
ব্ৰাহ্মণশাসিত হিন্দুসমাজ ইসলাম ধৰ্ম্মের এই প্ৰবল আক্রমণ রোধ করিবার জন্য ভ্ৰান্তপথে অগ্রসর হইল। অধিকতর সাম্যভাব বা উদারতর নীতি অবলম্বন করা দূরে থাকুক, হিন্দুসমাজ নিজের চারিদিকে দুর্ভেদ্য দুর্গ রচনা করিল; জাতিভেদের কঠোরতা আরও বর্দ্ধিত হইল, অস্পৃশ্যতা ও অনাচরণীয়তা আরও বেশী প্ৰবল হইল। ইহার ফলে কোনরূপ “যবন সংস্পৰ্শ” ঘটিলেই তাহা পাতিত্যের কারণ বলিয়া গণ্য হইতে লাগিল। “শ্ৰীচৈতন্য চরিতামৃতে” রূপসনাতন ও সুবুদ্ধি রায়ের যে কাহিনী আছে, তাহা হইতে এই “যবন সংস্পৰ্শজনিত” পাতিত্য দোষের স্বরূপ বেশ বুঝা যায়। রূপ সনাতন দুই ভ্ৰাতা গৌড়ের বাদশাহের 1 প্রধান অমাত্য ছিলেন। অনেক সময়েই তাঁহাদিগকে রাজকাৰ্য্য ব্যপদেশে বাদশাহের ভবনেই থাকিতে হইত, ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশাও করিতে হইত। সম্ভবত “আহার্য্য দোষও” কিছু ঘটিয়া থাকিবে। তাঁহারা ছিলেন মূলত কানাড়ী ব্ৰাহ্মণ—তাঁহাদের পূর্বপুরুষেরা বাঙলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করাতে তাঁহারা বাঙালী ব্ৰাহ্মণসমাজেই মিশিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু গৌড়ের বাদশাহের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসাতে ব্ৰাহ্মণসমাজ তাঁহাদিগকে “পতিত” বলিয়া গণ্য করিলেন। শ্ৰীগৌরাঙ্গের কৃপায় ইহারা উভয়েই সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী হন এবং বৃন্দাবনে থাকিয়া ভক্তিধৰ্ম্ম প্রচার করিতে থাকেন। তাহারা বাদশাহের মন্ত্রীরূপে কেবল যে রাজকাৰ্য্যে বিচক্ষণ ছিলেন তাহা নহে, সৰ্বশাস্ত্ৰে প্ৰগাঢ় পণ্ডিতও ছিলেন। তাঁহারা যে সব বৈষ্ণব দর্শনের গ্ৰন্থ লিখিয়া গিয়াছেন, তাহাতেই তাহাদের পাণ্ডিত্য ও অগাধ শাস্ত্ৰজ্ঞানের পরিচয় সুপ্ৰকাশ। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধৰ্ম্ম ও দর্শন প্রচারে তাঁহারাই যে অগ্রণী, এমন কি সর্বশ্রেষ্ঠ, একথা বলিলে অত্যুক্তি হয় না। অথচ সমাজের অলঙ্কারস্বরূপ এই দুই ভ্ৰাতাকেই তদানীন্তন ব্ৰাহ্মণসমাজ ‘পতিত’ বলিয়া গণ্য করিয়াছিলেন ।
সুবুদ্ধি রায়ের কাহিনীও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তিনি পূর্ব্বে গৌড়ের রাজা ছিলেন, পরে স্বীয় মুসলমান মন্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতায় রাজ্যচু্যত হন। এই মুসলমান মন্ত্রীই পরে বাদশাহ হন এবং তঁহারই ছলনাতে একবার সুবুদ্ধি রায় কোন “অখাদ্য” দ্রব্যের ভ্রাণ গ্ৰহণ করিয়াছিলেন। সেই অনিচ্ছাকৃত মহা অপরাধের জন্য ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতেরা ব্যবস্থা দিলেন, তাহাকে “তুষানল প্ৰায়শ্চিত্ত” করিতে হইবে। অর্থাৎ তুষের আগুনে ধীরে ধীরে পুড়িয়া আত্মহত্যা করিতে হইবে। মহাপ্ৰভু শ্ৰীগৌরাঙ্গের রূপায় অবশেষে তিনি এই আত্মহত্যার দায় হইতে মুক্তিলাভ করেন এবং একজন ঈশ্বরভক্ত পরম বৈষ্ণব হইয়া উঠেন। 2
বাঙলাদেশে “পীরালি” 3 ব্ৰাহ্মণদের ইতিহাসও ঠিক এই শ্রেণীর ঘটনার সহিত সংসৃষ্ট। এই “পীরালি” ব্ৰাহ্মণদের সম্বন্ধে নানারূপ কাহিনী প্ৰচলিত আছে। তবে কোনরূপ “যবন সংস্পৰ্শ” দোষেই যে তাঁহারা “পীরালিত্ব” প্ৰাপ্ত হইয়াছিলেন, সমস্ত কাহিনীতেই এইরূপ কথা আছে। সম্ভবত এই “পীরালিদের” পূৰ্বপুরুষ রূপ-সনাতনের মতই কোন মুসলমান নবাব বা বাদশাহের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন অথবা সুবুদ্ধি রায়ের মত “অখাদ্যের” ভ্ৰাণ গ্ৰহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। কেহ কেহ মনে করেন, ইহাদের কোন পূৰ্বপুরুষ কোন একজন মুসলমান পীরের ভক্ত হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। যে কারণই সত্য হউক, কোনরূপ “যবন সংস্পৰ্শ’ই যে ইহাদের পাতিত্যের কারণ, তাহাতে সন্দেহ নাই। এই “অপরাধে”র জন্য পুরুষপরম্পরাক্রমে ইহাঁরা হিন্দুসমাজে কোণঠাসা হইয়া আছেন। আধুনিককালে যদিও “পীরালি” ঠাকুর বংশের বংশধরগণ নিজেদের বিদ্যা-বুদ্ধি-প্ৰতিভায় বাঙালী হিন্দুসমাজে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছেন, তবুও তাঁহাদের সেই “মালিন্য” তিরোহিত হয় নাই। হিন্দুসমাজের এই আত্মহত্যাকর নীতির দ্বারা তাহার যে কি গুরুতর ক্ষতি হইয়াছে, তাহা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
• হুসেন শাহ↩
• প্রায়শ্চিত্ত পুঁছিল তিঁহো পণ্ডিতের স্থানে
তাঁরা কহে তপ্তঘৃত খাঞা ছাড় প্রাণে ॥
প্রভু কহে ইঁহা হইতে যাহ বৃন্দাবন ।
নিরন্তর কৃষ্ণনাম কর সঙ্কীর্তন ॥
এক নামাভাষে তোমার পাপ দোষ যাবে ।
আর নাম লইতে কৃষ্ণ চরণ পাইবে ॥
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত—মধ্যলীলা, ২৫শ পরিচ্ছেদ
↩
• মুসলমানের অন্নগ্রহণ দোষপৃষ্ট ব্রাহ্মণ । ঘ্রাণের দ্বারাও অর্ধভোজন হয়, সুতরাং নিষিদ্ধ খাদ্যের ঘ্রাণ-গ্রহণ করলেও পতিত হবার রীতি ছিল । জোড়াসাঁকোর ঠাকুররা ছিলেন পীরালি ব্রাহ্মণ ।
চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন