১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মানব সভ্যতায় ‘অহিংসার স্থান’

মহাত্মা গান্ধী কিছুদিন পূর্বে “প্রত্যেক ব্রিটেনের প্রতি” এই শিরোনামা দিয়া যে পত্ৰখানি প্ৰকাশ করিয়াছেন,1 তাহা মানবসভ্যতার ইতিহাসে স্মরণীয় হইয়া থাকিবে। পত্ৰখানি তিনি ভারতের বড়লাট ও রাজপ্ৰতিনিধির মারফৎ ব্রিটিশ গবৰ্ণমেণ্টের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন। ব্রিটিশ গবৰ্ণমেণ্ট তাহার একটা উত্তরও বড়লাটের মারফৎ গান্ধীজীকে দিয়াছেন। তাঁহারা সৌজন্যসহকারে জানাইয়াছেন যে, বৰ্ত্তমান অবস্থায় মহাত্মাজীর পরামর্শ গ্ৰহণ করিতে তাঁহারা অক্ষম।


সমগ্ৰ ইউরোপ যখন নাজীবাহিনীর পদভরে টলমল, সমুদ্র পরিখাবেষ্টিত ব্রিটেন হিটলারের বিমানবাহিনীর আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষার পন্থী উদ্ভাবনে ব্যাপৃত, তখন ব্রিটিশ জাতির নিকট অস্ত্ৰ ত্যাগের জন্য প্ৰস্তাব করা বর্তমান জগতে একমাত্ৰ মহাত্মা গান্ধীর পক্ষেই সম্ভব। অন্য কেহ এরূপ প্ৰস্তাবের কথা কল্পনাই করিতে পারিত না। কল্পনা করিতে পারিলেও, তাহা প্ৰকাশ্যে ব্যক্ত করিতে সাহস পাইত না, অন্ততপক্ষে দ্বিধাবোধ করিত। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী সাধারণ মানব নহেন, অসাধারণ মানব। অসাধারণ মানবেরাই অসাধারণ প্ৰস্তাব করিতে পারেন। অনুরূপ অবস্থায় বুদ্ধ, খ্রীস্ট বা চৈতন্যও খুব সম্ভব ঐ রূপ প্ৰস্তাবই করিতেন। পক্ষান্তরে, ব্রিটিশ গবৰ্ণমেণ্ট যে জবাব দিয়াছেন, কোন সাধারণ মানুষ, রাষ্ট্র বা গবৰ্ণমেণ্টেও উহা ব্যতীত অন্য কোনরূপ উত্তর দিতে পারিতেন না।


মহাত্মা গান্ধী কেবল ব্রিটিশ গবৰ্ণমেণ্টের নিকটই এইরূপ প্ৰস্তাব করেন নাই, ভারতের গণশক্তির প্রতিনিধি, জাতীয় প্ৰতিষ্ঠান কংগ্রেসের নিকট ও অনুরূপ প্ৰস্তাব করিয়াছেন। কিন্তু যে কারণে ব্রিটিশ গবৰ্ণমেণ্ট মহাত্মা জীর প্ৰস্তাব গ্রহণ করিতে পারেন নাই, সেইরূপ কারণেই কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটিও তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারেন নাই। ইতিপূৰ্ব্বে মহাত্মাজী চীন, আবিসিনিয়া, চেকোশ্লাভাকিয়া, প্ৰভৃতিকেও ঐরূপ পরামর্শ দিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, তাহারাও উহা গ্রহণযোগ্য মনে করে নাই।


মহাত্মাজীর এই প্ৰস্তাবটি বড়লোকের খেয়াল বা পাগলামী বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। বস্তুত, মহাত্মাজী তাহার প্রস্তাবের মধ্য দিয়া যে প্রশ্ন উত্থাপন করিয়াছেন, তাহা মানবসভ্যতার একটা জটিল প্ৰশ্ন, উহার উপর মানবসভ্যতা তথা মনুষ্য জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করিতেছে। বুদ্ধ, খ্রীস্ট ও চৈতন্যও এই প্রশ্নই তুলিয়া মানবসভ্যতাকে ঢালিয়া সাজিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহারা সফলকাম হন নাই, মহাত্মাজীও সফলকাম হইবেন না। তথাপি প্রশ্নটি রহিয়া যাইবে এবং অনাগত ভাবিষ্যতে অন্য কোন মহাপুরুষ আসিয়া উহার সমাধানের জন্য পুনরায় চেষ্টা করিবেন। প্রশ্নটি এই—মানুষ কি “হিংসা” ত্যাগ করিয়া, সম্পূর্ণভাবে ‘অহিংসার’ আদর্শের দ্বারাই জীবন পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করিবে ? লোক রক্ষা, সমাজস্থিতি, বহিঃশত্রুর আক্রমণ হইতে দেশরক্ষা-সমস্তই কি অহিংসা ও মৈত্রীর দ্বারা সাধন করা সম্ভবপর ? মহাত্মা গান্ধী বলিতেছেন, তাহা সম্ভবপর। সমাজস্থিতি রক্ষা, আভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষা, বহিঃশত্রুর আক্রমণ হইতে দেশরক্ষা,—সমস্তই অহিংস উপায়ে করা যাইতে পারে এবং সভ্য মানুষকে তাহাই করিতে হইবে। পরাধীন দেশের পক্ষ হইতে স্বাধীনতা লাভের জন্য সংগ্রামও তিনি এই অহিংস উপায়ে চালাইবার নির্দেশ দিয়াছেন।


 মহাত্মা গান্ধী বলেন, হিংসা ও বলপ্রয়োগ মানুষের পশুত্ব ও বর্ব্বরতার নিদর্শন। আদিম বর্ব্বর মানুষের পক্ষে এই পন্থা অবলম্বন স্বাভাবিক হইতে পারে। কিন্তু মানুষ যতই সভ্যতার উচ্চস্তরে উঠিয়াছে, ততই সে অধিক পরিমাণে অহিংসা ও মৈত্রীর আদর্শ অনুসরণ করিয়াছে। পৃথিবীতে যে সব প্ৰধান প্রধান ধৰ্ম্ম প্রচারিত হয়েছে, সেগুলিও অহিংসা ও মৈত্রীর আদর্শেই অনুপ্ৰাণিত। আদিম বন্য বর্ব্বর অবস্থায় মানুষ পরস্পরের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদ গায়ের জোর, ছাড়া অন্য কোন উপায়ে মিটাইতে জানিত না। কিন্তু মানুষের মধ্যে ধৰ্ম্ম ও নীতি যতই উন্নত হইয়াছে, ততই সে গায়ের জোরের পরিবর্তে বুদ্ধি ও চরিত্রবলের আশ্রয় লইয়াছে; প্রেম ও অহিংসাকেই উচ্চতম নীতি বলিয়া শ্রদ্ধা করিতে শিখিয়াছে। নরমাংস ভক্ষণ, নিহত শত্রুর মাথার খুলি লইয়া গলায় মুণ্ডমালা ধারণ, শত্রুর রক্তপান প্রভৃতি আদিম যুগের প্রথা—সভ্য মনুষ্যসমাজে লোপ পাইয়াছে। মানুষ পরিবার ও সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। অথচ আদিম বর্ব্বর যুগের নিদর্শন যুদ্ধটাই শুধু টিকিয়া থাকিবে কেন ? সভ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উহাও বিলুপ্ত হওয়া উচিত। নতুবা আদিম বন্য মানুষ ও সভ্য মানুষে প্রভেদ রহিল কি ?


যুক্তির দিক দিয়া কথাগুলি আপাতত নির্ভুল বলিয়াই মনে হয় বটে। কিন্তু এই যুক্তির মধ্যে একটা ফাঁক রহিয়া গিয়াছে, objective reality বা বাস্তব সত্যের সঙ্গে ইহার সামঞ্জস্য সাধন করা যায় না। মানবসভ্যতার একটা বড় ট্রাজেডি এই যে, মানুষ বুদ্ধি ও মেধার দিক দিয়া যেরূপ উন্নত হইয়াছে, ধৰ্ম্ম ও নীতির দিক দিয়া তদনুপাতে উন্নত হয় নাই, বরং অনেক পশ্চাতে পড়িয়া আছে। মানবসভ্যতার ইতিহাস লেখক জনৈক মনীষী এজন্য দুঃখ করিয়া বলিয়াছেন যে, দুই হাজার বৎসর পূৰ্ব্বেকার মানুষের তুলনায় বৰ্ত্তমান যুগের মানবের বুদ্ধি ও মেধা তীক্ষ্ণতর হইয়াছে, জ্ঞানবিজ্ঞানে সে উন্নত হইয়াছে, প্ৰকৃতির রহস্য ভেদ করিয়া নানা অত্যাশ্চৰ্য্য যন্ত্রের সে আবিষ্কার করিয়াছে; কিন্তু ধৰ্ম্ম ও নীতির দিক দিয়া, প্রেম ও অহিংসার মাপকাঠিতে দুই হাজার বৎসর পূর্ব্বেকার মনুষ্য সমাজের তুলনায় বৰ্ত্তমান যুগের মানুষের কিছুমাত্র উন্নতি হয় নাই। মানুষ ঠিক সেইরূপ নিষ্ঠুর, হিংস্র, ঈৰ্ষাপরায়ণ, পরধনলোভী, দুৰ্ব্বলপীড়কই আছে। তারপর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্বন্ধের মধ্যে মানুষ যেটুকু-বা সত্য, অহিংসা, প্ৰেম, মৈত্রী প্ৰভৃতির নীতি রক্ষণ করিয়া চলিবার চেষ্টা করে, রাষ্ট্ৰক্ষেত্রে সেটুকুও করে না। এখানে মানুষ একেবারে আদিম যুগের বন্য, বর্ব্বর, হিংস্র।

 বরং আদিম যুগের মানুষের তুলনায় বুদ্ধি ও মেধায় উন্নত হওয়াতে তাহার ক্রূরতা ও হিংস্ৰতা আরও বেশী ভয়ঙ্কর হইয়াছে। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিকে সে প্রতিবেশীর সংহার কাৰ্য্যে নিয়োগ করিয়াছে, প্ৰকৃতির গোপন অন্তঃপুর হইতে যে সব অত্যাশ্চৰ্য্য রহস্যের সে সন্ধান পাইয়াছে, তাহার দ্বারা শক্তিশালী মারণাস্ত্ৰসমূহ নিৰ্ম্মাণ করিতেছে। অর্থাৎ তথাকথিত সভ্য, উন্নত মানুষের বুদ্ধি সর্বনাশী মূৰ্ত্তিতে দেখা দিয়াছে। ছিন্নমস্তার ন্যায় সে নিজের রুধির নিজেই পান করিয়া পৈশাচিক আনন্দে নৃত্য করিতেছে। বুদ্ধির দ্বারা শাণিত এই প্রতিযোগিতামূলক হিংসার খেলায়, অথবা বৈজ্ঞানিক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে যদি মহাত্মা গান্ধীর মত দুই একজন আদর্শবাদী মহাপুরুষ অহিংসা ও প্রেমের জয়গান করেন, তবে কে তাঁহাদের কথা শুনিবে ? অহিংসা ও প্রেমের আদর্শের প্রতি যদি কোন মানুষের, সমাজের বা রাষ্ট্রের শ্রদ্ধা থাকিয়াই থাকে, তাহা হইলেও উহার দ্বারা কিরূপে সে আত্মরক্ষা করিবে ?

একজন বুদ্ধ, খ্রীস্ট, চৈতন্য বা মহাত্মা গান্ধী প্রেম ও অহিংসার আদর্শের জন্য পশুবলের নিকট আত্মবলি দিতে পারেন, কিন্তু একটা জাতি বা রাষ্ট্র কিরূপে তাহা করিতে পারে ? মহাত্মা গান্ধীর প্রস্তাবমত যদি কোন জাতি বা রাষ্ট্র হিংসার ভাব সম্পূর্ণ বর্জ্জন করিয়া, অস্ত্ৰত্যাগ করিয়া আততায়ীর নিকট আত্মসমৰ্পণ করে, তাহা হইলে হয় সেই জাতি বা রাষ্ট্র আততায়ী কর্তৃক সম্পূর্ণ ধ্বংস হইবে, অথবা দাসজাতি বা দাসরাষ্ট্রে পরিণত হইবে। অহিংসার জন্য এই আত্মবিসর্জনের দৃষ্টান্ত দেখিয়া অনাসক্ত মহাত্মা গান্ধী পুলকিত হইতে পারেন, কিন্তু কোন জাতি বা রাষ্ট্রই ঐভাবে আত্মবিসর্জন দিয়া প্রেম ও অহিংসার আদর্শ প্ৰতিষ্ঠায় সম্মত হইতে পারে না। সেই কারণেই ব্রিটিশ গবৰ্ণমেণ্ট মহাত্মা গান্ধীর প্ৰস্তাবে রাজী হইতে পারেন নাই, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিও তাহার প্ৰস্তাবে সায় দেন নাই। কেবল আততায়ী জাতি বা রাষ্ট্রের সম্পর্কেই নয়, কোন দেশের আভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষেও ঠিক এই কথা প্ৰযোজ্য। অহিংসা ও প্রেমের আদর্শ রক্ষার জন্য কোন রাষ্ট্রই চোর, ডাকাত, দাঙ্গাবাজ, বিদ্রোহী বা ষড়যন্ত্রকারীদের নিকট আত্মসমৰ্পণ করিতে পারে না।
মোট কথা, যতদিন পৃথিবীর সমস্ত ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র অহিংস না হইয়া উঠিতেছে, ততদিন মানুষকে আত্মরক্ষার জন্য হিংসা ও বলপ্রয়োগের পন্থা অবলম্বন করিতেই হইবে। হিংসার দ্বারা হিংসার প্রতিরোধ, বলের দ্বারা বলের প্রতিরোধ করা যায়, ইহা বাস্তব জগতের পরীক্ষিত সত্য। প্ৰেম ও অহিংসার দ্বারা হিংসা ও পশুবলের প্রতিরোধ করা সম্ভবপর, এই সত্য সর্ব্বক্ষেত্রে নিশ্চিতরূপে প্ৰমাণিত হয় নাই। ব্যক্তিগত জীবনে এরূপ দৃষ্টান্ত কদাচিৎ দেখা যাইতে পারে বটে, মহাত্মা গান্ধীর ন্যায় ২|৪ জন মহাপুরুষের জীবনেও এই সত্য পরীক্ষিত হইয়া থাকিতে পারে বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে, মনুষ্যসমাজ বা রাষ্ট্রের পক্ষে এখনও উহা সত্য হইয়া উঠে নাই,—কোনকালে হইবে, এরূপ সম্ভাবনাও আমরা দেখি না।


অন্যায়কারী, অত্যাচারী বা আততায়ীকে কি উপায়ে প্রেম ও অহিংসার দ্বারা জয় করা সম্ভবপর, মহাত্মা গান্ধী বহুবার তাহা ব্যাখ্যা করিয়া বলিয়াছেন। তাঁহার মতে প্ৰত্যেক মানুষের মনেই দেবভাব নিহিত আছে। ত্যাগ ও দুঃখবরণের দ্বারা যদি অত্যাচারী বা আততায়ীর হৃদয়ের অন্তর্নিহিত সেই দেবভাবের উদ্বোধন করা যায়, তাহা হইলেই অহিংসপন্থীর উদ্দেশ্য সফল হইবে, অত্যাচারী বা আততায়ী প্রেমের নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়া নত হইবে বা অস্ত্ৰত্যাগ করিবে। কিন্তু মানবপ্ৰকৃতির অন্তর্নিহিত দেবভাবের উপর মহাত্মা গান্ধীর ন্যায় এইরূপ একান্ত বিশ্বাস সাধারণ মানুষের নাই। সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য এরূপ অহিংসার পরীক্ষা হয়ত সফল হইতে পারে, কিন্তু কোন সমাজ, রাষ্ট্র বা জাতিই এইরূপ একটা ‘থিওরি’ বা মতবাদের উপর নির্ভর করিয়া অগ্রসর হইতে পারে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, প্ৰেম, ত্যাগ ও দুঃখবরণের দ্বারা আবিসিনিয়েরা আততায়ী ইতালীর2 হৃদয় জয় করিতে পারিত না, কিম্বা চেকোশ্লোভাকিয়া বা পোল্যাণ্ড সহস্ৰ বৎসর চেষ্টা করিলেও হিটলার ও তাঁহার নাজীবাহিনীর অন্তরের “দেবভাব” জাগাইয়া তুলিতে পারিত না । চীন জাপানের 3 অন্তরের ‘দেবভাব’ জাগাইবার চেষ্টা করিলে মাত্র পণ্ডশ্রমই করিত ।


আমরা এতক্ষণ প্ৰধানত মহাত্মা গান্ধীর যুক্তি অনুসরণ করিয়া মানবসভ্যতায় অহিংসার স্থান ও উহার কাৰ্য্যকারিতার সীমা নির্ণয়ের চেষ্টা করিলাম। এইবার আর একটু অগ্রসর হইয়া আমরা বলিব—বুদ্ধ, খ্রীস্ট, চৈতন্য বা মহাত্মা গান্ধীর এই ‘অহিংসা দর্শন’ মানবজীবনের পূর্ণ সত্য ব্যক্ত করে না, মানবসভ্যতা এই “নিভাঁজ” অহিংসনীতির উপরে গড়িয়া উঠিতে পারে না, কোন যুগে গড়িয়া উঠেও নাই এবং যেখানেই এই চেষ্টা হইয়াছে, সেইখানেই উহা ব্যর্থ হইয়াছে। ইহার কারণ এই যে, মানবপ্ৰকৃতির মধ্যে ‘হিংসার’ একটা স্থান আছে এবং উহাকে বাদ দিয়া মানুষের জীবনযাত্ৰা চলিতে পারে না । সৃষ্টির প্রথম হইতে অন্যান্য জীবের ন্যায় মানুষের পক্ষেও “হিংস” আত্মরক্ষার প্রধান উপায়, ইহাকে বর্জ্জন করিলে বহুযুগ পূর্ব্বেই মনুষ্যজাতি পৃথিবী হইতে লুপ্ত হইত। প্ৰেম, দয়া, ধৈৰ্য্য প্রভৃতি যেমন মানবপ্রকৃতির অংশ,—কাম, হিংসা, ক্ৰোধ প্ৰভৃতিও তেমনি উহার অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের বংশবিস্তার ও আত্মরক্ষার জন্য ঐ প্ৰবৃত্তিগুলি অপরিহার্য্য। প্ৰেম, দয়া, ধৈৰ্য্য প্রভৃতির তুলনায় কাম, হিংসা, ক্ৰোধ প্রভৃতিকে নিম্নতর বৃত্তি বলা যাইতে পারে। কিন্তু কোনমতেই ঐগুলিকে অনাবশ্যক বলিয়া বর্জ্জন করা বা ধ্বংস করা যায় না। তবে এই সব নিম্নতর বৃত্তির মোড় ঘুরাইয়া উৰ্দ্ধাভিমুখী করা যাইতে পারে,—অর্থাৎ ঐগুলিকে মহত্তর উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করা যাইতে পারে,—যথা দেশরক্ষা, জাতিরক্ষা, মানবকল্যাণ সাধন ইত্যাদি। আধুনিক মনোবৈজ্ঞানিকদের ভাষায় ইহারই নাম sublimation ! এইরূপ “উন্নয়নের” ফলেই ক্ৰোধ, হিংসা, কাম প্রভৃতি শৌৰ্য্য, বীৰ্য্য, প্রেম প্রভৃতিতে পরিণত হয়। অর্থাৎ ঐগুলি নষ্ট হয় না, ‘সংশোধিত’ বা উন্নত হইয়া মানবকল্যাণে সহায়তা করে।



প্ৰকৃতপক্ষে মানুষের এইসব বিভিন্ন বৃত্তির উৎকর্ষসাধন ও তাহাদের মধ্যে সুসঙ্গত সামঞ্জস্য স্থাপনই মানবসভ্যতার পূর্ণ আদর্শ। যে সমাজ বা জাতি কতকগুলি বৃত্তির উপর অতিরিক্ত ঝোঁক দেয় এবং অন্যগুলিকে দমন বা অবহেলা করে, তাহাদের অধঃপতন সুনিশ্চিত। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, বৌদ্ধধৰ্ম্মের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া এক সময়ে ভারতবর্ষ অতিরিক্ত পরিমাণে অহিংসা, প্রেম ও মৈত্রীর সাধনা করিয়াছিল, কিন্তু সেই অনুপাতে শক্তিসামর্থ্য, শৌর্য্যবীর্য্যের চর্চ্চা করে নাই। ফলে বিদেশী আততায়ী কত্তৃক সে পর্য্যুদস্ত হইয়াছিল, আত্মরক্ষা করিবার শক্তি তাহার ছিল না। অহিংসার আদর্শ ভারতবর্ষে কিরূপ চরম সীমায় উপনীত হইয়াছিল এবং তাহার কিরূপ শোচনীয় পরিণাম হইয়াছিল, তাহার দুইটি দৃষ্টান্ত দিব। পাঠানেরা যখন প্রথম উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়া ভারত আক্রমণ করে তখন ঐ অঞ্চলে কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল। ঐ সব রাজ্যে বৌদ্ধধৰ্ম্মই প্ৰবল ছিল, বৌদ্ধ শ্রমণেরা রাষ্ট ব্যাপারেও কত্তৃত্ব করিতেন। পাঠানেরা নগর আক্রমণ করিলে এইসব বৌদ্ধ শ্রমণেরা বলিলেন, প্ৰভু বুদ্ধের রাজ্যে হিংসা চলিবে না,—অতএব দুর্গদ্বার খুলিয়া দাও, অস্ত্র ত্যাগ কর, আততায়ীদের আসিতে দাও। ফল কি হইয়াছিল, তাহা সহজেই অনুমেয়। ঐ সব রাজ্যের চিহ্ন পৰ্যন্ত লুপ্ত হইল। লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, মহাত্মা গান্ধীও আজি সেই বৌদ্ধ শ্রমণদের মতই আততায়ীর সম্মুখে অস্ত্ৰত্যাগ করিবার পরামর্শ দিতেছেন। দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত,—ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে পশ্চিম ভারতের জৈনদের মধ্যে অহিংসা এরূপ বিকৃতরূপ ধারণ করিয়াছিল যে, তাহারা দস্যুদল কর্ত্তৃক আক্রমণ, লুণ্ঠন, নরহত্যা প্ৰভৃতিতেও বাধা দিত না। ফলে সর্বত্র অশান্তি ও অরাজকতার সৃষ্টি হইয়াছিল।


পক্ষান্তরে কোন সমাজ বা জাতি যদি প্ৰেম, অহিংসা, দয়া, ক্ষমা প্রভৃতি অবহেলা করিয়া কেবলমাত্ৰ হিংসা ও শক্তিচর্চার উপর অতিরিক্ত ঝোঁক দেয়, তবে সেই সমাজ বা জাতি প্ৰকৃতপক্ষে আদিম বন্য বর্ব্বর সমাজ হইয়া দাঁড়ায়,—যুদ্ধ, নরহত্যা, পররাজ্য জয়, দস্যুতা, লুণ্ঠন—এই সবই তাহাদের নিত্যকাৰ্য্য হইয়া উঠে। এইরূপ জাতি বা সমাজের দ্বারা পৃথিবীর ঘোর অকল্যাণ হয়, তাহাদের আদর্শ মানব সভ্যতার উচ্চাদর্শ বলিয়াও গণ্য হইতে পারে না।


বস্তুত হিংসা ও অহিংসার সুসঙ্গত সামঞ্জস্য সাধনেই মানব সভ্যতার পূর্ণ আদর্শ। এই আদর্শে অহিংসা ও মৈত্রীর যেমন স্থান আছে, আত্মরক্ষার্থ অন্যায়ের প্রতিরোধ করিবার জন্য হিংসারও তেমনি স্থান আছে। ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ ভগবদগীতায় এই পূর্ণাঙ্গ সভ্যতার আদৰ্শই স্থাপন করিয়াছেন। সর্ব্বকালের মানবজাতির জন্য তিনি ঘোষণা করিয়াছেন, মাত্র প্রেম ও অহিংসাই শ্রেষ্ঠ ধৰ্ম্ম নহে, যুদ্ধমাত্রই পাপ নহে;—ধৰ্ম্মরক্ষার জন্য, দেশরক্ষার জন্য, লোককল্যাণের জন্য যুদ্ধও অবশ্য কৰ্ত্তব্য। সেক্ষেত্রে অনাসক্তভাবে কৰ্ম্মযোগীর মত হিংসার আশ্রয় গ্ৰহণ করিতে হইবে। অহিংসা ও প্রেমের নামে যিনি মনুষ্যসমাজ বা মনুষ্যজাতিকে অন্যায়ের নিকট আত্মসমর্পণের পরামর্শ দিবেন, তিনি মানুষকে বিপথগামীই করিবেন। বৌদ্ধ অহিংসার ফলে ভারতবর্ষ যখন নিৰ্জীব ও অকৰ্ম্মণ্য হইয়া পড়িয়াছিল, তখন গীতোক্ত এই মহৎ মানব ধৰ্ম্ম ও পূর্ণাঙ্গ সভ্যতার আদর্শ প্রচারের প্রয়োজন হইয়াছিল। উহার ফলে ভারতে আবার হিন্দুজাতির নবজাগরণের সুচনা হইয়াছিল।


বীৰ্য্যহীন যে অহিংসা, তাহা তামসিক অহিংসা। উহারই আর এক নাম ‘ক্লৈব্য’। তার চেয়ে সাত্ত্বিক হিংসা শ্রেষ্ঠ। আমাদের আশঙ্কা হয়, মহাত্মা গান্ধী আজ সেই তামসিক অহিংসার বাণীই প্রচার করিতেছেন। তিনি বলিতেছেন বটে যে, তিনি শক্তিমানের অহিংসার আদর্শ প্রচার করিতেছেন, কিন্তু আসলে তাঁহার প্রচারিত অহিংসা দুর্বল ও নিবীৰ্য্যের তামসিক অহিংসা। কিন্তু গীতায় ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ বীৰ্য্যবানের অহিংসা অথবা সাত্ত্বিক হিংসার আদৰ্শই কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। এই সাত্ত্বিক হিংসা সমাজরক্ষা দেশরক্ষা লোক কল্যাণার্থ যুদ্ধ করিতে ভয় পায় না। মহাত্মা গান্ধী গীতার যে ভাষ্য করিয়াছেন, আমাদের মতে তাহাতে তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। গীতার মূলতত্ত্বকে বৌদ্ধ বা জৈন অহিংসার ছাঁচে কখনও ঢালা যায় না। মহাত্মা গান্ধী সেই অসাধ্যসাধন করিতে গিয়া ব্যর্থপ্রয়াস করিয়াছেন মাত্র। মহাত্মা গান্ধী নানাদিক দিয়াই বৰ্ত্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ মানব। কিন্তু তিনি যে নিষ্ক্রিয় তামসিক “অহিংসার” আদর্শ প্রচার করিতেছেন, তাহা কখনই মানবজাতির কল্যাণ করিতে পারিবে না। যদি মানুষ তাঁহার ঈপ্সিত পথে কখন ও সম্পূর্ণরূপে “অহিংস” হইয়া উঠে, তবে তাহারা আর মানুষ থাকিবে না, দেবতা হইয়া যাইবে, অথবা ধরাপৃষ্ঠ হইতে সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হইবে। প্রথম কল্পনা অবাস্তব, দ্বিতীয় কল্পনা যে আমরা নির্ব্বিকার চিত্তে পোষণ করিতে পারি না তাহা বলাই বাহুল্য।

• ২রা জুলাই, ১৯৪০ প্রকাশিত হয় ।↩

• ইতালীー১৯৩৫-৩৬ খ্রীস্টাব্দে আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়া জয় করেছিল ।↩

• চীন-জাপানের যুদ্ধ ১৮৯৪-৯৫, ১৯৩৭-৪৫ ; ১৯৩১↩

চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।